You dont have javascript enabled! Please enable it!
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় এই সংগঠনটির জন্ম । রাজনীতি সচেতন বামপন্থী ছাত্ররা যেহেতু ছাত্র ফেডারেশনের নামে রাজনীতি করতে সরকারি বাধা-বিপত্তি, জেল-জুলুমহয়রানির সম্মুখীন হচ্ছিল এবং যেহেতু ধর্মীয় কারণে মুসলিম ছাত্রলীগেও (১৯৫৩ পর্যন্ত) যােগ দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না; তাই একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিবাদী ছাত্রসংগঠনের প্রয়ােজনীয়তা থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সৃষ্টি হয়। জাতীয়ভিত্তিক এই ছাত্রসংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ছাত্র-ইউনিয়ন নামে সংগঠন বিভিন্ন মফস্বল এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে ড, আবুল কাশেম তার গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস প্রসঙ্গে ড. আবুল কাশেম ছাত্র ইউনিয়নের একজন প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকের নিমলিখিত বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন: মহান ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় ছাত্রআন্দোলন তথা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্মুখে যেসব নতুন সমস্যা ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল তা আলােচনা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য ১৯৫২ সালে এপ্রিল মাসে ঢাকায় একটি প্রাদেশিক সম্মেলন বসেছিল। ঐ সম্মেলন সর্বসম্মতিক্রমে একটা নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের পক্ষে মত দেয়। এই ছিল ‘৫২-এর এপ্রিল সম্মেলনে ছাত্র-প্রতিনিধিদের বক্তব্য ছাত্র প্রতিনিধিদের এই বক্তব্যের ভিত্তিতেই ঐ সম্মেলন ছাত্র প্রতিনিধিদের বক্তব্য । ছাত্র প্রতিনিধিদের এই বক্তব্যের ভিত্তিতেই ঐ সম্মেলনে যে নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করা। হয় তার নাম দেয়া হয় পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। একই সালের নভেম্বর মাসের সম্মেলনে যখন এর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয় তখন ছাত্র-সংগঠনটিকে একটি প্রাদেশিক সংগঠনে পরিণত করা হয়, নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠনে এবং পরবর্তীকালে সামরিক সরকার বিরােধী আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ১৯৫৭ সালে ন্যাপ গঠিত হলে ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ-এর অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৬৭ সালে ছাত্র ইউনিয়ন আদর্শিক সংঘাতের কারণে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়। এক গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ এবং অন্যটি ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায় (৪) ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এন.এস.এফ) ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনেম খান এন.এস.এফ গঠন করেন। দলটি শুরু থেকেই শাসকগােষ্ঠীর লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করে এবং আইয়ুবের পতন পর্যন্ত তা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার অনুগত সংগঠন হিসেবে কাজ করে। (৫) ছাত্র এসােসিয়েশন। দেশভাগের পর পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান। ছাত্র এসােসিয়েশন নামে একটি ছাত্র-সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দলের এই নামকরণ করা হয়েছিল। মুসলিম লীগ সরকারের শাসনামলে এই দলের বিকাশ সম্ভবপর হয়নি। (৬) পাকিস্তান ছাত্র সংঘ (স্টুডেন্ট র্যালি) অসাম্প্রদায়িক অথচ কমিউনিস্ট বিরােধী এমন ছাত্ররা এই দল গঠন করে। রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে ছাত্র-সংগঠন করাই এই দলের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এই দলটিও স্থায়ী হয়নি। (৭) ছাত্রী সংঘ মূলত কমিউনিস্ট পার্টির অনুপ্রেরণায় এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৮ সালে ইডেন ও কামরুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ের একত্রীকরণের বিরুদ্ধে তীব্র ছাত্রীবিক্ষোভ ও আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে এই সংগঠন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। তবে প্রকাশ্যে ইসলামী পাকিস্তানের রাজপথে ছাত্রীদের নিয়ে মিছিল করায় সেদিন এই সংগঠন তৎকালীন সরকার ও সমাজপতিদের তীব্র কটাক্ষের সম্মুখীন হয়। নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ও নানা প্রতিকূলতার জন্য শেষ পর্যন্ত এই সংগঠন তার স্থায়িত্ব সমুন্নত রাখতে পারেনি। বিভিন্ন জোট গঠন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী জীবিত থাকাকালীন আওয়ামী লীগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৬২ সালের সংবিধান ঘােষণার আগেই তাকে জননিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়েছিল। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি মুক্তি পান। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি ঢাকা আসেন এবং তার মুক্তি উপলক্ষে ঢাকায় এক সংবর্ধনার আয়ােজন করা হয়। সরকারপন্থী ‘ডন’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে উক্ত জনসভায় প্রায় দুই লক্ষ লােকের সমাবেশ ঘটেছিল উক্ত সমাবেশে সােহরাওয়ার্দী ঘােষণা করেন যে, বিরাজমান পরিস্থিতিতে তিনি আওয়ামী লীগের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিরােধী, তবে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে সকল দলের সমন্বয়ে তিনি একটি ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানান।
তার এই আহ্বানে ভালাে সাড়া পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক-শ্রমিকপার্টি, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও নূরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের অংশ মিলে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে অক্টোবর (১৯৬২) ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট’ এনডিএফ নামে সুপরিচিত। নামে একটি ফ্রন্ট গঠিত হয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সংবিধানের গণতন্ত্রীকরণের আন্দোলন গড়ে তােলাই ছিল এনডিএফ গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এনডিএফ গঠনকারীরা ঘােষণা করেন যে, তারা কেউ আইয়ুব সরকারের অধীন কোনাে পদ গ্রহণ করবেন না। এনডিএফ-কে এর নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক দল না বলে একে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য একটি আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করে। খুব শীঘ্র এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘রাজনৈতিক দল আইনের আওতায় এবডাের আওতাভুক্ত ব্যক্তিগণের রাজনীতি করার অধিকার ছিল না। কিন্তু এনডিএফ-কে রাজনৈতিক দল হিসেবে অভিহিত না করা অনেক এবভাের রাজনীতিবিদ এনডিএফ-এর আন্দোলনে জড়িয়ে যান। বিষয়টি সরকারকে ব্ৰিত করে। ফলে আইয়ুব খান ‘রাজনৈতিক দল আইন সংশােধন করে ১৯৬৩ সালের ৭ জানুয়ারি ২টি অধ্যাদেশ জারি করেন। প্রথম অধ্যাদেশে রাজনৈতিক দল’ কথাটির পুনঃব্যাখা করা হয় এবং বলা হয় যে একই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে একটি গ্রুপ কিংবা কিছু ব্যক্তি কোনাে রাজনৈতিক কার্যক্রমে লিপ্ত হলে এত রাজনৈতিক দলীয় কার্যক্রমের অনুরূপ বলে বিবেচিত হবে। এই অধ্যাদেশ বলে সরকার আরও একটি ক্ষমতা লাভ করে।
তাহলাে এবডাের অধীনে সাজাপ্রাপ্ত কোনাে ব্যক্তিকে সরকার ছয় মাসের জন্য যে-কোনাে ধরনের প্রেস কনফারেন্স করা ও বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারবেন। দ্বিতীয় অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট যে-কোনাে এবডো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার উপর থেকে অযোগ্যতার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারতেন। উপরিউক্ত অধ্যাদেশদ্বয় একদিকে যেমন যে-কোনাে রাজনৈতিক নেতাকে এনডিএফ-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করতে পারত, অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের দলের সদস্য হতে ইচ্ছুক এমন এবড়ােসাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা অপসারণ করা যেত। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সােহরাওয়ার্দী বৈরুতে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে। নবাবজাদা খাজা নসরুল্লাহ খান এর প্রেসিডেন্ট মনােনীত হন। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনােনীত হন। ইতিপূর্বে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ৩১ আগস্ট ১৯৬৩ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আত্মপ্রকাশ করেছিল। আওয়ামী লীগ এবং ন্যাপ এনডিএফ-এর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার কর্মসূচীতে অব্যাহত সহযােগিতার প্রতিশ্রুতি ঘােষণা করে। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় এনডিএফ-এর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এতে যােগ দেন।
সম্মেলন শেষে নূরুল আমিনকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠিত হয়। সম্মেলনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সমস্ত মতাদর্শগত বিভিন্নতার উর্ধ্বে উঠে এক মঞ্চে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। ১৯৬৪-৬৫ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনসমূহ বিভিন্ন বিরােধীদলকে আইয়ুববিরােধী মঞ্চে সমবেত হওয়ার পূর্বে সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়। ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনের একটি প্রস্তাব সমর্থন করে এবং সম্মিলিত বিরােধীদল’ (Combined Opposition Party বা COP) নামে একটি জোট গঠন করে। এই জোট প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সকল বিরােধীদলের পক্ষে মিস ফাতিমা জিন্নাহকে প্রার্থী মনােনয়ন করে এবং নয় দফা নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ঘােষণা করে। দফাগুলি ছিল: ১. একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন; ২. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা; ৩. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আইন ও বাজেট প্রণয়নের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান; ৪. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান; ৫. প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাসকরণ; ৬. শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ; ৭, আইনের সাংবিধানিক বৈধতা যাচাইয়ের ক্ষমতা সুপ্রীমকোর্টকে প্রদান; ৮. সকল রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি; ৯. নিবর্তনমূলক সকল আইনের বিলুপ্তি ।  ‘কপ’-এর পক্ষ থেকে লে. জেনারেল মােহাম্মদ আজম খানকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। করার ইচ্ছে থাকলেও ন্যাপের বিরােধিতায় তা সম্ভব হয়নি। ন্যাপ সভাপতি মওলানা ভাসানী ঘােষণা করেন যে, মার্শাল-ল’ জারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন কোনাে ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করার তিনি ও তার দল বিরােধী  আজম খান মার্শাল-ল’ জারির সঙ্গে ও মার্শাল ল’ প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তিনি পূর্ববঙ্গে ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাই আইয়ুবের বিরুদ্ধে তিনি একজন ভালাে প্রার্থী হতে পারতেন।
কিন্তু ন্যাপ-এর বিরােধিতায় তাঁকে প্রার্থী নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। ফলে মিস ফাতিমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মনােনীত করা হয়। এমনকি একজন মহিলাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রার্থী মনােয়ন করা শরিয়ত বিরােধী নয় এই মর্মে জামায়াতে ইসলামীর আমির মওলানা মওদুদী পার্টিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়ে নেন।  প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পাকিস্তান ছাত্রশক্তি নামক তিনটি ছাত্র সংগঠন মিলে পূর্ব পাকিস্তান সংগ্রামী ছাত্রসমাজ’ নামক ছাত্র ঐক্যজোট গঠন করা হয়। এই জোটের পক্ষ থেকে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। এতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গুরুত্ব, মৌলিক গণতন্ত্রী এবং দেশবাসীর উদ্দেশে আবেদন, ছাত্রসমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশদ ব্যাখা করা হয় এবং শেষে সাত দফা কর্মসূচী ঘােষণা করা হয়। সংগ্রামী ছাত্রসমাজের কর্মসূচীগুলাে ছিল নিম্নরূপ: ১. সকল ইউনিয়ন এবং সম্ভব হইলে ইউনিটে ‘ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনী কমিটি’ গঠন। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, ছাত্র, যুবক ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে ইহা গঠন করা । পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট (পি.ডি.এম) গঠন আওয়ামী লীগের ছয়দফা আন্দোলনের ফলে সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এই আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির প্রায় সকল নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে ছয়দফার আন্দোলন কিছুটা ভাটা পড়ে।
এমনি অবস্থায় আইয়ুব-বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দ ১৯৬৭ সালের ২ মে ঢাকায় আতাউর রহমানের (যিনি একসময় আওয়ামী লীগে নেতা ছিলেন এবং পরে এনডিএফ-এর সঙ্গে যুক্ত হন) বাসায় মিলিত হন এবং পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট। (পি.ডি.এম) নামক ঐক্যজোট গঠন করেন। এই জোটের অন্তর্ভুক্ত দলসমূহ ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে এছলামী, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, এন.ডি.এফ. এবং জামায়াতে ইসলামী। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা বন্দি থাকায় এবং ছয়দফা আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়  পি.ডি.এম. সেই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করে। পি.ডি.এম, এ যােগদান করা হবে কি-না এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন ধরনাের চেষ্টা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ কারাগারে বন্দি থাকার সুযােগে আওয়ামী লীগের কিছু রক্ষণশীল নেতা- যেমন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ পি.ডি.এম এ যােগদানের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু এই দলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আমেনা বেগম পি.ডিএম, এ যােগদানে বিরােধিতা করেন। ফলে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয় এক অংশে থাকে ছয়দফা-পন্থীরা, অন্য অংশে পি.ডি.এম,-পন্থীরা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সামান্য কয়েকজন রক্ষণশীল নেতা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে পি.ডি.এম-এ যােগ দেন। পি.ডি.এম. আট দফা কর্মসূচী ঘােষণা করে। উক্ত দফাগুলি ছিল নিম্নরূপপি.ডি.এম.এর আট দফা এক, শাসনতন্ত্রে নিমবিধানসমূহের ব্যবস্থা থাকিবে : 
(ক) পার্লামেন্টারি পদ্ধতির ফেডারেল সরকার; (খ) ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র মােতাবেক প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত  আইন পরিষদের প্রাধান্য; (গ) পূর্ণাঙ্গ মৌলিক অধিকার; (ঘ) সংবাদপত্রের অবাধ আযাদী ও (ঙ) বিচার বিভাগের নিশ্চিত স্বাধীনতা। দুই. ফেডারেল সরকার নিম বিষয়সমূহের উপর ক্ষমতা প্রয়ােগ করিবেন: (ক) প্রতিরক্ষা (ডিফেন্স); (খ) বৈদেশিক বিষয়; (প) মুদ্রা ও কেন্দ্রীয় অর্থব্যবস্থা; (ঘ) আন্তঃপ্রাদেশিক যােগাযােগ ও বাণিজ্য এবং ঐক্যমত নির্ধারিত অন্য যে কোনাে বিষয়। তিন, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা হইবে এবং কেন্দ্রীয় বিষয়গুলাে সরকারের অবশিষ্ট যাবতীয় ক্ষমতা শাসনতন্ত্র মােতাবেক স্থাপিত উভয় আঞ্চলিক সরকারের নিকটই ন্যাস্ত থাকিবে। চার, উভয় প্রদেশের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য বিষয়ে ব্যয় এবং বর্তমান ভবিষ্যৎ বৈদেশিক ঋণসহ কেন্দ্রীয় সরকারের দেনায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত অর্থের আনুপাতিক অংশ আদায়ের পর পূর্ব পাকিস্তানে অর্জিত সম্পূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা নিরঙ্কুশভাবে এই প্রদেশেই ব্যয় করা হইবে; (খ) দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রাদেশিক সরকারদ্বয়ের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বাধীনেই থাকিবে। (গ) অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না-হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে অগ্রাধিকার প্রদান করিবেন এবং এমন আর্থিক নীতি গ্রহণ করিবেন যাহাতে পূর্ব পাকিস্তান হইতে মূলধন। পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ হইয়া যায়। এই উদ্দেশ্যে ব্যাংকের মওজুদ অর্থ ও মুনাফা, বীমার প্রিমিয়াম এবং শিল্পের মুনাফা সম্পর্কে যথাসময়ে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হইবে।
আমেনা বেগম

আমেনা বেগম

মুদ্রা, বৈদেশিক মুদ্রা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং (খ) আন্তঃ আঞ্চলিক বাণিজ্য; (গ) আন্তঃ আঞ্চলিক যােগাযোেগ; (ঘ) বৈদেশিক বাণিজ্য। উপরােক্ত বিষয়সমূহের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকটি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত এক-একটি বাের্ড দ্বারা পরিচালিত হইবে । জাতীয় পরিষদের প্রত্যেক প্রদেশের সদস্যগণ নিজ প্রদেশের জন্য উক্ত বাের্ডসমূহের সদস্যগণকে নির্বাচন করিবেন। ছয়, সুপ্রিমকোর্ট এবং কূটনৈতিক বিভাগসহ কেন্দ্রীয় সরকারের সকল বিভাগ ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমসংখ্যক ব্যক্তি দ্বারা গঠিত। হইবে। এই সংখ্যাসাম্য অর্জনের জন্য ভবিষ্যতে এমনভাবে কর্মচারী নিয়ােগ করিতে হইবে যাহাতে দশ বৎসরের মধ্যে তাহাদের সংখ্যা উভয় প্রদেশে সমান হইতে পারে। সাত, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কার্যকরী সামরিক শক্তি ও সমরসজ্জার ব্যাপারে উভয় অঞ্চলের মধ্যে সমতা বিধান করা পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব হইবে। এই উদ্দেশ্যে : (ক) পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক একাডেমী, অস্ত্র নির্মাণ কারখানা, ক্যাডেট কলেজ ও স্কুল স্থাপন করিতে হইবে; (খ) দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটি বিভাগেই পূর্ব পাকিস্তান হইতে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক লােক নিয়ােগ করিতে হইবে; (গ) নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করিতে হইবে। আট, এই ঘােষণায় ‘শাসনতন্ত্র’ শব্দ দ্বারা ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বুঝায়-যাহা। অবিলম্বে জারি করা হইবে। এই শাসনতন্ত্র চালু করিবার ছয় মাসের মধ্যে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনেই এই কর্মসূচীর দুই হইতে সাত নম্বর দফাসমূহকে শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত করা হইবে। আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবির সঙ্গে পি.ডি.এম.-এর আট দফা দাবির তুলনা : পি.ডি.এম.-এর আট দফা দাবি আওয়ামী লীগের ছয়দফার বর্ধিত সংস্করণ। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য কত বছরে দূর করা হবে- ছয়দফায় এর কোনাে উল্লেখ ছিল না। কিন্তু আট দফায় বলা হয়েছিল যে, দশ বছরের মধ্যে ঐ বৈষম্যসমূহ দূর করতে হবে।
আট দফায় সামরিক বাহিনীর বৈষম্য দূর করার দাবি উত্থাপন করা হয় বা ছয় দফায় করা হয়নি। পি.ডি.এম.-এর গঠন-কাঠামাে ও এর গৃহীত কর্মসূচী ইতিপূর্বে গঠিত কপ কিংবা এন.ডি.এফ. থেকে ভিন্নতর ছিল। পি.ডি.এম, আইয়ুব বিরােধী আন্দোলন গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিল । পি.ডি.এম.-এ অনেক পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা ছিলেন, ফলে এই জোট একটি জাতীয় বিরােধীদলের জোট রূপ লাভ করে। আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের দাবি একটি আঞ্চলিক দলের জোট কিন্তু পি.ডি.এম-এর স্বায়ত্তশাসনের দাবি একটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। ফলে আওয়ামী লীগের ছয় দফায় বর্ণিত স্বায়ত্তশাসনের দাবি অধিকতর জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে ১৯৬৭ সালের ন্যাপ ও আওয়ামী লীগের ভাঙন এবং ভাসানী ন্যাপ কর্তৃক আইয়ুব সমর্থন দান ছয় দফা আন্দোলনকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলে। এসময় পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করেন এবং ভাসানী ন্যাপের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করেন। ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন পাকিস্তান সরকার যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করেছিলেন ঠিক এসই সময়েই পি.ডি.এম.-ভুক্ত পাঁচটি দল ও অপর তিনটি দল মিলে ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি সংক্ষেপে ‘ডাক’ (DAC) নামক একটি বিরােধী জোট গঠন করেন। এই জোট ছিল এন.ডি.এফ.পি.ডি.এম. ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (ওয়ালী), কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে এছলামী দলসমূহ । ভাসানী ন্যাপ এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এই জোটে যােগদান করেনি।
ডাক’ (DAC)-এর অন্যতম নেতৃবৃন্দ ছিলেন এন.ডি.এফ-এর হামিদুল হক চৌধুরী নূরুল আমিন, মাহমুদ আলী, নেজামে এছালামীর ফরিদ আহমেদ, পীর মােহসীনউদ্দিন (দুদু মিয়া), পি.ডি.এম.-পন্থী আওয়ামী লীগের আবদুস সালাম খান, ছয় দফা-পন্থী আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক গােলাম আযম, ন্যাপ (ওয়ালী)-এর অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ এবং স্বতন্ত্র বিচারপতি এস,এম, রাশেদ। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নসরুল্লাহ খান এর আহ্বায়ক মনােনীত হন। ‘ডাক’ জনসাধারণের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের মহান দায়িত্ব পালনের জন্য বর্তমান আন্দোলনকে ব্যাপকতর ও সমন্বিত করে একটি অহিংস, সংঘবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তােলার সংকল্প ঘােষণা করে এবং সে লক্ষে ৮ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। উক্ত ৮ দফা ছিল নিমরূপ : ১, ফেডারেল প্রকৃতির পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা কায়েম ২. প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটে প্রত্যক্ষ নির্বাচন; ৩. অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার; ৪, পূর্ণ নাগরিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। সমস্ত কালাকানুন বিশেষকরে বিনা বিচারে আটক রাখার আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল; ৫. খান আবদুল ওয়ালী খান, শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজনৈতিক বন্দি, রাজনৈতিক কারণে জারিকৃত সব গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রত্যাহার; ৬. ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারার আওতায় জারিকৃত সকল নির্দেশ প্রত্যাহার; ৭. শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার; ৮, নতুন ডিক্লারেশন দানের উপর আরােপিত বিধিনিষেধ সহ সংবাদপত্রের উপর জারিকৃত সকল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ইত্তেফাক, চাতন, প্রগেসিভ পেপারস লিমিটেডসহ সকল বাজেয়াপ্তকৃত কিংবা ডিক্লারেশন বাতিলকৃত প্রেস পত্রিকা। এবং সাময়িকী তাদের আদি মালিকের কাছে প্রত্যাবর্তন।’ 
‘ডাক’-এর এই কর্মসূচির দলিলে স্বাক্ষরদাতাগণ তাদের নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে এই প্রতিজ্ঞ করেন যে তারা এবং তাদের পাটি জনগণকে তাদের পূর্ণ সার্বভৌম ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এবং ৮ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে। সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত, অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাবে।  ‘ডাক’-এর গৃহীত ৮ দফা কর্মসূচির প্রথম দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বামপন্থী ও ডানপন্থীদের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ায় এই জোটের পক্ষে আওয়ামী লীগের ছয় দফাকেও পুরােপুরি সমর্থন করা সম্ভব ছিল না। কিংবা আমেরিকার সঙ্গে সামরিক জোট গঠনেও অস্বীকার করতে পারছিল না। এমতাবস্থায় ডাকের পক্ষে আইয়ুব বিরােধী গণআন্দোলন গড়ে তােলা সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ এক ব্যাপক ছাত্র-আন্দোলন গড়ে তােলেন যা পরে গণআন্দোলনের রূপ নেয়। ছাত্রদের এগার দফা আন্দোলন। বিস্তারিত সপ্তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য

সূত্রঃ   স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!