বাংলার বাণী
১০ই জানুয়ারী, ১৯৭৩, বুধবার, ২৬শে পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
মহান মুক্তি দিবস
১৯৭৩ সালের ১০ই জানুয়ারী। ঠিক একটি বছর পূর্বে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী বাংলার মানুষের মাঝে কারামুক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ সেই বাঙালীর মহাপুণার্হ ঐতিহাসিক দিন। এদিন বাংলার মানুষের কাছে প্রতি বছর মহানন্দে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে আনবে মুক্তিদিবস হিসেবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তি দিবস—গোটা বাঙালী জাতির জীবনে এদিন সার্বিক মুক্তি দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর সে দিন থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছিলো মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ। হয় বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির চির বিদায় হবে নয়তো বাঙালী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ইতিহাসের পাতা থেকে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এই মহা দুর্জয় শপথেই স্বাধীনতার রক্তসুর্য বাংলার মানুষের করায়ত্ত হয়েছে। স্বাধীনতা এলেও তার পরিপূর্ণতা বাঙালী লাভ করতে পারেনি ততদিন যতদিন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের মাঝে ফিরে আসেনি। সাম্রাজ্যবাদী পশু শক্তির ক্রীড়নক পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা শেষ অবধি গণতান্ত্রিক বিশ্বের, বিশেষত ভারতের মহিয়সী নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। গত বছর এই ঐতিহাসিক দশই জানুয়ারীতে বাঙালীর চিরবন্দিত নেতা ‘মুজিব ভাই’ ফিরে এলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় জনগণের মাঝে। বাংলাদেশের মানুষ যেন সেদিনই স্বাধীনতার আস্বাদন লাভ করেছিলো—সত্যিকার অর্থেই যেন বাংলার মানুষ মহাবিজয়ানন্দের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসবে পাগলপারা হয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের সংগ্রামী ইতিহাস অভিন্ন। তেমনি এদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তার সঙ্গে শেখ মুজিবের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুমহান নেতৃত্বও অমলিনভাবে বিজড়িত। তাই যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো তখন বঙ্গবন্ধু ছাড়া এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা আপন সত্তা বা জাতীয় সত্তা চিন্তা করতে পারেনি। এ কারণেই আজকের এই মহান মুক্তি দিবস বাংলাদেশের চিরকালের ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় অব্যয় হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ বাঙালী জাতির জনক—সরকারের প্রধানমন্ত্রী। চিরকাল এদেশের মানুষ তার সঙ্গে ছিলো—ভবিষ্যতেও থাকবে। আজকের এই মহান মুক্তি দিবসে গোটা জাতিকে শপথ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশা পর্যন্ত আমরা প্রত্যেকটি মানুষ তাঁর মহান নেতৃত্বের এক একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে যাবো। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শের মাধ্যমে তাঁর আজীবন সাধনার স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করবো।
০০০
বাংলার বাণীর তিন বৎসর
দেখতে দেখতে তিনটি বৎসর গড়িয়ে গেলো। তিনটি বৎসর অসংখ্য দিন। আর এই অসংখ্য দিনের অসংখ্য ঘটনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই তিনটি বৎসর যেমন তাৎপর্যপূর্ণ তেমনি ভবিষ্যত বাংলার রূপ নির্ধারকও বটে। আজ থেকে তিন বৎসর পূর্বে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম।
জন্মলগ্নে বাংলার বাণীর লক্ষ্য ছিলো দু’টি। নিকট লক্ষ্য বাংলার স্বাধীনতা, দূর লক্ষ্য আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে শোষণহীন এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। নিকট লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এ স্বাধীনতাকে সংহত করা এবং মূল লক্ষ্য বাংলার কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভে আমাদের অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এ সংগ্রামে বাংলার বাণী সেই মেহনতী মানুষেরই কণ্ঠস্বর, তার বান্ধব, তার সংগ্রামী সাথী।
স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হিসেবেই প্রণয়ন করেছিলো ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচী। এই ৬-দফা কর্মসূচী প্রকাশ হবার পর পরই তার অর্ন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলো তদানীন্তন পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসক চক্র। পর্যায়ানুক্রমে আন্দোলন এগিয়ে চলে চরম পরিণতির দিকে। সে সময়ে বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনকারী এই আন্দোলনকে সংবাদপত্রের পাতায় তুলে ধরবার মত সৎসাহসী সাংবাদিক খুব বেশী ছিলো না। সরকারী নির্যাতনের ভয়ে অনেকেই তখন আতঙ্কগ্রস্ত। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে সংগ্রাম পিছিয়ে পড়েনি। ক্রমে তা গণ-অভ্যূত্থানে পর্যবসিত হয়। শাসন ক্ষমতার বহির্মঞ্চ থেকে জেনারেল আইয়ুবের অন্তর্ধান এবং গণতন্ত্র প্রবর্তন ও সাধারণ নির্বাচনের ওয়াদাবদ্ধ জেনারেল ইয়াহিয়ার গদি আরোহণ সেই গণ-অভ্যূত্থানেরই পরবর্তী ঘটনাবলী। এসময় আন্দোলনকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সংগ্রামী রাজনৈতিক শিবিরে প্রচন্ডভাবে অনুভূত হতে থাকে। স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা এই নিকট অথচ বিপজ্জনক লক্ষ্যে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামী উদ্দেশ্যেই সত্তরে বাংলার বাণীর প্রথম আত্মপ্রকাশ।
অতঃপর যুদ্ধ সুরের সঙ্গে অসুরের, প্রগতিশীলতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলতার, জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে গণবিরোধী দুশমনদের। সত্তরের জানুয়ারী থেকে একাত্তরের মার্চ। সুদীর্ঘ পনেরটি মাস আমাদের বুঝতে হয়েছে ঔপনিবেশিক চক্রান্ত, সুবিধাবাদী আপোষকামী রাজনৈতিক ও অতিবিপ্লবী হঠকারী বালকসুলভতার বিরুদ্ধে। স্তরানুক্রমিকভাবে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে রাজনৈতিক আন্দোলন। প্রতিক্রিয়াশীলদের চরম আঘাত আসে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাত্রে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গোলার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় বাংলার বাণীর কার্যালয়। সমস্ত আক্রোশ নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের উপর। বাংলার বাণী পরিবারের একজন সংগ্রামী সদস্যকে হায়েনার দল নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের মুক্ত এলাকা থেকে জনগণের ইচ্ছের প্রতিধ্বনি করে বাংলার বাণী পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে। এ প্রকাশনা অব্যাহত থাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে পূর্ণ বিজয় অর্জন পর্যন্ত।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সাপ্তাহিক বাংলার বাণী তার দূর লক্ষ্য অর্জনের সুমহান ব্রত নিয়ে দৈনিক আকারে প্রকাশিত হয় বায়াত্তরের ফেব্রুয়ারীতে। সেই লক্ষ্যে আমাদের জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা তথা মুজিববাদের মাধ্যমে শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলা। অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও বাংলার বাণী সকল ভয়-ভীতি হামলার মোকাবেলা করে জনগণের সংগ্রামী আন্দোলনে শরীক থাকবে। স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্ত এবং অতিবিপ্লবী হঠকারী মহল থেকে বাংলার বাণীর উপর হামলা হয়েছে। জনগণের কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেয়ার নানা ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা আমাদের এই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে জনগণের সহযোগিতা, আন্তরিকতা ও আশীর্বাদকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি সেই ত্রিশ লক্ষ শহীদানকে যার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁর আদর্শকে বাস্তবায়িত করার সংগ্রামে শরীক হয়ে শাহাদত বরণ করেছেন। দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আমরা ঘোষণা করছি জনগণের সংগ্রামে আমরা ছিলাম, আমরা আছি, ভবিষ্যতেও আমরা জনগণের সঙ্গেই থাকবো।
০০০
নয়া শিল্প বিনিয়োগ নীতি
স্বাধীন বাংলার প্রথম শিল্প বিনিয়োগ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এ নীতির লক্ষ্য হলো পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
নয়া শিল্পনীতির বৈশিষ্ট্য হলো একচেটিয়া পুঁজিবাদের পথকে রুদ্ধ করা। বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগকে একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত বাড়তে দেয়া। কেবলমাত্র সরকারের সহযোগিতায় নয়া বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা।
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে যে, এ নয়া শিল্পনীতিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে সেজন্যে দশ বছরের জন্য জাতীয়করণ করা হবে না বলেও ঘোষণা করা হয়েছে। শিল্পনীতিতে একথাও বলা হয়েছে যে, বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সম্পত্তি ২৫ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে হবে না। এ সব প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে ৩৫ লাখ টাকার বেশী বাড়তে দেয়া হবে না। শুধু তাই নয় মালিকদের অব্যবস্থাপনা বা অবহেলায় কোন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন দক্ষতা পুরোপুরি ব্যাহত না হলে বা ক্রমাগত লোকসান হতে থাকলে সরকারের যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করার অধিকার সংরক্ষিত থাকবে।
বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে সরকারের যৌথ অংশীদারীত্বে বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগ অনুমোদন করা হবে। এক্ষেত্রে শতকরা ৫১ ভাগ থাকবে সরকারের অংশ। এভাবে বিনিয়োগকৃত পুঁজি ১০ বছরের মধ্যে জাতীয়করণ না করার নিশ্চয়তা সরকার প্রদান করছে এবং ১০ বছর পর যদি জাতীয়করণ করা হয় তাহলে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের জন্য যে বোর্ড গঠন করা হয়েছে তাতে সুস্পষ্টভাবেই কতকগুলো বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ফলে অতীতে বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগকারীরা নিজেদের খুশী মাফিক যে কায়কারবার চালাতে পারতো তার পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
নয়া শিল্পনীতির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কথা বাদ দিয়ে আমরা এ দু’টো বৈশিষ্ট্যকেই তুলে ধরলাম। কারণ বাংলাদেশ এখনো শিল্পক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনগ্রসর। পাকিস্তানী শাসন ও শোষনের ফলে এদেশে যেমন একদিকে মূলধনের অভাব তেমনি প্রয়োজনীয় শিল্পকারখানাও গড়ে ওঠেনি। সুতরাং এ দু’টো অবস্থাকে কাটিয়ে তুলতে হলে বেসরকারী ও বিদেশী পুঁজিকে উৎসাহিত করার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি! স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরের মধ্যে কোন শিল্পনীতি ঘোষিত না হওয়াতে এতদিন পর্যন্ত যে একটা শূন্যতা বিরাজ করছিলো—নয়া নীতির ফলে তার অবসান হবে বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক