You dont have javascript enabled! Please enable it! রাউজানের লামুরহাট এলাকায় গেরিলা অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
রাউজানের লামুরহাট এলাকায় গেরিলা অপারেশন
উদ্দেশ্য
সেপটেম্বরের দিকে লাম্বুরহাট এলাকায় রাজাকারদের যাতায়াত ও কার্যকলাপ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। জনগণ ক্যাপটেন করিমের কাছে রাজাকারদের অত্যাচারের কথা জানালে তিনি ঐ এলাকায় রাজাকারদের অত্যাচার এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করার উদ্দেশ্যে একটি অপারেশনের পরিকল্পনা করেন।
পর্যবেক্ষণ ও অপারেশন
বােয়ালখালীর ষষ্টিপুরা ইন্দুরবাড়ি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে ৪০-৪৫জনের মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপটি অপারেশনের প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে লাম্বুরহাটের দিকে যাত্রা করেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে নৌকাযােগে তাদের যাত্রা শুরু হয়। তারপর কৈগ্রামের এক জেলেরবাড়িতে শেষ রাতে আশ্রয় নেয়। পরদিন ক্যাপটেন করিম ঐ জেলেরবাড়ি থেকে হাবিলদার নুরুন্নবী, আজিজুল হক, সামসুল আলম ও পিসি গােলাম ফারুককে লাম্বুরহাট ব্রিজে টহলরত রাজাকারদের সংখ্যা ও অস্ত্রসহ অন্যান্য তথ্যসংগ্রহ করার জন্য পাঠান। পর্যবেক্ষণ রিপাের্টে দেখা যায় যে, সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাজাকাররা ঐ ব্রিজে পাহারা শুরু করে। ঐ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সন্ধ্যা ৭টায় মুক্তিযােদ্ধারা পূর্বোক্ত জেলেরবাড়ি থেকে পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে তারা ২জন রাজাকারের সাক্ষাৎ পান। তাদের ওপর আকস্মিকভাবে আক্রমণ করলে রাজাকাররা হাতের ২টি রাইফেল ফেলে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা ১জন রাজাকারকে ধরে ফেলেন। পরে তাকে বেদম প্রহার করে মৃতপ্রায় অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়। লাম্বুরহাট পৌছে মুক্তিযােদ্ধারা হাটের উত্তর দিকে একটি মিল ঘরে আশ্রয় নেন। ক্যাপটেন করিম ও শামসুল আলম বাকি মুক্তিযােদ্ধাদের সেখানে রেখে বাজারে কোনাে রাজাকার আছে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য গমন করেন। সে সময় বাজারের একটি দোকানে বসে ১০-১২জন রাজাকার জুয়া খেলছিল।
তারা ক্যাপটেন করিম এবং শামসুল আলমকে দেখে সন্দেহ করে ধরার চেষ্টা করলে ২জনই ত্বরিতগতিতে নিজেদের রিভলভার ও স্টেনগান বের করে গুলি শুরু করেন। পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই ৫জন রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে ঘটনাস্থলে মারা যায়। অন্যদিকে গুলির আওয়াজ শুনে মিল ঘরে অবস্থানরত অন্য  মুক্তিযােদ্ধারা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন। তবে ইতােমধ্যে বাকি রাজাকাররা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারদের লাশগুলাে বাজারের পাশের খালে ফেলে দিয়ে লাম্বুরহাট ব্রিজের দিকে যাত্রা করেন। রাত আনুমানিক ১১টা নাগাদ তারা ব্রিজের কাছে পৌছে দেখতে পান, ৮১০জন রাজাকার ব্রিজের ওপর টহল দিচ্ছে আর রেডিও বাজাচ্ছে। মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে কোনােপ্রকার বাধা দেওয়ার চেষ্টা না করেই তারা অস্ত্র ও রেডিও নদীতে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ধাওয়া না করে ব্রিজ পার হয়ে দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে এক গ্রুপ ক্যাপটেন করিম ও আজিজুল হকের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের সহযােগী এক দালালের বাড়িতে, অন্য গ্রুপ সামসুল আলম। ও হাবিলদার নুরুন্নবীর নেতৃত্বে ঐ এলাকার পাকিস্তানি সমর্থক চেয়ারম্যানের বাড়িতে আক্রমণের জন্য যাত্রা শুরু করেন। ক্যাপটেন করিমের গ্রুপ দালালের বাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাকে হত্যা করে। অন্য গ্রুপটি চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে তাকে না পেয়ে তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারপর মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রুপ ২টি পুনরায় রাত ৩টার দিকে একটি স্কুলের সামনে একত্র হয়। সেখান থেকে তারা রাত শেষে এক হিন্দু দারােগার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সারাদিন ওখানে থেকে রাতে তাঁদের বােয়ালখালী আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে আসেন। ঐ অপারেশনে ২টি এলএমজি, ৪টি এসএলআর ও ৩০-৩৫টির মতাে রাইফেল ব্যবহার করা হয়। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা ২টি রাইফেল হস্তগত এবং ১জন। দালালকে হত্যা করেন।
বিশ্লেষণ
লাম্বুরহাটের ক্যাপটেন করিমের অপারেশনগুলাে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, রাজাকাররা এসব অপারেশনে তেমন কোনাে বাধা দিতে পারে নি অথবা মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে পালিয়ে যায়। যা তাদের আদর্শ, মনােবল, আনুগত্য ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত দুর্বলতার পরিচায়ক। অন্যদিকে, মুক্তিযােদ্ধারা কয়েকটি ক্ষেত্রে। তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এ অপারেশনে তাদের বুদ্ধিমত্তা ও শক্ৰহননের অদম্য ইচ্ছা ও উঁচু মনােবলের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।  তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকারর: মুক্তিযােদ্ধা লিয়াকত আলী খান।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড