You dont have javascript enabled! Please enable it!

রুহুল কুদ্স
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত প্রাক্তন সিএসপি, অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মুখ্যসচিব এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব।
রুহুল কুদুস সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাইরে শেখ মুজিবর রহমানের একটি ইনার সার্কেল ছিল। ওই ইনার সার্কেলে তিনি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আরেক অভিযুক্ত প্রাক্তন সিএসপি আহমদ ফজলুর রহমানও ছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একজনই ছিলেন ইনার সার্কেলের লোেক তিনি তাজউদ্দীন আহমদ।  ছয়দফা প্রণয়ন সম্পর্কিত পূর্ব কথায় রুহুল কুদুস বলেন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণের সূত্রপাত ঘটায়। এই সময় পাকিস্তানের আয়কৃত মােট বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ৭০ ভাগ আয় করতে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান আয় করতে শতকরা ৩০ ভাগ। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন বাজেটে শতকরা ৭০ ভাগ ব্যয় বরাদ্দ থাকতাে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পূর্ব পাকিস্তান পেতে শতকরা ৩০ভাগ । উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য যে বৈদেশিক ঋণ আসতাে, তার প্রায় সবটাই যেতাে পশ্চিম পাকিস্তানে। অথচ ঋণ পরিশােধ করা হতাে পূর্ব পাকিস্তানের আয়কৃত অর্থ থেকে । ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন ঘােষণার মাধ্যমে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আইউব খানের আগমনে এতদঞ্চলের মানুষের ভাগ্য এক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয় ।
শোষণ আরাে তীব্রতর হতে থাকে এবং পাকিস্তানের মানুষ তাদের রাজনৈতিক, মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। যেহেতু আমি প্রশাসনের মধ্যেই ছিলাম, সে কারণে বৈষম্যের মেকানিজম এবং মাত্রা আমার কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ১৯৬১ সালের আগ পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিমে পাকিস্তানের বৈষম্যের সঠিক পরিসংখ্যানসহ কোন বক্তব্য আসেনি। তবে এতদিনে পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ এবং এখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তানি শােষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়ে ওঠেন। আমি ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শােষণের পুরাে তথ্য ও পরিসংখ্যানসহ ইংরেজিতে একটি নিবন্ধ রচনা করি। নিবন্ধটি প্রকাশ করার জন্য শেখ মুজিব মারফত দৈনিক ইত্তেফাক-এ দেই । দৈনিক ইত্তেফাক সেটার বাংলা করে ধারাবাহিকভাবে ছাপান।
১৯৬২ সালে আইউব খান নতুন শাসনতন্ত্র দেন। সে সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তানের। ওপর পাকিস্তানি শােষণ ও বৈষম্যের অবসান প্রশ্নে আমি প্রায়শই পূর্ব পাকিস্তানি। নেতাদের সঙ্গে মত বিনিময় করতাম। শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আলােচনাটা হতাে। বেশি। অবশ্যিই সেটা গােপনে। সরকারি কর্মচারী ছিলাম বলেই গােপনীয়তার আশ্রয় নিতে হতাে। আমি তখন কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর শেখ মুজিব আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণ অবসানের লক্ষ্যে স্বায়ত্ত শাসনভিত্তিক একটি দলিল তৈরি। করে দিতে বলেন। আমার রচিত ওই খসড়া দলিলটি ছিল সাত দফার । তৈরির পর সেটা নিয়ে শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলােচনায় বসি। আলােচনার পরে একটি দফা বাদ দেওয়া হয়। বাদ দেওয়া ওই দফাটি ছিল—প্রাদেশিক গভর্নরকে। নির্বাচিত হতে হবে।
দলিল তৈরির পর আমি সেটা টাইপ করাই খায়রুল কবিরের অফিস থেকে। খায়রুল কবির তখন তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের (স্বাধীনতার পর জনতা ব্যাংক) এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর আমি কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ফাইন্যান্স ডাইরেক্টর। প্রশ্ন : ছয় দফা দলিলটি সম্পূর্ণই আপনার তৈরি? রুহুল কুদুস : শতকরা একশত ভাগ আমারই তৈরি । খসড়া দলিলটি চূড়ান্ত হবার। পর আমি শেখ মুজিবকে সেটা নিয়ে নূরুল আমিনের সঙ্গে কথা বলতে বলি। তিনি তখন ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের (এন ডি এফ) নেতা। নূরুল আমিনের সঙ্গে আলােচনা করতে বলি এই কারণে যে, এ বিষয়ে সকল বাঙালি নেতাকে এক প্লাটফরমে আনা যায় কিনা, সে উদ্দেশ্যে । প্রথম দিকে শেখ মুজিব নূরুল আমিনকে ছয় দফার কপি দেখাতে রাজি ছিলেন না। কারণ, নূরুল আমিন সম্পর্কে তার সন্দেহ ছিল যে, এই বিষয়ে তিনি ঐকমত্যে আসবেন না। তথাপি আমার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হন এবং নূরুল আমিনের কাছে যান। তার হাতে ছয় দফার একটি কপি তুলে দেন। ওই সময় গণতন্ত্রী দলের নেতা মাহমুদ আলি সেখানে ছিলেন। নূরুল আমিন ছয় দফার কপিটি পড়েন এবং মাহমুদ আলীর হাতে তুলে দিয়ে বলেন, এ নিয়ে তিনি পরে আলাপ করবেন। পরদিন শেখ মুজিব আমাকে রেগেই বললেন “তােমাকে বলেছিলাম নূরুল আমিনকে দেখিয়ে কাজ হবে না। লাহাের সম্মেলনের আগেই ছয় দফা সরকারের কাছে চলে যাবে। সেখানে মাহমুদ আলী বসেছিলেন। সম্ভবত ইতােমধ্যেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।” মাহমুদ আলীকে আমরা সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের লােক বলে মনে করতাম।
পরে কেন্দ্রীয় তথ্য সচিব আলতাফ গওহর তার প্রভু আইউব খানকে তাসখন্দ চুক্তি উদ্ভুত সংকট থেকে বাচানাের জন্যে ছয় দফাকে ব্যবহার করেন। ছয় দফার। ব্যাপক প্রচারের জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের সকল পত্রিকা সম্পাদককে গােপন নির্দেশ
দেন। তিনি এই অপকৌশল অবলম্বন করে তাসখন্দ চুক্তি সৃষ্ট বিক্ষুব্ধ পশ্চিম পাকিস্তানিদের দৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন। ছয় দফার ব্যাপক প্রচারে প্রথম দিকে আমরা হতবাক হয় যাই। অবশ্যি সরকারের অপকৌশল অনুধাবনে আমাদের দেরি হয় না ।
প্রশ্ন ছয় দফার রচয়িতা একা আপনি, এ কথা শেখ মুজিব কখনাে বলেননি রুহুল কুদ্স কারাে কারাে সামনে তিনি বলেছেন। বলেছেন এইভাবে—“এই যে ইনিই ছয় দফা তৈরি করেছিলেন। আদতে অন্যের অবদানকে স্বীকৃতি দেবার উদারতার অভাব ছিল শেখ মুজিবের মানসিকতায়। তার অবর্তমানে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তাই কখনাে তিনি একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করেন নি কী কষ্ট আমরা করেছি, কী যন্ত্রণা আমরা সয়েছি অথবা কীভাবে আমরা যুদ্ধ করেছি । সৈয়দ নজরুল ইসলামও আমাকে বলেছেন, তার কাছেও স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানতে চান নি শেখ মুজিব। অন্যের অবদানকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের পর রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনা সভায় মামলায় অভিযুক্ত আসামীদের মঞ্চে তুলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতেন। তা করেন নি একই কারণে । অন্যদিকে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা ফেরার কয়েকদিন পরই তিনি সােজা চলে যান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি যুদ্ধ বন্দিদের দুঃখ-দুর্দশার খোঁজ খবর করতে । এ ব্যাপারটি আমাদেরকে তখন বিক্ষুব্ধ করে তােলে দারুণভাবে।

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক

 

 

 

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!