হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লী মিশন প্রধান, স্বাধীনতার পর দিল্লীতে বাংলাদেশ হাই কমিশনার, পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এক সময় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি।
প্রশ্ন : তিনজন সংখ্যালঘু নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন এবং তার কাছে বাংলাদেশকে ভারতের একটি অংশ করে রাখার প্রস্তাব দেন। আপনি এ সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের যােগাযােগ রক্ষা করার দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত ছিল । সেই সূত্রে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফদের সঙ্গে আমার হার্দিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর এক ব্যক্তিগত স্টাফ আমাকে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ জানান যে, আগের দিন অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর তিনজন সংখ্যালঘু নেতা যাদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন সুতার ছিলেন একজন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তারা তাঁর কাছে বাংলাদেশকে ভারতের অংশ করে রাখার প্রস্তাব রাখেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রস্তাবের জবাবে বলেন “ইয়ে না। মুমকীন হ্যায়। প্রধানমন্ত্রীর ওই ব্যক্তিগত স্টাফ সেই সময় সেখানে ছিলেন। তিনিই ওই সাক্ষাঙ্কারের ব্যবস্থা করে দেন। পরে আমি বাংলাদেশে সরকারকে বিষয়টি অবহিত করি । কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে। কোন ব্যবস্থা নেয় হয় না। আসলে, তারা, কিছু সংখ্যালঘু নেতা চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে সিকিম ধরনের ভারতীয় অংশ করতে ।
প্রশ্ন ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানি বন্দিদশ্য থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন দিল্লী হয়ে ঢাকা আসেন। তিনি লন্ডন থেকি দিলী আসেন ব্রিটিশ | বিমান বাহিনীর একটি বিমানে। দিল্লী থেকে নিজস্ব বিমানে তাকে ঢাকায় পৌছে দেবার প্রস্তাব রাখে ভারত সরকার। কিন্তু শেখ মুজিব ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সত্য কি? হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কথাটি সত্য। ভারত সরকারের তৎকালীন প্রানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ডি পি ধর, তার ওপর অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত বিষয়াবলি দেখা শােনার দায়িত্ব ছিল অর্পিত। তিনিই আমাকে ভারত সরকারের ওই প্রস্তাবটি জানিয়ে বলেন “ব্রিটিশ সরকার এখনাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। সেখানে শেখ সাহেব কী করে তাদের বিমানে ঢাকা যাবেন।” অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে একদিন বলেছিলেন ডি পি ধর যা বলবেন, সেটাকে বাংলাদেশ সরকারের আদেশ বলে মনে করতে হবে।’ তাজউদ্দীন আহমদের সে কথা মনে রেখেও আমি বঙ্গবন্ধুকে (শেখ মুজিব) ভারত সরকারের ওই প্রস্তাবের। বিষয় জানাতে সাহস পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমারই অনুরােধে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বঙ্গবন্ধুকে ওই প্রস্তাবের কথা জানান। বঙ্গবন্ধু তাতে বলেছিলেন “আমি ভারতীয় বিমানে ঢাকা যাব না। এটাই আমার শেষ কথা। ওদের বলে দিও।” আমি বঙ্গবন্ধুর এ জবাবে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম । স্বস্তিবােধ করেছিলাম।
প্রশ্ন ইতালীয় ফ্রি-ল্যান্স মহিলা সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছেন যে, শেখ মুজিব তার সামনে পবিত্র কুরআন শরীফ স্পর্শ করে বলেছিলেন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন। শেখ মুজিবকে এ বিষয়ে আপনি কখনাে কি কোন প্রশ্ন করেছিলেন।
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী : ওরিয়ানা ফালাসিকে দেয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওই সাক্ষাৎকারটি আমি ১৯৭২ সালেই পড়ি। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে এ নিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলাম একবার । তিনি অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, ভুট্টোকে তিনি এ ধরনের কোন কথা দেন নি। আর ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় আমার সঙ্গে ভুট্টোর দেখা হয় । আমি তখন সউদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত । ভুট্টো ওই সময় সউদি আরব সফরে যান । আমি ওরিয়ানা ফালাসিকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারে তাকে দেয়া শেখ মুজিবের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে বলি যে শেখ মুজিব আমাকে বলেছেন তেমন কোন। প্রতিশ্রুতি আপনাকে তিনি দেন নি। ভুট্টো আমার কথায় বার বার জোর দিয়ে বলেন যে, শৈখ মুজিব তার কাছে ওয়াদা করেছিলেন। তিনি এও বলেন যে, তিনি মিথ্যা। বলছেন না।
প্রশ্ন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার আগে সােভিয়েত ইউনিয়ন লিখিতভাবে জানতে চায় যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে কোন কাঠামােগত সম্পর্ক রাখবে কিনা? ঘটনাটি কতটুকু সত্য?
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ঘটনাটি সত্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান সােভিয়েত ইউনিয়নকে লিখিতভাবে জানান যে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের কোন কাঠামােগত সম্পর্ক রাখার কোনই সুযােগ নেই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এরপরই সােভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় । প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি আমি নিজে দিল্লীতে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের হাতে দেই ।
প্রশ্ন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে যে গােপন সাত দফা চুক্তি করে, প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা কি সেই সাত দফার মধ্যেই একটি? রক্ষী। বাহিনী কি সেই প্যারামিলিশিয়া বাহিনী?
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক লিখিত চুক্তিতে, প্যাক্ট নয় এগ্রিমেন্টে-এ আসেন। ওই চুক্তি বা এগ্রিমেন্ট অনুসারে দু’পক্ষ কিছু প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক সমঝােতায়। আসেন। প্রশাসনিক বিষয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ভারতের যে প্রস্তাবে রাজি হন, তা হলাে যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়ােজিত থাকতে পারবে। বাকিদের চাকুরিচ্যুত করা হবে এবং সেই শূন্য জায়গা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। স্বাধীনতার পর বেশ কিছু ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেও গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) এসে তাদেরকে বের করে দেন। সামরিক সমঝােতা হলাে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে (কতদিন অবস্থান করবে তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় না)। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতিবছর এ সম্পর্কে দু’দেশের মধ্যে পুনরীক্ষণের জন্য বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী থাকবে না। অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তি বাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে । ওই লিখিত সমঝােতাই হচ্ছে বাংলাদেশে রক্ষী বাহিনীর উৎস। আর ভারতপাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ বিষয়ক সমঝােতাটি হলাে সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তি বাহিনী সর্বাধিনায়ক নন। যুদ্ধকালীন মুক্তি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে ।
চুক্তির ওই অনুচ্ছেদটির কথা মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে জানান হলে তীব্র ক্ষোভে তিনি ফেটে পড়েন। এর প্রতিবাদে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকেন না। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাধারণ কথাবার্তার মাঝে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে বলেন “আমার দেশ থেকে আপনার সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনতে হবে। শেখ মুজিব এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এত সহজভাবে তুলতে পারেন ভাবতেও পারেন নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তার ওই অপ্রস্তুত অবস্থার সুযােগ নিয়ে শেখ মুজিব নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন: “এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আদেশই যথেষ্ট।” অস্বস্তিকর অবস্থা পাশ কাটাতে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি হতে হয় এবং জেনারেল মানেকশকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দিনক্ষণ নির্ধারণের নির্দেশ দেন। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যে চুক্তি হয়, সেটা খােলা বাজার (ওপেন মার্কেট) ভিত্তিক। খােলা বাজার ভিত্তিতে চলবে দু’দেশের বাণিজ্য। তবে বাণিজ্যের পরিমাণের হিসাবনিকাশ হবে বছরওয়ারি এবং যার যা প্রাপ্য, সেটা স্টার্লিং-এ পরিশােধ করা যাবে। স্বাধীনতার পর পরই চুক্তি অনুসারে খােলা বাজারভিত্তিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় । দু’দেশের সীমান্তের তিন মাইল খুলে দেয়া হয়। শেখ মুজিব এটা বন্ধ করে দেন।
বৈদেশিক বিষয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যে চুক্তিতে আসেন, সেটা হলাে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলবে এবং যতদূর পারে ভারত এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে। মূলত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারত। এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম । চুক্তি স্বাক্ষরের পর মুহূর্তেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভারত সরকারের সঙ্গে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গৃহীত এই পুরাে ব্যবস্থাকেই অগ্রাহ্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এ কারণে আমি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি যে, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ বাংলাদেশ পাকিস্তান সৈন্য মুক্ত হয় মাত্র। কিন্তু স্বাধীন। সার্বভৌম হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতে যেদিন শেখ মুজিব পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা আসেন। বস্তুত শেখ মুজিব ছিলেন প্রকৃত সাহসী এবং খাটি জাতীয়তাবাদী।
সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক