You dont have javascript enabled! Please enable it!
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অস্থিরতা ‘র’ – সিআইএ মুখােমুখি
যে উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয় ভারতের মাটিতে, তার বিনাশ ঘটায় ‘র’ তার উদ্দেশ্য সাধনে ভিন্নতর পরিকল্পনা নেয়। স্বাধীন বাংলার মাটিতে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ চরাকালীন ভারতের সঙ্গে যে সাত দফা গােপন চুক্তি সম্পাদন করে, তাতে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় যে আধাসামরিক বিশেষ বাহিনী গঠনের ধারা সন্নিবেশিত হয়, সেই বাহিনীই হচ্ছে সে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। রক্ষী বাহিনী হচ্ছে সে বাহিনী। রক্ষী বাহিনী গঠনের ভেতর দিয়ে র’ দু’টি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্থির করে। এক, কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, যারা ভারতে গিয়ে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে, তাদেরকে এবং দুই, তার মার্কিনপন্থী প্রতিপক্ষকে—তারা মুক্তিযােদ্ধা হােক বা না-ই হােক, তাদেরকেও কায়িকভাবে নিশ্চিহ্ন করা। শেখ মুজিব দেশ স্বাধীন হবার ২৫ দিন পর, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন। ক্ষমতায় বসার পর পরই যে বিষয়টির প্রতি তিনি সমধিক গুরুত্ব আরােপ করেন, তা হল, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা। আর তার প্রতিপক্ষ হচ্ছে তারই ভাষ্যানুযায়ী বামপন্থীরা। এ বিষয়ে ফ্রান্সের দৈনিক লা মদ-এ প্রকাশিত তার সাক্ষাৎকার স্মর্তব্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে কোন এক সময় লা মদকে দেয়া তার এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চে। তাতে শেখ মুজিব বলেন “পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কি এটা বােঝেন না যে আমিই হলাম একমাত্র লােক যে পূর্ব পাকিস্তানকে কমিউনিজম থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। যদি তারা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন তবে আমি ক্ষমতাচ্যুত হব এবং আমার নামে ‘নকশালরা নেমে পড়বে। যদি বেশি ছাড় দেই, আমি কর্তৃত্ব হারাব। মুশকিলে আছি আমি।” অতএব, লক্ষ্য অনুযায়ী শেখ মুজিবের পক্ষে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কায়িকভাবে বিনাশ করা সম্ভব সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বাহিনীকে ব্যবহার করে ।
উদ্দেশ্য সাধনে সেনাবাহিনীকে হয়তাে ব্যবহার করা যেতাে। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্যখানে। প্রথমত, সেনাবাহিনী তখনাে রয়েছে অসংগঠিত পর্যায়ে। উপরন্তু সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য (তখনাে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি সৈনিক ও অন্যান্য পেশার লােকজন ফিরে আসেনি বাংলাদেশে) অংশ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে  তাদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে নিয়ােগ, ভিন্ন ধরনের জটিলতা হয়তাে সৃষ্টি করতাে এবং সে জটিলতা অবশ্যিই রাজনৈতিক  অতএব, প্রতিপক্ষকে নির্মূলে এমন একটি বাহিনীর প্রয়ােজন পড়ে, যা কোন রাজনৈতিক চেতনায় সিক্ত নয়। কিংবা কোন লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত নয়। এই কারণেই মুজিব বাহিনী নেতৃবৃন্দ,দেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে (দেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করা হয়) অস্থায়ী সরকার বাতিল করে তারই নেতৃত্বে জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক শক্তিকে ওই সরকারের অন্তর্ভুক্তির যে আহবান জানায়, শেখ মুজিব তা নাকচ করে দেন।
বিপ্লবী সরকারের প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাবার পর স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আরাে দুটি প্রস্তাব রাখে শেখ মুজিবের কাছে । হাসানুল হক ইনুর দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রস্তাবগুলাে হলাে এক, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দল ও মতের প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধাকে সরকারি ঘােষণাবলে অস্ত্রসহ ক্যাম্পে একত্রিত করে তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং সরকারিভাবে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে মর্যাদাবান করতে হবে; দুই, পাকিস্তান ও ব্রিটিশের ছেড়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক প্রশাসনের বদলে নতুন প্রশাসনের অবকাঠামাে তৈরির লক্ষ্যে তাদেরকে মেধা অনুযায়ী কাজে লাগাতে হবে। এদের যারা স্বাধীন দেশের প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনে আসতে চায়, তাদেরকে মেধানুযায়ী সুযােগ দিতে হবে; তিন, মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে সেনাবাহিনী গড়ে তুলেতে হবে, তবে সে বাহিনী প্রচলিত (Conventional) বাহিনীর মত হবে না। এ বাহিনী হবে জনগণের বাহিনী যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তাদেরকে নিয়ােগ করতে হবে; চার? অস্থায়ী সরকার ও আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএ যারা ভারতে অবস্থানকালে দুর্নীতি করেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, গণবিরােধী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী কাজ করেছে, তাদেরকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচার করতে হবে। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ যারা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছে, তাদেরকে আওয়ামী লীগে আসার আহবান জানাতে হবে; পাঁচ, সরকার প্রধান নয়, দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ মুজিব সরকারের বাইরে থেকে সরকারের ভুলভ্রান্তিকেই শুধু দেখিয়ে দেবেন না, সেটা নিরসনে নির্দেশ দান করবেন এবং দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবেন; ছয়, বাইরে থেকে যে বিপুল সাহায্য আসছে তা প্রধানত দেশ পুনর্গঠনে ও গণশিক্ষার কাজে ব্যবহার করতে হবে । এবারও শেখ মুজিব এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
কেননা, প্রস্তাবের মধ্যে তিনি দেখেন জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ এমন এক সাচ্চা দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজকে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং মুজিব বাহিনীর মধ্যে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ । সুতরাং সঙ্গত কারণেই প্রস্তাব বাতিল হবার কথা। একই সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল দাবি তােলে, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে যেসব দল তাদেরকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে । শেখ মুজিব তাদের দাবিও অগ্রাহ্য করলেন এ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যে শেখ মুজিব আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল জুলুম নির্যাতন সয়েছেন, তিনি এই গণতান্ত্রিক দাবি অগ্রাহ্য করলেন কেন? এ কেমন ধারার মানসিকতা? আদতে গণতান্ত্রিক সহনশীলতার কথা তার মুখে উচ্চারিত হলেও এক আশ্চর্য রকমের আধিপত্যকামী মানসিকতা আগাগােড়াই তার ভেতর ক্রিয়াশীল ছিল। এধরনের মানসিকতার অধিকারী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহ্য তাে করতে পারেনই না, অন্যের অবদানের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হন । যেমন, ১৯৬৯ সালে আইউব আহূত লাহাের গােলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে প্যারােলে যেতে রাজি হয়ে যান তখন এক গােয়েন্দা কর্মকর্তা শেখ মুজিবকে অনিবার্য রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দেন। অথচ এর পুরাে কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন নিজ পত্নীকে, সাংবাদিক আবদুল গফফার চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপকালে শেখ মুজিব ওই গােয়েন্দা কর্মকর্তার ভূমিকা সম্পর্কে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে কোন আঁচ না দিলেও স্বীকার করেছেন অন্যখানে—জি ডবলিউ চৌধুরীর কাছে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল মুজাফফরউদ্দীনও জি ডবলিউ চৌধুরীর কাছে ওই গােয়েন্দা কর্মকর্তার ভূমিকার সত্যতা প্রতিপাদন করেন। অবশ্যি জি ডবলিউ চৌধুরী তার বইতে গােয়েন্দা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেননি। গােয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন শেখ মুজিবের সেই ঘনিষ্ঠতম ইনার সার্কেল—এ বি এস সফদার। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সময় রাষ্ট্রপতির পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ টিমের প্রধান হন তিনি। শেখ মুজিব করাচিতে অনুষ্ঠিত আইউব আহূত গােলটেবিল বৈঠকে যেতে রাজি হলেন কেন? কীভাবেই বা এ বি এস সফদার তাকে অনিবার্য রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচালেন? ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিখানায় শেখ মুজিবের সঙ্গে আইউবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এডমিরাল এ আর খানের তিন ঘণ্টাব্যাপী যে গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত। হয়, তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল—পাকিস্তানের পরবর্তী সরকার হবে পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক। শেখ মুজিব হবেন তার প্রধানমন্ত্রী আর আইউব খান হবেন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান। এবং শেখ মুজিবের দেয়া দুটি শর্ততার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিল্পপতি ইউসুফ হারুনাকে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর আর ডক্টর এম এন হুদাকে পুর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করা হবে যা কয়েকদিন পরই কার্যকর হয়ে যায়। এ বিষয়ে একই কথা বলেছেন জি ডবলিউ চৌধুরী তার দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান গ্রন্থে। আর ডক্টর এম এন হুদা আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন “গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করতে গিয়ে শেখ মুজিব উঠেছিলেন ইস্ট পাকিস্তান হাউজে।
 
————————————-
১. জি ডবলিউ চৌধুরী দ্যা লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান, পৃষ্ঠা -৩৭, ৪৫
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা -৩৮।
৩. এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর মােনায়েম খানের আমলে প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সাত্তারের সময় বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি।
আমিও তখন ছিলাম সেখানে। আমার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বললেন, “আপনি এখনও এখানে? আপনি শিগগির ঢাকায় যান। মােনায়েম খানের কাছ থেকে গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে নিন।” শেখ মুজিবের সঙ্গে এ আর খানের বৈঠকের পরই রাষ্ট্র হয়ে যায় যে, “শেখ মুজিব প্যারােলে লাহোর যেতে রাজি হয়েছেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র সারা বাঙলা তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সর্বত্র । এ সময়ই গােয়েন্দা কর্মকর্তা এ বি এস সফদার ছুটে যান বেগম মুজিবের কাছে। তাকে বলেন “আইউবের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র । এই সময় শেখ সাহেব যদি প্যারােলে গােলটেবিল বৈঠকে যান তবে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার চিরকালের জন্য মসীলিপ্ত হয়ে যাবে। একমাত্র আপনিই পারেন তাকে প্যারােলে যাওয়া থেকে নিরস্ত করতে পারেন তাকে বােঝাতে যে চাপাচাপি করলে আইউব খান তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবেন। দাবার ঘুটি এখন আর আইউবের হাতে নেই । তাকে আপনাকে গিয়েই বলতে হবে।” বেগম মুজিব রাজি হতেই তিনি গিয়ে দেখা করেন জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল মুজাফফর উদ্দিনের সঙ্গে। শেখ মুজিব ও বেগম মুজিবের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন  “অকস্মাৎ এক জটিল পারিবারিক সঙ্কট উদ্ভুত হওয়ায় তার সঙ্গে বেগম মুজিবের দেখা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এবং বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি”—এই কারণ দেখিয়ে এ বি এস সফদার জেনারেল মুজাফফরকে সাক্ষাতের অনুমতি দিতে রাজি করান  এবং বেগম মুজিব সকল সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে আচমকা কুর্মিটোলা বন্দি শিবিরে গিয়ে হাজির হন। শেখ মুজিব পত্নীকে দেখে অবাক হয়ে যান।
কেননা, তিনি জানতেন না স্ত্রী আসছেন দেখা করতে তাকে জানতে দেয়া হয়নি। এবার দেখা যাক ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশিবিরে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়া নিয়ে শেখ মুজিব সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে কি বলেছিলেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যাবার পথে বিমানে বসে শেখ মুজিব আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বলেন “হঠাৎ দেখি তােমার ভাবি কুর্মিটোলা বন্দি শিবিরে এসে হাজির। সেদিন তার সাথে আমার ইন্টারভিউ ছিল না। তাই বিস্মিত হলাম মিলিটারি গার্ড কী তবে তাকে ছেড়ে দিল! তিনি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন এসব কি শুনছি? তুমি সহবন্দিদের রেখে নাকি এক প্যারােলে মুক্ত হচ্ছ। তুমি আমার স্বামী। তুমি মুক্ত হলে আমার চাইতে খুশি দুনিয়াতে কেউ হবে না। কিন্তু এভাবে যদি মুক্ত হও, তাহলে আর কিছু না পারি, বাড়ি গিয়ে বটি দিয়ে ছেলেমেয়ে সবগুলােকে কেটে নিজে আত্মহত্যা তাে করতে পারি। সেদিনই সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম প্যারােলে মুক্ত হব না। যদি ছাড়া পাই বিনাশর্তে সকলকে নিয়ে ছাড়া পাব।” এরপর শেখ মুজিব ঘােষণা দেন যে নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া তিনি গােলটেবিল বৈঠকে যাবেন না।
————————–
৪. দৈনিক জনপদ : ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩
তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া তাে হয়ই, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাও হয় প্রত্যাহত । অথচ আশ্চর্যের বিষয়, যে ব্যক্তিটির অনন্য ভূমিকা তাকে অনিবার্য রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচায়, আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে তিনি তার নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না। অন্যের অবদানকে স্বীকার না করার শেখ মুজিবের এই মানসিকতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় ছয় দফার প্রণয়ন নিয়েও। ছয় দফার প্রণেতা সম্পর্কিত প্রশ্নটি শেখ মুজিব ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এড়িয়ে গেছেন। ওই বছরই অর্থাৎ দীর্ঘ সাত বছর পর এ বিষয়ে তিনি সর্বপ্রথম মুখ খােলেন। এর কারণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করা হলে ছয় দফার প্রণেতা রুহুল কুদ্স আমাকে বলেন “অন্যের অবদানকে স্বীকৃতি দেবার উদারতার অভাব ছিল শেখ মুজিবের মানসিকতায়  তার অবর্তমানে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন তাই আমাকে তিনি কখনাে জিজ্ঞেস করেননি কী কষ্ট আমরা করেছি অথবা যন্ত্রণা আমরা সয়েছি কিংবা যুদ্ধ করেছি কীভাবে । সৈয়দ নজরুল ইসলামও আমাকে বলেছেন তাকেও যুদ্ধ সম্পর্কে শেখ মুজিব কোন প্রশ্ন করেননি। অন্যের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারটি শেখ মুজিব সর্বদাই সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। অথচ আশ্চর্য! পাকিস্তান জেল থেকে দেশে ফিরেই সােজা ক্যান্টনমেন্টে চলে যান পাকিস্তানি যুদ্ধ বন্দিদের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে।” অন্যদিকে এই শেখ মুজিবই অতুলনীয় দার্ডের পরিচয় দেন সাত দফা গােপন চুক্তিকে অগ্রাহ্য করায় এবং অবলীলায় নিজেকে প্রতিভাত করান বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠতম পুরুষ হিসেবে পাশাপাশি ওই গােপন চুক্তির প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের ধারাটি কার্যকর করে তার আধিপত্যকামী মানসিকতাকেই স্পষ্ট করে তােলেন। এই ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যেমন অন্যের অবদানের স্বীকৃতি দিতে চান না, তেমনি প্রতিপক্ষকেও জিইয়ে রাখতে নারাজ। প্রতিপক্ষকে নির্মূল করাই তার সকল কর্মের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
শেখ মুজিব গােপন সাত দফা চুক্তির প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের ধারায় প্রতিপক্ষ নির্মূলের সেই সম্ভাবনাকে স্পষ্ট দেখতে পান। ছয় দফাতে প্যারামিলিশিয়া বাহিনী তৈরির কথা ছিল। সেটা পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যেই। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে নতুন কোন প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা আর থাকে না। কেননা, প্যারামিলিশিয়া বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল বিদ্যমান এবং সেটা বাংলাদেশ রাইফেলস। সীমান্ত নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই বাহিনীকে কার্যকরভাবে ব্যবহারের সুযােগ ছিল অবারিত। উপরন্তু ওই বাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। নিজেদেরকে করে পরিশুদ্ধ । এছাড়া নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠনের দ্বার যেখানে উন্মুক্ত। এবং যার প্রতিটি সদস্যের নবজন্ম ঘটে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে, তাদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে শেখ মুজিব তার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়ান। গঠিত হলাে রক্ষী বাহিনী। ১৯৭২ সালে ৭ মার্চে জাতীয় রক্ষী বাহিনী আদেশে করেন স্বাক্ষর । ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ আদেশ কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হলাে। অপরদিকে ‘র’ রক্ষী বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমে পড়ে। সিআইএও তৎপর হয়ে ওঠে।
—————————————————
৫, অস্থায়ী সরকারের প্রেসিডেন্ট, দেশ স্বাধীন হবার পর উপরাষ্ট্রপতি
২৫ মার্চের পর ভারতের মাটিতে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় সিক্ত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধাদের ভেতর সিআইএ যেমন সক্রিয় ছিল, দেশ স্বাধীন হবার পর একইভাবে তৎপর হয়ে ওঠে বাংলাদেশে ‘র’-এর পরিকল্পনা ভণ্ডুল করণে এবং নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। সিআইএ দ্বিমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একটা ব্যর্থ হলে আরেকটার হবে প্রয়ােগ ১৯৬৫ সালে আইউব উৎখাত পরিকল্পনার মতােই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিআইএ একদিকে শেখ মুজিব সরকারের অভ্যন্তরে গা ঢাকা দিয়ে থাকা তার শিখণ্ডীর পরিচর্যায় নামে। ওই শিখণ্ডী খােন্দকার মােশতাক। জোট যাদের সিআইএ তৈরি করে ভারতের মাটিতে, অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ভেতরে। আর রাজনৈতিকভাবে মােকাবিলার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় দীপ্ত অমিততেজা মুক্তিযােদ্ধাদের সততাকে পুঁজি করে মাঠে নামে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ শ্লোগান নিয়ে। এই লক্ষ্যে অর্থাৎ বাংলার বুকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ওয়াশিংটন থেকে উড়ে আসেন সাংবাদিকের ছদ্মবেশে ল্যারি লিপৎসুলজ। তার পথ ধরে পরে আসেন রিলিফ কর্মীর ছন্দবেশে পিটার কাসটারস। সিআইএ মােশতাক জোটকে তৈরির মাধ্যমে এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ‘র’এর পরিকল্পনা নির্মূলের লক্ষ্যই শুধু স্থির করে না—শেখ মুজিবকে উৎখাতের পরিকল্পনাও গ্রহণ করে। এখানে একটি প্রশ্ন অনিবার্য কারণে এসে যায়, যে শেখ মুজিব আগাগােড়াই পশ্চিমা ঘেঁষা, তাকে সিআইএ উৎখাত করতে চাইলােই বা কেন? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এক দ্বৈত মানসিকতাসম্পন্ন চরিত্রের মানুষ ছিলেন শেখ মুজিব। তার এই মানসিকতার প্রতিফলন শুধু তার ব্যক্তি জীবনেই ঘটেনি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ছাপ পড়েছে স্পষ্ট। আর এ কারণেই মার্কিনীদের আস্থা তাকে হারাতে হয়, আস্থা হারান ভারত এবং রাশিয়ারও। তার রাজনৈতিক দ্বৈত মানসিকতার পরিচয় সর্বপ্রথম মেলে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি জেল থেকে মুক্ত হবার পর পরই। 
পাকিস্তানি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হবার পর ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডনগামী বিমানে ওঠার আগে শেখ মুজিবের সঙ্গে পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর দু’দফা বৈঠক হয় । বৈঠকে শেখ মুজিব ভুট্টোকে আশ্বাস দেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের কাঠামােগত সম্পর্ক রাখবেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ববিখ্যাত ইতালীয় ফ্রিল্যান্স মহিলা সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন “লন্ডন হয়ে ঢাকা ফেরার আগে আমি দু’বার তার সঙ্গে দেখা করি। তিনি কুরআন বের করেন, কুরআন স্পর্শ করে শপথ নেন যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন।” লন্ডনে পৌঁছে হােটেলে বসে সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সঙ্গে আলাপকালে শেখ মুজিব যা বলেন, তাতে ভুট্টোকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতিরই সমর্থন মেলে।
—————————————
. ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউর সংবাদদাতা হয়ে ল্যারী লিপৎসুলজ বাংলাদেশে আসেন। পুরাে নাম লরেন্স লিপৎসুলজ. ওরিয়ানা ফালাসি ইন্টারভিউ উইথ হিস্টি পৃষ্ঠা -১৯৭
শেখ মুজিব এ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে বলেন “আপনার জন্য একটা দারুণ খবর আছে। এখানে কেউ জানে না খবরটি। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে কোন না কোনভাবে সম্পর্ক রাখতে যাচ্ছি। যতক্ষণ না আর সবার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলছি, তার আগে এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না। দোহাই আল্লার! আমি বলার আগে কিছু লিখবেন না। এ বিষয়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে দেয়া এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেন “আমি বঙ্গবন্ধুর (শেখ মুজিব) কাছে এ নিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলাম একবার। তিনি অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, ভুট্টোকে তিনি এ ধরনের কোন কথা দেননি। আর ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় আমার সঙ্গে ভুট্টোর দেখা হয় । আমি তখন সউদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ।ভুট্টো ওই সময় সউদি আরব সফরে যান । আমি ওরিয়ানা ফালাসিকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারে তাকে দেয়া শেখ মুজিবের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে বলি যে, শেখ মুজিব আমাকে বলেছেন, তেমন কোন প্রতিশ্রুতি আপনাকে তিনি দেননি। ভুট্টো আমার কথায় বার বার জোর দিয়ে বলেন যে শেখ মুজিব তার কাছে ওয়াদা করেছিলেন। তিনি বলেন যে তিনি মিথ্যা বলছেন না।৮
বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান ত্যাগের আগে শেখ মুজিব-ভুট্টোকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের কাঠামােগত সম্পর্ক রাখবেন এবং লন্ডনের হােটেলে এ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে সে সম্পর্কে আভাসও দেন কিন্তু লন্ডনের ওই হােটেলেই তকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বি কে নেহেরুর সঙ্গে আলাপের পর পরই যান বদলে এবং ঢাকা তেজগা বিমান বন্দরে পৌছে ঘােষণা করেন, পাকিস্ত। েিনর সঙ্গে তিনি কোন সম্পর্কই রাখবেন না। অথচ এই তিনিই দিল্লী থেকে ভারতীয় বিমানে ঢাকায় আসতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। ওই সময় শেখ মুজিবের কাছে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব রাখা হয় যে যেহেতু ব্রিটেন বাংলাদেশকে এখনাে স্বীকৃতি দেয়নি, সে কারণে দিল্লী থেকে ব্রিটিশ বিমানে করে তার ঢাকা যাওয়া সঙ্গত নয়। সে প্রেক্ষাপটে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমান প্রস্তুত রয়েছে তাকে ঢাকা পৌছে দেবার জন্য। শেখ মুজিব এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তার এ আচরণে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ক্ষুব্ধ হন। শেখ মুজিব ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানেই ঢাকা আসেন। শেখ মুজিবের এই দ্বৈত মানসিকতা আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্ষমতায় আরােহণের পর। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকৃত গােপন সাত দফা চুক্তি তিনি অগ্রাহ্য করলেও মাত্র দু’মাসের মধ্যে কার্যকর করেন প্যারামিলিশিয়া বাহিনীর ধারাটি। প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের প্রস্তাবের মধ্যে ‘র’-এর পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি অনবহিত ছিলেন, এ মেনে নেয়া যায় না। আর এই বাহিনীর সংগঠক মেজর জেনারেল এস এস উবান সম্পর্কে সম্যক ধারণা তিনি পেয়েওছিলেন। তার গােয়েন্দা দফতর তাকে সকল তথ্য। সরবরাহ করে। তথাপি ভারতকে খুশি করার জন্য যেমন—তেমনি প্রতিপক্ষকে নির্মূলের লক্ষ্যে রক্ষী বাহিনী গঠনের প্রস্তাব তিনি অনুমােদন করেন।
—————————————————-
 
৮. এন্থনী মাসকারেনহাস : বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড ; পৃষ্ঠা -৫
৯, প্রেসিডেন্ট এরশাদ শাসনামলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আর মুজিব বাহিনীর দুই নেতা সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাককে শেখ মুজিব অস্ত্র জমা দেয়ার ব্যাপারে যা বলেছিলেন, তাতে তার দ্বৈত মানসিকতা কেবল প্রতিভাত হয়ে ওঠে না, তার আধিপত্যকামী মনােভাবও স্পষ্ট ধরা পড়ে। ১৯৭২ সালে একদিকে তিনি সকল মুক্তিযােদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আবদুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করেন। শেখ মুজিবের ওই নিষেধ সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাক বলেন “সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু (শেখ মুজিব) বলেছিলেন সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলাে রাখার দরকার সেগুলাে রেখে দাও। কারণ, সমাজ-বিপ্লব করতে হবে, প্রতিবিপ্লবীদের উৎখাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগােতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।” কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও শেখ মুজিবের দ্বৈত মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা তাকে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কাছে বিরাগভাজন করে তােলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য সহযােগিতার কথা অস্বীকার করার উপায় ছিল না বলেই ১৯৭২ সালে ১৭ মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে শেখ মুজিব যে পঁচিশ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী-সহযােগিতা চুক্তি সাক্ষর করেন, যা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত ভারত-সােভিয়েত চুক্তিরই অনুরূপ, খুশি করে ভারতকে যেমন, রাশিয়াকেও তেমনি।
কিন্তু এই চুক্তি শেখ মুজিবের স্ববিরােধী চরিত্রকে তুলে ধরে পশ্চিমা জগৎ বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসনের কাছে। আবার মার্কিনিদের খুশি করার জন্য এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট (পরে প্রধানমন্ত্রী) জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে লাহােরে অনুষ্ঠিত মুসলিম দেশসমূহের শীর্ষ সম্মেলনে যােগদান করে বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন ভারতের। তার মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তাজউদ্দীন আহমদ শীর্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিবের অংশগ্রহণের ঘাের বিরােধিতা করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেন :“অন্যান্য দিকগুলাে যদি আমরা ছেড়েও দিই, শুধুমাত্র এই কারণে তার লাহোের যাওয়া ঠিক হবে না যে পাকিস্তান এখনাে পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। শেখ মুজিব মার্কিনিদের খুশি করতে আরাে এক পা এগােলেন। তার অবর্তমানে যিনি দীর্ঘ নমাস স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন দক্ষ হাতে, ২৫ মার্চের আগে যিনি ছিলেন তার সর্বক্ষণের অনুচর, সেই তাজউদ্দীন আহমদকে ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত করেন । অপসারণ করা হয় অত্যন্ত অবমাননাকরভাবে। ওইদিন বেলা ১১টায় শেখ মুজিব নিজ হাতে সই করে চিঠি পাঠান তাজউদ্দীন আহমদকে। তাতে তিনি তাকে ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে’ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। চিঠি পাঠানাের পর তাড়াহুড়াে করে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনের বিবরণ আমরা শুনবাে সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের মুখ থেকে। তিনি সেটা এনেছেন তার ‘মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা” পুস্তকে “ওইদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে।
———————————————–
১০. সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত : মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা, পৃষ্ঠা ২১-২২
তাড়াহুড়াে করে নতুন গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। মুজিব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘােষণা দেবেন। পরিবেশ ছিল উত্তেজনাকর । ক্যাবিনেট সেক্রেটারি তওফিক ইমাম এবং কয়েকজন অফিসার ফাইল নিয়ে দৌড়ঝাপের মধ্যে ছিলেন। লিয়াঁজো অফিসার তােয়াব সাংবাদিকদের দেখ ভাল করছিলেন  মুজিব ভেতরে ঢুকলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গােয়েন্দা বিভাগ প্রধান তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। ‘স্যার, তাজউদ্দীন সাহেব। এখনাে তার সমর্থকদের নিয়ে বসে আছেন এবং পদত্যাগ পত্রে সই করার ব্যাপারে সময় নিচ্ছেন,’ তিনি প্রেসিডেন্টকে বললেন। “মুজিব উচ্চকণ্ঠে আমাদের বললেন, ‘ভদ্রমহােদয়গণ আমি তাজউদ্দীনকে পদত্যাগ করতে বলেছি। যদি সে তা না করে তবে আমি তাকে আমার মন্ত্রিসভা থেকে তাড়াতাড়িই সরিয়ে দেব।’ তিনি পাইপ থেকে ধোঁয়া ছাড়লেন এবং দেখলেন ফাইল হাতে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি দরােজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তুমি ওখানে দাড়িয়ে কী করছাে? তােমার হাতে কী ওটা?’ তিনি তার প্রতি হুংকার ছাড়লেন। “স্যার, মৃদুভাষী ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, ‘যে মুহূর্তে আমি তার বাসভবনে গিয়েছি তৎক্ষণাৎ অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ পত্রে সই করেছেন। আমি আপনাকে সেটা দেখানাের জন্য অপেক্ষা করছি।” 
“একটি হতবাক করা নৈঃশব্দ নেমে এলাে। আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম।”১১ তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ পত্রে সই করেন ওইদিন ২৬ অক্টোবর বেলা ১২টা ২২ মিনিটে। শেখ মুজিব যাকে অসম্মানজনকভাবে পদত্যাগে বাধ্য করলেন তার প্রতি সেই তাজউদ্দীন আহমদের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা সম্পর্কে সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলছেন: “আমার মনে পড়ে ১৯৭২ সালের সেই দিনগুলাের কথা। মুজিব সবেমাত্র ফিরেছেন। বঙ্গভবনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান ছিল সেটা। তাজউদ্দীন সেখানে ছিলেন, সঙ্গে তার পরিবারবর্গও। আনন্দ-আভা ছড়িয়ে পড়েছে তার অবয়বে। সবার মধ্যে খুশির আমেজ। অনুষ্ঠান শেষে তিনি উপস্থিত ভারতীয় সাংবাদিকদের বললেন এটা আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নেতার অনুপস্থিতিতে আমি অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনে পরিচালনা করেছি। সরকারের দায়িত্বভার তার হাতে অর্পণ করতে পারায় আমি এটাকে একটা বিরাট সুযােগ হিসেবে দেখছি । ইতিহাসে তা যতই তৎপর্যহীন হােক, আমার অন্তত একটা স্থান থাকবে।”১২
—————————————–
১১. সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত মিড নাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা : পৃষ্ঠা -২১-২২
১২. প্রাগুক্ত : পৃষ্ঠা-২২।
এমন কী তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশে আসেন ২২ ঘণ্টার জন্য। সে সময় তার সম্মানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ভােজের আয়ােজন করে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদকে আমন্ত্রণ জানানাে হয় না। এহেন আচরণ তাকে ভয়ানক পীড়িত করে, ক্ষুদ্ধ করে টাইমস অব ইন্ডিয়ার ঢাকা সংবাদদাতা কিরিট ভৌমিক ও সুখরঞ্জন দাশগুপ্তকে তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন “আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকার মার্কিন দূতাবাস কিসিঞ্জারের সম্মানে আলাদা আলাদাভাবে দুটো পার্টি দেয় । আমাকে বাদে সংসদের আর সব সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। তিনি আমাদের বললেন আবেগে তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, “আমি পরিত্যক্ত হওয়ায় মােটে অখুশী নই; কারণ, আমি ভালভাবে জানি যে, এই সেই কিসিঞ্জার যিনি পাকিস্তানকে সাহায্য ও সমর্থন করেছিলেন যখন কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলাম। যা হােক, একটিবার আমি কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করতে চাই তাকে মাত্র এই বলার জন্যে যে তাদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ মুক্ত। তাজউদ্দীন আহমদকে ওই ভােজসভায় আমন্ত্রণ জানানাে হয় না এই কারণে যে, তার বিরুদ্ধে অভিযোেগ তিনি অতিমাত্রায় ভারত ঘেঁষা। একই অভিযােগের কারণে মার্কিন চাপে মন্ত্রিসভা থেকে হন অপসারিত। তাকে সরিয়ে দেবার কারণ আরাে রয়েছে।
তা এখানে নয়। শেখ মুজিবের এই দ্বৈত মানসিকতা অর্থাৎ সর্ব পক্ষকে খুশি রেখে চলার কৌশল, এতে সােভিয়েত ইউনিয়নও তার প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে সােভিয়েত ইউনিয়ন জানতে চায় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দেয়া শেখ মুজিবের প্রতিশ্রুতি মােতাবেক বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে কোন কাঠামােগত সম্পর্ক রাখা হচ্ছে কীনা। এর জবাব শেখ মুজিব নিজে লিখিতভাবে দেন। তাকে তিনি বলেন যে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন কাঠামােগত সম্পর্ক রাখার কোনই সুযােগ নেই। এর পরই সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ সম্পর্কে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী আমাকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সােভিয়েত ইউনিয়নকে লিখিতভাবে জানান যে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের কোন কাঠামােগত সম্পর্ক রাখার কোন সুযােগই নেই। প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি আমি নিজ হাতে দিল্লীতে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের হাতে দেই।” শেখ মুজিবের এই স্ববিরােধী চরিত্র সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার সম্পর্কে কতটা আস্থাহীন করে তােলে, তা আমরা জানতে পাব ‘র’এর পর্যবেক্ষণ থেকে। ‘র’-এর সে পর্যবেক্ষণ কি ছিল? *শেখ মুজিবুর রহমান দুই পরাশক্তির আস্থা হারিয়েছেন (সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং ভারতেরও তারা তাদের নিজস্ব লােক না পাওয়া পর্যন্ত তাকে ক্ষমতায় রাখছে। তার অস্থির নীতি তাকে বিশেষ কোন শক্তির প্রতি আসঞ্জিত না করায় তাকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে ।” শেখ মুজিব ‘র’-এর এই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।
——————————-
১৩, সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত : মিড নাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা: পৃষ্ঠা -৩৩
তার গােয়েন্দা বিভাগ তাকে জানিয়ে দেয় । তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যখন তাকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানাে হচ্ছে বলে হুঁশিয়ার করে দেন, তা তিনি গায়ে মাখেন না। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে দেয়া তার হুঁশিয়ারি সম্পর্কে মিসেস ইন্দ্রিরা গান্ধী ১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযােগী অধ্যাপিকা মিসেস মেরী সি কাররাসকে সাক্ষাৎকার দানকালে বলেন “আমি শুধু বলতে পারি, অনুগ্রহ করে সতর্ক হন । আমার মনে হচ্ছে মারাত্মক একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তিনি (শেখ মুজিব) বললেন, “না না, তারা আমার সন্তান।” শেখ মুজিব যেহেতু ‘র’-এর পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন, সে কারণে হয়তাে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকেও আস্থায় আনতে পারছিলেন না। তাই ওই রকম একটি গাছাড়া জবাব দেন ।
শেখ মুজিবের এই স্ববিরােধী রাজনৈতিক চরিত্রের কারণেই সিআইএ তার পরিকল্পনা নিয়ে এগােতে আরম্ভ করে । আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মন্ত্রিসভার ভেতর মােশতাক জোটকে সে পরিচর্যা শুরু করে, যাদের সঙ্গে তার সম্পর্কে গড়ে ওঠে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতায় মার্কিন কনসাল অফিসের মাধ্যমে। আর এর পাশাপাশি শেখ মুজিবের সমাজতন্ত্র, যার অপর নাম ‘মুজিববাদ’ জন্ম যার বামপন্থী ও মুজিব বিরােধীদের নির্মূলের লক্ষ্যে, তার জবাবে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নামক এক চটকদারী শ্লোগানকে হাতিয়ার করে মাঠে নামে। প্রক্রিয়াটা শুরু হয় ছাত্রলীগের ভাঙনের মধ্য দিয়ে ।  স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২১, ২২ এবং ২৩ জুলাই । ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, সম্মেলন করে পল্টন ময়দানে। অপরটির সম্মেলন হয় রেসকোর্স ময়দানে। এর নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি । দুই গ্রুপই শেখ মুজিবকে সম্মেলন উদ্বোধনের আমন্ত্রণ জানায় । শেখ মুজিব রেসকোর্সকেই বেছে নেন।  আবদুর রাজ্জাক বরাবরই সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বাভিলাষী দ্বন্দ্বের মাঝে দাঁড়িয়ে মুজিব বাহিনী ও ছাত্রলীগের পরস্পরবিরােধী দুই গ্রুপের ভেতর সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে এসেছেন। এবার কোন দিকে যাবেন তিনি? কঠিন সমস্যা তার জন্যে । কেননা, দু’পক্ষের কাছেই সাদরে গ্রহণীয় রেসকোর্সকে বেছে নিলেন তিনি? আমরা তা আবদুর রাজ্জাকের মুখ থেকেই শুনি এবং তা সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । আবদুর রাজ্জাক বলেন “আমার কাছে খবর এল, কমরুদ্দিন আহমদ বললেন, তিনি (সিরাজুল আলম খান) ট্রটস্কি লাইনের লােক। আর ট্রটস্কি লাইন সম্পর্কে আমার তাে পরিষ্কার ধারণা আছে—এটা সিআইএ’র লাইন, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।” এও সত্য যে, পল্টন ময়দানে সিরাজুল আলম খান গ্রুপের সম্মেলনে মুজিব বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যােগ দেয়। পল্টন সম্মেলনে মুজিব বাহিনীর বেশিরভাগ অংশ কেন গেল?
———————————-
১৪, জ্যোতি সেনগুপ্ত : বাংলাদেশ ইন ব্লডি অ্যান্ড টিয়ার্স, পৃষ্ঠা-৯১
১৫. প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত লেখক এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আকাঙ্ক্ষী গ্রুপের তাত্ত্বিক গুরু।
আবদুর রাজ্জাককেই আবার স্মরণ করতে হয়। “তখন এমন অবস্থা হয়েছে, যুদ্ধ ফেরতা তরুণদের রক্ত টগবগ করছে। আর সেভাবে তাে বিপ্লবী সরকার হয়নি—একটা সাধারণ পার্লামেন্টারি সরকার সেখানেও কিছু গােলমাল শুরু হয়েছে। তখন ওই ছেলেদেরকে বােঝানাে সহজ হয়েছে যে, এদেরকে দিয়ে হবে না। ছেলেরা কিন্তু অত্যন্ত সাচ্চা মনে সমাজতন্ত্র করার জন্য, সমাজবিপ্লব করার জন্য তৈরি হয়েছিল।” পল্টন ময়দানে সিরাজুল আলম খান গ্রুপের সম্মেলন শেষ হলাে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়দীপ্ত শ্লোগানের মধ্য দিয়ে এবং এই সম্মেলন থেকেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হলাে। ওই বছর ৩১ অক্টোবর আহবায়ক কমিটি গঠিত হলাে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তৈরির চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়নের লক্ষ্যে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আত্মপ্রকাশে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন ঝোকের জন্ম হলাে। এর পতাকা তলে এসে জড় হলাে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সৎ এবং দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধারা। যখন কেউ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে টু শব্দটি উচ্চারণে সাহসী হচ্ছিল না, তখন এরাই সর্বপ্রথম তার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হল । স্বাভাবিক কারণেই এরা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে এবং জনগণের কাছাকাছি চলে যায়। দলের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগানে আকৃষ্ট হয় এদেশের হাজার হাজার সৎ দেশপ্রেমিক তরুণ। অন্তরাল থেকে এদের সততা এবং দেশপ্রেমকে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে যায় সিআইএ এবং নিজস্ব লক্ষ্য সিদ্ধির পথে পা বাড়ায়। ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা সৃষ্ট রক্ষী বাহিনী মােকাবিলায় গড়ে তােলে গণবাহিনী। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, এর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগান এবং তার গণবাহিনী সৃষ্টির পেছনের কথকতা নিয়ে অনেক কথা। বলা হয়েছে ওই সময় এবং বলা হয় পরবর্তীকালে এ দল তৈরির পেছনে বিদেশী শক্তির অদৃশ্য হস্ত ছিল সক্রিয় । বলা হয়, সিআইএ ছিল এ দল তৈরির প্রক্রিয়ায় এবং এর কার্যক্রমের সাথে যুক্ত। অথচ তথ্য প্রমাণসহ সিআইএ-র সংযােগের বিষয়টি তুলে ধরতে পারেননি কেউই। ফলে এটা রয়ে যায় বিতর্কিত।
আমরা এ ব্যাপারে পরে আসছি। তার আগে দেখা যাক তােফায়েল আহমদ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সৃষ্টি সম্পর্কে কি বলেন । আমাকে দেয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন “তারা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করে। সেই পিটার কাসটার্সের কথা কে না জানে? পিটার কাসটার্স নিজে বলেছে আমি জাসদকে (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) সাহায্য করেছি। হল্যান্ডের লােক এই পিটার কাসটার্সকে তিনি? এগুলাে আপনারা জানেন। জানেন কার সাথে কোন সাম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল। আর এ সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্য আমরাতাে আগেই দেখেছি। তােফায়েল আহমদের বক্তব্য অনুসরণ করে আমরা পিটার কাসটার্স-এর কথকতায় আসতে পারি। সে কথকতাই স্পষ্টভাবে বলে দেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সৃষ্টি এবং এর নেতা সিরাজুল আলম খান ও কর্নেল তাহেরের নভেম্বর বিপ্লবের অন্তরালের কাহিনী, যার পুরােটা রহস্যঘন উপন্যাসকেও হার মানায়। সে পুরাে কাহিনীতে আমরা যাব না। অংশ বিশেষ দেখবাে। ১৯৭৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সকালে সারা বাংলাদেশের মানুষ সকল দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবরে চমকে ওঠে। খবরটি দুর্দান্ত রকমে নাড়িয়ে দেয় ইউরােপীয় দেশ হল্যান্ডকে । উদ্বেগের মধ্যে ফেলে মার্কিন প্রশাসন এবং তার গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে। খবরটিতে বলা হয়, সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্র মামলায় একজন বিদেশীসহ সাতজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্ব এবং উত্তরকালে এদেশে সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত কোন বিদেশীর সম্ভবত এই প্রথম কারাদণ্ড প্রদান ।
অতএব, বাংলাদেশের মানুষের চমকাবারই কথা। ওই বিদেশী, নাম পিটার কাসটার্স, পুরাে নাম পিটার জোসেফ জোয়ান মারিয়া কাসটার্স, হল্যান্ডের অধিবাসী বটে, কিন্তু ঢাকায় উড়ে আসেন সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে, বাংলাদেশের বুকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে । বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা ভাবনার উদয় তার মস্তিষ্কে ঘটে ১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে  টেলিভিশনের পর্দায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার ছবি দেখে তার কোমল হৃদয় কেদে ওঠে এবং এদেশের হতভাগা আদম সন্তানদের দুঃখ-কষ্ট নিরসনের প্রশ্নে রীতিমত উদভ্রান্ত হয়ে পড়েন। দুঃখ-দুর্দশা নিরসনের উপায়ও আবিষ্কার করে ফেলতে তার দেরি হয় না। তার সে আবিষ্কার “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”। অবশ্যি তার আগে আরেকজন বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মন প্রাণ ঢেলে কাজ করছিলেন। তিনি ল্যারি লিপসুলজ— ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’র তৎকালীন ঢাকা প্রতিনিধি।  ল্যারি লিপৎসুলজকে ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে অবাঞ্ছিত বিদেশী ঘােষণা করে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওই মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় জেল অভ্যন্তরে রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্রের অভিযােগে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরের বিচার কাজ চলছিল। সে সময় ল্যারি লিপসুলজকে সাংবাদিকের দায়িত্ব বহির্ভূত কার্যকলাপে লিপ্ত হতে দেখা যায় । জেলখানার সম্মুখে গিয়ে তিনি জেলখানার বহিরঙ্গ ও জেলখানার ভেতরে প্রবেশকারি প্রতিটি ব্যক্তির ছবি তুলতে থাকেন। ইতােমধ্যে পিটার কাসটার্সের সঙ্গে তার যােগাযােগের বিষয়টিও বাংলাদেশ সরকার জেনে যায়। সুতরাং তার বহিষ্কার অনিবার্য হয়ে পড়ে।  বাংলাদেশ থেকে ল্যারি লিপৎসুলজের বহিষ্কার ও অবাঞ্ছিত ঘােষণার ঘটনাটি দারুণ চমকপ্রদ।
ওই সময় জাতীয় নিরাপত্তা গােয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) মহাপরিচালক ছিলেন এবিএস সফদার। জেলখানার সমানে দাঁড়িয়ে লিপৎসুলজের ছবি তােলার ব্যাপারটি তাকে উত্তষ্ঠিত করে তােলে। এ ঘটনা যদি কোন বাংলাদেশী ঘটাতাে তবে তাকে আটক করা হতাে। লিপৎসুলজ যেহেতু বিদেশী এবং একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকার সাংবাদিক সেহেতু তাকে আটক করায় কিংবা ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদে বিদেশী প্রচার মাধ্যমে হইচই পড়ে যাবে। বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হবে সরকারের জন্য। কিন্তু তাই বলে একজন বিদেশীকে সাংবাদিকতার নামে এই ধরনের আইন বিরুদ্ধ কাজ করতে দেয়া যায় না। বিষয়টি দেখার এবং সামাল দেয়ার জন্য তিনি তার সংস্থার অন্যতম পরিচালক এ এফ জহিরুন্নবীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ। করেন। বলেন, নিজের পরিচয় দিয়ে তাকে কোন এক হােটেলে ডিনারের আমন্ত্রণ। জানাতে হবে। বলতে হবে, তিনি যা করছেন তা আইন বিরুদ্ধ । তিনি এ ধরনের কাজ করা থেকে বিরত না হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেই মতাে এ এফ জহিরুন্নবী তাকে হােটেল পূর্বাণীতে ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। ইতােমধ্যে এনএসআই কর্তৃপক্ষ লিপৎসুলজের কার্যকলাপ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জ্ঞাত করে এবং তার ওপর কড়া নজর রাখতে বলা হয় ।
এনএসআই’র হুশিয়ারী পাবার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের তৎপরতা দেখে হতবাক হয়ে যান এ বি এস সফদার এবং এ এফ জহিরুন্নবী । আমন্ত্রণ রক্ষার্থে ল্যারি লিপৎসুলজের স্কুটার সন্ধ্যায় হােটেল পূর্বাণীর প্রবেশদ্বারে যেই মাত্র ঢুকতে যাচ্ছে সেই মুহূর্তে একটি জীপ এগিয়ে এসে সেটার পথরােধ করে দাড়িয়ে পড়ে । এবং দুদ্দাড় নেমে পড়ে কয়েকজন সাদা পােশাকধারী এবং চোখের পলকে তাকে পাজা কোলা করে জীপে তুলে হাওয়া হয়ে যায় । এ এফ জহিরুন্নবী প্রবেশদ্বারের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি বােবা বনে যান। আসলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সতর্ক ছিল লিপসুলজ সম্পর্কে। গােয়েন্দা বিভাগের কড়া নজর ছিল তার ওপর। এনএসআই’র হুশিয়ারী পাওয়ায় তারা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তাকে বহিষ্কারের কারণ এমনিতেই তখন কর্নেল তাহেরের বিচার কার্য তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল । দেশে এ ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া হয় এনিয়ে তারা ছিল উৎকণ্ঠার মধ্যে। এর সাথে লিপৎসুলজের কার্যকলাপ আরেক সমস্যার জন্ম দেবে না, তাই-ই বা কে বলতে পারে। এই উটকো ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি বিদায় করা যায় ততই মঙ্গল। সুতরাং এনএসআই-এর অজান্তে তারা লিপসুলজকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সাদা পােশাকধারী পুলিশ পাঠিয়ে জিপে করে তুলে আনে। পরদিনই তাকে ব্যাংককগামী বিমানে চড়িয়ে দেয়া হয়। ল্যারি লিপসুল শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের ওপর সিআইএ-র অদৃশ্য হস্তের ভূমিকা নিয়ে লেখেন ‘দ্যা আনফিনিশড রেভুলিউশন’ নামে একটি বই। বইটি এদেশে দারুণ সাড়া জাগায়। তাতে তিনি নিজেকে সিআইএ বিরােধী হিসাবে প্রতিপন্ন করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছেন ।  পিটার কাসটার্সের সঙ্গে ল্যারি লিপৎসুলজ, সিরাজুল আলম খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের তাত্ত্বিক গুরু ডক্টর আখলাকুর রহমানের যােগাযােগের বিষয়টি আমরা কাসটার্সের মুখ থেকেই শুনবাে ধরা পড়ার পর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেয়া তার জবানবন্দি থেকে। তার আগে ১৯৭৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের দৈনিক খবরের কাগজগুলােয় প্রকাশিত তার বিরুদ্ধে আনীত মামলা ও রায়ের বিবরণ তুলে ধরা হচ্ছে দুই নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত হল্যান্ডের নাগরিক পিটার কাসটার্সসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘােষণা করেছেন। “পিটার কাসটার্সসহ সাতজনকে ১৪ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আদালত অন্য সাতজনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। অভিযুক্তরা হলেন পিটার কাসটার্স ওরফে পি জে জে এম কাসটার্স ওরফে রেভােকন্টি ওরফে আমিনুল ইসলাম ওরফে আনােয়ার সিদ্দিকী ওরফে রফিকুল ইসলাম; জামাল উদ্দীন ওরফে হামিদ ওরফে নজরুল ইসলাম ওরফে খসরু ওরফে আবদুল হামিদ, তাহমিনা বেগম ওরফে সুফিয়া খাতুন, আবদুল জলিল হাওলাদার ওরফে মাসুদ কবির, মােহাম্মদ হানিফ ওরফে সামাদ, খােরশেদ আহমদ ওরফে সাজু মিয়া এবং আবদুল গােফরান ওরফে রাজু আহমদ। “আদালত বাংলাদেশ ব্যবহারিক শিক্ষার নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ১,৯৬,৬৫৬.৪৮ পয়সা বাজেয়াপ্তেরও আদেশ দিয়েছেন। “৮-১২-৭৫ তারিখে পিটার কাসটার্সকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেয়া এক স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি বাংলাদেশে আসেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলাদেশ বিপিসি’র ১২১ এ ধারার অধীনে তার এবং সহঅভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট মামলা দায়ের করা হয় । “পিটার কাসটার্স বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৩ সালে। তিনি নিজেকে একজন ফ্রিল্যান্স রিলিফ কর্মী পরিচয় দেন বাংলাদেশে অবস্থানকালে। তিনি অধুনালুপ্ত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও তথাকথিত গণবাহিনীর নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তার ভাষায় ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে কর্মী জোগাড়ের জন্য তিনি অধুনালুপ্ত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা প্রয়াত লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু তাহের এবং তার কিছু সহযােগী ও অন্যদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন। “তিনি ‘সর্বহারা ঐক্য আন্দোলন নামে গােপন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তার সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় পরিষদের নাম দেয়া হয় “কেন্দ্রীয় বিকাশ গ্রুপ” । তার পরিকল্পিত বিপ্লবের সাফল্যের জন্য তিনি প্রয়াত সিরাজ শিকদারের ‘সর্বহারা পাটি’র সঙ্গে জাসদের (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) গণবাহিনীর ঐক্য সাধনের প্রচেষ্টা নেন। কাসটার্স ও তার সহযােগীরা তাদের লক্ষ্য সাধনে রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকর লিফলেট ও বুকলেট ছাপান এবং বিলি করেন। সংগঠনের অফিস ও সদস্যদের থাকার জন্য তিনি। শহরে তিনটি বাড়ি ভাড়া করেন এবং বিভিন্ন তারিখে সদস্যদের সঙ্গে তিনি সেখানে গােপন বৈঠক করেন। বিভিন্ন সর্বহারা গ্রুপকে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদেরকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কৌশল ও ধ্যান ধারণায় উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
——————————-
১৬. ওই সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়।
তিনি রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা সফর করেন এবং বাংলাদেশ ব্যবহারিক শিক্ষা সংস্থা’ নামের সমাজ সেবামূলক সংগঠনের আড়ালে কর্মী সংগ্রহ ও তাদেরকে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তােলার চেষ্টা করেন । বিপ্লবী গ্রুপের সদস্যরা (কেন্দ্রীয় বিকাশ গ্রুপ) সকলেই ছদ্মনাম গ্রহণ করে এবং গােপন কার্যকলাপ চালাবার সুবিধার্থে ভাড়াকৃত বাড়িগুলিরও ছদ্মনাম দেয়া হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সবুজদের বাড়ি শাপলা’ এবং ‘পেয়ারাবাগ’, এই ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়। কাসটার্স নিজেই আমিনুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলাম ছদ্মনাম ব্যবহার করেন । “কাসটার্স বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন বিদেশী স্বেচ্ছাসেবকমূলক সংগঠন থেকে কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের নাম করে অর্থ সংগ্রহ করতেন এবং ওই অর্থ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কিছু নেতাকে প্রদান করেন এবং নিজের সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যবহার করেন। তিনি তার দলের লােকদের দেশের অভ্যন্তর থেকে। অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহের পরামর্শ দেন এবং নিজের বৈদেশিক সূত্র থেকে অস্ত্র সংগ্রহের আশ্বাস দেন।
“তদন্তকালে প্রতিভাত হয় যে নিজের গােপন সংগঠনের কাজের জন্য ১৯৭৩ সালের বিভিন্ন সময়ে পিটার কাসটার্স অন্য অভিযুক্তদের সংগ্রহ করেন।” পিটার কাসটার্সের ওপর এই একটিমাত্র সংবাদই বের হয় বাংলাদেশের সংবাদপত্রে । মামলার রায় বের হবার পরের দিনই তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার এবং তাকে তার স্বদেশ হল্যান্ডে পাঠিয়ে দিতে হয় । অথচ তৎকালীন সরকার এ খবরটি চেপে যায়। অন্যদিকে পিটার কাসটার্সের গ্রেফতার ও তার বিচার শুরু হবার প্রথম খবরটিও জানতে পায় না বাংলাদেশের মানুষ। পিটার কাসটার্সের গ্রেফতার ও বিচার সংক্রান্ত প্রথম খবরটি ছাপা হয় বিদেশী পত্রিকায়-মার্কিন দৈনিক ‘নিউইয়র্ক টাইমসে’, ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট। খবরে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযােগে হল্যান্ডের সাংবাদিক পিটার কাসটার্সকে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।” খবরে পিটার কাসটার্সের সঙ্গে আর কতজন অভিযুক্ত হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয় না। তাছাড়া খবরে তাকে সাংবাদিক হিসাবে উল্লেখ করা হয়। অথচ বাংলাদেশে তিনি ফ্রিল্যান্স রিলিফ কর্মী’র পরিচয় দেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করার দাবি রাখে। নিউইয়র্ক টাইমস’-এ অভিযুক্তদের সংখ্যা উল্লেখ করে খবর করা হয় তিনদিন পর, ২৭ আগস্ট, ১৯৭৬-এ। খবরে পিটার কাসটার্সের সঙ্গে আরাে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের সংখ্যা ষােল বলা হয়। সামরিক আইনে পিটার কাসটার্সের বিচারের সংবাদে অস্বস্তিতে পড়ে তকালীন মার্কিন প্রশাসন। সিআইএ পড়ে বিপাকে। বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে হল্যান্ড সরকার ।
—————————–
১৭. দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬
৬ দিন পর মার্কিন প্রশাসন ও হল্যান্ড সরকারের উদ্বেগ নিরসনে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস বলে “পিটার কাসটার্স’ যুক্তিসঙ্গত ও পক্ষপাতহীন বিচার পাবেন । বাংলাদেশ দূতাবাসের এই বক্তব্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় ২৯ আগস্ট, ১৯৭৬-এ। পিটার কাসটার্সের দণ্ডাদেশের খবর বের হয় ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬-এ। আর আমাদের এখানকার পত্রিকায় ছাপা হয় একদিন আগে অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর । নিউইয়র্ক টাইমস-এর ওই খবরে বলা হয়, গােপন সামরিক আদালত পিটার কাসটার্সকে উৎখাত ষড়যন্ত্রের অভিযােগে বাংলাদেশে চৌদ্দ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে ৬ জন বাংলাদেশী প্রত্যেককে চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং সাতজন অভিযুক্তকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। খবরে আরাে বলা হয়, হল্যান্ড সরকার পিটার কাসটার্সকে হল্যান্ডে ফেরত পাঠানাের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সম্মত করানাের চেষ্টা চালাচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এ পিটার কাসটার্স সংক্রান্ত সর্বশেষ খবরটি ছাপা হয় ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬-এ। খবরে বলা হয় পিটার কাসটার্সকে হল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে । এ খবরটি বাংলাদেশের পত্রিকায় আসে না । জানানাে হয় না কাগজকে  বিচারের রায় ঘােষণার পরদিনই যাকে স্বদেশ হল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ সরকার, সেই পিটার কাসটার্স বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের কথা এবার আমরা তার নিজের মুখ থেকেই শুনব।  আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পিটার কাসটার্স গ্রেফতার হন ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭৫ সালে । গ্রেফতারের পর জবানবন্দি দেবার আগে তাকে রাখা হয় ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি দোতলা বাড়ির ছাদের ওপর একটি কক্ষে। একটি মাত্র কক্ষই ছিল ছাদের ওপর বন্দিদশা থেকে পলায়নের চেষ্টায় তিনি দোতলা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। হিসেবে ভুল হওয়ায় সীমানা প্রাচীরের বাইরে না পড়ে ভেতরে পড়েন। সতর্ক প্রহরী তাকে সঙ্গে সঙ্গে জাপটে ধরে। এবং প্রহরী তৎক্ষণাৎ খবর পাঠায় তার উধর্বতন কর্মকর্তাকে। কর্মকর্তা, জাতীয় নিরাপত্তা গােয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন প্রধান এ বি এস সফদার এবং তার সহকর্মী এ এফ জহিরুন্নবী ছুটে আসেন সেই বাড়িতে। অপার বিস্ময়ে তারা দেখতে থাকেন কাসটার্সকে। কারণ, অত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ায় তার হাত-পা ভেঙ্গে যাবার কথা। কিন্তু একটু-আধটু ছড়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি তার। তাদের বিস্ময় অপনােদনের জন্য পিটার কাসটার্স যা বলেন এতে এ বি এস সফদার ও এ এফ জহিরুন্নবী একেবারে থ বনে যান । কাসটার্স বলেন “আমি তাে পিটি করতাম।” অর্থাৎ কমান্ডাে ট্রেনিং ছিল তার। এ এফ জাহিরুন্নবী ছিলেন পিটার কাসটার্স রহস্য উদঘাটনে মূল নায়ক। তিনিই তাকে পাকড়াও করেন । এ ঘটনার প্রায় তিনমাস পর জবানবন্দি দেন পিটার কাসটার্স। জবানবন্দি গ্রহণ করেন ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট এ আর মজুমদার; ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসের ৯ তারিখে।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া পিটার কাসটার্সের জবানবন্দি “আমার নাম পিটার জোসেফ জোয়ান মারিয়া ওরফে পিটার কাসটার্স । আমার বয়স অনুমান ২৭ বৎসর। আমি লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ১৯৭০ সনে আন্তর্জাতিক আইনে এম এ পাশ করি এবং ঐ বৎসর ওয়াশিংটন জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট নেওয়ার জন্য ভর্তি হই (আন্তর্জাতিক রিলেশনে)। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি চাইনিজ, রাশিয়ান এবং ইউরােপীয় ভাষা শিক্ষা করি। এছাড়াও আমি নিজে হিন্দি এবং বাংলায় লেখাপড়া এবং বলা শিক্ষা করি । আরবি এবং উর্দু ভাষাও কিছু কিছু শিক্ষা করি । দেশে থাকাকালীন আমি ডাচ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ল্যাটিন, গ্রিক ও স্পানিশ ভাষাও শিখিয়াছি । ১৯৭০ সনে ওয়াশিংটনে যাওয়ার পূর্বে আমি বেলজিয়াম, রাশিয়া, পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স। প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করিয়াছি। ওয়াশিংটনে থাকাকালীন এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং সামাজিক ইতিহাস ও ভাবধারা সম্পর্কে পড়াশুনা করি। তখন আমার মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাওবাদের উপর বিশ্বাস জন্মে এবং আমি সেই লাইনে কাজ করার মনস্থ করি। ১৯৭১ সনে ওয়াশিংটনে থাকার সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করিয়া এবং টেলিভিশনে জেনােসাইডের প্রমাণ্য ছবি দেখিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করিতে থাকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা পৌছি।” জবানবন্দি অনুযায়ী পিটার কাসটার্স ওইবার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা মেজর জলিল ও আ স ম আবদুর রবের সঙ্গে দেখা করেন।
ওই বছর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ফিরে যান ওয়াশিংটনে পিএইচডি’র থিসিস জমা দিতে এবং ডক্টরেট লাভ করেন। এরপর ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফিরে আসেন ঢাকায় “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বাংলাদেশে আসেন তিনি স্বেচ্ছাসেবী রিলিফ কর্মী পরিচয়ে। আসার কিছুদিন পর শুরু করেন ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিকতা। ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য হলিডেতে ‘আনােয়ার সিদ্দিকী” নাম নিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ওপর লেখা শুরু করেন। এই ছদ্ম পরিচয়ের আড়ালে তিনি ‘র’-সৃষ্ট রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার প্রস্তুতিতে নামেন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দরের নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের, সিরাজুল আলম খান ও দলের তাত্ত্বিক গুরু ডক্টর আখলাকুর রহমানকে তার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ মতবাদের অনুসারী দেখতে পান এবং রক্ষী বাহিনীর মােকবিলায় “গণবাহিনী” তৈরির পরিকল্পনা নেন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, সর্বহারা পার্টি ও অন্যান্য দলের সঙ্গে তার যােগসাজশের বিবরণ ম্যাজিস্ট্রেট এ আর মজুমদারের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন ১৯৭৩ সনের ২৫শে জানুয়ারি তারিখে আমি পুনরায় ঢাকায় আসি।
বামপন্থী জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) মস্কোপন্থী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আমার বিশেষভাবে আলাপ-আলােচনা হয়। তাহারা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যকলাপের নিন্দা করে। ঢাকায় থাকাকালীন জাসদ নেতা মেজর জলির, আ স ম আবদুর রব, মমতাজ বেগম প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সহিত রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনা হয়। ইহা ছাড়া মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে দেশের সম্পদ জাতীয়করণ সম্পর্ক আলাপ-আলােচনা করি । “ইহার পর এপ্রিল মাসের ৭ কি ৮ তারিখে আমি কলকাতা-দিল্লী হইয়া ওয়াশিংটনে যাই ।… ওয়াশিংটনে যাইয়া আমি বাংলাদেশের অবস্থা সম্বন্ধে আমার মতাদর্শে বিশ্বাসী বন্ধু ও কমরেডদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করি। তাহারা মন্তব্য করেন যে এখন বাংলাদেশে মার্কস বা লেনিনবাদ প্রয়ােগর ক্ষেত্র প্রস্তুত এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সহজতর হইবে ।  “১৯৭৩ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আমি পুনরায় ঢাকায় আসি । ইহার পূর্বে হল্যান্ডে থাকাকালীন আমার রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজন। আমাকে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠনের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুতের উদ্দেশ্যে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
* আমেরিকার সাংবাদিক ল্যারি লিপসুলজের সঙ্গে আমার ঢাকায় পরিচয় হয়। তাহাকে আমার চিন্তাধারায় সমগােত্রীয় হিসেবে চিনিতে পারিয়া তাহার নিকট আমার প্ল্যান-প্রােগ্রাম সম্পর্কে বলি। তাহার নিকট হইতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহের সাহেবের চিন্তাধারা সম্পর্কে অবগত হইয়া তাহার নির্দেশমত ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে তাহের সাহেবের নারায়ণগঞ্জের বাসায় যাইয়া তাহাকে না পাইয়া ক্যান্টনমেন্ট সিএমএইচ-এ অসুস্থ অবস্থায় তাহার সহিত দেখা করি । তাহাকে আমি আমেরিকান সাংবাদিক ল্যারির কথা বলি।”  “১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি মমতাজউদ্দীন খান ঢাকা আসিলে তাহাকে সঙ্গে নিয়া ড. আখলাকুর রহমান সাহেবের বাসায় যাই । ইহার ২/৩ দিন পর মমতাজউদ্দীন আমাকে নিয়া সিরাজুল আলম খানের বাসায় যান। সিরাজুল আলম খান মত প্রকাশ করেন যে, কৃষকদের মনে ঘৃণার সৃষ্টি করিতে হইবে এবং এই লাইনে কাজ করিলে তাহার দল জাসদ পাটি সহযােগিতা করিতে প্রস্তুত আছে।” “১৯৭৪ সালের সম্ভবত ২৮ নভেম্বর তারিখে অনুমান বেলা ১টার সময় আমি সিরাজুল আলম খানের বাসায় পুনরায় যাই। সেখানে তাহার সঙ্গে জাসদ দলের খসড়া থিসিস এবং সিরাজ শিকদার সম্বন্ধে আলাপ-আলােচনা হয়।” “ইহার পর কয়েকবার কর্নেল তাহেরের সঙ্গে আমার দেখা এবং আলাপ হয় । তিনি আর্ম ক্যাডার সৃষ্টির জন্য ক্যাডারদের সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করিবেন এবং সেজন্য তাহাকে ৫০,০০০ ডলার দিতে হইবে বলিয়া দাবি করেন। পরবর্তী পর্যায়ে আমি কর্নেল তাহেরকে আমার মিশনে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বাহার এবং আনােয়ারের মাধ্যমে তাহাকে মােট ৬০,০০০/- টাকা দেই ।
কর্নেল তাহের সর্বহারা পার্টির লােকদের সঙ্গে দেখা করিতে চাহিলে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন এক রবিবারে জলিলকে সঙ্গে লইয়া তাহের সাহেবের বাসায় যাই। তাহের সাহেব জলিলের নিকট হইতে ক্যাপটেন আলতাবের বিষয় জানিতে চাহিলে জলিল তাহাকে বলে যে, আলতাব সাহেব সুন্দরবন এলাকায় আছেন। এবং তাহার সঙ্গে যােগাযােগ করা সম্ভব নহে। কর্নেল তাহের রাজনৈতিক আলাপআলােচনা করেন। পরে আমরা চলিয়া আসি ।…
“কর্নেল তাহের সাহেবকে আমি পূর্বে যে ৬০,০০০/- টাকা প্রদান করি তাহা রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণের জন্য এবং রাজনৈতিক প্রচারণার জন্য ব্যবহৃত হইবে বলিয়া প্রফেসর আনােয়ার আমাকে জানান। “১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি আমি ড. আখলাকুর রহমান সাহেবের সঙ্গে তাহার মােহাম্মদপুরের বাসায় দেখা করি। আমাকে জানান যে কর্নেল তাহেরকে আমি যে টাকা দিয়াছি তাহা তিনি শুনিয়াছেন । তিনি আমাকে বিদেশ হইতে অস্ত্র আনার ব্যবস্থা করিতে বলেন যাহাতে ১০ বৎসরের মধ্যে বিপ্লব সংগঠন করা যায় । “ড, আখলাকুর রহমানের গুলশানের বাড়ি দেখিয়া আমার ধারণা জন্মে তাহাদের গণঅভ্যুত্থান ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতা লাভের জন্য, জনগণের স্বার্থে নহে । “১৯৭৫ সালের ১৬ই আগস্ট সন্ধ্যার সময় এলিফ্যান্ট রােডে কর্নেল তাহেরের ভাই আবু ইউসুফের বাসায় কর্নেল তাহেরের সঙ্গে দেখা করি। তিনি প্রকাশ করেন যে, শীঘ্রই তাহার পক্ষে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হইবে ।  “১৫ নভেম্বর তারিখ রাত ৮টার সময় বেলাল আর বাহার আমার ৫৩ নং এলিফ্যান্ট রােডের বাড়িতে আসে। তাহারা আমাকে রংপুর ক্যান্টের এবং কুমিল্লায় সৈনিক বিদ্রোহের সংবাদ দিয়া আমার মতামত জানিতে চায়। আমি সম্পূর্ণ সংবাদ না পাইয়া কোন মতামত ব্যক্ত করা সম্ভব নয় বলিয়া জানাই। তবে আমি ইহাও বলিয়াছিলাম যে, ভারত ইহার সুযােগ লইতে পারে। এই কথা শুনিয়া তাহারা আমাকে সিআইএর দালাল বলিয়া অভিহিত করে। আমি তখন তাহাদিগকে বাসা ছাড়িয়া যাওয়ার কথা বলিলে তাহারা উভয়ে পকেট হইতে রিভলবার বাহির করিয়া আমাকে। গুলি করিতে উদ্যত হয়।
এই সময় টিএন্ডটির সৈয়দ আনােয়ার পাশের ঘর হইতে আসিয়া মাঝখানে দাঁড়ায় এবং গােলমাল মিটমাট করিয়া দেয়। অতঃপর বেলাল ও বাহার চলিয়া যায়।”  সিআইএ সৃষ্ট গণবাহিনীর ভেতর র’ এরও যে অনুপ্রবেশ ঘটে তার ইঙ্গিত মেলে কর্নেল তাহেরের মামলার রায় ঘােষণার পর পরই ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনের ডিফেন্স অ্যাটাশের বহিষ্কারের মধ্যে। ওই সময় ডিফেন্স অ্যাটাশে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ভােরা। তাকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ঘােষণা করে সরকার বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করে । এরও আগের এক ঘটনায় ‘র’-এর অনুপ্রবেশ আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে। ‘র’-এর ডিরেক্টর আর এন কাও আসেন ঢাকায়। তিনি ওঠেন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সাত তলার একটি স্যুইটে । শেখ মুজিবর রহমান তখন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশ গােয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন প্রধান প্রয়াত আহমদ ইব্রাহিমকে কাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আহমদ ইব্রাহিম কাওয়ের স্যুইটে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রহস্যময় পুরুষ বলে কথিত এক ব্যক্তিকে দেখে অবাক হয়ে যান।
———————
১৮. পরবর্তীতে হােটেল শেরাটন।
কাও তখন বলেন He is our man, Try to help him. (তিনি আমাদের লােক। তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবেন)।” ম্যাজিস্ট্রেট এ আর মজুমদারের কাছে দেওয়া পিটার কাসটার্সের জবানবন্দির প্রেক্ষাপটে আর ব্যাখ্যার প্রয়ােজন পড়ে না জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং তার সশস্ত্র ক্যাডার ‘গণবাহিনী” তত্ত্ব কোথা থেকে আসে, কি-ই বা তার লক্ষ্য । পিটার কাসটার্স ‘গণবাহিনী” তৈরির পরিকল্পনা নেন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে ‘র’ কে মােকাবিলা এবং শেখ মুজিবকে উৎখাতে। এই পিটার কাসটার্স পরবর্তীতে সমবায় আন্দোলনের ছদ্মাবরণে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রচেষ্টায় আত্মনিয়ােগ করেন, যােগাযােগের সূত্র তৈরি করেন বামপন্থী বলে কথিত কোন কোন দলের সঙ্গে। ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে বামপন্থী বলে কথিত একটি দলের এক নেতা এবং একটি কৃষক সংগঠনের এক নেতা তার আমন্ত্রণে যান হল্যান্ডে সমবায় আন্দোলন-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের সবক নিতে। অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পাশাপাশি সিআইএ মােশতাক জোটকে পরিচর্যা করতে থাকে তাৎক্ষণিক আঘাত হানার জন্য। শেখ মুজিব উৎখাতে এই জোটের ষড়যন্ত্রের ওপর লেখালেখি হয়েছে অনেক। পুস্তকাকারেও এসেছে। অতএব, সে বিষয়ে আমরা যাব না। আমরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রক্ষী বাহিনীর ব্যবহারে ‘র’ এবং একাধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিনাশে রক্ষী বাহিনীর ব্যবহারে শেখ মুজিবের ভূমিকা এবং অপরদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শ্লোগানের মধ্য দিয়ে গণবাহিনী সৃষ্টি করে র’ কে প্রতিহত করতে এবং শেখ মুজিব উৎখাতে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সিআইএ যে যুদ্ধে নামে, তার মাঝেই আমাদের আলােচনা সীমিত থাকবে ।

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক, pp 111-133

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!