You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ
মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের অন্যতম আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্য অনুযায়ী মুজিব বাহিনী তখনাে যুদ্ধ শুরুই করেনি। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একেবারে সামনাসামনি না পড়ে গেলে তারা যুদ্ধ করে না। এও সঠিক সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং হাসানুল হক ইনুরা তখনাে যুদ্ধে নামেননি কিন্তু ‘র’ যুদ্ধে নেমে পড়ে শেখ ফজলুল হক মনি গ্রপের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত বামপন্থীদের বিরুদ্ধে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনী সদস্যরা ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। কিন্তু তাদের দু’মাস আগেই মুক্তিবাহিনী সদস্যরা এসে যায় বাংলাদেশে এবং অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত বামপন্থীদের সঙ্গে মিলে যুদ্ধে নেমে পড়ে।
বৃহত্তর বরিশাল জেলায় পেয়ারা বাগানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয় মুক্তিবাহিনী সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পাটির সঙ্গে মিলে। এই যুদ্ধ সম্পর্কে ১৯৭১ সালের ৭জুন পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির এক প্রচারপত্রে বলা হয় “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন (সর্বহারা পার্টির অঙ্গ শ্রমিক সংগঠন) প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সকল দেশপ্রেমিক পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঠিক পথে সংগ্রাম পরিচালনা করতে আহবান জানায়। বরিশাল জেলার ঝালকাঠির মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিকরা এ আহবানে সাড়া দেয়। তাদের অংশগ্রহণসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের নিয়ে স্থানীয় ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা হয়।১  ঐক্যবদ্ধ মুক্তিবাহিনী তফশিলী হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত পূর্ববাংলার বৃহত্তম পেয়ারা বাগান কুরিয়ানা, ডুমুরিয়া, ভীমরুলী এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির যােদ্ধারাই শুধু নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। লড়াইরত সকল বামপন্থী সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনুদের কাছে সহযােদ্ধা গণ্য হলেও শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের কাছে তা ছিল না। এদের কাছে তারা ছিল কেবলমাত্র বামপন্থী এবং শত্রু চর। অতএব, শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুখ্য লড়াই হয়ে দাড়ায় বামপন্থী নির্মূল করা, পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয় এবং
——————-
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫২০-২২
আগস্ট মাসে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপ বাংলাদেশে প্রবেশ করেই শুরু করে দেয় বামপন্থী নির্মূল অভিযান। সম্মুখ যুদ্ধে না নেমে তারা বেছে নেয় গুপ্তহত্যা প্রক্রিয়া। কোথাও কোথাও নেমে পড়ে সরাসরি লড়াইয়ে। শুধু বামপন্থী নিমূলই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত মুক্তি বাহিনীর বিরুদ্ধেও অস্ত্র তুলে ধরে তারা। এমন কী মুজিব বাহিনীর সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনু গ্রুপের বামপন্থী চিন্তাচেতনার অনুবর্তী সহযােদ্ধাদেরও হত্যা করে নির্দ্বিধায়। মুজিব বাহিনীর শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্ত তুলে ধরার শুরুতে আসতে হয় প্রকাশিত একটি গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে। বইটি ইন্দিরা গান্ধীর বিচার চাই লেখক অধ্যাপক আহসাব উদ্দীন আহমদ। লেখক তার গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ষােলজন নিহতের নামে, যাদের চৌদ্দজনই মারা গেছেন মুজিব বাহিনীর হাতে, যারা ছিলেন বামপন্থী চেতনায় সিক্ত। চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার নাপােড়া পাহাড়ে রাতের আঁধারে ঘুমন্ত অবস্থায় স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এই মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা করে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুজিব বাহিনীর সদস্যরা। একইভাবে গুপ্ত হত্যার শিকার হন আজকের সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার সৈয়দ কামেল বখত নেহাৎ ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান তার জ্যেষ্ঠ সৈয়দ দীদার বখত। সৈয়দ কামেল ছিলেন কাজী জাফর-মেননের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলার সমন্বয় কমিটির সাতক্ষীরা এলাকার নেতা জ্যেষ্ঠ সৈয়দ দীদার ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত একজন মুক্তিযােদ্ধা।
সৈয়দ কামেল ১৯৭১ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে একক প্রচেষ্ঠায় নিজ এলাকায় গড়ে তােলেন গণমুক্তিবাহিনী। জুন মাসের মাঝামাঝিতে নিজ বাহিনী নিয়ে দখল করেন তালা থানা এবং থানা ভবনে সর্বপ্রথম তােলেন বাংলাদেশের পতাকা। পরবর্তীকালে মুক্তিবাহিনীর সহযােগিতায় আক্রমণ হানেন কপিলমুণি থানায়। সালতা নদী, পাটকেল ঘাটা ও সাগরদাড়িতে প্রচণ্ড সম্মুখ সমরে তিনি অবর্তীর্ণ হন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। আগস্ট মাসে সীমান্ত পেরিয়ে ওই এলাকায় আসে মুজিব বাহিনীর এক গ্রুপ কমান্ডার। সৈয়দ কামেল ও সৈয়দ দীদারের আশ্রয়েই দিন কতক অবস্থানের পর সে ফিরে যায় ভারতে। এরপর আবার সে ফিরে আসে মুজিব বাহিনীর জনাকয়েক সদস্যের একটি দল নিয়ে ওঠে সৈয়দ কামেল ও সৈয়দ দীদারেরই আস্তানায়। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়, যখন মুক্তিবাহিনী অবিরাম আঘাত হেনে চলেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর, সেই সময় রাতের অন্ধকারে স্টেনগানের ব্রাস ফায়ারে তারা হত্যা করে সৈয়দ কামেল বখতকে। তার সঙ্গে ছিলেন আরেক মুক্তিযােদ্ধা নাম। শংকর, তাকেও তারা শেষ করে। সৈয়দ দীদার ওই রাতে কনিষ্ঠের সঙ্গে ছিলেন না। তিনি বেঁচে গেলেন বটে; কিন্তু তাকে তাড়িয়ে ফিরতে থাকে মুজিব বাহিনী সদস্যরা এবং স্বাধীনতার পরও তাড়িয়ে ফেরে।
—————————————-
২. পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রী
তালা এলাকায় যে পদ্ধতিতে প্রবেশ করে মুজিব বাহিনী সদস্যরা, একই পদ্ধতি অনুসরণ করে সেপ্টেম্বর মাসে মুজিব বাহিনীর তিনজনের একটি দল প্রবেশ করে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানায়। আশ্রয় লাভ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বামপন্থীদের আস্তানায়। কয়েকদিন পর হাতিয়ারসহ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে তারা  বাধা দিলে হত্যা করে এডভােকেট আবদুর রউফকে। আবদুর রউফ ছিলেন ওই এলাকায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুক্তিযােদ্ধা। খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার দু’জন বামপন্থী মুক্তিযােদ্ধাকে তারা হত্যা করে রাজাকারদের সহায়তায়। যেখানে গুপ্তহত্যার সুযােগ ছিল না, সেখানে মুজিব বাহিনীর শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপ নেমে যায় সরাসরি যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আলাউদ্দিন-মতিনের পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের বিরুদ্ধে পাবনার শাহপুরে তারা নেমে পড়ে সংঘর্ষে । এই যুদ্ধে আলাউদ্দিন-মতিনের কমিউনিস্ট পার্টির এমন কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা প্রাণ হারান যারা এপ্রিলের শুরু থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়ে আসছিলেন। মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করতেও দ্বিধান্বিত হয় না মুজিব বাহিনী। বিভিন্ন । জায়গায় দুপক্ষের মধ্যে গােলাগুলি বিনিময় হয়। নরসিংদীতে প্রচণ্ড রকমের যুদ্ধ শুরু। হয়ে যেত যদি না সেখানকার মুজিব বাহিনীর ভেতরকার সিরাজুল আলম খান-আবদুর। রাজ্জাক-হাসানুল হক ইনুর সমর্থকরা বাধা দিত। নরসিংদীতে মুজিব বাহিনীর শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের সদস্যরা দাবি করে মুক্তি বাহিনীকে তাদের অধিনায়কত্বে আসতে হবে।
মুক্তি বাহিনী কমান্ড ওই দাবি প্রত্যাখান করলে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের সদস্যরা তাদেরকে বশে আনতে অস্ত্র তুলে নেয় হাতে। কিন্তু সমাজতন্ত্রকামী মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রবল বাধার মুখে তাদেরকে নিরস্ত হতে হয়। কেবল বামপন্থী মুক্তিযােদ্ধা এবং কখনাে কখনাে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরাই শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল না, নিজেদের বাহিনী তথা মুজিব বাহিনীর তথা মুজিব বাহিনীর ভেতরকার সমাজতন্ত্রকামীরাও তাদের আক্রমণের তালিকায় এসে যায়। যুদ্ধ চলাকালীন দেশের বিভিন্ন এলাকায় দু’গ্রুপের মধ্যে গােলাগুলি বিনিময় হয়। হত্যাকাণ্ড ঘটাতেও পেছপা হয় না শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপ। এই গ্রুপের লােকজন হত্যা করে চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা ১৯৭০ সালে ১২ আগস্টে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাবের উত্থাপক স্বপন চৌধুরীকে। তিনি ছিলেন সিরাজুল আলম খানআবদুর রাজ্জাক-হাসানুল হক ইনুদের চট্টগ্রাম এলাকার মুজিব বাহিনীর নেতা। যুদ্ধের শেষভাগে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার আগে তিনি প্রতিরােধ করেন এবং আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার পরিচয় পেয়ে সতর্ক হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর সংগ্রহের আশায় তাকে সুস্থ করে তােলার জন্য রাঙ্গামাটি হাসপাতালে নিয়ে রাখে। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই রাঙ্গামাটি মুক্ত হয়ে যায় ।
স্বপন চৌধুরী ওই তারিখে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর হাসপাতালে ছিলেন। কিন্তু পরদিন তার আর খোঁজ পাওয়া যায় না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে স্বপন চৌধুরীর ধরা পড়া। এবং নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সম্পর্কে আমাকে দেয়া এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে হাসানুল হক ইনু বলেন, “আমাদের বিশ্বাস শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের লােকজন তাকে পাক বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। তাকে গােপনে সরিয়ে ফেলা হয়। তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। যে নার্স তার চিকিৎসায় ছিলেন তিনিও ১৯৭২ সালেই গায়েব হয়ে যান। কেননা, স্বপন চৌধুরীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সাক্ষী ছিলেন ওই নার্স।” আর এ বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন “আমি শুনেছি, আমার কাছে এ রকম একটি খবর আছে যে তাকে ধরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পাল্টাও শােনা যায় যে, রাজাকাররা ধরিয়ে দেয় । ওই ছেলেটি একটি ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল। আমার হাতেরই রিক্রুট ছিল। খুবই ভাল ছেলে ছিল।” শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুজিব বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের নানা বিবরণ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বই-পুস্তকে এসেছে। অধিক দৃষ্টান্তের বিবরণে এর কলেবরই বাড়বে মাত্র।  ‘র’-এর হয়ে যুদ্ধ চলাকালীন শেখ ফজলুল হক মণি এবং তার গ্রুপ বামপন্থী ও মুজিব বাহিনীর সমাজতন্ত্রকামীদের নির্মূলে যে অভিযানে নামে, স্বাধীনতার পর তা সম্প্রসারিত হয় তার ব্যক্তি উচ্চাভিলাষ চরিতার্থে নেমে পড়েন অভিযানে বেসরকারি সশস্ত্র বাহিনী আওয়ামী যুবলীগ তৈরি করে ‘র’ সৃষ্ট ‘মুজিববাদ’ নামক অদ্ভুত বাদ” প্রতিষ্ঠার শ্লোগানকে করা হয় হাতিয়ার। এখানে অনিবার্য কারণে এসে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একটি বামপন্থী দল সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বিষয়ক ঘটনাবলি। এ ঘটনার উল্লেখ এই কারণে আসে যে, তা না আনলে ওই দলটি তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের কাছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে ভুল ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবে। ইতােমধ্যে এ দলটি কোন কোন পত্রিকায় শ্রেণী।
শত্রু খতমের’ নামে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ডকে বিপ্লবী যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। তাই মুজিব বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি অনিবার্য কারণে এসে পড়ে আবদুল হক-মােহাম্মদ তােয়াহার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি। (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) সংঘটিত পেড়ােলী হত্যাকাণ্ড।  পেড়ােলী আজকের নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার একটি গ্রাম। স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন এ গ্রামে শ্রেণী শত্রু খতমের নামে কয়েকশ’ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। আবদুল হকের কমিউনিস্ট পার্টি। এ তথ্য আমাকে দিয়েছেন শাহ মােহাম্মদ নাজমুল আলম। তখন তিনি খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি সর্বপ্রথম খুলনা কালেক্টরেট ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ কারণে তাকে তৎকালীন উপআঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের সহকারী মেজর হিশাম উদ্দীনের মুখােমুখি হতে হয় জবাবদিহি করার জন্য। আবদুল হকের কর্মীরা ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তাদের হাতে তার তুলে দেয়া অস্ত্র দিয়ে । ১৯৭১ সালের। এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে খুলনার পতন ঘটলে শাহ মােহাম্মদ নাজমুল
—————————
৩. পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব
৪. পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের সচিব।
আলম শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। পরে ভারত গমনের উদ্দেশ্যে সিরাজুল আলম খান ও কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে মিলে মেহেরপুরে এসে হাজির হন। মেহেরপুরের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের মেজর ওসমান তার বাহিনীর অস্ত্রাগার থেকে এক ট্রাক ভর্তি ৩০৩ রাইফেলস, স্টেনগান, রকেট লাঞ্চার, গ্রেনেড, হালকা মেশিনগান তুলে দেন। তাদের হাতে। পৌছাতে হবে পিরােজপুরে মেজর জলিলের কাছে দায়িত্ব পড়লাে শাহ মােহাম্মদ নাজমুল আলমের ওপর। পথে দেরি হওয়াতে পূর্ব নির্ধারিত টেকেরহাট থেকে পিরােজপুরগামী লঞ্চ না পাওয়াতে গােপালগঞ্জগামী একটি লঞ্চে উঠে পড়েন। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এবং সেখানে পৌছে অস্ত্র তুলে দেন প্রাদেশিক পরিষদের এক সদস্যের হাতে। কিছু অস্ত্র আটটি স্টেনগান, চার বাক্স গ্রেনেড ও একটি রকেট লঞ্চার রেখে দেন নিজ এলাকা পেড়ােলীতে প্রতিরােধ ঘাটি গড়ে তােলার লক্ষ্যে। পেড়ােলী পৌছে সেখানকার পীরের ছেলে নিয়াজ আহমদ নিয়াজী ওরফে মধুর হাতে তুলে দেন সে। সব। মধুর সঙ্গে শাহ মােহাম্মদ নাজমুল আলমের জানাশােনা ছিল আগে থেকেই তাকে তিনি প্রগতিশীল বলে জানতেন। জানতেন না সে আবদুল হকের শ্রেণীশত্রু  খতম লাইনের লােক। জানলে তার হাতে অস্ত্র তুলে দিতেন না। নিয়াজ আহমদ নিয়াজী ওরফে মঞ্জুর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে শাহ মােহাম্মদ নাজমুল আলম চলে যান অন্য এলাকায়। এর আগেই এই এলাকায় ডাক্তার সাইফ-উদ-দাহারের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যৌথ প্রতিরােধ কমিটি করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে। নিয়াজ আহমদ নিয়াজী ওরফে মঞ্জু এবং তার নেতা কায়সার শিকদারও নিজেদের কর্মীবাহীনী সঙ্গে নিয়ে এসে যােগ দেয় যৌথ প্রতিরােধ কমিটিতে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে ওই গ্রামে আসেন আবদুল হক এবং কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করেন। এলাকা থেকে তার চলে। যাওয়ার পর পরই মস্তু এবং কায়সার শিকদার তাদের কর্মীদের নিয়ে প্রতিরােধ কমিটি ছেড়ে চলে যায় এবং শুরু করে দেয় শ্রেণীশত্রু খতমের নামে সাধারণ মানুষ হত্যা। ঠিক এই সময় ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর একটি দল কমিউনিস্ট কর্মী। সংঘ ও আওয়ামী লীগ যৌথ বাহিনীতে এসে যােগ দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে।
পেড়ােলী ইউনিয়নে আবদুল হকের বাহিনী, যা পরিচালিত হচ্ছিল মঞ্জু এবং কায়সার শিকদারের নেতৃত্বে, তাদের নির্বিচার হত্যালীলায় ভীত-সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ যৌথ বাহিনীর কাছে ছুটে আসে প্রাণ বাঁচানাের আবেদন নিয়ে। যৌথ প্রতিরােধ বাহিনী আবদুল হকের বাহিনীর ওপর প্রথম আঘাত হানে আগস্ট মাসে। কিন্তু সে আক্রমণ ব্যর্থ হয়। সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তি বাহিনীর নতুন আরেকটি দল এসে যােগ দেয় যৌথ প্রতিরােধ বাহিনীতে এবং এর শক্তি আরাে বৃদ্ধি পায়। এই যৌথ বাহিনী অক্টোবর মাসে চূড়ান্ত আঘাত হানে আবদুল হকের বাহিনীর ওপর এবং তাদেরকে আত্মসমর্পণ ও এলাকা
——————————————————–
৫. ওই সময় নড়াইলের এসডিও পরে বাংলাদেশ সরকারের যুগ্মসচিব
৬. পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাইফেলস
ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। এ সম্পর্কে আমাকে দেয়া এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে কমিউনিস্ট কর্মী সংঘের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কমরেড ডাক্তার সাইফ-উদদাহার বলেন “আমারই প্রস্তাব মতে পেড়ােলীর পাশের গ্রাম খড়লিয়ায় গঠিত হয় যৌথ প্রতিরােধ কমিটি । আমরা জুলাই মাস পর্যন্ত একসঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়েছি। জুলাই মাসে পেড়ােলী গ্রামে আবদুল হকের সফরের পর পরই মধু-কায়সার শিকদাররা যৌথ প্রতিরােধ কমিটি পরিত্যাগ করে চলে যায়, নেমে পড়ে শ্রেণীশত্রু খতমের নামে সাধারণ মানুষ হত্যায়। তাদের হত্যাকাণ্ড রােধের আবেদন নিয়ে আমাদের কাছে ছুটে আসে স্থানীয় অধিবাসীরা। তাই যৌথ প্রতিরােধ বাহিনীকে নামতে হয় শ্রেণীশত্রু খতমকারীদের বিরুদ্ধে। অক্টোবর মাসে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষায় তাদের উৎখাতে সফল অভিযান চালাই আমরা। তারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদেরকে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করি।” এ ঘটনা উল্লিখিত হচ্ছে এই কারণে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন চলছিল, সে সময় মুজিব বাহিনী যে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে, তার সঙ্গে আবদুল হকের ‘বিপ্লবী বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের মূলগত কোন পার্থক্য নেই। তবে এরা হত্যা করেছে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে আর শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মুজিব বাহিনী হত্যা করেছে ‘র’এর প্ররােচনায় তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বাধীনতা যােদ্ধাদের । কিন্তু তাদের মাধ্যমে ‘র’-এর পক্ষে পুরাে পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হয়ে ওঠে না মুজিব বাহিনীর বেশিরভাগ অংশের সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক চেতনার অনুবর্তী হয়ে পড়ার কারণে যাদের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান-আবদুর রাজ্জাক এবং হাসানুল হক ইনুরা ।
 

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!