You dont have javascript enabled! Please enable it!
২৫ মার্চ হামলার পর র’ এবং সিআইএ আটঘাট বেঁধে ‘র’ তৈরি হয়েই ছিল
২৫ মার্চ রাতের হামলার পর দলে দলে হিন্দু-মুসলমান নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধযুবা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। আর ৩০ মার্চ ‘র’-এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র- ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স এ্যান্ড অ্যানাল্যাসিসের ডাইরেক্টর কে। সুব্রামানিয়াম ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স আয়ােজিত এক সিম্পােজিয়ামে বলেন “যে বিষয়টি ভারতের উপলদ্ধিতে আনতে হবে, সেটা হলাে পাকিস্তানের ভাঙন আমাদের স্বার্থেই আসবে। এ জাতীয় সুযােগ কখনাে আসবে না।(১) কে সুব্রামানিয়াম যৌথভাবে মােহাম্মদ আইউব এবং তার লেখা দ্যা লিবারেশন ওয়ার গ্রন্থের ভূমিকায়। লেখেন “ভারতের জন্য এটা এমন একটি ঘটনা, যা শতাব্দীতে আর ঘটেনি।” ‘র’এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডাইরেক্টর যখন ২৫ মার্চ হামলাকে অখণ্ড পাকিস্তানকে খণ্ডিত। করার জন্য ‘শতাব্দীর বিরল ঘটনা হিসেবে দেখতে পান, সেক্ষেত্রে ‘র’ তার প্রস্তুতি যে। কতটা সম্পন্ন করে ফেলে, তা সহজেই অনুমেয়।
পূর্বশর্ত অধ্যায়ে আমরা দেখেছি ভারতের ছয় ডিভিশনের এক বিশাল বাহিনী। আগে থেকেই ঘিরে রেখেছিল পূর্ব পাকিস্তানের চারদিক । উপরন্তু, ৯ মার্চে অনুষ্ঠেয় ভারতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের অজুহাতে কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চল থেকে পশ্চিম বাংলায় সরিয়ে আনা হয় চতুর্থ মাউনটেন ডিভিশন। এই প্রস্তুতিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মুক্ত করার লক্ষ্যে কে সুব্রামানিয়াম একাই কেবল পূর্ব বাংলায় সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ। করার কথা বললেন না, তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিজের দল কংগ্রেস ও বিরােধীদলের কিছু সদস্য। কণ্ঠ মেলান অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন জেনারেলও  তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অবিলম্বে পূর্ব বাংলায় সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের আহবান জানালেন। ভারতীয় সেনা সদর দফতরের মিলিটারি অপারেটর্সের ডেপুটি ডাইরেক্টর। মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং এ সম্পর্কে আমাদের জানাচ্ছেন “কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল অবিলম্বে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের পক্ষে প্রকাশ্যে এই যুক্তি উত্থাপন করে বলেন, সমুদ্র পথে ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র আনিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেকে শক্তিশালী করার আগেই পূর্বাঞ্চলকে মুক্ত করতে হবে। তারা
————————————
১. লেখক অনুদিত সিদ্দিক সালিকের ‘নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-১০০
যুক্তি দেখালেন, ভারত পাকিস্তানকে যতবেশি সময় দেবে, সামরিক দিক দিয়ে কার্যক্রম তত বেশি ব্যয়বহুল হবে । কার্যক্রম গ্রহণের সময় এখনই তারা সমস্বরে বললেন। তাদের কেউ কেউ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশকে এই বলে অভিযুক্ত করেন যে, তিনি শীতল মনােভাব দেখাচ্ছেন  এই রকম গুজব রটে যে,  অর্থমন্ত্রী ওয়াই ভি চ্যানের সমর্থন নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে অবিলম্বে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের কথা বলেন এবং এ ব্যাপারে জেনারেল শ্যাম মানেকশর যদি কোন বিভ্রান্তি থেকে থাকে সেক্ষেত্রে তাকে সরিয়ে দেবার পরামর্শও তারা দেন। বলা হয়, এই যুক্তি উত্থাপন করেন যে ঈশ্বর প্রদত্ত এই সুযােগকে কোন অবস্থাতেই হাতছাড়া করা উচিত হবে না।২ অবিলম্বে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের অর্থ বর্ষা মৌসুমের আগেই যুদ্ধ শুরু করা এবং তার সমাপ্তি ঘটানাে । ওয়াই ভি চ্যাবন, জগজীবন রাম, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা এবং কে সুব্রামানিয়ামের। সমর্থকরা সেটাই চাইছিলেন কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী দূরদর্শী রাজনীতিক তিনি জানতেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল বলে গণ্য হবে। এতে যে ঝুঁকি বিদ্যমান, তা ভারত নিতে পারে না । ঝুঁকিটা হলাে- ইচ্ছে করলেই কোন আঞ্চলিক শক্তি ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশীর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে না, যতক্ষণ না সে কোন না কোন পরাশক্তির সমর্থন পুষ্ট হচ্ছে।
পরাশক্তির সমর্থন বা অসমর্থন হলাে আজকের বিশ্বের সকল ক্ষুদ্র অথবা আয়তনে বৃহৎ দেশের শক্তিমত্তার পরিচায়ক। তাই পূর্ব বাংলায় সামরিক কার্যক্রম গ্রহণের আগে যে কোন পরাশক্তির সমর্থন ভারতের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এবং প্রয়ােজন পড়ে ভারতের জন্য বিশ্ব জনমতেরও। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এ কারণেই অবিলম্বে-সামরিক কার্যক্রমের প্রস্তাব বাতিল করে দেন । ১৯৭১ সালে উপমহাদেশের ক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলাের ভূমিকা কি ছিল? ভারতের জানা ছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দৃঢ় সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাকিস্তানের পেছনে। ২৫ মার্চের বর্বরােচিত হামলার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ যখন প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়ে ওঠে, তখন মার্কিন প্রশাসন শুধুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশের মধ্য  দিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বলেন “আমরা উদ্বেগের সঙ্গে ঘটনা প্রবাহের প্রতি নজর রাখছি।” ২ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক বিবৃতিতে “পাকিস্তানি জনগণের জীবনহানি ও দুঃখ-কষ্ট ভােগে” উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় মাত্র। আর চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ১৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় বলেন “এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যাপক জনগণ থেকে গুটিকয়েক ব্যক্তিকে আলাদা করা যারা
 
————————–
২, মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং : দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮
৩, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ত্রয়ােদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং সিআইএ ৭৭ পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনাশ করতে চায়।৪ এই বার্তায় ভারতীয় আগ্রাসনের মুখে পাকিস্তানকে দৃঢ় সমর্থনের কথা ঘােষণা করেন তিনি। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, যে ভয়ঙ্কর নরহত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী, সে বিষয়ে একটি বাক্যও চৌ এন লাই তার বার্তায় উল্লেখ করেন না। একমাত্র সােভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক বল প্রয়ােগ, প্রাণহানি ও নিপীড়নে উদ্বেগ প্রকাশই করেন না কেবল, প্রতিবাদও জানায়। সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পােদগর্নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে বলেন: “শেখ মুজিবর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বন্দি করায় এবং নির্যাতন করায় সােভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ বােধ করছে। এই সব নেতারা হালের সাধারণ নির্বাচনে। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সন্দেহাতীত সমর্থন লাভ করেছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি, যে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, বল প্রয়ােগ না করে রাজনৈতিকভাবে তার সমাধান করা যায় এবং করতে হবে।৫
সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সংঘটিত নরমেধ যজ্ঞের প্রতিবাদ করলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অথবা পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সর্বাত্মক সামরিক কার্যক্রমে সক্রিয় সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসবে, এ আস্থা কখনােই সােভিয়েতের ওপর আনতে পারেননি মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। কেননা, শুরু থেকেই সােভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব বাংলার ব্যাপারে একটি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলতে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা নয়। কারণ, সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন মনে করেনি। তাই ১৯৭১ সালের মে মাসের কোন এক সময় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ইলা মিত্র এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংকে যেতে হয়েছিল মস্কোতে  যেতে হয়েছিল সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিকে বােঝানাের জন্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের উপাদান রয়েছে। ইলা মিত্র এবং মণি সিংয়ের মস্কো থেকে ঘুরে আসার পরই সােভিয়েত কিছুটা নমনীয় হয়। তথাপি ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বরের আগ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে প্রকাশ্য স্বীকৃতি লাভ করে না।
নভেম্বরে একটি সােভিয়েত সংসদীয় প্রতিনিধিদল আসে ভারত সফরে  সংসদীয় দলের নেতা ভি কুরিয়াভেংসেভ ৯ তারিখে দিল্লীতে বলেন, “বাংলাদেশে যে সংগ্রাম চলছে তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং তার মধ্যে গৃহযুদ্ধের উপাদান রয়েছে।” অবশ্যি বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেন না এবং এই সমস্যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোন সশস্ত্র সংঘর্ষও ডেকে আনবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এখানে তৎকালীন সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পােদগনির উক্তি স্মর্তব্য।
———————————-
৪, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ত্রয়ােদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৯৩
৫. প্রাগুক্ত : ত্রয়ােদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৬১, ৫৬২
৬. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৭৭, ৫৭৮
১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর উত্তর ভিয়েৎনাম যাবার পথে প্রেসিডেন্ট পােদগর্নি। দিল্লীতে যাত্রা বিরতি করেন। তার সম্মানে দেয়া এক ভােজসভায় তিনি বলেন। “আমরা মনে করি সামরিক সংঘাতের দিকে আরাে ঝুঁকে পড়াকে রােধ করতে হবে।৭  মস্কোর ধারণা সম্ভবত এই রকম ছিল যে, রাজনৈতিক সমাধানের পথ তখনাে রুদ্ধ হয়ে যায়নি এবং সেটাই ছিল তার কাম্য। কেননা, উপমহাদেশের দুই দেশ ভারত এবং পাকিস্তান আবার আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হােক, সােভিয়েত ইউনিয়ন তা চায়নি এ কারণে যে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদনে যে ভূমিকা সে পালন করে এবং এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তার মাধ্যমে সে পাকিস্তানকে মার্কিন প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টায় ছিল। আরেকটি ভারতপাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে তার সেই সম্পর্ক বিনষ্ট হবার সম্ভাবনাই শুধু প্রত্যক্ষ করে না সােভিয়েত রাশিয়া; উপরন্তু পাকিস্তানের অধিক মাত্রায় মার্কিনি প্রভাবাধীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও তার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এক কোটি শরণার্থীর চাপ মুক্ত হতে গেলে ভারতের পক্ষে সর্বাত্মক যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। এক্ষেত্রে বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসনের বক্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযােগ্য: “কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বস্তুত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকেই, যখন ইয়াহিয়া তার সামরিক বাহিনীকে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের আদেশ দেন। যখন সীমান্তের অপর পারে গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, তখন কোন জাতিই উদাসীন থাকতে পারে না। উপরন্তু, এ নির্যাতন বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে ভারতে ঠেলে দেয়। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে এক কোটি পূর্ব পাকিস্তানি ক্ষুধার্ত এবং মানবেতর অবস্থার ভেতর দিয়ে এসে জড় হয় হাজার হাজার শরণার্থী ক্যাম্পে। এক অর্থে ভারতের বিরুদ্ধে এটি একটি আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ ।
কেননা, এমনিতেই ভারত তার কোটি কোটি ক্ষুধার্ত জনগণের খাদ্য সংস্থানে ছিল কঠিন চাপের মধ্যে । তার ওপর একজন অবিমৃষ্যকারীর স্বেচ্ছাচারের দরুণ সৃষ্টি হয় দলে দলে গৃহহীন মানুষের অতিরিক্ত চাপ।”৭ ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে ভুল হিসেব কষে, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৭১ সালে হিন্দু বিতাড়নের মধ্যে। সামরিক জান্তার হিসেব ছিল। এই—পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দিলে ভারত যে অর্থনৈতিক সংকটের আর্বতে নিপতিত হবে, তাতে সে পাকিস্তানের দেয়া শর্তে রাজনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নেবে। কিন্তু সামরিক জান্তার কল্পনাতেও আসেনি যে হিন্দুদের সাথে লাখ লাখ মুসলমানও সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় প্রার্থী হবে ভারতে। ফলে পুরাে ঘটনাই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে এবং মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এই শরণার্থী সমস্যাকেই করেন তার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনের অন্যতম হাতিয়ার। বেরিয়ে পড়েন। ইউরােপের বিভিন্ন দেশ সফরে। বক্তব্য রাখেন ২৭ মার্চ ভারতীয় পালামেন্টে দেয়া তার
———————————–
৭, লেখক অনূদিত মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিংয়ের স্বাধীন বাংলাদেশের অভূদয়, পৃষ্ঠা -৮৭
৮, জ্যাক এন্ডারসন দ্য এন্ডারসন পেপারস, পৃষ্ঠা-২৬১
নিজের ভাষণের আলােকে অবিলম্বে যুদ্ধের পক্ষে যারা, তাদের প্রশ্নের জবাবে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তিনি পার্লামেন্টে বলেন “আমি সেই সব সদস্যদের আশ্বস্ত করতে চাই, যারা জিজ্ঞেস করেছেন সময় মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কী না, অবশ্যিই সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় । সময় উতরে যাবার পর সিদ্ধান্ত নেবার কোন যৌক্তিকতা নেই । … একই সময়ে আমাদেরকে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও অনুসরণ করে চলতে ইউরােপ সফরে বিশ্ব জনমত ভারতের অনুকূলে মােটামুটি এলেও মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে যুদ্ধে নামা সম্ভব হয়ে ওঠে না সােভিয়েতের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া। কারণ, তিনি জানতেন যুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের পাশে তাে দাঁড়াবেই এবং চীন তার এলাকা থেকে আঘাত হানতে পারে। চীন যে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নেয়, নভেম্বরের শেষ দিকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চীনা-যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর সময় মতাে সিআইএ জানিয়ে দেয় পেন্টাগনকে । সিআইএ তার রিপাের্টে বলে: “কয়েক মাস যাবৎ তিব্বত এলাকায় যুদ্ধ প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিব্বতের ইয়াং তুং এলাকার ৫৩ তম চীনা স্বতন্ত্র পদাতিক ডিভিশনের ১৫৭তম পদাতিক রেজিমেন্টের সৈন্যদের জরুরি উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠানাে হয়েছে।৯
ইয়াং তুং হয়ে চীনারা সিকিম ও ভুটানের মধ্য দিয়ে ভারত ভূমিতে পা রাখতে পারে । অবশ্যি ভারতের ওপর চৈনিক হামলায় সােভিয়েত ইউনিয়ন নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতাে না। দিল্লীতে রুশ রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগােভ ভারতীয় কর্মকর্তাদের চীনা হামলার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হবার জন্যে বলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে চীনারা যদি আঘাত হানে সেক্ষেত্রে রুশরা “ভিন্নমুখী আক্রমণ পরিচালনা করবে।” ক্রেমলিনের কট্টরপন্থীরা চীনের লন নর হ্রদ এলাকায় আঘাত হানার পরিকল্পনা নেয় । এই এলাকাতেই চীনের পারমাণবিক বােমা তৈরির প্রকল্প। ক্রেমলিনের কট্টরপন্থীদের এই মনােভাবের কথা জানতে পেয়েই চৈনিক নেতারা নিজেদের সংযত করেন। সিআইএ’র রিপাের্ট এবং ভারতীয় কর্মকর্তাদেরকে দেয়া সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের প্রতিশ্রুতিই বলে দেয় যে, সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে চৈনিক আক্রমণের বিষয়টি মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আগে থেকেই হিসেবে আনেন । তাই সােভিয়েতের সাহায্য তার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে এবং তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে সােভিয়েতকে জড়িত করতে। জড়িত করেন ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে সম্পাদিত ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে । চুক্তি সম্পাদনের পর পরই আরেকটি করণীয় সম্পন্ন করে ফেলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অক্টোবর মাসে এক চুক্তির মাধ্যমে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললেন অস্থায়ী বাংলাদেশ
——————————————————-
৯, বাংলাদেশ ডকুমেন্ট, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৬৯
১০. জ্যাক এন্ডারসন দ্য এন্ডারসন পেপারস, পৃষ্ঠা-৩১৯ ১১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩১৯।
সরকারকে। এ চুক্তি সম্পাদনের পর থেকেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অপারেশন সুসংগঠিত করতে বিশেষ মনােযােগী হয়ে ওঠে ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ। এ চুক্তি গােপন সাত দফা চুক্তি নামে খ্যাত, যা আজ পর্যন্ত দু’দেশের সরকার বাংলাদেশ এবং ভারত; প্রকাশ করেনি। চুক্তির শর্তগুলাে হচ্ছে (১) যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়ােজিত থাকতে পারবে । বাকীদের চাকুরিচ্যুত করা হবে এবং সেই শূন্যপদ। পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা (2) বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়ােজনীয়। সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে (কতদিন অবস্থান করবে, তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় না)। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতি বছর এ সম্পর্কে পুনীরিক্ষণের জন্য দু’ দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে (৩) বাংলাদেশের কোন নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না (৪) অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে (৫) সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান, মুক্তিবাহিনী সর্বাধিনায়ক নন এবং যুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে (৬) দু’ দেশের বাণিজ্য হবে খােলা। বাজার (ওপেন মার্কেট) ভিত্তিক। তবে বাণিজ্যের পরিমাণ হিসাব হবে বছরওয়ারি এবং যার যা পাওনা সেটা স্টার্লিংয়ে পরিশােধ করা হবে (৭) বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যােগাযােগ। রক্ষা করে চলবে এবং ভারত যদুর পারে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের সঙ্গে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সম্পাদিত এই সাত দফা গােপন চুক্তির তথ্য আমাকে এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লী মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী । অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সাত দফা গােপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন অস্থায়ী।
রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরদানের পর পরই তিনি মুছা যান। ভারত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে এই চুক্তিতে আবদ্ধ করায় কেন? এর চমৎকার জবাব দেয়া যায় পশ্চিম বাংলার নকশাল বাড়ি আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদারের ভাষ্যে: কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ শাসক শ্রেণীর এই আওয়াজ দেয়া হয়েছে লুণ্ঠনের স্বার্থে।১২ ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সাত দফা। চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধে লড়ার লক্ষ্যে সকল রাজনৈতিক করণীয় সম্পন্ন করে ফেলেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। অন্যদিকে অক্টোবরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ তার বাহিনীকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে লড়ার উপযুক্ত করে তােলেন । অবিলম্বে-যুদ্ধ কার্যক্রমের পক্ষে যারা ছিলেন, বর্ষা মৌসুম শুরু হবার আগেই
—————————————————–
১২. চারু মুজমদার “আধুনিক শােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান” চতুর্থ দলিল
বাংলাদেশকে মুক্ত করার আওয়াজ তুলেছিলেন যে কট্টরপন্থীরা, তাদেরকে ওই সময় জেনারেল মানেকশ এই বলে হতাশ করেন যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে লড়ার প্রস্তুতিতে নেই । প্রস্তুতির জন্য কমপক্ষে ন’মাসের সময়ের প্রয়ােজন । কিন্তু নির্ধারিত নমাসের আগেই তিনি প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেন সবকিছু গুছিয়ে আনা সত্ত্বেও মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে তখনাে যুদ্ধে নামা সম্ভব ছিল না। কেননা, নভেম্বরের আগ পর্যন্ত যুদ্ধ প্রশ্নে সােভিয়েতের সুস্পষ্ট সমর্থনের ইঙ্গিত মেলেনি। ওই মাসে অর্থাৎ নভেম্বরে ভারত-সােভিয়েত চুক্তির প্রেক্ষাপটে সােভিয়েত বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল কুতুকভের নেতৃত্বে একটি সােভিয়েত সামরিক প্রতিনিধি দল আসে ভারত সফরে। সামরিক প্রতিনিধি দলের পর পরই আসেন সােভিয়েত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্শাল গ্রেচকো। এই সফরের মধ্য দিয়েই সােভিয়েত সমর্থন নিশ্চিত হয়ে যায় এবং মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবার নিঃশঙ্কচিত্তে নামেন যুদ্ধ-ময়দানে। ২১ নভেম্বর শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধের অঘােষিত মহড়া। ওই তারিখে ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্যাংক বহর পাঠিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তরে বিরাট এলাকা দখল করে খুঁটি গেড়ে বসে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। নির্দেশ আসে ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর, যখন পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানি বােমারু বিমান বােমা বর্ষণ শুরু করে এবং আরম্ভ হয়ে যায় তৃতীয় ভারতপাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ।

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!