You dont have javascript enabled! Please enable it!
র’ এবং মুজিব বাহিনী
২৫ মার্চের পর শুধু যুদ্ধ প্রস্তুতিই নয়, যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্য যাতে বজায় থাকে, সে পরিকল্পনা রচনার প্রস্তুতি নেয় ভারত সরকার এবং পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব অর্পিত হয় ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’ -এর ওপর। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীনে বাঙালি যখন মরণপন লড়াইয়ে লিপ্ত, মুক্তিবাহিনীর অকুতােভয় যােদ্ধারা যখন জীবনবাজি রেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কামান আর মেশিন গানের মুখােমুখি যুদ্ধরত, তখন ‘র’ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে উত্তর ভারতের দেরাদুনের কাছাকাছি তানদুয়ায় গড়ে তুলতে থাকে তার নিজস্ব বাহিনী সে বাহিনীর নাম মুজিব বাহিনী। এই বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ার পশ্চাৎপটে আমরা এখন যাব।
যুদ্ধ প্রস্তুতি
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তাদান সংক্রান্ত বিষয়ে ভারত সরকার তিনটি কমিটি গঠন করে। একটি রাজনৈতিক এবং অপর দুটি সামরিক। ভারত সরকার এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে রাজনৈতিক কমিটি। এ কমিটির প্রধান করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্লানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ডি পি ধরকে আর যুদ্ধ প্রস্তুতি সংক্রান্ত যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান করা হয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশকে। ডি পি ধরকে যুদ্ধ কাউন্সিলেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জেনারেল মানেকশ সেনাবাহিনী উপপ্রধানকে চেয়ারম্যান করে আরেকটি কমিটি তৈরি করেন। সেটা যুগ গােয়েন্দা কমিটি কমিটিতে ‘র’-কেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যদিও সেনাবাহিনী উপপ্রধানকে করা হয় এর চেয়ারম্যান কিন্তু জেনারেল শ্যাম মানেকশই থাকেন চূড়ান্ত নির্দেশদানের অধিকর্তা যুগ্ম গােয়েন্দা কমিটি যুদ্ধ প্রস্তুতিতে তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী তরুণদের নিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গঠনের পরিকল্পনাতেও নেমে পড়ে। পরিকল্পনাকে ফলপ্রসূ করে তােলার দায়িত্ব পড়ে তার অঙ্গ সংগঠন ‘র’-এর ওপর। জেনারেল শ্যাম মানেকশ নিজেই থাকেন এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে। আর এই বাহিনী গঠনে ডেকে পাঠানাে হয় বিশেষ বাহিনী তৈরিতে পারদর্শী মেজর জেনারেল উবানকে। তিনি অতি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে লেগে যান। কাজটি তার জন্য সহজ হয়ে গেল তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হবার ঘটনায়। তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের চার যুবনেতা। তাদের ক্ষোভের সুযােগ নেয়া হল। যদিও তাদের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল আগে থেকে, অন্যভাবে এবং গড়ে ওঠে মুজিব বাহিনী।
জেনারেল উবান তার যাবতীয় নিষ্ঠা প্রয়ােগে গড়ে তুলতে থাকেন মুজিব বাহিনী তিনি এর গঠন প্রক্রিয়া এবং কার্যক্রমের জন্য দায়ী থাকেন সরাসরি সেনাবাহিনী প্রধান। জেনারেল শ্যাম মানেকশর কাছে এ কারণে তার বাহিনী এক সময় শ্যাম ‘মানেকশর ছেলেরা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সেহেতু মেজর জেনারেল উবান মুজিব বাহিনীর ব্যাপারে দায়ী ছিলেন সরাসরি জেনারেল মানেকশ আর ‘র’-এর ডিরেক্টর আর এন কাওয়ের কাছে যিনি ছিলেন ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি; তার বেসামরিক ওপরঅলা । অবশ্যি জেনারেল উবান তাকে ‘র’-এর ডিরেক্টর হিসেবে উল্লেখ করেননি। তার ফ্যানটমস অব চিটাগং ফিথ আর্মি ইন বাংলাদেশ বইয়ের কোথাও আর এন  কাওয়ের এই দ্বৈত পরিচয় তিনি এড়িয়ে গেছেন। জবাবদিহি মাত্র দু’জনের কাছে করতে হতাে বলেই তিনি নির্দ্বিধায় ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরােরার অজ্ঞাতে তার বাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেদের পাঠাতে শুরু করেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে  এতে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে তৈরি হয়ে যায় দ্বৈত অধিনায়কত্ব এবং স্বাভাবিক কারণেই জেনারেল আরােরার কাছে তা গ্রহণযােগ্য হবার কথা নয়। তিনি সেনাবাহিনী সদর দফতরকে বলেন মুজিব বাহিনীকে তার অধিনায়কত্বে ছেড়ে দিতে। তার অনবরত চাপে ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেটর্স লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে কে সিং মুজিব বাহিনীর তাৎপর্য সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ যখন মুজিব বাহিনীর অস্তিত্বের কথা জানতে পান, তখন তিনিও জেনারেল শ্যাম মানেকশকে অনুরােধ জানান এই বাহিনীকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীন ছেড়ে দিতে। জেনারেল মানেকশ তাকে জানান যে, সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই বাহিনী। কিন্তু কী সে দায়িত্ব, সে সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদকে তিনি কী বলেছিলেন, তা জানা যায় না। মুজিব বাহিনী সংগঠক জেনারেল উবান তার ফ্যানটমস অব চিটাগং ফিপথ আর্মি ইন বাংলাদেশ গ্রন্থেও সে বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেননি। তবে সাত দফা গােপন চুক্তির আলােকে এ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য অনুধাবনে বেগ পাবার কথা নয়। তা হল, মুক্তিবাহিনীর এক বিরাট সংখ্যক সদস্য বামপন্থী চিন্তাধারায় সিক্ত। স্বাধীনতার পর এরা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে—এই চিন্তা থেকে এদেরকে নির্মূলের লক্ষ্যে প্রয়ােজন হয়ে পড়ে একটি আজ্ঞাবহ বাহিনীর আর সে বাহিনী গড়ে উঠবে শেখ মুজিবের নামে এবং মুজিবের রাজনীতির নামে সে বাহিনী পরিচালিত হবে বামপন্থী নিমূলে । তবে মুজিব বাহিনী তৈরি করে ‘র’ যা করতে চেয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে ঘটে যায় উল্টোটি। কারণ, খােদ মুজিব বাহিনীর ভেতরই সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বামপন্থী চিন্তাধারার অনুবর্তী ছিল শতকরা আশি ভাগ। মুজিব বাহিনী কাদের নিয়ে গঠিত হয়, কি উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়, এ সবই এসেছে জেনারেল উবানের ফ্যান্টমস অব চিটাগং ফিপথ আর্মি ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে । আসেনি কেবল মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয় সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমদের সঙ্গে কোথায়, কার মাধ্যমে তার প্রথম পরিচিতি ঘটে, এই প্রসঙ্গটি।
বইতে শুধু বলেছেন এক বন্ধুর বাড়িতে তাদের প্রথম দেখা ও বৈঠক কিন্তু তার সেই বন্ধু যে চিত্তরঞ্জন সুতার, এ নামটি ভুলেও তিনি আনেননি। বইয়ের কোথাও তিনি চিত্তরঞ্জন সুতারের নামটি উচ্চারণ না করলেও আমরা তা জানতে পাব আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্য থেকে। আর এই সুতারের পরিচয় তাে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়েই পেয়েছি। তাতে পরিষ্কার হয়ে যায় ‘র’-এর সঙ্গে জেনারেল উবান ও মুজিব বাহিনীর যােগসূত্রটি। এবার আমরা আসতে পারি আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্যে । আর মুজিব বাহিনী সম্পর্কে জেনারেল উবানের ভাষ্যে আসবাে পরে।
আবদুর রাজ্জাক আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন : “জায়গা মত যেয়ে দেখি যে, শেখ ফজলুল হক মণি ও তােফায়েল আহমদ । সে জায়গাটা কলকাতায় ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রােড; যেখানে চিত্তরঞ্জন সুতার বঙ্গবন্ধুর (শেখ মুজিব) রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন । তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ করলেন। সেই আলাপের প্রেক্ষিতে একজন অফিসার আসেন। জেনারেল উবানই এসেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি ঘটে ১৯৭১ সালের মে মাসের গােড়ার দিকে এবং চূড়ান্ত হয়ে যায় মুজিব বাহিনী তৈরির প্রক্রিয়া। আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারেই আমরা দেখতে পাব কী নিপুণ কৌশলে চিত্তরঞ্জন সুতার এই চারজনকে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হবার ঘটনাকে অজুহাত করে ঐক্যবদ্ধ করেন। যুবনেতা চতুষ্টয় মনে করতেন, যেহেতু আওয়ামী লীগের ভেতর ছাত্রলীগের তরুণরাই হচ্ছে যােদ্ধা অংশ; তাদের নেতৃত্বে আছেন তারাই-সেহেতু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবার কথা তাদেরই। মাঝখান দিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হয়ে নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেবেন, এ তাদের মােটেই কাম্য ছিল না। চিত্তরঞ্জন সুতার এটাকে উস্কে দেন এভাবে “আপনাদের ভেতর মত পার্থক্য কেন হচ্ছে? আপনারা এক থাকেন। সরকারের (ভারত সরকার) সঙ্গে কথা বলেন, সরকার তাে আপনাদেরকেই চেনে, আবদুর রাজ্জাক আমাকে বলেন একথা । যুবনেতা চতুষ্টয় চিত্তরঞ্জন সুতারের এই আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্বের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব তােলেন। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করবে যুদ্ধ কাউন্সিল। কেননা, তাদের মতে, মুক্তিবাহিনীতে ঢুকে যাচ্ছে এমন সব লােক যারা যুদ্ধে অনাগ্রহী এবং পাকিস্তানপন্থী । জেনারেল উবানের ভাষ্য অনুযায়ী বামপন্থী ও নকশালপন্থী নৈরাজ্যিকরা। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে । আর অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রশ্নে ভারত সরকারকে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অবশ্যিই অনুসরণ করতে হয়। এক্ষেত্রেও তারা হতাশ হন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আরাে বেশি মাত্রায়। অতএব, বিকল্প হিসেবে নিজেদের নেতৃত্বে একটি সমান্তরাল বাহিনী গড়ে তােলার প্রচেষ্টায় নামেন এবং চিত্তরঞ্জন সুতার সে ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ফেলেন। দৃশ্যপটে হাজির হয়ে যান জেনারেল উবান ।
জেনারেল উবানের সঙ্গে চার যুবনেতার সাক্ষাতের দু’সপ্তাহের মাথায় মুজিব বাহিনীর প্রথম দলটি ভারতীয় মিলিটারি একাডেমী শহর দেরাদুন থেকে দেড় কিলােমিটার দূরে পাহাড় শীর্ষের শহর তানদুয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১৯৭১ সালের মে মাসের ২৯ তারিখে ।
আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প খােলা হয় মেঘালয়ের তুরার কাছাকাছি হাফলং-এ। মাত্র একটি দলের ট্রেনিং শেষে এ ক্যাম্পটি তুলে দেয়া হয় । তানদুয়ার ট্রেনিং ক্যাম্পের মূল পরিকল্পক ও পরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল উবান ।  প্রথম দলটি, যার সংখ্যা ২৫০, তাদের ট্রেনিং দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসাররা। ট্রেনিং শেষে এদের ভেতর থেকে ৮ জনকে করা হয় প্রশিক্ষক।
হাসানুল হক ইনুকে করা হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রধান। প্রশিক্ষকরা হলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আফম মাহবুবুল হক, রফিকুজ্জামান, মাসুদ আহমদ রুমী, সৈয়দ আহম্মদ ফারুক, তৈফিক আহমদ ও মােহনলাল সােম। পরে প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানাে হয়। করা হয় বাহান্নো। এরাই বাকি দশ হাজার মুজিববাহিনী সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেন। ট্রেনিং প্রদান বন্ধ হয়ে যায় নভেম্বর ১৯৭১ সালের ২০ তারিখে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালনায় ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার আর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রধান হাসানুল হক ইনুর ওপরঅলা ছিলেন একজন কর্নেল  প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অন্যান্য ভারতীয় অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর মালহােত্রা। তাকে আমরা আবারাে দেখতে পাব রক্ষীবাহিনী গঠন কার্যক্রমে। 
মুজিব বাহিনীর অপারেশন পরিচালনার জন্য চার যুবনেতা বাংলাদেশকে চারটি সেক্টরে ভাগ করে নেন।
1. বৃহত্তর রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর নিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর-এর দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মণি ।
2. বৃহত্তর খুলনা, যশাের, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল এবং পটুয়াখালী নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় সেক্টর,-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন তােফায়েল আহমদ। সেকেন্ড ইন-কমান্ড ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ।
3. বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম , কুমিল্লা, নােয়াখালী, সিলেট এবং ঢাকা জেলার কিছু অংশ নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর। শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এই সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সেকেন্ড-ইনকমান্ড ছিলেন আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন।
4. আর কেন্দ্রীয় সেক্টর ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং ঢাকা জেলার কিছু অংশ নিয়ে । সদর দফতর ছিল মেঘালয়ের ডালুতে। এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। সেকেন্ড-ইনকমান্ড ছিলেন সৈয়দ আহমদ।
চার যুবনেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমদের ওপর ছিল মুজিব বাহিনীর কর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব। ছাত্রলীগ কর্মী এবং শেখ মুজিবের কট্টর অনুসারীর বাইরের কারােরই মুজিব বাহিনীতে প্রবেশাধিকার ছিল না। মুজিব বাহিনীর জন্য ভারত সরকার প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং ব্যয় নির্বাহে আর্থিক সহায়তার সমন্বয় বিধান করতেন জেনারেল উবান। তার মাধ্যমেই অস্ত্র এবং বাজেট অনুযায়ী অর্থ সরাসরি চলে আসতাে চার যুবনেতার হাতে। দেয়া হতাে সেক্টর ভিত্তিক চার যুবনেতা পেতেন জেনারেলের মর্যাদা। যাতায়াতের জন্য পেতেন হেলিকপ্টার। ২৫ মার্চের আগে শেখ ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খানের ভেতর স্বাধীনতার প্রশ্নে যে মতবিরােধ ছিল, ভারতের মাটিতে পা দেয়ার পর তার অবসান ঘটে। কিন্তু মুজিব বাহিনী গঠনের প্রারম্ভিক কাল থেকে আরেকটি বিরােধ অংকুরিত হতে থাকে সেটা যেমন নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, তেমনি মতাদর্শগত বিরােধও এবং এক সময় বিরােধ প্রকট হয়ে দেখা দেয়। তাদের এই বিরােধের প্রথম প্রকাশ আমরা দেখতে পাই ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির ১৯৭০ সালের ১২ আগস্টের বৈঠকে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাব গৃহীত হবার কালে । ছাত্রলীগের যে গ্রুপটি এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে, তার প্রকাশ্য নেতৃত্বে নুরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদুস মাখন ছিলেন বটে, পেছনের শক্তি ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। এর বিস্তারিত আমরা পেয়েছি পূর্ববর্তী অধ্যায়ে। 
শেখ ফজলুল হক মণি তখন ছাত্র ছিলেন না ঠিকই, বৃহত্তর রাজনীতিতে প্রবেশের চেষ্টায় ছিলেন, তবে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিজের মুঠোয় রাখার প্রয়াস থেকে দূরে ছিলেন । অপর গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তার স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ডাক-এর প্রতি ছাত্রলীগের বেশিরভাগ তরুণ ঝুঁকে পড়লেও সমাজতন্ত্রের প্রতি সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততার প্রশ্নটি সংশয়ের উর্ধ্বে রাখা যায় না আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্য অনুযায়ী। আবার সমাজতন্ত্রকে তিনি ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ চরিতার্থে ব্যবহার করেছিলেন কিনা, এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বলার অবকাশ রয়ে যায় যে, ২৫ মার্চের আগে সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মণির ভেতর যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল, সেটা ছিল একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব এবং সমাজতন্ত্রের শ্লোগান তুলে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বকে সুকৌশলে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বে রূপ দিতে পেরেছিলেন সিরাজুল আলম খান। ভারতের মাটিতেও ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ প্রতিষ্ঠার পুরােনাে দ্বন্দ্বটি ঢাকা পড়ে যায় তথাকথিত মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের আড়ালে। এবার আমরা আবদুর রাজ্জাকের ভাষ্যে আসতে পারি। দেখতে পাব সমাজতন্ত্রের প্রতি সিরাজুল আলম খানের বিশ্বস্ততার প্রশ্নে তার বক্তব্য  আবদুর রাজ্জাক বলেন “ভারতে যতদিন ছিলেন যুদ্ধে তিনি (সিরাজুল আলম খান) তাে যানইনি, কলকাতাতেই অধিকাংশ সময় ছিলেন। ওখানে তার যে ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন শিলিগুড়ির পাংগা ক্যাম্প,—তার ইনচার্জ ছিলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মর্শাল মণি এবং মান্নানকে দায়িত্ব দিয়ে কলকাতাতেই থাকতেন। কলকাতায় কোথায় কি করতেন, কাউকে জানতে দিতেন না। পরবর্তীকালে খবর পাওয়া গেল তিনি নকশালদের সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন। এসইউসি’র (সসালালিস্ট ইউনিটি সেন্টার নেতা শিবদাশ ঘােষ) সঙ্গেও যােগাযােগ করেছেন।
সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, যিনি দক্ষিণপন্থী লবির লােক, তার সঙ্গেও যােগাযােগ ছিল সিরাজুল আলম খানের। মােটিভটা ধরা পড়েছে অনেক পরে যখন আমরা দেখলাম পিটার কাসটারর্সের সঙ্গে তার সংযােগ, যখন দেখলাম পশ্চিম বাংলার অতি বামপন্থীদের সঙ্গে তার যােগসূত্র রয়েছে, যাদের সঙ্গে ট্রটস্কিপন্থী আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রীদের যােগাযােগ, যারা সিআইএ অরগানাইজড তাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক দেখা গেল পরবর্তীকালে। আমি তখন বুঝতে পারলাম তিনি একটা মটিভ নিয়ে কাজ করছেন। আর ট্রটস্কি লাইন সম্পর্কে আমার তাে পরিষ্কার ধারণা আছে, এতাে সিআইএ’র লাইন।” অতএব, এক প্রকার স্পষ্ট যে। ভারতের মাটিতে মুজিব বাহিনীর দুই নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাসী দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটে মতাদর্শগত বিরােধ প্রকাশের মধ্য দিয়ে  এক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রের শ্লোগান সিরাজুল আলম খান ব্যবহার। করলেও ছাত্রলীগের প্রায় আশিভাগ তরুণ কিন্তু বামপন্থী চিন্তাধারার অনুবর্তী হয়ে পড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সৎ নিষ্ঠাবান লড়াকুতে পরিণত হয়ে যায় আবার। সিরাজুল আলম খানেরই নেতৃত্বকে দৃঢ়তর করে।
অপরদিকে শেখ মুজিবের প্রতি আবদুর রাজ্জাকের গভীর আনুগত্য সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের প্রতি তার বিশ্বস্ততা মুজিব বাহিনীর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকামী তরুণদের ভেতরেও তার নেতৃত্বকে সমভাবে প্রোথিত করে। আবার শেখ মুজিবের প্রতি আনুগত্যের কারণে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের সদস্যদের কাছেও ছিলেন সমান শ্রদ্ধাভাজন। ফলে ভারতের মাটিতে তাকে শেখ ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে হয় । অন্যদিকে মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে একাধিপত্য অর্জনের চেষ্টায় সতর্ক পদক্ষেপে নেমেও ব্যর্থ হতে হয় শেখ ফজলুল হক মণিকে। ব্যর্থ হন এই কারণে যে, তানদুয়ার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যারা প্রশিক্ষক ছিলেন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন হাসানুল হক ইনু। তিনি বামপন্থী চিন্তাধারার অনুবর্তী এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকামী। প্রথম দলের ট্রেনিং শেষে যে আটজনকে প্রশিক্ষক করা হয়, তাদের মধ্যে একজন বাদে আর সকলেরই চোখে ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। প্রশিক্ষকের সংখ্যা যখন বায়ান্নতে উন্নীত হয়, তখনাে বামপন্থী অনুবর্তীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ  তিনজন বাদে আর সকলেই ছিলেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকামী। স্বাভাবিক কারণেই প্রশিক্ষকদের রাজনৈতিক মটিভেশন সমাজতন্ত্রের পক্ষেই হবার কথা। যেহেতু আওয়ামী লীগের ঘােষণাপত্রে সমাজতন্ত্রের কথা ছিল, সে কারণে সমাজতন্ত্রের ওপর রাজনৈতিক বক্তৃতা রাখা তাদের পক্ষে সুবিধাজনক হয়ে ওঠে। কিন্তু বিষয়টিকে মােটেই সহজভাবে নেয় না তানদুয়ার ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ। প্রশিক্ষণ প্রধান হাসানুল হক ইনুর ওপরঅলা ভারতীয় কর্নেল রাজনৈতিক বক্তৃতা বন্ধের নির্দেশ দেন।
এ আদেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে  হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে প্রশিক্ষকরা দাবি তােলেন যে সরাসরি দিল্লী থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তারা সামরিক প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি রাজনৈতিক বক্তৃতাও চালিয়ে যাবেন। কিন্তু কর্নেলের অনবরত চাপে পরিস্থিতি এক পর্যায়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রশিক্ষণ প্রধান হাসানুল হক ইনু কর্নেলকে জানিয়ে দেন যে দিল্লী থেকে রাজনৈতিক বক্তৃতা প্রদানের অনুমতি যতদিন না আসছে ততদিন ট্রেনিং বন্ধ থাকবে। প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণদান বন্ধ করে দিলেন। এ খবর দিল্লীতে পৌছতে তানদুয়ায় ছুটে আসেন জেনারেল উবান । চার যুবনেতাও এলেন তার সঙ্গে। আসল সত্যটা এড়িয়ে গিয়ে কৌশলে অচলাবস্থার নিরসন ঘটানাে হয় । ট্রেনিং প্রদান আবার আরম্ভ হয় এবং রাজনৈতিক বক্তৃতাও চলতে থাকে। প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণদান বন্ধ রাখেন তিনদিন এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ২০ নভেম্বর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হলেও সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চেতনায় প্রভাবিত থাকার কারণেই প্রশিক্ষকদের ১৬ ডিসেম্বরের আগে তানদুয়া থেকে ছাড়া হয় না । রাজনৈতিক বক্তৃতা এবং প্রশিক্ষণ বন্ধের ঘটনা ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থার ‘র’-কে মুজিব বাহিনীর প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা এনে দেয়। ‘র’ হিসেব কষে ফেলে, যে পরিকল্পনাকে সামনে রেখে মুজিব বাহিনী করা হচ্ছে তা অংকুরেই বিনষ্ট হতে যাচ্ছে এবং আশ্রয় নেয় ভিন্ন কৌশলের । আত্মপ্রকাশ ঘটে এক অদ্ভুত মতবাদের নাম তার মুজিববাদ!
১৯৭১ সালের মে মাসের ২৯ তারিখে তানদুয়ায় মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং শুরু হলেও অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এক অস্তিত্বের খবর জানতে পায় আগস্ট মাসে। এ মাস হতেই সীমান্তে মুক্তিবাহিনী কমান্ড ও ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী কমান্ডের অগােচরে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুজিববাহিনী সদস্যরা বাংলাদেশ অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করে  কিন্তু বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিবাহিনী কমান্ড ও ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তারা ধরা পড়ে। প্রয়াত মুক্তিবাহিনী কমান্ডার মেজর জলিলের সেক্টরে মুক্তি বাহিনী সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে বাইশজন মুজিববাহিনী সদস্য। ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে আমাকে দেয়া টেপকৃত এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে মেজর জলিল বলেন “আমার সেক্টরাধীন হিঙ্গেলগঞ্জের ফিল্ডে যারা মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন, তারা বাইশজনকে গ্রেফতার করেন। তারা তখন ভেতরে প্রবেশ করছিল। সেখানে তাদের চ্যালেঞ্জ করা হয়। এক ভদ্রলােক নিজেকে ক্যাপ্টেন জিকু বলে পরিচয় দেন। তাকেও গ্রেফতার করা হয়।’ এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। এর প্রেক্ষাপটে কলকাতার হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল হােটেলে অনুষ্ঠিত হয় এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক। ভারত সরকারের পক্ষে ছিলেন ডি পি ধর। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আর ছিলেন মুজিব বাহিনীর নেতারা। সেপ্টেম্বর মাসেও অনুষ্ঠিত হয় আরেকটি বৈঠক। প্রথম বৈঠকেই একটি আপােস রফা হয়ে যায় ।
শাহজাহান সিরাজকে মুজিব বাহিনী ও অস্থায়ী সরকারের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষার জন্য নিয়ােগ করা হয় । মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই শাহজাহান সিরাজ এই নিয়ােগ লাভ করেন। অবশ্যি এই নিয়ােগকে সিরাজুল আলম খানের রহস্যজনক কার্যকলাপের আরেকটি দিক হিসেবে উল্লেখ করে আবদুর রাজ্জাক বলেন যে তিনি তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে গােপন আঁতাত রাখার জন্য শাহাজাহান সিরাজের নিয়ােগের ব্যবস্থা করেন ।  আগস্ট মাসে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা শুরু করলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামার কোন পরিকল্পনা তাদের ছিল না। দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আবদুর
——————
১. নুরে আলম জিকু, পরবর্তীকালে জাসদ নেতা।
………………………
রাজ্জাক ও হাসানুল হক ইনু আমাকে বলেছেন যে, সামজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা ধাপে ধাপে এগােবার পরিকল্পনা নেন । এই উদ্দেশ্যে প্রতিটি থানায় একজন করে কমান্ডারের অধীনে দশজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনী সদস্যের সমন্বয়ে একটি কমান্ড গঠন করা হয়। তাছাড়া ছিল একজন রাজনৈতিক কমান্ডার রাজনৈতিক মটিভেশন প্রদানই ছিল তার কাজ। একই পদ্ধতিতে গঠন করা হয় জেলা কমান্ড  জেলাতেও ছিল। রাজনৈতিক কমান্ডার থানা কমান্ড ও জেলা কমান্ড গঠিত হলেও যুদ্ধ বলতে যা। বােঝায় তা করেনি মুজিব বাহিনীর সদস্যরা তারা যা করে, সেটা আমরা জানতে পাব আবদুর রাজ্জাকের মুখ থেকে আমরা জনগণের সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করছি। কিছু কিছু রাজাকারও খতম হচ্ছে। কিন্তু মূল জায়গাটা মানে পাক আর্মির সামনে না পড়লে যুদ্ধ করছি না। দু’চার জায়গায় সামনে পড়ে গেছি যুদ্ধ হয়েছে। আমরা তাে লড়াই শুরুই করিনি।  আমাদের তাে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। পাঁচ বছরের প্রথম বছরে কি করবাে , তৃতীয় এবং চতুর্থ বছরে কি করবাে তারপর সরকার তৈরি করবাে,—এই ছিল আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা । আমরা যদি সফল হতাম তাহলে কোন ঘাস থাকতাে না, আগাছা থাকতাে না। সমাজ দেহ থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতাম। প্রতিবিপ্লবীদের থাকতে হতাে না। হয় মটিভেট হয়ে এদিকে আসতে হতাে নইলে নিশ্চিহ্ন হতে হতাে।২ আবদুর রাজ্জাক আমাকে দেয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
এবং তার মুখ থেকেই এসে গেছে ‘র’-এর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছক। অবশ্যি আবদুর রাজ্জাক এ কথা বলেছেন তার বামপন্থী চিন্তাধারার আলােকে তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বামপন্থী চিন্তাধারার অনুবর্তী এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকামী তরুণদের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতাই পরবর্তীকালে ‘র’-কে তার পরিকল্পনা কার্যকর করতে দেয়নি। আবদুর রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনুরা পরিকল্পনা মাফিক এগােননি সত্য কিন্তু শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের মাধ্যমে ‘র’ নেমে পড়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। 
————————————————
২. পরবর্তীকালে উপজেলা।

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!