You dont have javascript enabled! Please enable it!
১৯৬৮-১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন ও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিংপন্থী) সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী । ১৯৬৮ সালের ২৮ নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং), কৃষক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের এক যৌথসভায় ৬ ডিসেম্বরকে জুলুম প্রতিরােধ দিবস হিসেবে ঘােষণা করে। এবং ওই ৬ ডিসেম্বরেই পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় মাওলানা ভাসানী বলেন “পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি মানিয়া না লইলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিচ্ছিন্ন হইয়া স্বাধীন পূর্ব বাংলা গঠন করিবে।(১) পল্টনের ওই জনসভায় জুলুম প্রতিরােধে পর দিন ৭ ডিসেম্বর। ঢাকায় হরতাল আহবান করা হয়। ওই দিনে পুলিশের গুলিতে তিন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। এবং আন্দোলন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। দিনে দিনে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে শহর-বন্দরগঞ্জে। ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত তক্কালীন পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী বিরােধী দলগুলাে, ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নেয় না। অংশ নেয়া শুরু করে ওই তারিখ থেকে অর্থাৎ ৮ জানুয়ারিতে ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি সংক্ষেপে ‘ডাক’ গঠনের মধ্য দিয়ে । ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির (ডাক) শরীকদল ছিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, (ছয় দফা) জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো), পিপলস ডেমােক্রেটিক মুভমেন্টের (পি.ডি.এম.) অঙ্গদল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ, পাকিস্তান জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, নেজামে ইসলাম পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী।(২) ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে সূচিত আইউব বিরােধী আন্দোলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলমত নির্বিশেষে সকলকে অংশগ্রহণের আহবান জানালেও ছয় দফাপন্থী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সে আহবান পাশ কাটিয়ে যায় । ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (ছয়দফা) তৎকালীন অস্থায়ী সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন :“নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও স্বৈরাচারী
————————
১. দৈনিক সংবাদ; ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৮
২. প্রাগুক্ত ৯ জানুয়ারি, ১৯৬৯
শাসনের অবসানকল্পে ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর আন্দোলনে শরীক হইবার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বিরােধী রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি তিনি আহবান জানাইয়াছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় নেতা ছয়দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করিয়াছেন এবং তাহারা আওয়ামী লীগের সহিত ঐক্যবদ্ধ হইতে অনিচ্ছা প্রকাশ করিয়াছে।(৩) তৎকালীন বিরােধী দলগুলাের বিরুদ্ধে এই অভিযােগ সত্ত্বেও আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনে মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিং) সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ না হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (ছয়দফা) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ (মস্কো) সকল দক্ষিণপন্থী দলসমূহের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে ৮ জানুয়ারি, ১৯৬৯ সালে ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠনের মধ্য দিয়ে। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে সহজভাবে নিতে পারেনি কোন দক্ষিণপন্থী দলই। নিতে পারেনি তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পাটিও (মস্কো)। (৪)৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কো) কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির পঞ্চম দিনের বৈঠকে গ্রহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবগুলাের একটিতে আন্দোলনরত মাওলানা ভাসানী এবং তার দল অভ্যন্তরের পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের কটাক্ষ করে বলা হয় “দলীয় অহংকার বা সঙ্কীর্ণতা, উগ্র হঠকারিতা ও একলা চলার মনােভাব আন্দোলনের অন্তরায়।(৫) অথচ, এই কটাক্ষ সত্ত্বেও পরিস্থিতি তখন এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়, সেখানে শুধু মৌখিক নয় কায়িকভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাড়া তাদের আর কোন বিকল্প থাকে না।
কেননা, ইতােমধ্যে ৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি তাদের এগার দফা দাবি পেশ করে আন্দোলনে নতুন মাত্রা এনে দেয় । ১২.৪০ মিনিট তাই পরিস্থিতিকে নিজেদের নাগালে আনার লক্ষ্যেই মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগ এবং আর দক্ষিণপন্থী বিরােধী দলগুলাে ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন করে। ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটিতে (ডাক) যােগদানের প্রশ্নে ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগ যেসব প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তির দাবি জানায় সেগুলাে হল সার্বজনীন ভােটাধিকার, ফেডারেল পদ্ধতির পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা, শেখ মুজিব, ওয়ালী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, তাজউদ্দিনসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি, ট্রাইবুনালে উত্থাপিত সকল মামলা ও গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রত্যাহার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন।(৬) মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলগুলাে ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগের প্রস্তাব ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটিতে যােগদানের প্রশ্নে ছয় দফাপন্থী আওয়ামী
———————————————–
৩. দৈনিক আজাদ : ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৬৮
৪. বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ওই সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কোপন্থী) অভ্যন্তরে থেকে কাজ করতাে।
৫. দৈনিক সংবাদ : ৭ জানুয়ারি, ১৯৬৯
৬. দৈনিক আজাদ : ৮ জানুয়ারি, ১৯৬৯
লীগের প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি আসেনি। ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির প্রস্তাবেও স্বাধীনতার কথা ছিল না। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এককভাবে ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে আইউব বিরােধী আন্দোলন শুরু করেন, তার এক মাস দুদিনের মাথায় অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারিতে মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলগুলাের সক্রিয় অংশগ্রহণে তা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের রূপ নেয়। কেবল পূর্ব পাকিস্তানেই নয়, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানেও সৃষ্টি হয় বাঁধ ভাঙা জোয়ার। আদতে পশ্চিম পাকিস্তানে আইউব বিরােধী আন্দোলনের সূত্রপাত। করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৬৭ সালের ১ ডিসেম্বরে পিপলস পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে তাসখন্দ চুক্তিকে বিষয় করে । ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) সভাপতি মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানে যে গণআন্দোলন শুরু করেন এবং একক নেতৃত্বে তাকে টেনে নিয়ে যান পুরাে মাস, সৃষ্টি করেন সারা পূর্ব বাংলা জুড়ে এক প্রচণ্ড ঝড়াে হাওয়া আর পশ্চিম পাকিস্তানে যার সূত্রপাত ঘটান জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেই আন্দোলনের তােড়ে কেঁপে ওঠে আইউবের দশ বছরের পােক্ত সিংহাসন। শেখ মুজিবর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হন তিনি। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব বেরিয়ে আসেন আইউবের জেল থেকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয় প্রত্যাহৃত । শেষ পর্যন্ত আইউব খানকেও নিতে হয় বিদায় ।
২৬ মার্চ ১৯৬৯ সালে শাসন ক্ষমতা দখল করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ।। ৬ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির পঞ্চম দিনের বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির (পিকিং) যাদেরকে “উগ্র হঠকারী” বলা হয়, তারাই হলাে বামপন্থী স্বাধীনতাকামী। এরাই ওই সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিং) ভেতর থেকে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার শ্লোগান তােলে। বাইরের এই প্রভাব পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ভেতরে স্বাধীনতার পক্ষে দ্রুত মেরুকরণ ঘটাতে থাকে। এর অভ্যন্তরে। ১৯৬৪ সাল থেকে স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের তৎপরতাকে এক ধাক্কায় এ সময় যে পরিমাণ এগিয়ে দেয়- শুরুর কাল থেকে অর্থাৎ ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছরে তার এক-চতুর্থাংশও এগােতে পারেনি এই সংগঠনটি। কেননা, এই সময় থেকেই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য। রাখতে থাকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিং) ভেতরকার বামপন্থীরা স্বাধীনতার পক্ষে তাদের উচ্চকিত শ্লোগান পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বড় রকমের গুণগত পরিবর্তন এনে দেয়। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ তেজোদীপ্ত তরুণরা দলে দলে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের পতাকাতলে এস জড়াে হতে থাকে। অবশ্যি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিং) ভেতরকার বামপন্থীরা সর্বপ্রথম ১৯৬৯ সালেই স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তােলে। এর আগে ওই পার্টির অভ্যন্তরের কোন বামপন্থী দল বা উপদলের কর্মসূচিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা আসেনি।
১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) সভাপতি মাওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার কথা বললেও মাত্র তার পাঁচদিন আগে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ১৯৬৮ সালের ১ ডিসেম্বর স্বাধীনতার আহবান সংবলিত শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস প্রকাশ করে। (৭) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিং) অভ্যন্তরে কাজী জাফর আহমদ(৮) হায়দার আকবর খান রনাে(৯) ও রাশেদ খান মেননের(১০) নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি স্বাধীন পূর্ব বাংলার কর্মসূচি সংবলিত একটি প্রচারপত্র বিলি করে ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে। ওই প্রচারপত্রে বলা হয় সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বৃহৎ পুঁজির প্রতিভূ, এককেন্দ্রীক স্বৈরাচারী সমরবাদী শাসকগােষ্ঠীকে পূর্ব বাংলার বুক হইতে উচ্ছেদ করিয়া একমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের মাধ্যমে শােষিত, বঞ্চিত জনতার মুক্তি সম্ভব।(১১) দিনে দিনে স্বাধীনতার শ্লোগান যেভাবে উচ্চকিত হয়ে উঠছিল, তার মােড় ঘুরিয়ে। দেওয়ার জন্য ক্ষমতায় এসে ইয়াহিয়া খান সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে অবাধ সাধারণ নির্বাচন দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর এক বেতার ও টিভি ভাষণে ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে এক প্রলয়ঙ্করী বন্যার তােড় বিপর্যস্ত করে দেয় পূর্ব বাংলার জনজীবন। সাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে নেয়া হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ (ভাসানী) সকল দলই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু নিজ দলের ভেতরকার বামপন্থীদের প্রবল চাপের মুখে পড়েন মাওলানা ভাসানী। তারা নির্বাচন বয়কটের দাবি তােলে। বামপন্থীরা এই বলে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে, ব্যালটের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মেহনতি জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন আনা যাবে না এবং তা সম্ভব কেবল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে। এ লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ( ১১) ১৯৭০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার
 
——————————-
৭, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭৭-৮৪
৮. স্বাধীনতার পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শিক্ষামন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী।
৯, স্বাধীনতার পর ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ।
১০, প্রাগুক্ত।
১১, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭
১২. এই ছাত্র সংগঠনটি মেনন গ্রুপ নামে পরিচিত ছিল। এদেরকে পিকিংপন্থী ছাত্র সংগঠন বলা
লক্ষ্যে ১১ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সালে পল্টনের জনসভায় তা পঠিত ও গৃহীত হয়। এই ঘােষণার প্রেক্ষিতে সামরিক আদালত কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননকে সাত বছর করে আর মােস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাহকে এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয় । আওয়ামী লীগ ছয় দফা নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামে। দলের ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিটি তরুণ নেমে পড়ে নির্বাচনী প্রচারে। তবে ইতােমধ্যে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এবং কর্মীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এসে যায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নেতৃত্বাধীন। নির্বাচনী প্রচারকে তারা জনগণের দোরগােড়ায় নিজেদেরকে নিয়ে যাবার সুযােগ হিসেবে গ্রহণ করে এবং ছয় দফার আড়ালে এক দফার সংগ্রাম অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে জোরদার করার কাজে নেমে পড়ে। ওই বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালর ১৫ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের তিন নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ তাদের ৬ বছরের গােপন তৎপরতার অর্জিত সাফল্যের প্রকাশ্য প্রদর্শনীতে নামার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দি দশায় ঢাকা সেনানিবাসের কয়েদ থানায় সেনাবাহিনীর সদস্যের গুলিতে নিহত হন। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কেন্দ্রীয় সেল ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত কার্যকর করার দায়িত্ব অর্পিত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশের ওপর ।
এই অংশের নেতৃত্বে ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের ছাত্র নেতৃত্ব। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ কেন্দ্রীয় সেল এবং ছাত্র নেতৃত্ব মার্চ মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মার্চ মিছিলকারীদের নামকরণ করা হয় “১৫ই ফেব্রুয়ারি বাহিনী।” ওই সময় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী । তাকে “১৫ই। ফেব্রুয়ারি বাহিনী এবং মার্চ মিছিল সম্পর্কে কিছুই জানানাে হয় না । জানানাে হয় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন (ডাকসু) সহসভাপতি আ, স, ম, আবদুল রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখনকেও। তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহজাহান সিরাজ। তাকে এ বিষয়ে জ্ঞাত করা হয়। এমনকি এক সময়কার ছাত্রলীগ নেতা এবং মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের অন্যতম শেখ ফজলুল হক মণিকে “১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনী” এবং মার্চ মিছিল সম্পর্কে জানানাে হয় না। এ বিষয়ে জানতেন না তিনি কিছুই
 
—————————-
১৩, পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারের মন্ত্রী।
১৪, পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি ওই সময় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (আলাউদ্দিন-মতিন) প্রভাবাধীন ছিলেন।
১৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯০-২।
১৬. পরবর্তীতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (সিরাজ) সভাপতি।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী মার্চ মিছিলে “১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনীর” নেতৃত্ব দেন তৎকালীন নগর ছাত্রলীগ সভাপতি মফিজুর রহমান খান। বাহিনীর উপনেতৃত্বে ছিলেন প্রকৗশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু।(১৭) তৎকালীন ছাত্রলীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও(১৮) ছিলেন মিছিলের নেতৃত্বে। শেখ হাসিনাকে মিছিলে সামিল করানাে হয় এই ধারণা দেয়ার জন্যে যে “১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনীর” মার্চ মিছিলের প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। অবশ্যি শেখ মুজিবকে মার্চ মিছিলের সিদ্ধান্তটি জানানাে হয়। তিনি সমর্থন বা অসমর্থন সুচক কোন মনােভাবই দেখান নি। যদিও তিনি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কর্মধারা ও লক্ষ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন।
মূলত শেখ মুজিবের ভাবমূর্তিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নেতারা। তাছাড়া তার বিশাল ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করে তাদের পক্ষে স্বতন্ত্রভাবে টিকে থাকাও সম্ভব ছিল না। আরেকটি বিষয় তারা সম্ভবত অনুধাবন করতে পারেন যে শেখ মুজিবের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যাবে না। কেননা, তার অসমর্থনসূচক মনােভাবের পরিচয় তারা পান ওই বছরই—১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে। তাই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের ত্রয়ী নেতৃত্ব স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাননি বিপাক এড়াতে এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন একনিষ্ঠ গােপনীয়তার আড়ালে। আর এই কারণেই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কায়িক অস্তিত্বের কথা জানতে পায় নি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা। জানতে পায়নি স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত কেউই। “১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনী গঠন করার পর স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদকে যে বিষয়টির মুখােমুখি এনে দাঁড় করায় সেটা ট্রেনিং। কিন্তু প্রশিক্ষণ প্রদানের উপযুক্ত ছিল না এই বাহিনী। স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মীর যেমন ছিল অভাব তেমন ছিল দোদুল্যমানতা। তাই নতুন বাহিনীর প্রয়ােজনীয়তা অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং দরকার পড়ে অধিকতর গােপনীয়তার । ১৯৭০ সালের ৭ জুন ছয় দফা দিবসকে সামনে রেখে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী। পরিষদ নতুন বাহিনী গঠনের তৎপরতা শুরু করে এবং অধিকতর সংগ্রামী চেতনায় পুষ্ট একটি বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই বাহিনীর নামকরণ করা হয় “জয়বাংলা বাহিনী।” ওই দিনে আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক লীগ পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে অভিবাদন দেবার কর্মসূচি গ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ছাত্রলীগের মাধ্যমে তাকে গার্ড অব অনার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। ইতােমধ্যে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে প্রায় একাধিপত্য অর্জন করে ফেলে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র।
 
——————————–
১৭, পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) সাধারণ সম্পাদক।
১৮. পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ।
ইউনিয়নের (ডাকসু) সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব(১৯) স্বাধীনতার প্রেরণায় সিক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের ছাত্রফ্রন্টের নেতৃত্বে এসে যান। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়  ৭ জুনে “জয়বাংলা বাহিনী” শহীদ মিনার থেকে পূর্ণ সামরিক কায়দায় যাবে পল্টন  ময়দানে। সেখানে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের মাঝে মঞ্চে দণ্ডায়মান শেখ মুজিবকে জানাবে অভিবাদন । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মার্চ মিছিলের নেতৃত্ব দেবেন আ স ম আবদুর রব ও হাসানুল হক ইনু। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানানাে হয় না পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের (ডাকসু) সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখনকে। কেননা, আগাগােড়াই তারা স্বাধীন বাংলাদেশের বিরােধিতা করে এসেছেন। তাদের বিরােধিতার বিষয়টি আমরা পরে দেখতে পাব। ৭ জুনকে সামনে রেখে “জয়বাংলা বাহিনী গঠন এবং মার্চ মিছিল সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবকে অবহিত করে। কিন্তু তার হাতে “জয়বাংলা বাহিনী”র পতাকা (পরবর্তীতে যা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় পরিণত হয়) তুলে দেয়া হবে, সে সম্পর্কে কোন কিছুই বলা হয় না। আসলে পতাকাটি একটি আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফসল।
৬ জুন রাতে ইকবাল হলের(২০) ১১৮ নম্বর কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় একটি আলােচনা সভা। তাতে উপস্থিত ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মণি) (২১) এরা সবাই ছিলেন স্বাধীন বাংলা। বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। সভায় শেখ মুজিবকে পতাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পতাকার ডিজাইন কেমন হবে এবং তার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বক্তব্য রাখা হয়। সবুজের ভেতর লাল সূর্য হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতীক। রক্তবর্ণ সূর্যের মাঝে বাংলাদেশের মানচিত্র বসিয়ে দেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয় এইভাবে যে, এই আন্দোলনের সঙ্গে পশ্চিম বাংলা কিংবা ভারতের সঙ্গে কোন যােগসূত্র নেই । অথবা যুক্তবাংলা আন্দোলনের সঙ্গেও এর কোন সংশ্রব নেই। আলােচনা চলাকালীন হাসানুল হক ইনু ছিলেন পাশের রুমে । তাকে ডেকে আনা হয় এবং তার ওপর পতাকার ডিজাইন তৈরি এবং বানিয়ে আনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ওই দিন সকালে কুমিল্লার তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা শিব নারায়ণ দাস এসে উঠেছিলেন ইকবাল হলে । তিনিও ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। তার আসাটা ছিল নিতান্তই কাকতালীয় । শিব নারায়ণ দাস আঁকতে-জুকতে পারতেন ভাল । হাসানুল হক ইনু তার সাহায্য চান। তিনি সাদা কাগজের ওপর পতাকার নক্সা এঁকে দেন। এরপরের কাজ দর্জির কাছে যাওয়া ।।
 
———————————-
১৯. পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (রব) সভাপতি এবং প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে | জাতীয় সংসদের বিরােধীদলের নেতা।
২০, পরবর্তীকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ।
২১, পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় অফিস ৪২, বলাকা ভবনের লাগােয়া কক্ষ ছিল নিউ পাক ফ্যাশান টেইলার্স। এই সূত্রেই দোকানের ম্যানেজার মােহাম্মদ নাসিরউল্লাহর সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীদের পরিচয়। এই টেইলারিং শপ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতারা তাদের পরিধেয় তৈরি করিয়ে নিতেন। দোকানটির মালিক ছিলেন মােহাম্মদ নাসিরউল্লাহর ভগ্নীপতি মােহাম্মদ হাসেম । ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তারা পশ্চিম বাংলার কলকাতা থেকে চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এই ‘নিউ পাক ফ্যাশান টেইলার্স’ থেকেই তৈরি হয় “জয়বাংলা বাহিনী” তথা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটি। ১-১৪ এপ্রিল, ১৯৮৯ সালের পাক্ষিক তারকালােক-এ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের অন্যতম নেতা কাজী আরেফ আহমেদ ‘ছাত্রলীগের তিন দশকের ইতিহাস লিখতে গিয়ে পতাকা তৈরি করেন যে দর্জি, তার পরিচিতি সম্পর্কে বলেছেন “যে দর্জি এই পতাকা তৈরি করে, সে অবাঙালি ছিল। সে তখন এই পতাকার ইতিবৃত্ত না জেনেই পতাকা তৈরি করেছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর ওই দর্জি পাকিস্তানে চলে যায়।” কাজী আরেফ আহমেদের বক্তব্যকে বানােয়াট কাহিনী বলা ছাড়া উপায় নেই। কেননা, নাসিরউল্লাহ এবং পতাকার কাটিং ও সেলাই যিনি করেন, আবদুল খালেক মােহাম্মদী, দু’জনের কেউই অবাঙালি নন। এরা খাটি বঙ্গজ সন্তান— একজন পশ্চিম বাংলার এবং অপরজন এই বাংলাদেশেরই । পাতার কাটিং ও সেলইয়ের কাজ করার সময় তারা ভালােভাবেই জানতেন কি করছেন তারা। শুধু আওয়ামী লীগেরই সমর্থক ছিলেন না তারা, শেখ মুজিবেরও ছিলেন ভক্ত।
মােহাম্মদ নাসিরউল্লাহ পশ্চিম বাংলার মানুষ হলেও বিয়ে করেন ঢাকার বিক্রমপুরে। ওই সময় তার বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায় আর আবদুল খালেক মােহাম্মদীর পঁচিশ। টাঙ্গাইল জেলার মানুষ তিনি। এরা দু’জনেই এখনাে বেঁচে আছেন । নাসিরউল্লাহ ছাত্রলীগের সবার কাছে ছিলেন ‘মামা’। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটি তৈরির ইতিবৃত্ত মােহাম্মদ নাসিরউল্লাহ ও আবদুল খালেক মােহাম্মদীর ভাষ্যে তুলে ধরা হচ্ছে “হাসানুল হক ইনু এবং শিব নারায়ণ দাস রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে আমাদের দোকানে আসেন। দোকানের মালিক এবং অন্যান্য কর্মচারী ততক্ষণে যে যার ঘরে চলে গেছে। হাসানুল হক ইনু ও শিব নারায়ণ দাস কাগজের ওপর আঁকা ছাত্রলীগের পতাকার একটি ও বাংলাদেশের পতাকার আরেকটি না দেখিয়ে এবং সাইজের কথা বলে জানতে চাইলেন কোন রঙের কাপড় কতটুকু লাগবে। আমরা কাপড়ের পরিমাণ বলে দিতে তারা বেরিয়ে গেলেন এবং নিউমার্কেট থেকে লেডি হ্যামিলটন কাপড় নিয়ে ফিরলেন । আমরা কাজ শুরু করি রাত বারােটার পর । শুরুর আগে দোকানে প্রবেশের প্রধান গেটের গ্রিল টেনে তালা মেরে দিই। কাপড়ের কাটিং শেষ হলে হাসানুল হক ইনু ও শিব নারায়ণ দাস বাইরে চলে যান। ঘণ্টা খানেক পর আবার ফিরে আসেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কাজ দেখেন। ভাের চারটার দিকে দুটো পতাকার কাজ শেষ হয়ে যায়। তারা নিয়ে চলে যান।”
কাটার আগে কাপড়ের ওপর পতাকার নক্সা করেন আবদুল খালেক মােহাম্মদী তিনিই কাটেন এবং প্রথম সেলাইটা তিনিই করেন। এ সময় মােহাম্মদ নাসিরউল্লাহ বাইরের গেটের তালা মারা গ্রিলের প্রহরায় থাকেন দ্বিতীয় সেলাই অর্থাৎ উল্টো সেলাইটা করেন মােহাম্মদ নাসিরউল্লাহ এবং ডেলিভারি দেন তিনি। তারা এই পতাকা তৈরির মজুরিও নেন না। ৭ জুনে “জয়বাংলা বাহিনী” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্চ মিছিল করে যায় পল্টন ময়দানে। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন আ স ম আবদুর রব ও হাসানুল হক ইনু। আ স ম আবদুর রবের হাতে ছিল ‘জয়বাংলা বাহিনীর পতাকা- গােটানাে অবস্থায়। আর হাসানুল হক ইনুর হাতে ছিল ছাত্রলীগের পতাকা। পল্টন ময়দানে অভিবাদন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলেন শেখ মুজিব তার দুপাশে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ ও কাজী আরেফ আহমেদ মার্চ মিছিল অভিবাদন মঞ্চের কাছে পৌছলে আ স ম আবদুর। রব দণ্ডে গােটানাে পতাকাটি হাঁটু গেড়ে শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেন ।শেখ মুজিব সেটা গ্রহণ করেন এবং কিছুটা খুলে আবার গুটিয়ে ফেলে আ স ম রবের হাতে ফেরত দেন। অথচ শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে ভিন্ন কথা বলেছেন কাজী আরেফ আহমেদ।১-১৪ এপ্রিল ১৯৮৯ সালের তারকালােক-এ তিনি বলেন “৭ই জুন ভাের থেকেই মুষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। বাংলাদেশের প্রথম পতাকা পলিথিনের কাগজে মুড়িয়ে আমি পল্টন ময়দানে গেলাম । শেখ মুজিবের ডান পাশে আমি পলিথিনে মােড়ানাে পতাকা নিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম । শেখ মুজিব আমার হাত থেকে পতাকাটা নিয়ে খােলা অবস্থায় উপস্থিত জনতাকে প্রদর্শন করে রবের হাতে প্রদান করেন।
কিন্তু মার্চ মিছিলে ছাত্রলীগের পতাকা যিনি বহন করেছিলেন, হাসানুল হক ইনু, তিনি আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “আ স ম আবদুর রবই ‘জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেন। ওই দিন পল্টন ময়দানে ছিলেন শিব নারায়ণ দাস । তিনি আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন। এ বিষয়ে আলাপ করি আ স ম আবদুর রবের সঙ্গেও। আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শেখ মুজিবের হাতে ‘জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা তিনিই তুলে দেন। মার্চ মিছিলের পর আ স ম রব সংরক্ষণের জন্য পতাকাটি তুলে দেন হাসানুল হক ইনুর হাতে । ৭ জুনের পর ঢাকা নগর ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটে মার্চ মিছিল করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। প্রথম মার্চ মিছিলটি করার কথা ছিল ঢাকা কলেজে । মিছিলের জন্য হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে ‘জয় বাংলা বাহিনীর পতাকাটি নিয়ে আসেন তৎকালীন ঢাকা নগর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মােহাম্মদ জাহিদ হােসেন। কিন্তু মার্চ মিছিলের সিদ্ধান্তটি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীন বাংলার পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপকে সরাসরি মুখােমুখি এনে দাঁড় করায় । তাই ছাত্রলীগের ভাঙন রােধে মার্চ মিছিলের সিদ্ধান্ত পরিত্যক্ত হয় এবং ‘জয় বাংলা বাহিনীর পতাকাটি রয়ে যায় শেখ মােহাম্মদ জাহিদ হােসেনের কাছে । ৭ জুন মার্চ মিছিলের পর স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ স্বাধীনতার প্রশ্নে আরাে বেশি অনমনীয় ও আপােসহীন হয়ে ওঠে এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে স্বাধীনতার প্রশ্নে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি এনে দাঁড় করায়। ৭ ডিসেম্বরে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া সম্পর্কিত প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়ার ঘােষণার তিন দিন আগে ১৯৭০ সালের ২২ আগস্ট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই দিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বিপ্লবী পরিষদ স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেয়। তৎকালীন চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক স্বপন চৌধুরী কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ জন ।
সংখ্যাগুরু অংশ ছত্রিশ জন ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। এরা সবাই প্রস্তাবের পক্ষে ভােট দেন। বাকি ৯ জন এদের মধ্যে ছিলেন নুরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দস মাখন, শেখ শহীদুল ইসলাম(২২) প্রমুখ প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। এরা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণির কট্টর অনুসারী। ওই দিন কেন্দ্রীয় কমিটির সভা পরিচালনা করছিলেন সংগঠনের সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী । স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব বিপুল ভােটে অনুমােদিত হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। চলে যান শেখ মুজিবের কাছে। প্রস্তাব অনুমােদন রােধের আবেদন নিয়ে। তিনি আর সভাকক্ষে ফিরে আসেন নি । সভাপতির অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভার কাজ আবার শুরু হয় এবং স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুমােদিত হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি যখন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই সময় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের অন্যতম নেতা আবদুর রাজ্জাক মারফত শেখ মুজিব এই প্রস্তাবের প্রতি তার আপত্তির কথা জানিয়ে দেন । তিনি প্রস্তাব গ্রহণকারীদের ওপর রীতিমত রুষ্ঠ হয়ে ওঠেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি গৃহীত স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাবের প্রতি শেখ মুজিবের বিরােধিতা সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক এর সত্যতা স্বীকার করেছেন আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে । তবে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন “তিনি (শেখ মুজিব) বলেছিলেন কৌশলগত কারণে তােমরা এমন একটি প্রস্তাব নাও যাতে সবটাই বােঝায়। আমরা স্বাধীনতার পক্ষে এটা যেমন বােঝায়, তেমনি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ যাতে না হয় সে ব্যবস্থাও রাখ । তার মানে এই নয় যে, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের বিরােধিতা করা হয়েছে।” ১২ আগস্ট ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুমােদিত হয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পড়ে বিপাকে। তাদের শক্তির
—————————————
২২. পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারের মন্ত্রী।
অন্যতম উৎস ছাত্রলীগ স্পষ্টতই দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে শেখ মুজিবের ছয় দফাপন্থী, অপরদিকে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ পন্থীরা। ছয় দফাপন্থী ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন নুরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদুস মাখন। এদেরকে বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিতে থাকেন শেখ ফজলুল হক মণি ও তােফায়েল আহমদ । আর এক দফাপন্থী অর্থাৎ স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী ছাত্রলীগ কর্মীদের নেতৃত্বে চলে আসেন আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ। বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিতে থাকেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের ত্রয়ী নেতৃত্ব সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ।

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক

 

 

 

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!