ছাত্রসমাজে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করে শেখ মুজিবর রহমান ধাপে ধাপে সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে চূড়ান্ত শীর্ষে উপনীত করেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন বটে, কিন্তু ছয় দফার ফাদেও আটকে যান। তারই নেতৃত্বের ছায়ায় নিখাদ জাতীয়তাবাদী চেতনায় সিক্ত হয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা স্বাধীনতাকামী এক দফা পন্থীদের সরাসরি মুখােমুখি হন তিনি যখন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত সংক্রান্ত বার্তাটি রাওয়ালপিণ্ডি থেকে পাবার পর শেখ মুজিবকে জানানাের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর এস এম আহসান ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তাকে গভর্নমেন্ট হাউজে ডেকে পাঠান। গভর্নমেন্ট হাউজে গভর্নর আহসান শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডির বার্তাটি জানিয়ে দেন। আলাপ আলােচনা শেষে গভর্নমেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আসার আগ মুহূর্তে শেখ মুজিব গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে বলেন “আমার অবস্থা দুপাশে আগুন, মাঝখানে আমি দাড়িয়ে। হয় সেনাবাহিনী আমাকে মেরে ফেলবে, না হয় আমার দলের ভেতরকার চরমপন্থীরা আমাকে হত্যা করবে। কেন আপনারা আমাকে গ্রেফতার করছেন না? টেলিফোন করলেই আমি চলে আসব ।(১) শেখ মুজিব যাদেরকে চরমপন্থী বলেছেন তারাই এক দফাপন্থী, তার দলেরই ভেতরকার দ্বিতীয় স্তরের ব্যাপক অংশ জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং শােষণহীণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ব্যাপক তরুণ সমাজ। এরাই নেয় সশস্ত্র প্রতিরাধ সংগঠনের প্রস্তুতি। তাই আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাড়িয়ে যারা উচ্চকণ্ঠে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একাত্তরের সশস্ত্র প্রতিরােধে প্রস্তুতি নিয়েছিল, সেই উচ্চকণ্ঠ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা, আওয়ামী লীগের শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্যই তাকে সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনে। মূলত আওয়ামী লীগ ছিল তৎকালীন উদীয়মান বাঙালি ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধি। আর ছয় দফা ছিল সেই উদীয়মান ধনিক শ্রেণীর
———————————
১. লেখক অনূদিত সিদ্দিক সালিকের নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৫৬
বিকাশের সনদ । তাই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের রাজনীতি ছিল ছয় দফার মাধ্যমে ভােট যুদ্ধে জিতে ক্ষমতায় যাওয়া । আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সশস্ত্র প্রতিরােধ না চাইলেও দলগত ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থা তাদের অনুকূলে ছিল না। নানান মতের সমাবেশ ঘটেছিল আওয়ামী লীগের ভেতর। বিভিন্ন মতধারার মাঝে ছিল দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটে পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রে থাকার প্রশ্নে । দ্বিতীয় স্তরের ব্যাপক অংশ যাদের নেতৃত্বে ছিল একদল তরুণ, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে থেকে বেরিয়ে আসার প্রশ্নে এরা ছিল অনমনীয়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই মতধারার অনুসারীরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের ভেতর এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে তাদের পুরােপুরি উপেক্ষা করা আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এমনকি শেখ মুজিবের পক্ষেও এদের শক্ত ভিত নড়ানাে দুষ্কর ছিল। শেখ মুজিব কথিত এই চরমপন্থীরা ছাত্র লীগের অভ্যন্তরে সংগঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী। পরিষদের গােপন নেতৃত্বে। যদিও ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত চিত্তরঞ্জন সুতার ও কালিদাস বৈদ্যের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের তৎপরতা শুরু হয় ১৯৬২ সালে, ছাত্রসমাজের মধ্যে এই সংগঠনটি গড়ে ওঠে ১৯৬৪ সালে। ওই বছর জুলাই মাসে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ মূলত গঠিত হয় সিরাজুল আলম খানের(২) নেতৃত্বে। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক। আবদুর রাজ্জাক(৩) তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক।
তাকে এবং তৎকালীন ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা কাজী আরেফ আহমেদকে(৪) নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের তিন সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় সেল। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কেন্দ্রীয় সেল তৈরি সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাক আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন :“তিনি (সিরাজুল আলম খান) প্রস্তাবটি প্রথম উত্থাপন করেন। বলেন, এস আমরা একটা কিছু করি । আমরা আলাপ-আলােচনা করতাম ইকবাল হলের(৫) মাঠে বসে। তাে সেখানেই আমাদের মধ্যে আলাপ হত যে, সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। সেইজন্য আমরা নিজেদেরকে সংগঠিত করি । এই চিন্তা নিয়ে আমরা শুরু করি এবং চিন্তা-ভাবনা। করি পরবর্তী লােক কাকে নেব । ঠিক করি কাজী আরেফকে আমরা সঙ্গে নিতে পারি । কাজী আরেফের সঙ্গে আগেই তার (সিরাজুল আলম খান) আলাপ হয়েছিল। অবশেষে তাকে নিয়ে নেয়া হয়। তিনজনের এই কমিটি গােপনে স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে
———————————————
২. পরবর্তীতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা, এ দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের অন্যতম।
৩. পরবর্তীতে শেখ মুজিবের সময় জাতীয় সংসদ সদস্য। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের অন্যতম।
৪. পরবর্তীতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা।
৫. পরবর্তীতে সাঙেন্টি জহুরুল হক হল।
রেখে কাজ শুরু করে। কমিটি তার আরম্ভকাল থেকে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় কাজ করে এসেছে বলে এর অস্তিত্ব লােকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। আর এ কারণেই পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা এ সংগঠনের খবরা-খবর কিছুই জানতে পায়নি। অবশ্য চিত্তরঞ্জন সুতার ও কালিদাস বৈদ্যের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের খবর তাদের অজানা ছিল না । স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ কেন্দ্রীয় সেলের তিন সদস্য নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নেন এইভাবে, সিরাজুল আলম খান, শ্রমিক ফ্রন্ট; আবদুর রাজ্জাক,—শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের মধ্যে যােগাযােগ এবং কাজী আরেফ আহমেদ,ছাত্রফ্রন্ট ও ছাত্রলীগ । কেন্দ্রীয় সেল কর্মী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ধাপে ধাপে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং কাজ শুরু করে দেয় স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কাজে নামার পরই তাদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা বিকাশ লাভ করে ধীরে ধীরে। অবশ্যি মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের অন্যতম তােফায়েল আহমদ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করেছেন। আমাকে দেয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন :“স্বাধীন বাংলা পরিষদ নামে কোন কিছুই গঠন করা হয় নি । যারা এ সম্পর্কে ইন্টারভিউ দিয়েছেন তারা ছাড়া এদেশের কেউই এই সংগঠনটির অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।” তােফায়েল আহমদ কেন, মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের আরেকজন শেখ ফজলুল হক মণি, তিনিও জানতেন না এ সংগঠনটির খবর। কারণ, তাদেরকে আস্থায় আনতে পারেন নি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নেতৃবৃন্দ। আবদুর রাজ্জাক যিনি ছিলেন মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের অন্যতম, আমাকে বলেন “না, জানতেন না। জানানাে হয়নি। কেননা, এটা তাে আমাদের সংগঠন ছিল, গােপন সংগঠন।
তাদের সঙ্গে আমরা আলাপ করিনি বিভিন্ন কারণে। যেমন শেখ ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই ছিল। সেটা অতীত থেকে চলে আসছিল। তােফায়েল আহমদের তখনাে অতােটা পরিপক্কতা আসেনি।” আবদুর রাজ্জাক যে কথা অনুক্ত রেখেছেন, তা হলাে, শেখ ফজলুল হক মণি ও তােফায়েল আহমদকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি মতাদর্শগত কারণে । মতাদর্শগত বিরােধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৭০ সালের অগাস্ট মাসে,যখন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণ করে। শেখ মুজিব এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। শেখ ফজলুল হক মণি ও তােফায়েল আহমদ শেখ মুজিবকেই সমর্থন করেন। ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠনকালে কেন্দ্রীয় সেলের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার । কর্মী। সংগ্রহে নেমে কেন্দ্রীয় সেলকে প্রথম যে প্রশ্নের মুখােমুখি হতে হয় – সেটা হল, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পর কি হবে? শুধু পতাকা বদলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে না। পাকিস্তানি একচেটিয়া পুঁজির শােষণ ও নিপীড়ন উৎখাত করে বাঙালি পুঁজির শােষণ ও নির্যাতনকে বহাল করার জন্য অযুত প্রাণের বলিদান হতে পারে না। পাকিস্তানি শাসন ও শােষণের চব্বিশ বছরের অভিজ্ঞতার আলােকেই এ প্রশ্নটি ওঠে আসে কর্মীদের সামনে। আর এ প্রশ্নই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যুক্ত করে ও শােষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলা চেতনার উন্মেষ ঘটায় । এবং যে সময় থেকে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক বাংলার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ, তখন থেকেই তার কর্মী সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় এক গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয় ।
তীব্র স্বদেশ প্রেম উদ্বুদ্ধ এবং শােষণমুক্ত বাংলার স্বপ্নে লালিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একাংশের অমিততেজা তরুণরা এর পতাকাতলে এসে সমবেত হতে থাকে। কেন্দ্রীয় সেল সশস্ত্র যুদ্ধেরু মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের দীক্ষা। দিতে থাকে এই তরুণদের। এ কথা এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯৬৮-১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের আগ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের বিস্তৃতি তেমন ব্যাপক হতে পারেনি। সশস্ত্র যুদ্ধের প্রােগ্রাম থাকলেও অস্ত্র সংগ্রহ ও ট্রেনিংয়ের বিষয়টি তেমন জরুরি হয়ে ওঠেনি তখনাে। এ বিষয়টি আসে আরাে পরে। অথচ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নেতা কাজী আরেফ ছাত্রলীগের ইতিহাস আলােচনা করতে গিয়ে ১৯৮৯ সালের ১৪ এপ্রিলের পাক্ষিক তারকালােকে বলেন :’৬৫ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের ৪০ জন সদস্যকে বিদেশে সামরিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এই ৪০ জন সদস্যকে নির্বাচিত করে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠাবার কথা ছিল। এ ব্যবস্থা শেখ মুজিব আমাদের কর্মীদের জন্য করেছিলেন। এই ৪০ জন সদস্যকে পাঠানাের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়েছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ইন্দোনেশিয়ায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন ঘটেছিল। সুকানোকে ক্ষমতাচ্যুত করে সুহার্তো ক্ষমতা দখল করে। তাই ট্রেনিংয়ে পাঠানাে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সম্ভবত শেখ মুজিব সে সময় জাকার্তায় নিযুক্ত বাঙালি কূটনীতিক শামসুর রহমান খানকে দিয়ে ব্যবস্থা করেছিলেন। কাজী আরেফ বর্ণিত কূটনীতিক হলেন সিএসপি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী শামসুর রহমান খান। তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলি। তিনি আমাকে দেয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেন “১৯৬৫ সালে জাকার্তায় আমি ছিলাম না । জাকার্তায় যাই ১৯৬৭ সালে ইন্দোনেশিয়া-পাকিস্তান ইকনমিক কালচারাল কো-অপারেশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল হয়ে, কূটনীতিক হিসেবে নয়।”
ওই বছর ইন্দোনেশিয়া-পাকিস্তান ইকনমিক কালচারাল কো-অপারেশন নামে দু’দেশ বন্ধুত্ব ও সহযােগিতামূলক একটি সংস্থা গঠন করে। সংস্থার বিধিবদ্ধ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রথম তিন বছরের জন্য সেক্রেটারি জেনারেল হবে ইন্দোনেশিয়া এবং পরের | তিন বছর হবে পাকিস্তান। পাকিস্তান সরকার শামসুর রহমান খানকে ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল করে পাঠায়। তাছাড়া ১৯৬৯ সালের আগ পর্যন্ত শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের। অস্তিত্বের কথা জানতেন না। তাকে জানানাে হয়নি । আবদুর রাজ্জাক বলেন “১৯৬৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আইউবের জেল থেকে বেরিয়ে এলে আমি আর সিরাজুল আলম খান তার সঙ্গে দেখা করি। আমাদের পরিকল্পনা তাকে খুলে বলি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী। পরিষদের অস্তিত্বের কথা তখনই তাকে জানাই। তাকে বলি আপনি আমাদের সর্বাধিনায়ক।” অতএব, এটা পরিষ্কার যে শেখ মুজিব ১৯৬৫ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের অস্তিত্বের কথা জানতেনই না। সুতরাং ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য শেখ মুজিব লােক পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন বলে কাজী আরেফ যে কথা বলেছেন, সেটা তার মনগড়া। তাছাড়া, সে সময় ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে বন্ধুতা বিরাজমান ছিল তার প্রেক্ষিতে বলতেই হয়, তকালীন প্রেসিডেন্ট সুকানো ইন্দোনেশিয়ার মাটিতে পাকিস্তান ভাঙার জন্য পূর্ব পাকিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণদানের অনুমতি দেবেন, এ কোনভাবেই বিশ্বাস্য নয় । ১৯৬৪ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বিপ্লবী বাংলা নামে সাইক্লোস্টাইল করা একটি গােপন পত্রিকা বের করে। পরপর তিনটি সংখ্যা বের করার পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তারা আর কোন পত্রিকা বের করেনি। কিন্তু কর্মী সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করলে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ তার লক্ষ্য স্থির করে ফেলে। তারা ছয় দফাকে এক দফায় পরিণত করার তৎপরতায় নেমে পড়ে। কিন্তু ১৯৬৮-১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের আগ পর্যন্ত তাদের তেমন অগ্রগতি সাধিত হয় না। গণআন্দোলনের সময়কালেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ব্যাপক অংশ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নেতৃত্বাধীনে চলে আসে। স্বাধীনতার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ব্যাপক অংশের ঝুঁকে পড়া স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের নিরবচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতার ফল যদিও, কিন্তু সংগঠন বহির্ভূত রাজনৈতিক প্রভাব স্বাধীনতার প্রতি তাদের ঝুঁকে পড়ায় গতি সঞ্চার করে। এ বক্তব্যকে আরাে পরিষ্কার করে বলা যায় এইভাবে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের যে তরুণদের মনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশ্নে দোদুল্যমানতা ছিল, সংগঠন বহির্ভূত রাজনৈতিক প্রভাব, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ১৯৬৮-৬৯ সালের গণআন্দোলনের তােড় তাদের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে।
সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক