১৯৭০ সালের নির্বাচন, শেখ মুজিব এবং সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্র
৫ অক্টোবর থেকে ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন পিছিয়ে গেলে আওয়ামী লীগ নির্বাচন প্রচারণার জন্য আরাে সময় হাতে পায়। ছয় দফাপন্থী ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের বিজয় অর্জন অভিযানে নেমে পড়ে। আর এক দফাপন্থী ছাত্রলীগ নির্বাচনী প্রচারণাকে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সুযােগ হিসেবে গ্রহণ করে। এই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের জন্য, যারা নির্বাচন বিজয়ের প্রশ্নে ছিলেন এক প্রকার নিশ্চিত এবং নির্বাচনের পর পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বসার স্বপ্ন দেখছিলেন, তাদের জন্য তৈরি করে এক দারুণ নাজুক অবস্থা। তাদের জন্য আরাে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিং) ভেতরকার বাপন্থীরা। ২ অক্টোবর, ১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন এক প্রচারপত্রে বলে “শাসকগােষ্ঠী ও সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনী ষড়যন্ত্র ছিন্ন করিয়া গ্রামে গ্রামে গড়িয়া তুলুন তীব্র শ্রেণী সংগ্রাম, সৃষ্টি করুন সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্নিকণা… যাহা পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করিবে শোষণহীণ এক নতুন রাষ্ট্র-জনতার রাষ্ট্র, জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ।(১) পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে প্রায় সমান তালে এগােতে থাকে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগসহ অপরাপর সকল দল ৭ ডিসেম্বরের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে নির্বাচনী প্রচরণাকে জোরদার করতে সকল শক্তি নিয়ােগ করে। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচনে নামার প্রস্তুতিতে মনােনয়ন দেয়। কিন্তু নির্বাচন তারিখের ঠিক চব্বিশ দিন আগে ১২ নভেম্বর, ১৯৭০ সলে দক্ষিণ বাংলার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ইতিহাসের এক প্রলয়ঙ্করী ঘূণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বিস্তীর্ণ জনপদ। প্রাণ হারায় তিন লাখ আদম সন্তান। লাখ লাখ নর নারী হয়ে পড়ে নিঃসহায়, সম্বলহীন। সারা বিশ্বের মানুষ ছুটে আসে আর্ত মানবতার সেবায় অথচ পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার প্রদর্শন করে চরম উদাসীনতা। দুর্গত মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি প্রকাশ করে না। পাঠায় না কোন সাহায্য।
———————————————–
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, ৫৫০।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) অভ্যন্তরে কাজী জাফর, রননা, মেননের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি প্রভাবিত ছিল এই ছাত্র সংগঠনটি। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অমানবিক আচরণে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা পূর্ব বাংলা। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) সভাপতি মওলানা ভাসানী কেন্দ্রীয় সরকারের এই হৃদয়হীন আচরণের জবাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহবান জানিয়ে এক প্রচারপত্রে বলেন “আজ হইতে ১৩ বৎসর পূর্বেই ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, শশাষণ আর বিশ্বাসঘাতকতার নাগপাশ হইতে মুক্তিলাভের জন্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে। “আচ্ছালামু আলাইকুম” বলিয়াছিলাম। হয়ত বাঙালী সেদিন নাটকের সব কটি অংক বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। আমি আশা করি, সচেতন শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন কোন বাঙালীকে বুঝাইতে হইবে না যে, মানবতা বর্জিত সম্পর্কের মহড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠিয়াছে । এইবার নেমেসিসের সমুচিত শাস্তি বিধানের অপেক্ষায়ই আমরা আছি অন্যদিকে ঘূণিঝড়ের প্রেক্ষিতে নির্বাচন পেছানাের দাবি ওঠে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ফলে মওলানা ভাসানী নির্বাচন বয়কটের ঘােষণা দেন। ইয়াহিয়া খান ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের দেখতে আসেন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে যখন আর আসার কোন প্রয়ােজনই ছিল না। এই সফরে তার সঙ্গী ছিলেন সেনাবাহিনীর চিফ অব। স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান। ঢাকায় অবস্থানকালে ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের তিন তিনটি গােপন বৈঠক হয় । ইয়াহিয়ার যােগাযােগ মন্ত্রী জি ডবলিউ চৌধুরীর ভাষায় ওই বৈঠকের পরিবেশে।
ছিল নভেম্বরের হালকা শীতের আমেজ। বৈঠক শেষ হওয়ার পর ইয়াহিয়া জি ডবলিউ চৌধুরীকে ডেকে পাঠান। বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে তাকে “উফুল্ল চিত্তে বলেন “নির্বাচন স্থগিত না করার তার সিদ্ধান্ত সঠিক ও দূরদর্শীসম্পন্ন।” অতএব, নির্বাচন ৭ ডিসেম্বরেই বিধিবদ্ধ থাকে । ইয়াহিয়ার এই উৎফুল্লচিত্ততার কারণ আমরা। পরে জানতে পাব-নির্বাচনের পর শেখ মুজিবের সঙ্গে তার ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারির বৈঠকে। ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের পরিদর্শন ও শেখ মুজিবের সঙ্গে গােপন বৈঠক শেষে ৩ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া ঢাকা থেকে রাওয়ালপিণ্ডি ফিরে যান। কিন্তু ইতােমধ্যে শাসন ক্ষমতায় হাত বদল ঘটে যায়। ঢাকায় তার অবস্থানকালেই গুজব রটে যে, ইয়াহিয়া খানের হাতে আর ক্ষমতা নেই । চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান ঢাকাতে প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হয়ে এলেও তারই নেতৃত্বে সামরিক জান্তা সকল ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে । ইয়াহিয়া এখন কার্যত সামরিক জান্তার হাতের পুতুল মাত্র । যদিও তিনি ৩ ডিসেম্বর করাচিগামী বিমানে ওঠার আগে ঢাকা বিমান বন্দরে এক বিদেশী
——————————————–
২, ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে বক্তৃতাদানকালে তিনি পশ্চিম।
পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে এ কথা বলেন।
৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা -৫৭৮
৪. জি ডবলিউ চৌধুরী দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-১০১।
৫. প্রাগুক্ত।
৬. প্রাগুক্ত।
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ওই গুজবকে অস্বীকার করেন কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলীর ভাষ্যে গুজবের সত্যতা প্রতিপাদিত হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণায় পূর্ব বাংলায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, সে সম্পর্কে তাকে জ্ঞাত করতে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজার অনুরােধে গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ১ মার্চ রাতেই রাওয়ালপিণ্ডি রওনা হন। ৩ মার্চ তিনি ইয়াহিয়ার সাক্ষাৎ লাভ করেন। প্রেসিডেন্ট হাউজের লাউঞ্জে পা দিতেই যে দৃশ্য তার চোখে পড়ে, তাতে তিনি হতবাক হয়ে যান। তার ভাষায় “পরদিন বেলা এগারটায় প্রেসিডেন্ট হাউজে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা হলাে । লাউঞ্জে বসে জেনারেল হামিদ, মি ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট মদ্যপান করছিলেন। সামনের টেবিলের ওপর ইয়াহিয়া ও হামিদ দুজনে পা তুলে বসেছিলেন(৭) এই দৃষ্টান্তই বলে দেয়, নির্বাচনের আগ থেকেই ইয়াহিয়াকে ক্ষমতা হারিয়ে প্রায় পুতুল হয়ে প্রেসিডেন্টের গদিতে বসে থাকতে হয় জাস্তা যেভাবেই চায়, তাকে তখন থেকে সে পথেই চলতে হয়। কিন্তু শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ওই গুজব বিশ্বাস করেন নি বলেই নির্বাচনের পর তারা ইয়াহিয়াকে আশ্বাস দেন যে ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাকেই তারা প্রেসিডেন্ট রাখবেন । তাই হামলা আসছে জানতে পেয়েও শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার ওপর ভরসা করেই ১৯৭১ সালের মার্চের আলােচনা চালিয়ে যান। অপরদিকে নির্বাচনে বিজয়ী হলে আওয়ামী লীগের হাতে তথা বাঙালির কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা তুলে দেবে না সামরিক জান্তা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) সভাপতি মওলানা ভাসানী তা জানতেন। তাই নির্বাচনের দু’দিন আগে ৫ ডিসেম্বর পল্টনের এক জনসভায় শেখ মুজিবের প্রতি স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যােগ দেবার আহবান জানিয়ে বলেন “মুজিব তুমি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সংগ্রামে যােগ দাও। যদি আমেরিকা ও ইয়াহিয়ার স্বার্থে কাজ কর তাহলে আওয়ামী লীগের কবর ‘৭০ সালেই অনিবার্য।(৮) ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল হতভম্ব করে দেয় সামরিক জান্তাকে। হতবাক হবার কারণ,সামরিক জান্তার হিসেব ছিল কোন দলই জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। অতএব, কোয়ালিশন সরকার আসবে কেন্দ্রে। ক্ষমতা প্রকারান্তরে জান্তার হাতেই থেকে যাবে। সামরিক জান্তা এই হিসেব করে তার নিজস্ব গােয়েন্দা সূত্র প্রস্তুতকৃত তথ্য থেকে। নির্বাচনের আগে দলগত
————————————–
৭. মােস্তফা হারুন অনুদিত উর্দু ডাইজেস্টে প্রকাশিত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ‘ভুটটো – শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ পৃষ্ঠা-৬০। ৮. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৮৪-৫৮৫।
অবস্থান সম্পর্কে ওই গােয়েন্দা রিপাের্টে কোন দল কতটা আসন পেতে পারে , তা তুলে ধরা হয় এইভাবে “আওয়ামী লীগ ৮০; মুসলিম লীগ (কাইউম) ৭০; কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৪০; ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো ওয়ালী মুজাফফর নেতৃত্বাধীন) ৩৫; পাকিস্তান পিপলস পার্টি ২৫।(৯) অথচ, পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের ১৬০টি পেয়ে যাবে আওয়ামী লীগ আর পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের ৮৮ টি পেতে পারে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পাটি, এ সামরিক জান্তার কষ্ট কল্পনাতেও আসে নি। আওয়ামী লীগের এই ১৬০ আসনের সঙ্গে যুক্ত হবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৭ টি আসন । অতএব, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের মােট আসন দাঁড়াবে ১৬৭। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর পশ্চিম পাকিস্তানে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয় পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি। আওয়ামী লীগের এহেন বিপুল বিজয়ে বিস্ময়ের ঘাের কাটতেই ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পাঁয়তারা কষতে থাকে সামরিক জান্তা। পাঁয়তারা কষা এক বিষয় আর তার প্রয়ােগ আরেক। এর সঙ্গে জড়িত বিপুল বুকি—অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক। অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি নিরসনে তারা বেছে নেয় উচ্চাভিলাসী ক্ষমতালি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখছিলেন নির্বাচনের আগ মুহূর্তেও। তার ক্ষমতালিপ্সাকে ক্ষমতা হস্তান্তর না। করার চক্রান্তে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় জান্তা। আর নির্বাচনী ফলাফলে স্বপ্ন ভঙ্গ ঘটাতে জুলফিকার আলী ভুট্টো তৈরি হয়েই ছিলেন
তাছাড়া আগাগােড়াই তিনি বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার ছিলেন বিরােধী। তার ওই মনােভাবকে স্বচ্ছ ভাষায় তুলে। ধরেছেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এক সময়কার প্রধান এবং তৎকালীন তেহরিকে ইশতিকলাল পাটির সভাপতি মােহাম্মদ আসগর খান তার জেনারেল ইন পলিটিকস গ্রন্থে। পূর্ব বাংলার সমস্যা সমাধানে জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইয়াহিয়া খানকে বলেন “পূর্ব পাকিস্তান কোন সমস্যাই নয়। বিশ হাজারের মতাে লােক মারতে হবে এবং সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।(১০) অতএব, অতি দ্রুত দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যায়। ক্ষমতা যে হস্তান্তরিত হচ্ছে না, তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল ২০ ডিসেম্বর লাহােরের জনসভায় ভুট্টোর ভাষণে । তিনি বললেন “পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি) জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলীয় আসনে বসতে রাজি নয়।(১১) ভুট্টোর এই মন্তব্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সারা পূর্ব বাংলা । এর প্রেক্ষিতে শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (১২)নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুত নির্বাচন সুসম্পন্ন করায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন “তার (ইয়াহিয়ার) অধঃস্তনদের মধ্যে
———————————————-
৯, মােহাম্মদ আইউব ও কে সুব্রামানিয়াম, দ্য লিবারেশন ওয়ার, পৃষ্ঠা-৮৭।
১০. মােহাম্মদ আসগর খান : জেনারেলস ইন পলিটিকস, পৃষ্ঠা-২৮।
১১. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৩১-১৩৩।
১২. পরবর্তীকালে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান।
একটি অংশ সক্রিয়, যারা এখনাে নির্বাচনী ফলাফলকে উল্টে দেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।১৩ শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার যে অধঃস্তনদের কথা ইঙ্গিত করেন, তাদের নিয়েই গঠিত ছিল সামরিক জান্তা। জাস্তার সদস্যরা ছিলেন “জেনারেল আবদুল হামিদ খান, সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস.এম.জি, পীরজাদা, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, কোর কমান্ডার, মেজন জেনারেল ওমর, চেয়ারম্যান, জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি, মেজর জেনারেল আকবর খান, পরিচালক, আস্ত সার্ভিস গােয়েন্দা বিভাগ। এছাড়া দু’জন বেসামরিক ব্যক্তিকে রাখা হয় জান্তায় । এরা হলেন প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমদ ও কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা ব্যুরাের পরিচালক এন এ রিজভি।১৪ বেসামরিক এই দু’ব্যক্তি ইয়াহিয়া খানের একান্ত অনুগত ও বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন। | ভুট্টোর ২০ ডিসেম্বরের ঘােষণায় ইয়াহিয়া খান এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। জটিলতা নিরসনে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনার জন্য ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন। ওই দিন তিন ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠক হয় শুধু তার এবং শেখ মুজিবের মধ্যে। এই বৈঠকেই শেখ মুজিব সরকার গঠনের পর তাকে প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব রাখেন।
মােহাম্মদ আসগর খান তার জেনারেলস ইন পলিটিক্স’ গ্রন্থে বলেছেন। “আলােচনার এক পর্যায়ে শেখ মুজিব ইয়াহিয়াকে বললেন যে, নতুন শাসনতন্ত্র রচনার পর তারা (আওয়ামী লীগ) তাকে প্রেসিডেন্ট করতে চান। এ প্রস্তাবে ইয়াহিয়া খান বিস্মিত হলেন এবং জিজ্ঞেস করেন কেন আপনারা আমাকে প্রেসিডেন্ট করতে চান? শেখ মুজিবর রহমান ব্যাখ্যা দেন যে, তিনি এবং তার দল মনে করে এটাই হবে সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার দু’বছরের অভিজ্ঞতা এবং সেনাবাহিনীতে তার অবস্থানকে সুবিধা হিসেবে কাজে লাগানাে যাবে এবং তিনি (শেখ মুজিব) অনুরােধ করেন প্রস্তাবটি ইয়াহিয়া খানকে গ্রহণ করতে ইয়াহিয়া খানকে রাজি করাতে বেশি জোরাজুরি করতে হল না। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল।১৫ একদিন পর ১৪ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডির পথে করাচিগামী বিমানে ওঠার আগে তেজগাঁও বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন “শেখ মুজিবর রহমান দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।১৬ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে পা দিতেই পরিস্থিতি তার জন্য আরাে জটিল হয়ে ওঠে। চাপ বাড়ে ভুট্টোর । চাপ বাড়ে জান্তার ।
————————————-
১৩. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩৮।
১৪. মােহাম্মদ আইউব ও কে সুব্রামানিয়াম, দ্য লিবারেশন ওয়ার, পৃষ্ঠা- ৯৫।
ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং এর ডাইরেক্টর ছিলেন কে সুব্রামনিয়ম এবং ডক্টর মােহাম্মদ আইউব ছিলেন ওই
ইনস্টিটিউটের সহযােগী গবেষক ও পাকিস্তান বিভাগের প্রধান।
১৫. মােহাম্মদ আসগর খান, জেনারেলস ইন পলিটিকস্, পৃষ্ঠা-২৭।
১৬. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস : প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪৪।
চাপে পড়েন ১৭ জানুয়ারি সিন্ধু প্রদেশে ভুট্টোর লারকানার বাড়িতে তথাকথিত বুনাে হাঁস শিকারে গিয়ে। ভুট্টোর আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন সেখানে। গিয়েছিলেন জান্তার সদস্য জেনারেল হামিদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা প্রমুখ। লারকানার গােপন বৈঠকের পর হাতে যা-ও বা ক্ষমতা ছিল, তাও ছাড়তে হয় ইয়াহিয়াকে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায় ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে না। কিন্তু কিভাবে? কার্যক্রমটা কি হবে? সাধারণ পুলিশী কার্যক্রমে অমিততেজা বাঙালিকে দমানাে যাবে না। বিকল্প হচ্ছে সামরিক হামলা। অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার বদলে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিশ্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। বিশেষত, প্রতিবেশী দেশ ভারত, যে মূলত শত্রুভাবাপন্ন, সে কি ভূমিকা নেবে, সেটা তত পরিষ্কার নয় এবং তা হয়ে দাড়ায় উদ্বেগের বিষয়। তবে জান্তা অনুমান করে, সুযােগ ভারত হয়তাে নেবার চেষ্টা করবে। তাতে পরিস্থিতি আরাে জটিল হয়ে উঠবে এবং সেটা জাস্তার পক্ষে সামলানাে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই হামলা প্রস্তুতি ও আক্রমণ পরিচালনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে । অবশ্যি মার্কিন প্রশাসন জান্তা ও ভুট্টোর দিকে মুখ ফিরিয়েই ছিল । | তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, পাকিস্তান ও ভারতকে সরাসরি যুদ্ধের মুখােমুখি দাঁড় করিয়েও আইউব উৎখাতে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন নামে ছয় দফার মাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় এবং আইউবের পতনের মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রশাসনের কাছে ছয় দফার প্রয়ােজন যায় ফুরিয়ে। কিন্তু যে ছয় দফাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে সিআইএ তথা মার্কিন প্রশাসন, তা ইতােমধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে এক দফায় পরিণত হয়ে যায়।
ছয় দফার এই পরিণতি মার্কিন প্রশাসনের কাছে মােটেই কাম্য ছিল না। কেননা, কদাপিও পাকিস্তানকে খণ্ডিত দেখতে চায়নি সে। অন্যদিকে ছয় দফাকে এক দফার আন্দোলনে পরিণত করতে ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’ পর্দার অন্তরাল থেকে যে পরিকল্পনা এঁটে রেখেছিল, পশ্চিম পাকিস্তানি। শশাষণ, বঞ্চনা, এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে তা ধীরে ধীরে পুষ্ট হয়ে ওঠে। ছয় দফার মধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষ বঞ্চনা ও শােষণ মুক্তির ইঙ্গিত দেখতে পায়, সেটাকে আঁকড়ে ধরে এবং এক অবিনাশী সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে যায় স্বাধীনতা অর্জনের পথে । ‘র’ এই স্বাধীনতাকামী মানুষের আবেগ এবং তার তীব্র সংগ্রামী চেতনাকে কৌশলে নিয়ে আসে নিজের হাতের মুঠোয়। ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম কলকে সাজালাে সিআইএ, টানও দিল এবং নেশার আশ মিটল কিন্তু সুখটানটা আর দিতে পারলাে না। সুখটানটা দেওয়ার আগেই কলকে ছিনতাই করলাে ‘র’। অর্থাৎ ছয় দফা দিয়ে যা করতে চেয়েছিল সিআইএ-তা করেও বটে, কিন্তু যা চায় নি এবং হিসেবেও আসে নি, সেটা ঘটতে থাকে ভেতরে ভেতরে,—তার। ইচ্ছার বাইরে এবং এক সময় সে দেখে তার দেওয়া ছয় দফা আর ছয় দফায় নেই, হয়ে গেছে এক দফা। বাঙালি জনগণ শােষণ মুক্তির লক্ষ্যে ছয় দফাকে করে ফেলেছে এক দফা ।
‘র’ এটাই চাইছিল । সিআইএ ‘র’ এর হাতে খেল বড় রকমের মার । প্রমাদ গােনে মার্কিন প্রশাসন। পাকিস্তানের অঙ্গহানির মধ্য দিয়ে ভারত হয়ে উঠবে আরাে। শক্তিধর। তাকে শক্তিমান হতে দেওয়া যায় না। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্ত। যুদ্ধের পর ডেমোেক্রট সরকার ভারতকে যে সমর্থন ও সহায়তা দেয়, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের রিপাবলিকান সরকার আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে তাকে ফ্রাংকেনস্টাইন। হতে দিতে পারে না। রিপাবলিকান সরকারের কাছে বলশালী পাকিস্তান শক্তিমান। ভারতের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই সামরিক জান্তা ও ভুট্টোকে সমর্থন দেওয়ার কথা মার্কিন প্রশাসনের । আর অখণ্ড পাকিস্তানের প্রশ্নে পূর্ব বাংলার জনগণ প্রিয় যে নেতার ওপর নির্ভর করা যায়, যাকে অখণ্ড পাকিস্তানের একমাত্র শক্তিশালী সেতুবন্ধ হিসেবে বিবেচনা করা যায়, মার্কিন প্রশাসনের কাছে সেই ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। এ বিষয়ে বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসনের এন্ডারসন পেপারস-এ তুলে ধরা পাকিস্তানে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের মন্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযােগ্য “আমি ইয়াহিয়াকে বলেছিলাম যে, আমরা মনে করি মুজিবই হচ্ছেন পাকিস্তানের,—পূর্ব এবং পশ্চিম—এর স্থায়িত্বের চাবিকাঠি ।১৭ মার্কিন প্রশাসন শেখ মুজিবকে অখণ্ড পাকিস্তানের মুখ্য সেতুবন্ধ মনে করলেও তার ওপর ভরসা রাখতে পারে নি দ্বিবিধ কারণে। প্রথমত, ছয় দফা শেখ মুজিবের হাতে আর ছিল না। চলে যায় স্বাধীনতাকামী জনগণের হাতে এক দফায় রূপান্তরিত হয়ে এবং এর নিয়ন্ত্রণে আসে তার পার্টিরই ছাত্র সংগঠনের ভেতরকার সমাজতন্ত্রকামী লড়াকু তরুণরা শেখ মুজিবের ভাষায় চরমপন্থী’ যারা ।
নিয়ন্ত্রণ কমবেশি চলে যায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) ভেতরকার বামপন্থীদের হাতেও পর্দার অন্তরালে ‘র ‘ তাে আছেই । খেলছে এবং খেলাচ্ছে নিজের লাইনে। দ্বিতীয়ত, শেখ মজিব যতই প্রিয় ব্যক্তি হােন না কেন মার্কিন প্রশাসনের কাছে, তার বিশাল জনপ্রিয়তাও আতঙ্কগ্রস্ত করে তােলে তাদের। কেননা, মার্কিন প্রশাসন দেশে দেশে তার অভিজ্ঞতায় দেখেছে। যে এ ধরনের জনপ্রিয় লােককে শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে । জনপ্রিয় ব্যক্তি তাদের কাম্য বটে, তবে নিয়ন্ত্রণের অযােগ্য জনপ্রিয়তাকে তারা সুনজরে দেখে ১৯৮৬ সালের ফিলিপাইনের সাধারণ নির্বাচনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে এটা অনুধাবনে হয়তাে সুবিধা হবে । ফিলিপাইনের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভােটে বিজয়ী হন মিসেস কোরান একুইনাে । কিন্তু শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে ভােটের ফলাফলকে উল্টে দেন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস । কোরাজন একুইনাে এবং মার্কোস দুজনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বস্ত । অথচ নির্বাচনে মার্কোসের ভােট ডাকাতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল প্রেসিডেন্ট রােনাল্ড রিগ্যানের প্রশাসন মর্কোসকে সমর্থন দিতে থাকে। মার্কিন আস্থা অর্জনের জন্য কোরাজন একুইনােকে পরিষ্কার বলতে হয় যে, ফিলিপাইনের মার্কিন ক্লার্ক বিমান ঘাঁটি ও সুবিক নৌ-ঘাটি অপসারণের কোন পরিকল্পনা তার নেই । বলেন প্রকাশ্য জনসভায়
—————————————
১৭. জ্যাক এন্ডারসন : এন্ডারসন পেপারস, পৃষ্ঠা-২৭৬।
“আমি কমিউনিস্ট নই, কমিউনিস্ট ছিলাম না এবং ভবিষ্যতেও কমিউনিস্ট হবাে না।” তবু রিগ্যান প্রশাসন সমর্থন দিয়ে যেতে থাকে মার্কোসকে । সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ এবং জনগণের প্রেসিডেন্ট ভবন ঘেরাওয়ের মধ্য দিয়ে ফিলিপাইনের জনগণ যখন এক অবশ্যম্ভাবী ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে এগােতে থাকে এবং ফিলিপাইনের তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বসওয়ার্থ যখন একের পর এক রিপাের্ট দিয়ে যেতে থাকেন যে, কোরাজন নিয়ন্ত্রণেই থাকবেন, একমাত্র তখনই রিগ্যান প্রশাসন মার্কোস থেকে সমর্থন তুলে নেয় এবং মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জর্জ শুলজ স্বীকার করেন যে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে । আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা নিজ স্বার্থের পক্ষে কি পরিমাণ বিপজ্জনক হতে পারে এ তিক্ত অভিজ্ঞতা মার্কিন প্রশাসন অর্জন করে ১৯৫২ সালে মিশর থেকে । ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই মিশরীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নগিব ও কর্নেল গামাল নাসের এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে উৎখাত করেন বাদশা ফারুককে। সুয়েজ খালকে | আন্তর্জাতিকীকরণের গােপন প্রতিশ্রুতি দানের মাধ্যমে সামরিক অফিসাররা অভ্যুত্থান | সংঘটনের ব্যাপারে লাভ করেন তকালীন মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিকীকরণের বদলে কর্নেল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে তার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের কিছুই করার থাকে না। কারণ, জনপ্রিয়তায় নাসের তখন এক বিশাল মানব হয়ে যান। সকল নিয়ন্ত্রণের উর্ধ্বে চলে যান তিনি। পরের ইতিহাস তার কাছে মার্কিন প্রশাসনের বার বার মার খাওয়ার ইতিহাস । গামাল নাসের জনপ্রিয়তালব্ধ তিক্ত অভিজ্ঞতাই ১৯৮৬ সালে রিগ্যান প্রশাসনকে ফিলিপাইনের কোরাজন একুইনাের। গগনচুম্বি জনপ্রিয়তায় যেমন উদ্বিগ্ন করে তােলে, তেমনি ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবের আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা আতঙ্কগ্রস্ত কর তােলে নিক্সন প্রশাসনকে ।
ফিলিপাইনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বসওয়ার্থের রিপাের্টে কোরাজন একুইনাের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে রিগ্যান প্রশাসন নিশ্চিত হলেও শেখ মুজিবের ব্যাপারে ঢাকায় তল্কালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লডের রিপাের্টে নিশ্চিত হতে পারে নি নিক্সন প্রশাসন। তাদের কাছে চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড এবং ইসলামাবাদে তৎকালীন সিআইএ স্টেশন প্রধান উলফের রিপাের্ট। ঢাকায় তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লড ১৯৭১ সালের মার্চ। মাসে ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার কয়েকদিন পর সরাসরি ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপাের্ট পাঠান যে পূর্ব বাংলার মানুষ শেখ মুজিবের পক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরিত না হলে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অনিবার্য। ২৫ মার্চে সামরিক জান্তার বর্বর হামলার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের উদাসীনতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আর্চার কে ব্লাড এবং তার অধঃস্তনদের স্বাক্ষরসহ একটি প্রতিবাদ লিপি পাঠান ওয়াশিংটনে। এতে মর্কিন পররাষ্ট্র দফতর তাকে ‘আতঙ্ক-বাতিকগ্রস্ত’ বলে অভিহিত করে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠান এবং সাধারণ প্রশাসনিক ডেস্কে তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় ।
জোসেফ ফারল্যান্ড ছিলেন পাকিস্তানে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের মুখ্য ব্যক্তি। যদিও সিআইএ স্টেশন প্রধান ছিলেন উলফ তথাপি গােয়েন্দাগিরিতে ফারল্যান্ডের পূর্ব অভিজ্ঞতাই তার গুরুত্বকে অধিকতর বাড়িয়ে তােলে। তাই তার রিপাের্টই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এবং প্রতিরক্ষা দফতরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হতাে। শেখ মুজিব সম্পর্কে তার রিপাের্টটি কি ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে আবার আমাদেরকে ফিরে তাকাতে হয় সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসনের দিকে। তার আগে জোসেফ ফারল্যান্ডের পরিচিতি আমাদের জানা দরকার। তাতে পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন মার্কিন প্রশাসন তার রিপাের্টকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করতাে। জোসেফ ফারল্যান্ড প্রথম জীবনে ছিলেন আইনজীবী এবং জর্জটাউন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণপন্থী স্ট্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের নির্বাহী পরিষদ ও রিসার্চ কাউন্সিলের সদস্য। পরে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গােয়েন্দা সংস্থা এফবিআইএর (ফেডারেল ব্যুরাে অব ইনভেস্টিগেশন) এজেন্ট। গােয়েন্দাগিরিতে হাত পাকান। এখানেই। ১৯৫৭ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার তাকে দক্ষিণ আমেরিকার ডােমিনিকান রিপাবলিকে পাঠান রাষ্ট্রদূত করে। তিন বছর তিনি সেখানে ছিলেন একনায়ক রাফায়েল টুজিল্লো আর মার্কিন প্রশাসনের সংযােগ রক্ষাকারী (সিআইএ’র) হিসেবে। এরপর আসেন পানামাতে । প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির পুরাে সময়টা ছিলেন পানামাতে।
১৯৬৯ সালের শেষের দিকে আসেন পাকিস্তানে। তাকে তৎকালীন পাকিস্তানের কোন কোন মহল সিআইএ এজেন্ট হিসেবে অভিহিত করতাে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দক্ষিণ বাংলার ওপর দিয়ে যে ভয়ঙ্কর জলােচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়, জোসেফ ফারল্যান্ড তার ওপর ওয়াশিংটনে যে রিপাের্ট পাঠান, তার উল্লেখ এখানে সঙ্গত কারণেই করতে হয়। ফারল্যান্ড তার রিপাের্টে বলেন “বিপর্যয়ে যতটা জীবনহানি ঘটেছে, বাঙালীরা তার অতিরঞ্জন ঘটিয়েছে রাজনৈতিক কারণে ।১৮ এই জোসেফ ফারল্যান্ডের কাছে শেখ মুজিব কেমন ব্যাক্তি ছিলেন? সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসনের গ্রন্থ থেকে আমরা সেটা জানতে পাব,— “ফারল্যান্ড মুজিবকে জানতেন এবং তাকে প্রাণবন্ত ও প্রাণ প্রাচুর্যসম্পন্ন দেখতে পান কিন্তু তিনি গালভরা বুলি কপচাতে ভালােবাসেন।১৯ বুলিকপচান ব্যক্তি সাধারণত কারাে বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন না। আর তিনি যদি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার অধিকারী হন, সকল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া তার পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে। মিশরের অভিজ্ঞতাই সচেতন করে তােলে মার্কিন প্রশাসনকে। যদিও শেখ মুজিবই ছিলেন তাদের বিবেচনায় পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র সেতুবন্ধ, তথাপি তার ওপর পুরােপুরি আস্থা আনতে পারে মর্কিন প্রশাসন। উপরন্তু, এও তাদের আর অজানা ছিল না যে, ছয় দফা আর শেখ
—————————————
১৮. জ্যাক এন্ডারসন : দ্য এন্ডারসন পেপারস, পৃষ্ঠা-২৭৫।
১৯. প্রাগুক্ত।
মুজিবের হাতে নেই। চলে গেছে তার দলের মূল প্রাণশক্তি ছাত্রলীগের বৃহত্তর অংশের। হাতে এবং তা হয়ে গেছে একদফা, যা তাদের কাম্য না কদাপিও । অতএব, কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড়ের রিপাের্ট নয় তার ওপরঅলা জোসেফ ফারল্যান্ডের রিপাের্ট, যা সিআইএ স্টেশন প্রধান উলফ সমর্থিত, তাকেই গ্রহণ করে ওয়াশিংটন। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রত্যাশাকে পূরণ করে নিক্সন প্রশাসন এবং এসেও যায় সবুজ সংকেত। ডকুমেন্টারি ফিল্ম দ্য বাংলাদেশ স্টোরি, পার্ট-২’র দ্য মুজিব ইয়ারস’-এ দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের বৈদেশিক সাবকমিটি সদস্য (১৮৮১-৮৫) সিনেটর উইলিয়াম ব্রান্ডসের বক্তব্যে সেই সবুজ সংকেত প্রদানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। | ব্রান্ডস বলেন “Next thing, Kissinger had a great deal of sympathy for Yahya Khan because he was the first Pakistani leader to hold free election and therefore, I feel that Sheikh Mujib should meet him at least half a way. Moreover, I don’t think they expected him to resort to a campaign of terror in East Pakistan, I think they expected that he would take sharp quick military action and that would be sufficient as have been in the past to put down rise in East Pakistan. (তাছাড়া ইয়াহিয়ার প্রতি কিসিঞ্জার প্রভূত সহানুভূতিশীল ছিলেন। কারণ, ইয়াহিয়া খান হচ্ছেন প্রথম পকিস্তানি নেতা যিনি সর্বপ্রথম অবাধ নির্বাচন দেন। অতএব, আমি মনে করি, এ ব্যাপারে শেখ মুজিবকে (সমঝােতার জন্য) আরাে কিছু দূর অগ্রসর হওয়া। উচিত ছিল উপরন্তু, আমি মনে করি না, তারা (মার্কিন প্রশাসন) এটা মনে করেছিল যে, তিনি (ইয়াহিয়া) সন্ত্রাসের আশ্রয় নেবেন।
আমি মনে করি, তারা (মার্কিন প্রশাসন) আশা করেছিল যে, তিনি (ইয়াহিয়া) একটি ত্বরিত সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ করবেন যা অতীতে পূর্ব পাকিস্তানে অভ্যুত্থান দমনে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে)।”২০ সিনেটর উইলিয়াম ব্রান্ডসের ভাষ্য অনুযায়ী তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন মনে করেছিল পুলিশী ধরনের সামরিক কার্যক্রমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। ‘র’-এর পরিকল্পনাও হবে ব্যর্থ। তারপর ছয় দফাকে পাশ কাটিয়ে। সমঝােতার মাধ্যমে অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য একটি নতুন ব্যবস্থা কায়েম করা যাবে। একই রকমের ধারণা ছিল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোরও। কিন্তু তাদের কারােরই কল্পনাতে আসেনি-না নিক্সন প্রশাসন না সামরিক জান্তার যে ‘পুলিশী ধরনের সামরিক কার্যক্রম লাখ লাখ নর-নারীকে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী করে তুলবে । রুখে দাঁড়াবে বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতা। অস্ত্র তুলে নেবে সাহসী তরুণরা। মার্কিন সবুজ সঙ্কেত পাওয়ামাত্রই হামলা পরিচালনার ছক তৈরির প্রস্তুতিতে নেমে পড়ে সামরিক জান্তা। প্রস্তুতির জন্য সময়ের প্রয়ােজন। আর সময় হাতিয়ে নিতে গেলে।
———————————–
২০. এইচ নাজারেথ (প্রযােজক) দ্য বাংলাদেশ স্টোরি, পার্ট-২, দ্য মুজিব ইয়ারস।
পূর্ব বাংলার মানুষকে ফেলতে হবে বিভ্রান্তিতে যাতে তারা ইঙ্গিত পায় ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে । বিভ্রান্তির ঘাের কাটার আগেই চূড়ান্ত করতে হবে প্রস্তুতি। সামরিক জান্তা হিসেব কষে, জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের দিন-তারিখ ঘােষণায় বিলম্ব হলে। তাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা যাবে না পূর্ব বাংলার মানুষকে। তাই প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে দিয়ে জাতীয় পরিষদ। অধিবেশনের তারিখ ঘােষণা করিয়ে দেয়। কিন্তু এর দু’দিন আগে ১১ তারিখে এক গােপন বৈঠকে সামরিক জান্তা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় হামলা পরিচালনার । ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সাল। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার । ঐদিনের প্রথম ভাগে। রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদর দফতরে বসে সামরিক জান্তার একটি বৈঠক। ২৫ মার্চের হামলা পরিচালনা ওই দিনের বৈঠকের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন । বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল হামিদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল ওমর, মেজর জেনারেল আকবর ও পকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা প্রধান এন এ রিজভী। বৈঠকে অতিরিক্ত ছিলেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান এস এ সউদ। জান্তার বাইরের। লােক তিনি। তাকে ডেকে পাঠানাে হয়। বেলা তিনটার দিকে বৈঠক শেষ হয় এবং বৈঠকে পূর্ব বাংলায় হামলা পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যায় । এই বৈঠকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের ভাগ্যও হয়ে যায় নির্ধারিত।
সাহেবজাদা ইয়াকুবের জায়গায় আসবেন কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানযিনি আইউব আমলে বেলুচিস্তানে গণঅভ্যুত্থান দমনে হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় দার্ডের পরিচয় দিয়ে নিজের যােগ্যতার প্রমাণ রেখেছিলেন । “বেলুচিস্তানের কসাই’—এই কুখ্যাতিই পূর্ব বাংলায় হামলা পরিচালনায় তার নিয়ােগে জাস্তার কাছে উপযুক্ত সাটিফিকেট হিসেবে বিবেচিত হয়। সিদ্ধান্ত আরাে গৃহীত হয়,—গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসানকেও যেতে হবে। তিনটি পদই দখল করবেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান—গভর্নর, সামরিক আইন প্রশাসক ও পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড প্রধান। এডমিরাল আহসান ও জেনারেল ইয়াকুবের বিরুদ্ধে অভিযােগ এই—তারা রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে এবং শেখ মুজিবের প্রতি নমনীয়। | শেখ মুজিবের প্রতি তাদের ওই নমনীয়তার কারণ হলাে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গুলশানের একটি বাড়িতে তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত গােপন বৈঠকে শেখ মুজিব। বামপন্থীদের খতম করার আশ্বাস দেন। এ সম্পর্কে জি ডবলিউ চৌধুরী তার দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান গ্রন্থে বলেছেন “মুজিবর রহমান গর্ব সহকারে বলেন। যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থীদের নির্মূল করে দেবেন।২১
————————–
২১. দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-১১৯।
একই দিন অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আরেকটি বৈঠক হলাে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে। ভুট্টো সামরিক জান্তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলেন। সিদ্ধান্ত পাওয়া মাত্রই নেমে পড়েন প্রথম রাউন্ডের খেলায়। বৈঠকে তারই পরামর্শে একদিন পর অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের তারিখ ঘােষণা করেন এবং ছক অনুসারে এর একদিন পর অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো নামেন দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায়। ওই তারিখে ঘােষণা করলেন “তার দল মার্চের ৩ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে বসবেন যতক্ষণ না তার দলের লােকজনের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল প্রকাশ্য অথবা গােপন আলােচনায় পারস্পরিক সুযােগ-সুবিধার অধিকার দিচ্ছে।” ভুট্টো নেমেছিলেন হামলা পরিচালনায় সামরিক জান্তাকে সৈন্য-সামন্ত-রসদপত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এনে জড়ো করার সময় করিয়ে দেবার খেলায় এবং সময় পেয়ে যায় জান্তা। এর আগে অর্থাৎ সৈন্য সামন্ত আনার আগে ছকমাফিক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ। কাজ সেরে ফেলে সামরিক জান্তা। ইয়াহিয়াকে দিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি তার বেসামরিক মন্ত্রিসভা দেয় ভেঙে। এর পর পরই শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও যুদ্ধ উপকরণ প্রেরণের কার্যক্রম। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বােয়িং বিমান ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বপ্রথম সৈন্য ও রসদপত্র আনা শুরু করে।
রাওয়ালপিন্ডি সেনা সদর দফতরে ১১ ফেব্রুয়ারির গােপন বৈঠকে সামরিক জান্তা পূর্ব বাংলায় হামলা পরিচালনার যে সিদ্ধান্ত নেয়, সে সম্পর্কে শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া কি ছিল? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সামরিক জান্তার ১১ ফেব্রুয়ারির গােপন বৈঠকে জান্তার সদস্যরা ছাড়া বাইরের ছিলেন মাত্র একজন। তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান এস এ সউদ। এস এ সউদ হামলা পরিকল্পনাকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করতে পারেন। নি। অবশ্যি জান্তার বৈঠকে উচ্চবাচ্য করতেও সাহসী হননি। হামলা পরিকল্পনার প্রতি তিনি তার বিরক্তি ও অসমর্থনের কথা সেনা সদর দফতর থেকে ফিরে এসেই প্রকাশ করেন গােয়েন্দা বিভাগের এক পদস্থ বাঙালি কর্মকর্তার কাছে। বেলা গড়িয়ে তখন তিনটা । বাঙালি কর্মকর্তা সউদের কথা চুপচাপ শুনে যান কোন মন্তব্য না করেই । একদিন পর সেনা সদর দফতরে নেয়া জান্তার সিদ্ধান্তের বিষয়টি জেনে যান শেখ মুজিব। খবরে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন । সত্যতা যাচাই করতে চাইলেন। পরদিন সকালে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠতম ইনার সার্কেল এ বি এস সফদার, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন প্রাদেশিক প্রধান, আসেন তার বত্রিশ নম্বর বাড়িতে। শেখ মুজিবকে তখন ঘিরে বসেছিলেন নির্বাচন বিজয়ী তার দলের নেতা এবং কর্মীরা। তিনি এ বি এস সফদারকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন, যিনি ছিলেন তার এক ইনার সার্কেল, তাকে নিয়ে তিনি ঢুকলেন পাশের রুমে।
—————————————–
২২. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২৫।
এই ইনার সার্কেলটি ছাড়া শেখ মুজিবের ছিল আরাে দুটি ইনার সার্কেল । সিএসপি রুহুল কুদুস এবং সিএসপি আহমদ ফজলুর রহমানের কথা তার পার্টির উর্ধ্বতন ব্যক্তিরা জানতেন। এই ইনার সার্কেলটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ । এই ইনার সার্কেলটি গড়ে ওঠে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসার পর। অপর ইনার সার্কেলটি একক এবং একজন প্রয়াত সিএসপি, যিনি তকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন । তৃতীয় ইনার সার্কেলটি এবং তিনিও ছিলেন। একক ব্যক্তি, এ বি এস সফদার- শেখ মুজিবের ছিলেন ঘনিষ্ঠতম। এই ইনার সার্কেলটি অপর দুই সার্কেলের সকল খবরা-খবর রাখতেন। এই ইনার সার্কেল অর্থাৎ এ বি এস সফদার ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এবং ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিবের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর রিয়ার এডমিরাল এস এম আহসান ও পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের সঙ্গে দুটো করে মােট চারটে বৈঠকের ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। চারটে বৈঠকই। অনুষ্ঠিত হয় গুলশানের একটি বাড়িতে পাশের রুমে গিয়ে শেখ মুজিব এ বি এস সফদারকে বললেন “বড়ই উদ্বেগের। মধ্যে আছি। ক্ষমতা না দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
প্রয়ােজনে শক্তি প্রয়ােগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে । সাহেবজাদা ইয়াকুবের সঙ্গে দেখা করে আসল খবরটা আমাকে জানান।” এ বি এস সফদার ওইদিনই যােগযােগ করেন সাহেবজাদা ইয়াকুবের সঙ্গে। পরদিন দশটায় পান সময়। তার কাছে শেখ মুজিবের উদ্বেগের কথা শুনে জেনারেল ইয়াকুব জানান যে খবরের পেছনে কোন সত্যতা নেই । তাকে পাশ কাটিয়ে এখানে কোন সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ সম্ভব নয়। তিনি বললেন, “Tell Sheikh Sahib not to be worried so long I am here. If situation changes, he would be informed duely. (শেখ সাহেবকে গিয়ে বলুন তিনি যেন উদ্বেগের মধ্যে না থাকেন যতক্ষণ আমি এখানে আছি। পরিস্থিতি নতুন কোন মােড় নিলে অবশ্যই তাকে সময় মতাে জানানাে হবে।) এ বি এস সফদার ফিরে এসে শেখ মুজিবকে জেনারেল ইয়াকুবের আশ্বাস বাণী শােনালেন । জানান তিনি (এ বি এস সফদার) ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। তবে তােক ঠিক করে যাচ্ছেন তার আর জেনারেল ইয়াকুবের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষার জন্য । জেনারেল ইয়াকুব শেখ মুজিবকে ওই আশ্বাসবাণী শােনাতে পেরেছিলেন এই কারণে যে, তখনাে তিনি জানতেন না ১১ ফেব্রুয়ারি জান্তার গােপন বৈঠকে তাকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। জানতেন না পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক আর থাকছেন না। অপরদিকে শেখ মুজিব ১১ ফেব্রুয়ারির ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি বললেন “ক্ষমতা। হস্তান্তর বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র পাকান হচ্ছে…।
———————-
২৩. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৫২।
জেনারেল ইয়াকুবের কথায় শেখ মুজিব তাৎক্ষণিকভাবে আশ্বস্ত হলেও দু’দিন পর। নিশ্চিত হয়ে যান যে, সামরিক হামলা আসছে। তার র’ সূত্র তাকে নিশ্চিত করে। এই ‘র’ সূত্র তার দ্বিতীয় ইনার সার্কেল, যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া তিনি আরাে নিশ্চিত হয়ে যান ১৭ তারিখে ইয়াহিয়ার নিজের মন্ত্রী পরিষদ ভেঙে দেয়ায় । তথাপি ইয়াহিয়া খানের প্রতি তার বিশ্বাসে চিড় ধরে না। কারণ, তখনাে পর্যন্ত জাতীয় সংসদ অধিবেশনের জন্য নির্ধারিত তারিখে কোন পরিবর্তন আসে নি। সামরিক জান্তার গােপন বৈঠকের খবরে ‘র’ তৈরি হয়ে যায় শতাব্দীর সুযােগএর সর্বোত্তম ব্যবহারে। প্রয়েজন যদি পড়ে সম্মুখ সমরে নামার, তার জন্যেও সে। আঁটঘাট বাঁধতে থাকে। হামলা পরিচালনায় জান্তার পরিকল্পনা মােতাবেক ২৭ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও গােলাবারুদ প্রেরণ কার্যক্রম শুরু হবার প্রায় একই সময়ে ভারত তার কাশ্মীরের লাদাখ এলাকা থেকে চতুর্থ। মাউনটেইন ডিভিশন পশ্চিম বাংলায় সরিয়ে আনতে শুরু করে নির্বাচনের অজুহাত তুলে । ওই সময়, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৯ মার্চ, ১৯৭১-এ ছিল পশ্চিম বাংলায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্ধারিত দিন। নির্বাচনের আগে পশ্চিম বাংলায় ছিল দুটি ডিভিশন। সিকিম-ভুটান সীমান্তে দুটি এবং নোয় (উত্তর-পূর্ব। সীমান্ত এজেন্সি) ছিল দুটি। মােট ছ’ডিভিশন সৈন্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বেষ্টন করে । নির্বাচনী কার্যক্রম তদারকের অজুহাতে কাশ্মীর থেকে অতিরিক্ত একটি মাউনটেইন। ডিভিশনের পশ্চিম বাংলায় বিচলনে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার পক্ষে তাকে সন্দেহের চোখে দেখাই ছিল স্বাভাবিক । পূর্ব বাংলায় সামরিক কার্যক্রম গ্রহণে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষের মুখােমুখি এসে দাড়াতে পারে, এ আশঙ্কা সামরিক জান্তার ছিলই। কাশ্মীর থেকে পশ্চিম বাংলায় চতুর্থ মাউনটেইন ডিভিশনের বিচলনে সশস্ত্র সংঘর্ষের ওই আশঙ্কাকে দৃঢ়তর করে। তাই, শুধু পূর্ব বাংলার ওপর হামলার লক্ষ্যেই নয়, ভারতীয় সশস্ত্র হুমকি মােকাবেলার প্রশ্নেও মার্কিন প্রশাসনের সবুজ সংকেত জান্তার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে । জান্তার আশঙ্কা যে সঠিকই ছিল, সেটা আমরা দেখতে পাব ২৫ মার্চের পর। ১৯৭১ সালের মে মাসেই ভারত সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে ‘শতাব্দীর সুযােগকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল ।
হামলা পরিচালনার প্রস্তুতি মার্চ মাসের মাঝামাঝি তক চূড়ান্ত না হবার সম্ভাবনা দেখে সামরিক জান্তা আরেক কৌশল অবলম্বন করে । ইয়াহিয়াকে দিয়ে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করিয়ে দেয়। এর প্রেক্ষাপটে এক দফাকামী চরমপন্থীদের মােকাবেলায় শেখ মুজিব চাইলেন নতুন আরেকটি তারিখ । ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে গভর্নর এম এম আহসান শেখ মুজিবকে গভর্নর হাউজে ডেকে পাঠান ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতকরণ সিদ্ধান্তটি জত করাতে গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীও ছিলেন সেখানে। গভর্নর আহসানের কথায় শেখ মুজিব যা বলেন, সেটা আমরা রাও ফরমান আলীর মুখ থেকেই শুনি “নিঃসন্দেহে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হল। আমাদের পায়ের নিচের মাটি সরিয়ে ফেলা হল।
শেখ মুজিবের সঙ্গে আরাে দু’জন লােক ছিল। তিনি তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে একা থেকে গেলেন । পরে বললেন, অধিবেশনের নতুন একটা তারিখ যদি এ মাসেই ঘােষণা করা হয়, তাহলে জনসাধারণকে নিরস্ত করা যাবে । আপনি দয়া করে মূলতবি ঘােষণার পর পরবর্তী একটা তারিখ ঘােষণা করার জন্য বলুন।” শেখ মুজিব গভর্নর আহসানকে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের আরেকটি তারিখ ঘােষণার অনুরােধ জানিয়ে স্থগিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ও একদফাকামী চরমপন্থীদের মাকাবেলায় এবং সারা বাংলার মানুষের ক্রোধ প্রশমনে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহবান করলেন এবং বললেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী কর্মসূচির ঘােষণা দেবেন কিন্তু ১ মার্চে ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার সাথে সাথে ক্রোধে ফুসে ওঠে সারা বাংলার মানুষ ওই দিন সন্ধ্যায় একদফাপন্থী স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের দশজন তরুণের একটি দুঃসাহসিক দল হামলা চালায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়িতে। রাজপথে নামিয়ে দেওয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ঢাকায় প্রাণ হারায় কয়েক ব্যক্তি। ২ মার্চে অবতারণা হল অভূতপূর্ব ঘটনার।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ােজন করে এক প্রতিবাদ সভা। সভায় বক্তৃতা করার কথা ছিল ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ আ স ম আবদুর রব, নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখনসহ আরাে কয়েক জনের । সভা শুরু হয় নুরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে । মঞ্চ কলা ভবনের অলিন্দের ছাদ । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের (ডাকসু) সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব যখন বক্তৃতা করছিলেন ঠিক সেই সময় পশ্চিম দিকের গেট দিয়ে একটি ছােট্ট মিছিল সভায় প্রবেশ করে । মিছিলের নেতৃত্বে যিনি ছিলেন, তিনি শেখ মােহাম্মদ জাহিদ হােসেন, ছাত্রলীগ নগর শাখার সম্পাদক। তার হাতে ছিল ৭ জুন, ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেয়া ‘জয় বাংলা বাহিনীর সেই পতাকা । প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে শেখ মােহাম্মদ জাহিদ হােসেনের হাতে এ পতাকাটি কিভাবে আসে, সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে পতাকাটি নিয়ে জাহিদ হােসেন রেখে দেন নিজের বইয়ের র্যাকে । তিনি জানান, তার পরিষ্কার মনে আছে যে ২ মার্চের বটতলায় ছাত্র সভায় আগের দিন তার অগােছালাে ঘরটি গােছগাছ করেন তার মা বেগম লুফুন্নেছা । পতাকাটি বইয়ের ব্ল্যাক থেকে তুলে তিনি ভাজ করে রাখেন টেবিলের ওপর । বেগম লুৎফুন্নেছা আমাকে দেওয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেন “ছেলের অগােছালাে ঘর গােছাতে গিয়ে র্যাকে পাই পতাকাটি। ওই দিনই প্রথম দেখলাম সেটি। ঘরে পতাকা রাখার ব্যাপারে বিপদ-আপদের ভীতি ছিল আমার। কিন্তু ছেলের প্রয়ােজনীয় মনে করায় টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখি।”
———————————-
২৪. উর্দু ডাইজেস্ট-এ প্রকাশিত রাও ফরমান আলীর লেখা মােস্তফা হারুণ অনুদিত ভুটা শেখ মুজিব।
ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৫৬।
শেখ মুজিবের সঙ্গে আরাে দু’জন লােক ছিল। তিনি তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে একা থেকে গেলেন । পরে বললেন, অধিবেশনের নতুন একটা তারিখ যদি এ মাসেই ঘােষণা করা হয়, তাহলে জনসাধারণকে নিরস্ত করা যাবে । আপনি দয়া করে মূলতবি ঘােষণার পর পরবর্তী একটা তারিখ ঘােষণা করার জন্য বলুন।” শেখ মুজিব গভর্নর আহসানকে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের আরেকটি তারিখ ঘােষণার অনুরােধ জানিয়ে স্থগিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ও একদফাকামী চরমপন্থীদের মােকাবেলায় এবং সারা বাংলার মানুষের ক্রোধ প্রশমনে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহবান করলেন এবং বললেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী কর্মসূচির ঘােষণা দেবেন। কিন্তু ১ মার্চে ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার সাথে সাথে ক্রোধে ফুসে ওঠে সারা বাংলার মানুষ । ওই দিন সন্ধ্যায় একদফাপন্থী স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের দশজন তরুণের একটি দুঃসাহসিক দল হামলা চালায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়িতে। রাজপথে নামিয়ে দেওয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ঢাকায় প্রাণ হারায় কয়েক ব্যক্তি। ২ মার্চে অবতারণা হল অভূতপূর্ব ঘটনার । পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ােজন করে এক প্রতিবাদ সভা। সভায় বক্তৃতা করার কথা ছিল ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ আ স ম আবদুর রব, নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখনসহ আরাে কয়েক জনের । সভা শুরু হয় নুরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে । মঞ্চ কলা ভবনের অলিন্দের ছাদ ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের (ডাকসু) সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব যখন বক্তৃতা করছিলেন ঠিক সেই সময় পশ্চিম দিকের গেট দিয়ে একটি ছােট্ট মিছিল সভায় প্রবেশ করে । মিছিলের নেতৃত্বে যিনি ছিলেন, তিনি শেখ মােহাম্মদ জাহিদ হােসেন, ছাত্রলীগ নগর শাখার সম্পাদক। তার হাতে ছিল ৭ জুন, ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেয়া ‘জয় বাংলা বাহিনীর সেই পতাকা । প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে শেখ মােহাম্মদ জাহিদ হােসেনের হাতে এ পতাকাটি কিভাবে আসে, সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে পতাকাটি নিয়ে জাহিদ হােসেন রেখে দেন নিজের বইয়ের র্যাকে । তিনি জানান, তার পরিষ্কার মনে আছে যে ২ মার্চের বটতলায় ছাত্র সভায় আগের দিন তার অগােছালাে ঘরটি গােছগাছ করেন তার মা বেগম লুফুন্নেছা । পতাকাটি বইয়ের ব্ল্যাক থেকে তুলে তিনি ভাজ করে রাখেন টেবিলের ওপর । বেগম লুৎফুন্নেছা আমাকে দেওয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেন “ছেলের অগােছালাে ঘর গােছাতে গিয়ে র্যাকে পাই পতাকাটি। ওই দিনই প্রথম দেখলাম সেটি। ঘরে পতাকা রাখার ব্যাপারে বিপদ-আপদের ভীতি ছিল আমার। কিন্তু ছেলের প্রয়ােজনীয় মনে করায় টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখি।”
———————————-
২৪. উর্দু ডাইজেস্ট-এ প্রকাশিত রাও ফরমান আলীর লেখা মােস্তফা হারুণ অনুদিত ভুটা শেখ মুজিব।
ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৫৬।
পরদিন অর্থাৎ ২ মার্চ সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির অঙ্গ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে বললাে :”আপনার ও আপনার পার্টির ছয় দফা সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে, ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবীসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে।”২৫ ১ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত আরাে রক্ত ঝরলাে । সেনাবাহিনী ও ইপিআর-এর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সঙ্গে মুখােমুখি সংঘর্ষে সারা পূর্ব বাংলায় প্রাণ হারায় ১৭২ জন এবং আহত হয় ৩৫৮ জন। এ হিসেব তৎকালীন সরকারি বিজ্ঞপ্তির। শেখ মুজিবের ১ মার্চ ঘােষণার প্রেক্ষিতে যে দিনটির অপেক্ষায় উন্মুখ ছিল পূর্ব বাংলা তথা সারা পাকিস্তান এসে যায় সেই ৭ মার্চ। এর আগের দিন ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক ঘােষণায় ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের তারিখ পুনঃনির্ধারণ করেন। একই দিনে দু’ দুটো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক নির্দেশ জারির মাধ্যমে জান্তার সদস্য কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করেন এবং অপসারিত হন ভাইস এডমিরাল এস। এম আহসান । আর সন্ধ্যায় তিনি টেলিফোনে আলাপ করেন শেখ মুজিবের সঙ্গে, পাঠান গােপন বার্তা । বার্তায় তিনি শেখ মুজিবকে বলেন “আমি শিগগিরই ঢাকায় আসছি এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করবাে। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাক্ষা ও জনগণের প্রতি দেওয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরােপুরি মর্যাদা দেব ।
আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে, যা আপনাকে ছয় দফা থেকেও বেশি খুশি। করবে।” পরদিন রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠেয় জনসভায় তিনি কি বলবেন, তা নির্ধারণের জন্য ওই রাতেই বসে আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের এক গােপন বৈঠক। একটানা ন’ ঘণ্টা চলে সে বৈঠক। শেখ মুজিব সন্ধ্যায় পাওয়া ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতির প্রতি ছিলেন আস্থাবান । তাই তুমুল বাক-বিতণ্ডা শেষে বৈঠকে বক্তৃতার বিষয়বস্তু নির্ধারিত হয়ে যায় স্বাধীনতাকামীদের পাশ কাটিয়ে । ওই গােপন বৈঠকের তথ্যাদি কাউকে জানতে দেওয়া হয় না। কিন্তু ওই সময় লন্ডনের দৈনিক টেলিগ্রাফ-এর দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা ডেভিড লােসাক বৈঠকের আলাপ-আলােচনা সম্পর্কে যে টুকরাে-টাকরা তথ্য সংগ্রহ করেন তা তিনি তার পাকিস্তান ক্রাইসিস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। বৈঠকে শেখ মুজিব বলেন “বিচ্ছিন্নতা থেকে পূর্ব পাকিস্তান কিছুই পাবে না… রক্তপাত এবং পীড়ন ছাড়া । আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেট স্বাধীনতার জন্য নয়স্বায়ত্তশাসনের জন্য।”২৭ ৭ মার্চের আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে তার কাছে মার্কিন নীতি তুলে ধরেন এবং তার (শেখ মুজিব) ব্যক্তিগত
———————————————–
২৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৬৩-৬৬৫।
২৬. সিদ্দিক সালিক প্রণীত লেখক অনুদিত নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা-৬৪।
২৭. মােহাম্মদ আইউব ও কে সুব্রামনিয়াম দ্য লিবারেশন ওয়ার, পৃষ্ঠা -১১৯।
ও পারিবারিক নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। শেখ মুজিবের কাছে ফারল্যান্ডের তুলে ধরা। মার্কিন নীতিমালা সম্পর্কে জি ডবলিউ চৌধুরী বলেন “ফারল্যান্ড মুজিবের কাছে মার্কিন নীতিমালা তুলে ধরেন এবং জানান, তিনি যেন তার বিচ্ছিন্নতাবাদী খেলায় ওয়াশিংটনের দিকে ফিরে না তাকান। আর তাকে (শেখ মুজিব) দেয়া ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গ্যারান্টি সম্পর্কে জানা যাবে এন্ডারসন পেপারস-এ তুলে দেওয়া ফারল্যান্ডের নিজেরই ভাষ্য থেকে যুদ্ধের ওপর যখন ইতিহাস লেখা হবে, প্রমাণিত হবে, মার্কিন নীতি এবং আমাদের স্থানীয় কর্মতৎপরতা শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রেখেছে।”২৯ | রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড তার কাছে মার্কিন নীতি তুলে ধরলেও শেখ মুজিবের সম্ভবত তখনাে ভরসা ছিল কনসাল জেনারেল আর্চার কে রাডের সঙ্গে তার গােপন বৈঠকের প্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনে প্রেরিত তার রিপাের্টের ওপর। আশা ছিল কনসাল জেনারেলের রিপাের্টকে ওয়াশিংটন আস্থায় আনবে এবং জান্তাকে বাধ্য করাতে পারে ক্ষমতা হস্তান্তরে। অথচ তখনাে তিনি জানতেন না তার সম্পর্কে ফারল্যান্ডের পর্যবেক্ষণ এবং ইসলামাবাদস্থ সিআইএ স্টেশন প্রধান উলফ-এর রিপাের্টের কথা । তাছাড়া শেখ মুজিব তখন হয়তাে বিশ্বাস করেন নি যে, ইয়াহিয়া খানের হাত থেকে জান্তা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। এ ব্যাপারে জি ডবলিউ চৌধুরী কি বলেন দেখা যাক “এ বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে যে, ফেব্রুয়ারিতেই আহসানের মতােই ইয়াহিয়াকে অপসারণ করে হামিদকে বসানাে হতাে, তিনি (ইয়াহিয়া) হয়তাে খুশি মনেই বিদায় নিতেন। কিন্তু কিছু কিছু কারণে জান্তা ইয়াহিয়াকে ধরে রাখে। ওয়াশিংটন এবং পিকিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের যে দায়িত্ব নিক্সন তার (ইয়াহিয়া) ওপর অর্পণ করেন, সে প্রেক্ষিতে ইয়াহিয়ার অপসারণে বা ইস্তফাদানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে ওয়াশিংটন ও পিকিংয়ের যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতাে, সে সম্পর্কে তারা (জান্তা) সচেতন ছিল।”
ইয়াহিয়া যে ফেব্রুয়ারি মাসেই ক্ষমতা হারিয়ে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিলেন, তা শেখ মুজিব সম্ভবত অনুধাবনই করতে পারেন নি। তাই ৭ মার্চ বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে ২৫ মার্চে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যােগদানের প্রশ্নে আগের দিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার সঙ্গে টেলিফোন আলাপ এবং তাকে প্রেসিডেন্ট করার তার প্রতিশ্রুতির আলােকে চারটি শর্ত আরােপ করলের তিনি, এক, ‘সামরিক আইন তুলে নিতে হবে; দুই.ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; তিন, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে। নিতে হবে; চার, বাঙালি হত্যার কারণ খুঁজে বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করতে হবে এবং যতদিন দাবী আদায় না হবে ততােদিন অসহযােগ আন্দোলন
————————————————
২৮, জি ডবলিউ চৌধুরী : দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান, পষ্ঠা-১২০।
২৯, জ্যাক এন্ডারসন দ্য এন্ডারসন পেপারস, পৃষ্ঠা-২৭৬।
৩০. জি ডবলিউ চৌধুরী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার যােগযােগ মন্ত্রী ও শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা ছিলেন ।
লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার-এর প্রণেতা তিনি।
৩১. জি ডবলিউ চৌধুরী দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-১৫৬।
চালিয়ে যাবার আহবান জানালেন চাপ সৃষ্টির জন্য। অবশ্যি তিনি বক্তৃতায় এ কথাও বললেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।৩২ রাওয়ালপিন্ডি সেনা সদর দফতরে শেখ মুজিবের এ ভাষণের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ। তাৎপর্যপূর্ণ সদর দফতরে টেলিফোনে আলাপকালে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান যে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান) বলেছেন, ‘এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ। . শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণকে অভিনন্দন জানায় পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী দলগুলােও। কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা মিয়া মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা। বলেন, “শেখ মুজিবর রহমানের দাবী অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে তা গ্রহণ করতে হবে।”° পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গােলাম আজম অনতিবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান এবং বলেন । ৩৩ এভাবেই বর্তমান সঙ্কট থেকে জাতির উত্তরণ ঘটতে পারে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির সাধারণ সম্পাদক মওলানা সিদ্দিক আহমদ বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের চার দফা দাবী মেনে নিয়ে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়েই বর্তমান সঙ্কট সমাধান। সম্ভব।” এর আগে ৪ মার্চ পাকিস্তান তেহরিকে ইশতেকলাল পার্টি প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন “যদি এরপরও বর্তমান শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাহলে পূর্ব পাকিস্তানিদের সমর্থনে আমি আন্দোলন শুরু করব। তিনি। বলেন, শেখ মুজিবর রহমানকে সপ্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের ছয় দফায় খারাপ কিছু নেই।৩৪
শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণকে ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী দলগুলাে। অভিনন্দন জানায় বটে, কিন্তু এই ভাষণ ছয় দফাপন্থী ও এক দফাপন্থীদের সরাসরি মুখােমুখি এনে দাঁড় করায় । কাজী জাফর-মেননের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি ওই ৭ মার্চেই এক প্রচারপত্রে বলা হয় “আমরা পূর্বেই বলিয়াছি যে, নির্বাচনের মাধ্যমে আপােসে স্বাধীনতা আসিবে না – আসিবে না পূর্ব বাংলার কৃষকশ্রমিক মধ্যবিত্ত তথা সমগ্র জনতার মুক্তি। মুক্তির একমাত্র পথ সশস্ত্র জনতার বিপ্লব ইতিহাস বারবার এই শিক্ষাই আমাদের দিয়াছে।৩৬ কিন্তু ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি (মােজাফফর) তখনাে এক পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাঙালীর মুক্তির পথ খুঁজে
———————————————-
৩২. লেখক অনুদিত সিদ্দিক সালিকের নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা ৬৬।
৩৩. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৩।
৩৪. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৪৬।
৩৫. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম ঘণ্ড, পৃষ্ঠা-০১-২০২।
৩৬. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৬৯৬।
৩৭. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৬
৯৭, ৬৯৮, ৬৯৯।
বের করার কথা বলছিল। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মােজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেনের নামে ৭ মার্চে প্রচারিত পার্টি গৃহীত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের জন্য ১৭ দফা প্রস্তাবের ১৭ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয় “পাকিস্তানকে একটি পূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম ও জনকল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করিতে হইবে।৩৮ পরদিন ৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ স্বাধীনতার পক্ষে এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেয় । এদিনে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং দেশের সকল ছাত্রলীগ শাখা কমিটিকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শাখা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ছাত্রলীগ এই দিনে তার সংগঠনের ইতিহাসে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আরেকটি সাহসী প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংগঠনের নামের আগে পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দ বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে বলা হয় “অদ্যকার এই সভা আগামী কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের পরিবর্তে শুধুমাত্র ছাত্রলীগ ব্যবহৃত হইবে।৩৯ একই দিনে গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল সংক্রান্ত এবং এই ধরনের যুদ্ধে ব্যবহার উপযােগী অস্ত্র বিষয়ক একটি বেনামি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। পরদিন, ৯ মার্চ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলেন “আসুন, আমরা ঘােষণা করি যে, পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনই আমাদের লক্ষ্য। এর চেয়ে কম কিছু নয় ।
আসুন, এই আন্দোলনকে আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দ্বিতীয় ও শেষ পর্যায়ের মরণপণ সংগ্রামে পরিণত করি । সত্যিকারের জাতীয় মুক্তির আর কোন পথ নাই ।” একই দিনে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)** এক প্রচারপত্রে বলে, “মুক্তির জন্য শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন নয়, হরতাল- ধর্মঘট নয়,…অস্ত্র হাতে লড়াই করুন; শত শত হত্যার বদলা নিন ।…পূর্ব বাংলা মুক্ত করুন। জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম করুন।” ওই একই দিনে অর্থাৎ ৯ মার্চে পূর্ব। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) ৪০ এই মুহূর্তের জরুরি কর্তব্য বলে উপদেশ দান করে ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের আহবান জানিয়ে এক প্রচারপত্রে বলে, “কোন কোন নেতা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা হইয়া গিয়াছে বলিয়া ধ্বনি তুলিয়া আজিকার গণসংগ্রামের উদ্দীপনা, সংকল্প ও প্রস্তুতিতে ভাটা আনিয়া দিতে চাহিতেছেন ।…নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, সামরিক শাসন প্রত্যাহার প্রভৃতি যে দাবিগুলাে আওয়ামী লীগ প্রধান (শেখ মুজিব) উত্থাপন করিয়াছেন,
———————————–
৩৮, প্রাক্ত, পৃষ্ঠা- ৬৯৭, ৬৯৮, ৬৯৯।
৩৯, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৮
৪০. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭০৭
৪১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭১২,৭১৩।
৪২. এই দলটি হক-তােয়াহা গ্রুপ নামে পরিচিত ছিল।
৪৩, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১৬, ৭১৭
৪৪. পরবর্তীতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
সেগুলি আদায় করিতে পারিলে স্বাধীন বাংলা’ কায়েমের সংগ্রামে সুবিধা হইবে ইহা উপলব্ধি করিয়া এই দাবির পেছনে কোটি কোটি জনগণকে সমবেত করা এবং এই দাবিগুলাে পূরণে ইয়াহিয়া সরকারকে বাধ্য করা…ইহা হইল এই মুহুর্তের জরুরী কর্তব্য।৪৫ এর আগে, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ সালের এই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পাটিরই (মণি সিং) নেয়া এক রাজনৈতিক প্রস্তাবের ৩ নম্বর প্রস্তাবে মওলানা ভাসানী এবং স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে বলা হয়, “অন্যদিকে কিছু উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী তথাকথিত স্বাধীন পূর্ব বাংলার নামে অবাঙালী বিরােধী জিগির তুলিয়া এবং মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ তুলিয়া জনগণের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরােধী মনােভাব গড়িয়া তুলিয়া অবস্থা আরাে জটিল ও ঘােরালাে করিয়া তুলিয়াছে।” এবং ওই রাজনৈতিক প্রস্তাবের ৫ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়, “এই সংগ্রামের সফলতার জন্য উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের অবাঙালী জনগণ বিরােধী এবং মওলানা ভাসানীর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরােধী জিগিরের মুখােশও আমাদের খুলিয়া দিতে হইবে।”৪৬ পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) তার রাজনৈতিক প্রস্তাবে মওলানা ভাসানী ও স্বাধীনতাকামীদের মুখােশ খুলে ফেলতে বলে এবং এও বলে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান উত্থাপিত দাবি আদায় করতে পারলে ‘স্বাধীন বাংলা কায়েমের সুবিধা হবে। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) কথিত শেখ মুজিবের ওই দাবি তথা ছয় দফা সম্পর্কে মুসলিম লীগ সমর্থক দক্ষিণপন্থী। করাচির দৈনিক দ্য ডন’ কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। ‘দ্য ডন’ মনে করে নি যে স্বাধীনতার কোন দাবি ছয় দফাতে রয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১-এ ‘দ্য ডন’ লেখে, “ফেডারেল পদ্ধতির জন্য ছয় দফা আমাদের দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের পক্ষে একটি ন্যায়সঙ্গত এবং বাস্তবানুগ কর্মসূচি।”
‘দ্য ডন’ ছাড়াও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলগুলাে, যেমন, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, জাস্টিস পার্টি, যাদের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তারাও মনে করে নি যে ছয় দফার মধ্যে স্বাধীনতার দাবি আছে। সে কারণে তারা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) ছয় দফার মধ্যে স্বাধীনতা খুঁজে পায়, আর কেউ না পেলেও। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীনতা আসবে বলে মনে করলেও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং তার নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তা কদাপিও মনে করেনি। তাই তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিতে নেমে পড়ে। ৭ মার্চের দু’দিন পর অর্থাৎ ৯মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা হাসানুল হক ইনু ও শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে
————————————————–
৪৫, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৯, ৭১০, ৭১১
৪৬. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৫৩, ৬৫৪
৪৭. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪৭
৪৮, পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) নেতা
সেগুলি আদায় করিতে পারিলে স্বাধীন বাংলা’ কায়েমের সংগ্রামে সুবিধা হইবে ইহা উপলব্ধি করিয়া এই দাবির পেছনে কোটি কোটি জনগণকে সমবেত করা এবং এই দাবিগুলাে পূরণে ইয়াহিয়া সরকারকে বাধ্য করা…ইহা হইল এই মুহুর্তের জরুরী কর্তব্য।৪৫ এর আগে, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ সালের এই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পাটিরই (মণি সিং) নেয়া এক রাজনৈতিক প্রস্তাবের ৩ নম্বর প্রস্তাবে মওলানা ভাসানী এবং স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে বলা হয়, “অন্যদিকে কিছু উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী তথাকথিত স্বাধীন পূর্ব বাংলার নামে অবাঙালী বিরােধী জিগির তুলিয়া এবং মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ তুলিয়া জনগণের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরােধী মনােভাব গড়িয়া তুলিয়া অবস্থা আরাে জটিল ও ঘােরালাে করিয়া তুলিয়াছে।” এবং ওই রাজনৈতিক প্রস্তাবের ৫ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়, “এই সংগ্রামের সফলতার জন্য উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের অবাঙালী জনগণ বিরােধী এবং মওলানা ভাসানীর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরােধী জিগিরের মুখােশও আমাদের খুলিয়া দিতে হইবে।”৪৬ পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) তার রাজনৈতিক প্রস্তাবে মওলানা ভাসানী ও স্বাধীনতাকামীদের মুখােশ খুলে ফেলতে বলে এবং এও বলে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান উত্থাপিত দাবি আদায় করতে পারলে ‘স্বাধীন বাংলা কায়েমের সুবিধা হবে। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) কথিত শেখ মুজিবের ওই দাবি তথা ছয় দফা সম্পর্কে মুসলিম লীগ সমর্থক দক্ষিণপন্থী। করাচির দৈনিক দ্য ডন’ কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। ‘দ্য ডন’ মনে করে নি যে স্বাধীনতার কোন দাবি ছয় দফাতে রয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১-এ ‘দ্য ডন’ লেখে, “ফেডারেল পদ্ধতির জন্য ছয় দফা আমাদের দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের পক্ষে একটি ন্যায়সঙ্গত এবং বাস্তবানুগ কর্মসূচি।” ‘দ্য ডন’ ছাড়াও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলগুলাে, যেমন, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, জাস্টিস পার্টি, যাদের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তারাও মনে করে নি যে ছয় দফার মধ্যে স্বাধীনতার দাবি আছে। সে কারণে তারা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) ছয় দফার মধ্যে স্বাধীনতা খুঁজে পায়, আর কেউ না পেলেও। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীনতা আসবে বলে মনে করলেও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং তার নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তা কদাপিও মনে করেনি। তাই তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিতে নেমে পড়ে। ৭ মার্চের দু’দিন পর অর্থাৎ ৯মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা হাসানুল হক ইনু ও শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে
————————————————–
৪৫, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৯, ৭১০, ৭১১
৪৬. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৫৩, ৬৫৪
৪৭. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪৭
৪৮, পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) নেতা
সেগুলি আদায় করিতে পারিলে স্বাধীন বাংলা’ কায়েমের সংগ্রামে সুবিধা হইবে ইহা উপলব্ধি করিয়া এই দাবির পেছনে কোটি কোটি জনগণকে সমবেত করা এবং এই দাবিগুলাে পূরণে ইয়াহিয়া সরকারকে বাধ্য করা…ইহা হইল এই মুহুর্তের জরুরী কর্তব্য।৪৫ এর আগে, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ সালের এই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পাটিরই (মণি সিং) নেয়া এক রাজনৈতিক প্রস্তাবের ৩ নম্বর প্রস্তাবে মওলানা ভাসানী এবং স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে বলা হয়, “অন্যদিকে কিছু উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী তথাকথিত স্বাধীন পূর্ব বাংলার নামে অবাঙালী বিরােধী জিগির তুলিয়া এবং মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ তুলিয়া জনগণের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরােধী মনােভাব গড়িয়া তুলিয়া অবস্থা আরাে জটিল ও ঘােরালাে করিয়া তুলিয়াছে।” এবং ওই রাজনৈতিক প্রস্তাবের ৫ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়, “এই সংগ্রামের সফলতার জন্য উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের অবাঙালী জনগণ বিরােধী এবং মওলানা ভাসানীর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরােধী জিগিরের মুখােশও আমাদের খুলিয়া দিতে হইবে।”৪৬ পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) তার রাজনৈতিক প্রস্তাবে মওলানা ভাসানী ও স্বাধীনতাকামীদের মুখােশ খুলে ফেলতে বলে এবং এও বলে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান উত্থাপিত দাবি আদায় করতে পারলে ‘স্বাধীন বাংলা কায়েমের সুবিধা হবে। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) কথিত শেখ মুজিবের ওই দাবি তথা ছয় দফা সম্পর্কে মুসলিম লীগ সমর্থক দক্ষিণপন্থী। করাচির দৈনিক দ্য ডন’ কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। ‘দ্য ডন’ মনে করে নি যে স্বাধীনতার কোন দাবি ছয় দফাতে রয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১-এ ‘দ্য ডন’ লেখে, “ফেডারেল পদ্ধতির জন্য ছয় দফা আমাদের দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের পক্ষে একটি ন্যায়সঙ্গত এবং বাস্তবানুগ কর্মসূচি।” ‘দ্য ডন’ ছাড়াও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলগুলাে, যেমন, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, জাস্টিস পার্টি, যাদের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তারাও মনে করে নি যে ছয় দফার মধ্যে স্বাধীনতার দাবি আছে। সে কারণে তারা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) ছয় দফার মধ্যে স্বাধীনতা খুঁজে পায়, আর কেউ না পেলেও। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীনতা আসবে বলে মনে করলেও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং তার নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তা কদাপিও মনে করেনি। তাই তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিতে নেমে পড়ে। ৭ মার্চের দু’দিন পর অর্থাৎ ৯মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা হাসানুল হক ইনু ও শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে
————————————————–
৪৫, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০৯, ৭১০, ৭১১
৪৬. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৫৩, ৬৫৪
৪৭. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৪৭
৪৮, পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) নেতা
একদল তরুণ এক অসম সাহসী ‘ডাকাতি সংঘটিত করে। ঢাকা বিজ্ঞান গবেষণাগারে (সায়েন্স ল্যাবরেটরি) হামলা চালায় বিস্ফোরক সংগ্রহের জন্য। পরদিন খবরের কাগজে এই ‘ডাকাতির সংবাদ পড়ে চমকে ওঠে বাংলার মানুষ। এক দফাপী স্বাধীনতাকামীরা সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি যখন নিচ্ছে, শেখ মুজিব তখন আপােসের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আর জুলফিকার আলী ভুট্টো ও সামরিক জান্তা হামলা প্রস্তুতি চূড়ান্ত করার চেষ্টায় গতি সঞ্চার করে চলেছে । হামলা প্রস্তুতি চূড়ান্ত করার জন্য জান্তাকে আরাে সময় করিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ভুট্টো নতুন খেলায় নামেন । ১৪ মার্চ বলেন “পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার আওয়ামী লীগের হাতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা পিপিপির (পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি) হাতে দিতে হবে।৪৯ এতে অবস্থা আরাে জটিল হয়ে ওঠে। সমঝােতা বৈঠকের নামে পূর্ব বাংলার মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে। রাখার জন্য জান্তা ইয়াহিয়াকে ১৫ মার্চ ঢাকায় পাঠায়। ইতিমধ্যে ঢাকায় এসে পড়েন। জান্তার অন্যতম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। তার হাতে সকল ক্ষমতা হস্তান্তর করে গভর্নর এস এম আহসান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবদাজা ইয়াকুব খান বিদায় নিয়ে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আসেন জান্তার সদস্য—জেনারেল হামিদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওমর, মেজর জেনারেল আকবর ও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা প্রধান এন এ রিজভি। এরা ছাড়া আরাে আসেন কমান্ডাে বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল মিঠঠা খান। তার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয় শেখ মুজিবকে আটকের। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিব দু’জনে বৈঠকে বসেন ১৬ মার্চ বেলা। এগারটায়। এই বৈঠকে দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে একটি আপােস-সমঝােতা হয়ে যায় পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে অটুট রেখেই। পরদিন ১৭ মার্চ দুপক্ষ মুখােমুখি হলাে। নিজস্ব পরামর্শকদের নিয়ে এবং ২০ মার্চ একপ্রকার স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ১৬ মার্চের আপােস রফার আলােকে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে আরাে ছাড় দিতে রাজি এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তরে তিনি কমবেশি প্রস্তুতও হয়ে গেছেন । ইয়াহিয়া এই ছাড় দেয়াতে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে জান্তা। তাকে সতর্ক করে দেয়া হয় যে, তিনি অতিমাত্রায় ছাড় দিচ্ছেন। শেখ মুজিবকে ছাড় দেয়া নিয়ে ইয়াহিয়াকে দেয়া জান্তার সতর্ক বাণী সম্পর্কে রাওয়ালপিন্ডি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক দপ্তরের আইন বিশেষজ্ঞ এবং প্রেসিডেন্টের পরামর্শক দলের চতুর্থ ব্যক্তি কর্নেল হাসান জি ডবলিউ চৌধুরীকে জানান, “শেখ মুজিব এবং তার দলের সাথে বৈঠকে পর প্রতিদিন ইয়াহিয়াকে বসতে হত জান্তার সঙ্গে। তিনি শেখ মুজিবকে যে ছাড় দিচ্ছেন তাতে জাতীয় সরকারকে দুর্বল করার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তাকে (ইয়াহিয়া) হুশিয়ার করে দেয় জান্তা।৫০ ? আপােস-সমঝােতা সম্পর্কে আভাস পাওয়া গেল পাকিস্তানের
———————————
৪৯. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা-২৩৪, ২৩৫, ২৩৬
৫০. দ্যা লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-১৬৭
প্রজাতন্ত্র দিবস মার্চ উপলক্ষে ২২ মার্চে দেয়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণে “পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল একটি সমন্বিত পদ্ধতিতে একতানে, একযােগে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে বসে। সাধারণ লক্ষ্যে যাতে কাজ করে যেতে পারে, আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জন্য সে মঞ্চ এখন তৈরি হয়ে গেছে। ওই একই দিনে, ২২ মার্চ শেখ মুজিব বলেন “যদি তারা অনতিবিলম্বে আমাদের দাবি মেনে নেন তাহলে সম্ভবত আমরা বন্ধু হিসেবে এখনাে বাস করতে পারব।” একই দিনে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খানকে তিনি বলেন যে তিনি এখনাে পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী। সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাস জানাচ্ছেন আমাদের এ তথ্য “১৯৭১ সালের ২২ শে মার্চ তারিখে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, শেখ সাহেব, আমাকে বলুন, আপনি কি এখন পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করেন?’ মুজিব এর উত্তরে বলেন, খান সাহেব, আমি একজন মুসলিম লীগপন্থী। মুজিবের উত্তরের তাৎপর্য এই যে, খান ওয়ালী খান ১৯৪৮ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির বিরােধিতা করেছিলেন বলে তিনি তাকে ভৎর্সনা করলেন (যে জামাতে ইসলামী এখন পাকিস্তানের আদর্শের রক্ষক বলে দাবি করে, সেই দলও ভারত বিভক্তির বিরােধিতা করেছিল) এবং তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, তিনি অর্থাৎ শেখ মুজিব কেবল পাকিস্তান আন্দোলনকেই সমর্থন করেননি, এখন পর্যন্ত এর ধারণার প্রতি অনুগত রয়েছেন।”৫৩।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের ভাষ্য অনুযায়ী বৈঠকে আলাপ-আলােচনা কতটুকু সফল হয়েছিল? আপােস-সমঝােতায় তারা কতদূর পৌঁছে ছিলেন? এ বিষয়ে জি ডবলিউ চৌধুরীর বক্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযােগ্য। আমাকে দেয়া তার এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের কথায় আগে আসি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন “শেষের দিকে, একেবারে আর্মি এ্যাকশন (২৫ মার্চ হামলা পরিচালনার আগে) নেয়ার আগ খানে ইয়াহিয়া যে প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন, আমি মনে করি ছয় দফার প্রায় নব্বই ভাগ তার মধ্যে ছিল।” প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে আপােস-সমঝােতায় আসা সত্ত্বেও শেখ। মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ক্ষমতায় যেতে পারল না কেন? জি ডবলিউ চৌধুরী তার “দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’ গ্রন্থে আরাে পরিষ্কার করে বলছেন “পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত শ্বেতপত্রে খসড়া ঘােষণা পত্রের সংক্ষিপ্তসার দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের মে মাসে আমি এক ব্যক্তিগত সফরে ইসলামাবাদে এবং ঢাকা যাই । তখন এর পুরাে মূল অংশটি পড়ি। ঢাকা-সংলাপের মূল
.———————————————
৫১. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬১
৫২. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃ: ২৬১
৫৩, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বাংলাদেশ লাঞ্ছিত, ডক্টর মাযহারুল ইসলাম অনুদিত বাংলা একাডেমী।
কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৭৩ পৃষ্ঠা: ১৬০, ১৬১
কপি আমার কাছে ভিন্নতর চিত্র তুলে ধরে । শ্বেতপত্রে আপােসের কথা যা বলা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আপােস করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশ রাজ্য’র। (নামকরণও বাংলাদেশ রাজ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়) মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি করা হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়াহিয়ার জন্য আমি যে ফর্মুলা তৈরি করে দিয়েছিলাম, সেটাকে । তার ভিত্তি ছিল অখণ্ড পাকিস্তানসহ ছয় দফা । পীরজাদাকে আমি জিজ্ঞেস করি কেন শ্বেত পত্রের পুরাে বিবরণ প্রকাশ করা হলাে না। এতে তার জবাব ছিল “চাপ প্রয়ােগের মধ্য দিয়ে একটি ঘােষণাপত্র তৈরি করা হয়।”ঐ* এবং সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবের সঙ্গে আপােস-সমঝােতায় আসায় ইয়াহিয়ার যেটুকু ক্ষমতা ছিল, তাও কেড়ে নেয় জান্তা। ইয়াহিয়া অথর্ব হয়ে পড়েন। জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রথম দিকে ঢাকা-সংলাপে আসতে চাননি। কিন্তু আপােসসমঝোতার খবর পৌঁছতেই ২১ তারিখে চলে আসেন ঢাকায়। ২২ মার্চ বসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের সঙ্গে। জাস্তার হয়ে আপােস-সমঝােতা বানচালের জন্য তিনি বলেন, ‘সামরিক আইন প্রত্যাহার করা যাবে না । ১৪ মার্চে তােলা পাকিস্তানের দু’অংশের সংখ্যাগুরু দলের হাতে আলাদা আলাদাভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরকরণ’ বিষয়ক তার সেই দাবির প্রতি রইলেন অনড়। অপরদিকে আপােস-সমঝােতার খবর রাষ্ট্র হয়ে পড়ায় এক দফাপন্থী স্বাধীনতাকামীরা এবার প্রতিরােধে নামে। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস ২৩ মার্চকে প্রতিরােধ দিবস’ ঘােষণা করে পল্টন ময়দানে মার্চ মিছিল করে । আনুষ্ঠানিকভাবে তােপধ্বনির মাধ্যমে তােলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করে ২১ বার তােপধ্বনি করেন কামরুল ইসলাম খসরু এবং পিস্তল ফুটিয়ে পতাকা তােলেন হাসানুল হক ইনু। গীত হলাে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সােনার বাংলা’ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা নুরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদুস মাখন। সালাম জানান বাংলাদেশের পতাকাকে। এরপর তারা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় দীপ্ত চারটি প্লাটুনের অভিবাদন গ্রহণ করেন ‘আমার সােনার বাংলার’ ব্যান্ডের তালে তালে । ওই মুহূর্ত থেকে আমার সােনার বাংলা’ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় গেল অভিষিক্ত হয়ে । অভিবাদন পর্ব শেষ হতেই আ স ম রব একটি খণ্ড মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। শেখ মুজিবের বাসভবনের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন তার বাড়ির গেটে। অথচ শেখ মুজিবের বাড়িতে যাওয়ার কোন প্রােগ্রামই ছিল না স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের । শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে সর্বশেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলাে ২৪ মার্চ । ইয়াহিয়ার দলের মুখ্য আলােচক পাকিস্তান প্লানিং কমিশনের চেয়ারম্যান এম এম
——————————————–
৫৪. দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-১৬৬
আহমদ বৈঠকে খসড়া ঘােষণাপত্রের সংশােধনীও অনুমােদন করিয়ে নেন। বৈঠক শেষে ২৫ তারিখে শেখ মুজিব বলেন “সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে আমাদের কর্তব্য সম্পন্ন করেছি এবং প্রাণপণ প্রচেষ্টা নিয়ােজিত করেছি।”৫৫ একই দিনে তিনি নতুন নির্দেশ জারি করলেন। বললেন, “টেলিফোন ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন, ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন এবং টেলিগ্রাফ ওয়ার্কশপে সকল উৎপাদন বিভাগ অনতিবিলম্বে চালু হবে। তিনি পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। | ২৪ মার্চের বৈঠকে অনুমােদিত খসড়া ঘােষাণাপত্রটি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম জি পীরজাদার সঙ্গে বৈঠকের পর চূড়ান্তভাবে গৃহীত হবার কথা ছিল। পীরজাদারই জানানাের কথা ছিল অনুষ্ঠেয় বৈঠকের সময় । পীরজাদার তরফ থেকে কোন সাড়া এলাে না । এম এম আহমদ ২৫ তারিখ সকালেই রওনা দেন করাচির উদ্দেশ্যে বিনা নােটিশে। এর অর্থ হামলার প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত রাজনৈতিক দলের নেতারা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বিমান ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন ।
যেন আসন্ন মহাপ্রলয়ের সংকেত পেয়ে গেছে ভীত সন্ত্রস্ত পক্ষীকুল নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে প্রাণপণ । ইতােমধ্যে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিদেশীদের ঢাকা ত্যাগ শুরু হয়ে যায় বিদেশী মিশনগুলাে তাদের লােকজন সরানাের কাজও সম্পন্ন করে ফেলে। ইতিহাসের আরেকটি ভয়াবহতম নরমেধ সংঘটনের চূড়ান্ত সময় নির্ধারণ করে। ফেলে জান্তা। ২৬ মার্চ রাত ১ টায় পরিচালিত হবে হামলা। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তৈরি হয়েই বসেছিল। অপেক্ষায় ছিল চূড়ান্ত আদেশের । ২৫ তারিখ সকাল এগারটায় জেনারেল টিক্কার কাছ থেকে নির্দেশ গেল ঢাকা সেনানিবাসে জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজার কাছে। বিলম্ব তার সইছিল না। নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগেই ২৫ তারিখে রাত সাড়ে এগারটায় খাদিম হােসেন রাজা খুলে দিলেন ঢাকা সেনানিবাসের গেট। ট্যাংক, কামান, মর্টার, মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে আসে তৈমুরীয় দানবরা। হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরপরাধ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রাণ নেয় কেড়ে। স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণ করলেন শেখ মুজিব । এবং বেজে উঠলাে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বপ্নের অখণ্ড পাকিস্তানের মৃত্যু ঘণ্টা। আর ‘র’ আটঘাট বাধলাে ।
————————————-
৫৫, বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭৪
৫৬. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৭১
সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক