You dont have javascript enabled! Please enable it!
সিআইএ’র সামরিক চাপ
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারিতে আইউব খান তার আবিষ্কৃত মৌলিক গণতন্ত্রভিত্তিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরােধী দলের প্রার্থী পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ-অনুজা মিস ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে নিজ অবস্থান আরাে সুদৃঢ় করেন। এই নির্বাচন অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও আইউব বিরােধী আন্দোলনকে থিতিয়ে দেয়। আর আইউবের স্তাবকরা নির্বাচনে বিজয়ী আইউবের স্তুতিতে স্তুতিবাদের ক্ষেত্রে এক নতুন রেকর্ড স্থাপন করে। তাকে বানিয়ে ফেলে এশিয়ান দ্য গল। এটি উচ্চাভিলাষী আইউবের আকাঙক্ষাকে আরাে উত্তুঙ্গ করে তােলে দক্ষিণ এশিয়ার নেতা হবার উদগ্র বাসনা তাকে পেয়ে বসে। সিআইএ তক্কে তক্কেই ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার নেতা হবার তার বাসনাকে আরাে খুঁচিয়ে তােলে এবং সেটাকেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করে। আইউব আগ-পিছু না ভেবেই গিলে ফেলেন সিআইএ-র টোপ  অন্যদিকে সিআইএ তৈরি করে রেখেছিল তার শিখণ্ডী। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর কালাবাগের আমির মােহাম্মদ খান সেই শিখণ্ডী । আইউব খতম হলেই পরিকল্পনা মােতাবেক তিনি গিয়ে বসবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের গদিতে। আইউব সিআইএর টোপ গলাধঃকরণ করেন অন্য কারণে। যদিও প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন তার আমেরিকা সফরসূচি প্রত্যাখ্যান করেন তথাপি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বলে তিনি মার্কিনী সাহায্যের ব্যাপারে ছিলেন আস্থাবান।
বিপদের দিনে মার্কিনীরা সমর সম্ভার নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াবে, এ বিশ্বাস ছিল তার দৃঢ়  পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি অনুযায়ী ওই সময় পাকিস্তানের সমরনীতি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত ছিল মার্কিন সমর বিভাগের হাতে। যে সংস্থার মাধ্যমে পেন্টাগন পাকিস্তানের সমরনীতির ওপর খবরদারি করতাে, সেটা মিলিটারি অ্যাসিসট্যান্স অ্যাডভাইজারি গ্রুপ (Military Assistance Advisory Group) সংক্ষেপে ‘ম্যাগ’। রাওয়ালপিণ্ডির সেনা সদর দফতরই ছিল ম্যাগ-এর দফতর। আর ম্যাগের পরিচালনায় ছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনী কর্মকর্তারা সুতরাং তখনাে পর্যন্ত মার্কিনীদের প্রতি অবিশ্বাস পােষণ করার কোন কারণ দেখা দেয় নি আইউবের মনে। ওই বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের ৬ আগস্টে কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স তাদের নেতা শেখ আবদুল্লাহর গ্রেফতার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ওই দিনে। শ্রীনগরে বড় রকমের গােলযােগ হতে পারে বলে পাকিস্তান সরকার ধারণা করে । সিআইএ দিনটিকে সামনে রেখে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
ম্যাগ আইউব খানকে পরামর্শ দেয় যে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে শ্রীনগরের সম্ভাব্য গােলযােগ চরম বিশৃংখলা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে তা থেকে কাশ্মীর দখল পরিকল্পনাকে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে আসা যাবে। কাশ্মীর দখল সহজসাধ্য ব্যাপারে পরিণত হবে। আইউব খান ম্যাগের পরামর্শ তিনটি প্রেক্ষিতে যাচাই করেন । এক, ওই বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে কচ্ছের জলাভূমির অধিকার নিয়ে পাক-ভারত সংঘর্ষে পাকিস্তান যে ক্ষুদ্র বিজয় অর্জন করে, তা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উৎকর্ষ এবং যােগ্যতা সম্পর্কে তার মনে এক ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শ্রেষ্ঠতর এ ধারণা তার মনে দৃঢ়ভাবে শেকড় গেড়ে বসে। ওই ভ্রান্ত ধারণা ম্যাগের পরিকল্পনায় তার সামনে কাশ্মীর দখলের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে ধরে। দুই, কাশ্মীর বিজয় মানেই দক্ষিণ এশিয়ার নেতা হবার সুপ্ত বাসনার বাস্তবায়ন। তিন, যেহেতু পরামর্শ ম্যাগের সেহেতু বড় রকম বিপদ দেখা দিলে অনিবার্য কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসবে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করে। অতএব, আইউব খান সানন্দে গ্রহণ করেন ম্যাগের পরামর্শ এবং গর্তে পা ফেলেন অবধারিতভাবে ডুবে যাওয়ার জন্য ম্যাগ পরিকল্পনা তৈরি করে পেশ করলাে আইউবের কাছে। ৫ আগস্টের চারপাঁচদিন আগ থেকে অস্ত্র-শস্ত্র ও খাদ্য সম্ভারসহ কয়েক হাজার লােকের অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে কাশ্মীরের উরি-পুঞ্চ এলাকায়। এখান থেকে হাঁটা পথ রয়েছে শ্রীনগরে যাবার । অনুপ্রবেশ ঘটাবার জন্যে এর চেয়ে উত্তম স্থান আর নেই। কেননা, ভারতীয়রা। এলাকাটিকে বিপজ্জনক এলাকা মনে করে না। তাই সেখানে প্রহরার কোন ব্যবস্থাও রাখে নি তারা। এখান থেকে পায়ে হেঁটে অনুপ্রবেশকারীরা ৪ আগস্ট রাতের অন্ধকারে ঢুকে পড়বে শ্রীনগর শহরে। দিনের আলাে ফুটতে পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী সময়মত নেমে পড়বে শেখ আবদুল্লাহর সমর্থনে।
গােলযােগ চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করাতে পারলে পরবর্তী কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়া হবে। অনুপ্রবশকারীদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা হবে গােপন বেতার মারফত। পরিকল্পনায় উরি-পুঞ্চ এলাকায় গােপন এয়ার ড্রপিংয়ের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ ঘটাবার কথা বলা হয়। আইউব খান ম্যাগের পরিকল্পনা অনুমােদন করেন এবং তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান নূর খানকে ম্যাগের পরিকল্পনা কার্যকর করতে নির্দেশ দেন। অনুপ্রবেশ ঘটাবার জন্য লােক সংগ্রহ করা হয় উপজাতীয় এলাকা থেকে । হালকা অস্ত্র-শস্ত্র এবং খাদ্য সম্ভার দিয়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনী গােপনে আকাশ পথে কয়েক হাজার উপজাতীয়কে উরি-পুঞ্চ এলাকায় নামিয়ে দেয় ৫ আগস্টের দিন পাঁচেক আগে। শ্রীনগরে ঢােকার আগের রাতে অনুপ্রবেশকারীদের দেখে ফেলে এক রাখাল বালক । দেখা মাত্রই সে ধরে নেয় এরাই সেই ‘কাবালি লােক।’ এই ‘কাবালি লােক’ কারা? ১৯৪৮ সালের কথা। খান আবদুল কাইউম খান তখন পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী।
ওই সময় তিনি বিপুল সংখ্যক উপজাতীয় লােক কাশ্মীরে ঢুকিয়ে দেন গােলযােগ পাকাবার লক্ষ্যে। অনুপ্রবেশকারী উপজাতীয়র: ভারতীয় এলাকায় বেপরােয়া লুটপাট চালায়। ওই অনুপ্রবেশের কারণেই বেধে যায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে প্রথমবারের মতাে যুদ্ধ। উপজাতীয়দের লুটতরাজের কাহিনী বয়ােজ্যেষ্ঠদের মুখে ফিরতে সর্বদা। দিনের পর দিন শুনতে শুনতে ওই লুটেরা উপজাতীয়দের পােশাক-আশাক, চেহারা-সুরত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে। বয়ােকনিষ্ঠদের মনে। রাখাল বালক অনুপ্রবেশকারী উপজাতীয়দের পােশাক-আশাক দেখেই বুঝে ফেলে এরাই সেই ‘কাবালি লােগ’ মানে লুটেরার দল,—আবার এসেছে লুটপাটের জন্যে। মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে সে নিজের লােকজনদের গিয়ে খবর দেয় উও কাবালি লােগ ফের আ গিয়া’ অর্থাৎ লুটেরারা আবার এসে গেছে। স্থানীয় লােকজন দৌড়ে গিয়ে খবর দেয় নিকটতম পুলিশ স্টেশনে। সেখান থেকে মুহূর্তে খবর চলে যায় শ্রীনগরে কাশ্মীর সরকারের কাছে এবং শ্রীনগর থেকে দিল্লীতে কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী পেছন থেকে এসে ঘেরাও করে ফেলে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের। গোপন বেতার মারফত এ খবর পৌছে যায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে। এমন অঘটন ঘটবে, আশা করেন নি আইউব খান। ম্যাগের কাছে জানতে চাইলেন, এখন কি করা হবে? উপজাতীয়দের ফিরিয়ে আনা হবে কিভাবে? ম্যাগ পরামর্শ দেয় চাম্ব সেক্টর দিয়ে সেনাবাহিনীর নিয়মিত ইউনিট ঢুকিয়ে দিতে । ম্যাগের পরামর্শে আইউব খান একটি প্রচলিত যুদ্ধের (Conventional War) সম্ভাবনা দেখতে পান। তাতে বিপদের মাত্র বাড়বে বৈ কমবে না।
আইউব দ্বিধাষিত হয়ে পড়েন চাম্ব সেক্টর দিয়ে সেনাবাহিনীর নিয়মিত ইউনিট প্রেরণের ব্যাপারে । কিন্তু ম্যাগ তাকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে যেহেতু কাশ্মীর একটি বিতর্কিত অঞ্চল, সংঘর্ষ কাশ্মীর সীমানার মধ্যেই সীমিত থাকবে। এই সংঘর্ষ আন্তর্জাতিক সীমান্তে সম্প্রসারিত হবার সুযােগ নেই। তাছাড়া ভারতীয়রা অতটা ঝুঁকি নিতে চাইবে না। আইউব খানকে ম্যাগের পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়। কেননা, তখন পেছানাের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।  ম্যাগের পরামর্শ কার্যকর করা হলাে। মেজর জেনারেল আখতার হােসেন মালিকের অধিনায়কত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত ইউনিট জম্মু-কাশ্মীর সীমান্ত অতিক্রম করে এবং সূচিত হয় ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধের । ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজেদের এলাকায় ঢুকে পড়া পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেয় বটে, কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আঘাতের মুখে পিছু হটতে হয়। আখনুর ও জারিয়ান দখলে এসে যায় পাকিস্তান বাহিনীর। এরপর তারা লক্ষ্য স্থির করে জম্মুর দিকে।  নিজের সেনাবাহিনীর এ তথাকথিত সাফল্যে আইউব খান অতিমাত্রায় উৎসাহিত হয়ে ওঠেন এবং ম্যাগের পরবর্তী ফাদে পা ঢােকান। ম্যাগ শ্রীনগর দখলের পরামর্শ দেয়। আইউব ম্যাগের এই পরামর্শের মধ্যে তার কাশ্মীর বিজয়ী বীর হবার সুপ্ত বাসনা বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দেখতে পান। পরামর্শ অনুযায়ী আইউব খান তার সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অংশকে শ্রীনগরের দিকে ধাবিত হবার নির্দেশ দেন।
এমন কী লাহােরের দিক থেকে ভারতীয়দের সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণ মােকাবিলার জন্য এই সেক্টরে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক সেনা ইউনিটও রাখেন না। কেননা, ম্যাগের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে একটি বিতর্কিত এলাকার সংঘর্ষকে ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্তে সম্প্রসারিত করবে না। সিআইএ এবার তার শেষ চালটি চালে । দিল্লীকে পরামর্শ দেয় খেমকারান সেক্টর দিয়ে অরক্ষিত লাহােরে ঢুকে পড়তে এবং ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ। ৫ আগস্ট শ্রীনগরকে সামনে রেখে সিআইএ যে। চক্রান্ত রচনা করে, ৬ সেপ্টেম্বর তা চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌছে দেয় । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তি, সামর্থ্য এবং যােগ্যতা সম্পর্কে সিআইএ’র সম্যক ধারণ ছিল। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখােমুখি করানােই ছিল তার চক্রান্তের লক্ষ্য এবং ধরেই নেয় যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় অবধারিত। আর কোন পরাজিত সেনাবাহিনীর নেতার পক্ষে ক্ষমতায় আসীন থাকা সম্ভব নয়। তাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। স্বেচ্ছায় সরতে না চাইলে বলপূর্বক সরানাে হবে । সরিয়ে দেবার পক্ষে যুদ্ধে হেরে যাবার গ্লানি আর অবমাননাকে জোরালাে যুক্তি হিসেবে খাড়া করা হবে। আইউব খানের অপসারণের পর যাকে ক্ষমতায় বসানাে হবে, সারা পাকিস্তানব্যাপী তার একটা ভাবমূর্তি ইতােমধ্যে তৈরি করে ফেলে সিআইএ। তিনি তৈরি হয়েই ছিলেন। যুদ্ধটা শেষ হতেই তিনি প্রেসিডেন্টের গদিতে গিয়ে বসবেন। আগেই তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর কালাবাগের আমির মােহাম্মদ খান, মার্কিনীদের বিশেষ প্রীতিভাজন ব্যক্তি ৬ সেপ্টেম্বর খেমকারান সেক্টর দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করতেই হকচকিয়ে যান আইউব  বুঝতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না কি এক ভয়ঙ্কর ফাঁদে তিনি পা গলিয়েছেন। ওই সন্ধ্যায় তিনি পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ম্যাকনােগিকে ডেকে পাঠান।
মার্কিন দূতাবাস তখন ছিল করাচিতে। কিন্তু ৬ সেপ্টেম্বরের দিন কয়েক আগেই রাষ্ট্রদূত ম্যাকনােগি এসে আসন গেড়ে বসেন রাওয়ালপিন্ডিতে । সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়ে তিনি আইউব খানকে যুদ্ধ সম্পর্কে মার্কিনী মহলের রিপাের্ট প্রদান করেন এবং ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্পর্কে আগাম মতামত ব্যক্ত করে বলেন, “Mr. President, the Indians have caught you by neck, If you want us, we can help in releasing the grip.” (“মি, প্রেসিডেন্ট, ভারতীয়রা এখন আপনার গলা টিপে চেপে ধরেছে । আপনি যদি চান, আমরা আপনাকে চাপমুক্ত করতে পারি।”) আইউব খান ম্যাকনােগির এ কথায় রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং বলেন। “Who has caught whom by the neck we will see and we will fight it out (“কে কার গলা চিপে ধরেছে, আমরা তা দেখে নেব)।” আইউব খান ওই মুহূর্তে ম্যাগনােগিকে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করতে নির্দেশ দিলেন। শুধু প্রেসিডেন্ট ভবন নয়, পরদিনই ম্যাগনােগি রাওয়ালপিন্ডি ছেড়ে করাচি চলে যান।
ওই রাতেই আইউব খান ম্যাগকে অপসারণ করে সেনাবাহিনীর কমান্ড নিজ হাতে তুলে নেন এবং শ্রীনগর অভিমুখী সেনা ইউনিটকে মুখ ঘুরিয়ে খেমকারান সেক্টরে এসে ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার আদেশ দেন । শ্রীনগর অভিমুখী সেনা ইউনিটের সর্বপশ্চাৎ অংশ ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। মুখ ঘুরানােতে সর্বপশ্চাৎ অংশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেনা ইউনিটের অগ্রবর্তী অংশ হয়ে যায় এবং সর্বাগ্রে ভারতীয় বাহিনীর মুখােমুখি হতে হয় এদেরকেই । যুদ্ধের ইতিহাসে খেমকারান সেক্টরে বাঙালি তৈরি করে এক অমিত বিক্রম সাহসের দৃষ্টান্ত। তাদের প্রচণ্ড প্রতিরােধের মুখে লাহােরের উপকণ্ঠে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা। আইউব খান এবার সাহায্যের জন্য পিকিংয়ের প্রতি অনুরােধই শুধু জানান না; মস্কোর দিকেও মুখ ফেরান।  সেনাবাহিনীর কমান্ড হাতে নেবার পর পরই প্রেসিডেন্ট আইউব পাকিস্তানে অবস্থানরত প্রতিটি মার্কিনীর গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দেন। আরাে আদেশ করেন, কোন আমেরিকান যদি কোন পাকিস্তানি কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে, ওই পাকিস্তানি কর্মকর্তা, তা তিনি মন্ত্রীও যদি হন,তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
যুদ্ধ চলাকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এম এ শােয়েবের সঙ্গে দেখা করেন এক মার্কিনী কূটনীতিক। পরদিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন প্রধান এ বি আওয়ান শােয়েবের অফিসে গিয়ে হাজির হন এবং আমেরিকান কূটনীতিকের সঙ্গে কি বিষয় নিয়ে তার আলাপ হয়েছে, জানতে চান। মন্ত্রী এম এ শশায়েব পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থার প্রধানের এহেন প্রশ্নে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। জানতে চান কোন অধিকার বলে তিনি এই স্পর্ধা দেখাতে সাহসী হয়েছেন। গােয়েন্দা প্রধান শশায়েবকে প্রেসিডেন্টের গােপন নির্দেশনামা দেখাতে তিনি যারপরনাই নরম হয়ে যান এবং আমেরিকান কূটনীতিকের সঙ্গে তার আলােচনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। যুদ্ধের পর আইউব শােয়েবকে মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত করেন।  পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর কালাবাগের আমির মােহাম্মদ খান সম্পর্কে আগে থেকেই প্রশ্নবােধক চিহ্ন ছিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার। যুদ্ধ যখন চলছিল তখন হঠাৎ করে তার লাহাের থেকে করাচি রওনা হওয়ায় সতর্ক হয়ে ওঠে তারা। আমির মােহাম্মদ খান তখনাে জানতে পাননি প্রেসিডেন্টের নির্দেশনামার খবর । এমন কি জানতে পাননি অর্থমন্ত্রীর জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টিও করাচিতে আমির মােহাম্মদ খান গিয়ে ওঠেন ওয়েস্ট পাকিস্তান হাউজে। গভীর রাতে দেখা গেল হাউজ থেকে বেরিয়ে আসছে কালাবাগের আমিরের গাড়ি।
আরােহী মাত্র দুজন— তিনি এবং ড্রাইভার। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ম্যাকনােগির বাড়ির প্রতি নজর রাখার ডিউটিতে ছিলেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার একজন পদস্থ কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তাটি বাঙালি,—নাম এ বি এস সফদার তাকে টেলিফোনে
জানান দেয়া হয় গভর্নরের গাড়ি ওয়েস্ট পাকিস্তান হাউজ থেকে বেরিয়ে গেছে  তিনি নড়ে চড়ে বসেন। শ্যেন পক্ষীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন রাষ্ট্রদূত ম্যাকনােগির বাড়ির দিকে। খানিক পর দেখেন গভর্নরের গাড়ি ঢুকছে রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের গেট দিয়ে । যতক্ষণ গভরি বেরিয়ে না আসেন ততক্ষণ তিনি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ঘণ্টা দেড়েক পর আমীর মােহাম্মদ খান বেরিয়ে আসেন ম্যাকনােগির বাসভবন থেকে  গােয়েন্দা কর্মকর্তা এবিএস সফদার ওই রাতেই রাওয়ালপিন্ডিতে তার প্রধান এবি। আওয়ানের কাছে এই বার্তাটি পাঠিয়ে দেন ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি টপ সিক্রেট’ মার্ক করে পরদিন সকাল হতেই এ বি আওয়ান প্রেসিডেন্টের টেবিলে পাঠিয়ে দেন বার্তাটি এবং আইউব খান পরের দিনই আমির মােহাম্মদ খানকে ডেকে পাঠান রাওয়ালপিন্ডিতে আইউব খান তাকে কি বলেছিলেন জানা যায় নি। তবে যুদ্ধ শেষ হবার মাস তিনেক পর প্রবল প্রতাপশালী কালাবাগের আমির মােহাম্মদ খান আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান।  দুই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে মস্কোর কি। ভূমিকা হতে পারে, তারও একটা হিসেব ছিল সিআইএ-র ।
সিআইএ-র হিসেব কষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাকিস্তান অধিকমাত্রায় পিকিংয়ের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে মস্কো নীরব দর্শকের ভূমিকা নেবে। তাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিআইএ-র পক্ষে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থার সৃষ্টি হবে। কিন্তু রুশ নেতৃবৃন্দের যুদ্ধ। বিরতির আহবানে সাড়া দিতেই অবাক হয়ে যায় মার্কিন প্রশাসন। দৌড়ের শেষ মাথায় এসে মস্কো তাদের সকল পরিকল্পনা এমনভাবে ভণ্ডুল করে দেবে, কল্পনাও করে নি সিআইএ কর্মকর্তারা। রুশ প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের সরাসরি হস্তক্ষেপে ১৭ সেপ্টেম্বর যুদ্ধরত দু’পক্ষ যুদ্ধ বিরতি করে এবং ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে কোসিগিনের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত পাক-ভারত শীর্ষ সম্মেলনে আইউব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী মুখােমুখি বসেন তাসখন্দে। সম্মেলন ভাঙতে ভাঙতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত কোসিগিনের চেষ্টায় দু’ নেতা এক শান্তি চুক্তিতে আসেন। যুদ্ধ বিরতি এবং তাসখন্দ চুক্তি সেনাবাহিনীর মধ্যে আইউবের ভাবমূর্তিকে বিপর্যয়ের মুখােমুখি এনে দাঁড় করায় না শুধু, সারা পাকিস্তানব্যাপী তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের রােষ ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে থাকে। বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালের ৬ নভেম্বর। ওইদিন রাওয়ালপিণ্ডির বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা এক প্রতিবাদী মিছিল বার করে । মিছিলে পুলিশের গুলিতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একজন ছাত্র নিহত হয়। আর ১৩ নভেম্বর পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালি) সভাপতি ওয়ালি খানকে আটক করা হয়। এবার সারা পশ্চিম পাকিস্তান আইউবের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে।
অপরদিকে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ কালীন পূর্ব পাকিস্তানি জনগণকে নতুন উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ করে । পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতীয় আক্রমণের মুখে পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ নিজেদেরকে নিতান্ত অসহায় ভাবতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল,’—পাকিস্তানি জেনারেলদের এই তথাকথিত রণকৌশল একটি স্পষ্ট প্রতারণা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে বাঙালি জনগােষ্ঠীর প্রতি পাকিস্তান সরকারের বঞ্চনার আরেকটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায় ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ। ফলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার জনগণ উপরন্তু যুদ্ধ জীবনযাত্রার ব্যয় দেয় বাড়িয়ে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সাধারণ জনজীবনকে করে দেয় বিপর্যস্ত  অতএব, মস্কোর হস্তক্ষেপের দরুণ আইউব উৎখাত চক্রান্ত ভণ্ডুল হয়ে গেলেও যুদ্ধ পরবর্তী জন-অসন্তোষের সুযােগ নেয় সিআইএ। তার দ্বিতীয় প্রকল্প অর্থাৎ রাজনৈতিক চাপ প্রয়ােগের পরিকল্পনা, সেটা নিয়ে মাঠে নামে। ছয় দফাই সেই রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির প্রকল্প।

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!