You dont have javascript enabled! Please enable it!
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি
১, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।
২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করে ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হবে। উচ্চ হারের খাজনা ন্যায়সংগতভাবে হ্রাস করা হবে এবং সাটিফিকেটযােগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হবে। পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে একে পূর্ব বাংলা সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনয়ন করে পাটচাষিদের পাটের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলে পাট কেলেঙ্কারি তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সবার শাস্তির ব্যবস্থা ও তাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। 
৪. কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে এবং সরকারি সাহায্যে সব ধরনের কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হবে। পূর্ব বাংলাকে লবণশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য সমুদ্র উপকূলে কুটির শিল্প ও বৃহৎ শিল্পের লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন করা হবে এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলের লবণের কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে। 
৬. শিল্প ও কারিগরি শ্রেণির গরিব মােহাজেরদের কাজের আশু ব্যবস্থা করে তাদের পুনর্বসতির ব্যবস্থা করা হবে। 
৭. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করে দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল হতে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হবে।  পূর্ব বাংলাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করে এবং কৃষিকে আধুনিক যুগােপযােগী করে শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সব ধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। 
৯, দেশের সর্বত্র একযােগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হবে এবং শিক্ষকদের ন্যায়সংগত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।
১০. শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকর করে কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে এবং সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলাের বর্তমান ভেদাভেদ উঠিয়ে দিয়ে একই পর্যায়ভুক্ত করে সব বিদ্যালয়কে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।
১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কালাকানুন বাতিল ও রহিত করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলােকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হবে এবং ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয়সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হবে। শাসনব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হবে এবং এতদুদ্দেশ্যে উচ্চ বেতনভােগীদের বেতন কমিয়ে ও নিম্ন বেতনভােগীদের বেতন বাড়িয়ে তাদের আয়ের একটি সুসংগত সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। যুক্তফ্রন্টের কোনাে মন্ত্রী এক হাজারের বেশি বেতন গ্রহণ করবেন না।
১৩, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, ঘুষ-রিশওয়াত বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা করা হবে এবং এতদুদ্দেশ্যে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি পদাধিকারী ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ নেওয়া হবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে না পারলে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
১৪. জননিরাপত্তা আইন, অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করে বিনা বিচারে আটক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে। রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হবে এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হবে। 
১৫. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা হবে। যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহীদ হয়েছেন, তাঁদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে এবং তাদের পরিবারগুলােকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘােষণা করে তাকে সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করা হবে। লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌম করা হবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ছাড়া আর সব বিষয় পূর্ব বাংলার সরকারের হাতে আনা হবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।
২০. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা কোনাে অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াতে পারবে আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস আগেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হবে, তিন মাসের মধ্যে তা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে এবং পরপর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনােনীত প্রার্থী পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
সূত্র : হক ও আলম, পৃ. ২৯৫-২৯৬

সূত্রঃ   আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!