শ্রাবণ , ১৩৭৮ সোমবার, ২৬ জুলাই ১৯৭১
কলকাতা ও লন্ডন থেকে যুগপৎ সাংবাদিক সম্মেলনে যথাক্রমে বাংলাদেশের মিশন প্রধান জনাব হোসেন আলী এবং বাংলাদেশ সরকারের ইউরোপের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী ঘোষণা করলেন আগামী ২৯জুলাই বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম ডাক টিকেট প্রকাশিত হবে।
বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন প্রধান হোসেন আলী কর্তৃক বাংলাদেশের নতুন ডাক টিকেটের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বিশ্বের সমস্ত দেশগুলিকে ‘বিপ্লবী ডাকটিকেট’কে অনুমোদন দানের অনুরোধ করা হয়। আট ধরনের মূল্যমানের ডাকটিকেট চালু করা হয়। দশ, বিশ পঞ্চাস পয়সা এবং এক, দুই,তিন, পাঁচ ও দশ টাকার এই বিপ্লবী বাংলাদেশ ডাকটিকেট গুলোর পরিকল্পনা করছেন লন্ডন প্রবাসী প্রখ্যাত বাঙালী শিল্পী ডঃ শ্রীবিমান মল্লিক। দশ পয়সার ডাক টিকেট আছে বাংলাদেশের মানচিত্র, বিশ পয়সায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্তাকাণ্ড, পঞ্চাস পয়সায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রতীক, এক টাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী পতাকা, দুই টাকার টিকিটে আওয়ামীলীগের বিজয়, তিন টাকার টিকিটে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণার প্রতীক, পাঁচ টাকার টিকিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি, দশ টাকার টিকিট গনপ্রজান্তন্ত্রী বাংলাদেশের সমর্থনের জন্য আবেদনের প্রতীক।
নেজামে ইসলামী পার্টির নেতা সৈয়দ মনজুরুল আহসান ও মাওলানা আব্দুল মতিন এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য আলেমদের প্রতি আহবান জানান। বিবৃতিতে রাষ্ট্র বিরোধী ব্যক্তিদের নির্মূল করার ব্যাপারে পাকবাহিনীর গুরুতবপূর্ণ ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। (দৈঃ পাঃ) ৭ খঃ পৃঃ ৬৮৫
দুই দেশের সীমান্তে অব্যাহত উত্তেজনা সম্পর্কে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব উ. থান্ট ভারতীয় ও পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতেদ্বয়ের সাথে পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।
মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ করে।
ন্যাপ প্রধান প্রধান রাজনীতিক মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বাম শক্তিসমূহকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা বাম ডান কিংবা মধ্য-যে পন্থীই হই না কেন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত মাতৃভূমির স্বাধীনতা। তিনি বলেন, কিছু লোক সম্পূর্ন ব্যক্তিস্বার্থে আমাদের মধ্যে বিভেদের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমাদের সবাইকে এসব মীর জাফরদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
ভারতের বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় শ্রীশরণ সিং বলেন, ভারত শ্রীশরণ জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টাকে জানিয়েছেন যে, ভারতসীমান্তে জাতিসংঘ পরিদর্শক প্রেরণ ভারত কোনক্রমে মেনে নেবে না। বাংলাদেশের স্বার্থেই এ প্রস্তাব মেনে নেয়া যায় না।
জাপানের সংসদসদস্য কে, নিশি সূরা (সমাজতন্ত্র দল) কলকাতায় বলেন, বাঙালীদের এই সমস্যা কোনক্রমেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তিনি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। (সংবাদপত্র)
২৬ জুলাই ‘হাউস অব কমন্স’-এর হারকোর্ট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকেট প্রকাশ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়জন করা হয়। পার্লামেন্টের সকল দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং প্রায় ৪০ জন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী সদ্দ-প্রকাশিত ডাক-টিকেটগুলি প্রদর্শন করেন। (জন ষ্টোন হাউস শরণার্থিদের অবস্থা পর্যবেক্ষন এবং বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সংগে পরামর্শের জন্য “ওয়ার অন ওয়ান্ট”-এর পক্ষ থেকে কয়েকবার মুজিবনগর যান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের সংগে আলোচনার সময় ডাক-টিকেট প্রকাশনার একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই ব্যাপারে জন ষ্টোনহাউস সরাসরি মুজিবনগরের নির্দেশ ও দায়িত্বে কাজে করেছিলেন। বাংলাদেশ ফান্ড কিংবা ষ্টিয়ারিং কমিটি ডাক-টিকেট বাবদ কোন অর্থ ব্যয় করেনি।… মিঃ ষ্টোনহাউস ডাক-টিকেটগুলো মুজিবনগর সরকারের নিকট পাঠিয়েছেন এবং ইউরোপে বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। বিচারপতি চৌধুরীর স্মৃতিকথা “প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের
দিনগুলি”) বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের লীগদলিয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
দশ পয়সার টিকেটে বাংলাদেশের মানচিত্র এবং পাঁচ-পয়সার টিকেটে শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয় বাংগালী গ্রাফিক-শিল্পী বিমান মল্লিক ডাক টিকেটগুলির নক্সা তৈরি করেন। বিদেশে চিঠিপত্র পাঠাবার জন্য ভারত সরকার টিকেটগুলি ব্যবহার করবার অনুমতি দিয়েছেন বলে উদ্যোক্তারা প্রকাশ করনে। ২৯শে জুলাই থেকে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, দূরপ্রাচ্য এবং বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে টিকেটগুলি পাওয়া যাবে বলে তাঁরা জানান। ব্রিটেনের প্রাক্তন পোষ্টমাষ্টার-জেনারেল (মন্ত্রী) জন ষ্টোনহাউস, পিটার শোর এবং অন্যান্য অতিথিদের উপস্থিতিতে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ডাক-টিকেটগুলি জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখ্যযোগ্য পদক্ষেপ বলে গণ্য করা হবে। বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, আগষ্ট মাস শেষ হওয়ার আগেই ব্রিটেনে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। হানাদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়াই বর্তমানে বাঙালীদের একমাত্র কর্তব্য। শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক ঘোষণার উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন,এই ঘোষণা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বাংগালী জাতি স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হবে। এই হীন উদ্যোগের বিরোধীতা করার জন্য তিনি বিশ্বের শান্তিকামী জনগণও বিভিন্ন দেশের সরকারের নিকট আকুল আবেদন জানান।
এ দিন ঢাকা থেকে সাহিত্যিক সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফর পাকবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে প্রকাশিত করেন ‘অভিযোগ’ পুস্তিকা, ঐ পুস্তিকায় তিনি লিখলেনঃ ‘শেখ মুজিবকে কেন্দ্র ক’রে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভূমিকা অপ্রতিরোধ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের মুখোশ ফেলে দিয়ে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী স্বরূপে আত্নপ্রকাশ করেছে। তাঁদের বর্বর অত্যাচারের ভেতর দিয়ে যে-কথাটা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে তা’ হোল বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রাদায়কে সম্পূর্ন ধ্বংস ক’রে অবশিষ্ট বাঙালীকে এমন একটি পঙ্গু সশস্ত্র মানব গোষ্ঠীতে পরিণত করা। যারা আর কোন যুগে বাঙালী জাতীয়তাবাদের অহমিকায় মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়াতে সাহস করবে না।… গত চার মাস ধরে আমাদের দেশকে ঘাতক ইয়াহিয়া এবং তাঁর সামন্ত বর্গের কর্তৃত্বধীন একটি পশুশালা বলে। বিবেচনা করছি আর ঘন্টা-চুক্তিতে প্রতি মুহূর্তের সন্দেহ এবং জীবন সংশয় নিয়ে মতই বেঁচে থাকছি। (পৃঃ ৩) উল্লেখ্য, পুস্তিকার দীর্ঘ বক্তব্য এক্ষেত্রে সংক্ষেপ করা সম্ভব নয় যাহোক পরবর্তীতে ঢাকা থেকে পালিয়ে সিকান্দার আবু জাফর মুজিব নগরে পৌঁছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদের নির্দ্দেশে নভেম্বর মাসে ‘অভিযোগে’ পুস্তিকাটি পুনঃ মুর্দ্রন করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করে শোনান হয়। ]
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী