You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.03.25 | ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া পাকিস্তানের ক্ষমতা নেন - সংগ্রামের নোটবুক
নির্বাচন
আইয়ুব খানের তৈরি ‘৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে জাতীয় পরিষদের স্পিকারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা। বাঙালি স্পিকার আবদুল জব্বার খান আইয়ুবের একান্ত অনুগত হলেও আইয়ুব তাকে বিশ্বাস করেননি। সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াই তিনি ভালাে মনে করেছিলেন।  জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে পাকিস্তানের ক্ষমতা হাতে নেন। রাষ্ট্রীয় কাজের সুবিধার জন্য ৩১ মার্চ তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেন। সেনাসদরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরের প্রধান নির্বাহী হলেন প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল সৈয়দ গােলাম মােহাম্মদ মহিউদ্দিন পীরজাদা। একটি জাতীয় নিরাপত্তা সেল তৈরি করা হলাে। এর কাজ হলাে সব গােয়েন্দা দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রেসিডেন্টের জন্য একটি সমন্বিত প্রতিবেদন তৈরি করা। আগে একেক গােয়েন্দা দপ্তর থেকে একেক রকমের তথ্য পাওয়া যেত এবং এটি আইয়ুব খানকে যথেষ্ট ভুগিয়েছে। ফলে। আন্তবাহিনী গােয়েন্দা দপ্তর (আইএসআই), গােয়েন্দা ব্যুরাে (আইবি), পুলিশের গােয়েন্দা দপ্তরগুলাে (সিআইডি ও স্পেশাল ব্রাঞ্চ) এবং সামরিক গােয়েন্দা দপ্তরকে (এমআই) একটি চেইনের মধ্যে নিয়ে আসা হলাে। জাতীয় নিরাপত্তা সেলের প্রধান নিযুক্ত হলেন মেজর জেনারেল গােলাম উমর। লে. জেনারেল আবদুল হামিদ খানকে জেনারেল পদমর্যাদা দিয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ করা হলাে। হামিদ-পীরজাদা-উমর এই ত্রয়ী ইয়াহিয়ার চারদিকে একটি বলয় তৈরি করতে সমর্থ হলেন, যা ভেদ করে বাইরের পৃথিবী দেখার ক্ষমতা ইয়াহিয়া হারিয়ে ফেললেন।
এর আগেও দেখা গেছে, সামরিক শাসন চালু হলে জেনারেলরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতাে জিহাদ শুরু করে দেন। অসামরিক সরকারের সময় দেখা যায়, রাষ্ট্র চুনােপুঁটিদের দুর্নীতি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। কারণ, বড় দুর্নীতিবাজগুলাে সরকারের ভেতরেই থাকে। সামরিক শাসনের শুরুতে দুর্নীতির দায়ে রুই-কাতলাদের ধরার একটি আয়ােজন থাকে। এতে সেনাশাসকেরা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। ইয়াহিয়া খানের শুরুটাও হলাে তেমনভাবেই। দুর্নীতিবাজদের একটি লম্বা তালিকা তৈরি হলাে। আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল আইয়ুবের অনুগত আমলাবাহিনী। ৩০৩ জনকে নানাভাবে শায়েস্তা করা হলাে। তাদের অনেকেই চাকরি হারালেন। তালিকার পয়লা নম্বরেই ছিলেন আইয়ুবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত তথ্যসচিব আলতাফ গওহর। অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে  ছিলেন এন এ ফারুক ও ফিদা হাসান। তালিকাভুক্ত কর্মকর্তাদের বলা হলাে ‘থ্রি নট থ্রি’। এ নামে একটি রাইফেল আছে, যা সাধারণ সেনারা ব্যবহার করেন। এই রাইফেলের নলের ব্যাস শূন্য দশমিক ৩০৩ ইঞ্চি। এ জন্যই এই নামকরণ। থ্রি নট থ্রি নামটা বেশ চাউর হলাে। পীরজাদা একসময় প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সামরিক সচিব ছিলেন।
১৯৬৪ সালের দিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আইয়ুব তাকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য পীরজাদা কখনােই আইয়ুবকে ক্ষমা করতে পারেননি। ১৯৬৬ সালে আইয়ুব একই কাজ করেছিলেন ভুট্টোকে নিয়ে। তাসখন্দ চুক্তির অল্প কয়েক দিন পরই ভুট্টো তাঁর মন্ত্রিত্ব হারান। শুরু হয় ভুট্টো-পীরজাদা আঁতাত, যা পরে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রেখেছিল।  ক্ষমতা নেওয়ার পর ইয়াহিয়া ২৬ মার্চ তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে ঘােষণা করেন, একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযােগী পরিবেশ তৈরি করা ছাড়া তার আর অন্য কোনাে উদ্দেশ্য নেই। তিনি আরও বলেন যে একটি স্বচ্ছ ও সৎ প্রশাসন হচ্ছে সুষ্ঠু ও গঠনমূলক রাজনীতি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটের ভিত্তিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বশর্ত। পাকিস্তানি কবি রইস আমরােহী ক্ষমতার এই পালাবদলকে উর্দুতে ছন্দোবদ্ধ করেছিলেন : সালটা ছিল আটান্ন কিংবা উনসত্তর আমার কাছে অর্থ একই দুটোর। ময়লা জমতে লেগেছে দশ বছর সাফ করছি দশ বছর অন্তর।
সুলতান মােহাম্মদ খান তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরে সচিব)। কবিতার এই লাইনগুলাে তিনি ইয়াহিয়াকে পড়ে শােনান। শুনেই ইয়াহিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ অসামরিক কর্মকর্তাদের সভা ডাকলেন। সামরিক আইন জারির পটভূমি ব্যাখ্যা করে তিনি একটি ভাষণ দিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, কারও কোনাে প্রশ্ন আছে কি । কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব কুদরতউল্লাহ শাহাব অতীতে একাধিক সরকারের উত্থান-পতন দেখেছেন। তিনি একজন উচ্চ মানের লেখক হলেও কথাবার্তায় মােটেও চৌকস ছিলেন না। সামরিক শাসনের অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বললেন, রাস্তাঘাট সাফ করা, মশা-মাছি মারা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ—সামরিক সরকারের অতি পছন্দের এসব কাজ বাদ দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার দিকে নজর দেওয়া দরকার। ইয়াহিয়া এ রকম মন্তব্য আশা করেননি। শাহাব বরখাস্ত হলেন। | সামরিক আইন জারি করার পর চতুর্দশ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মুজাফফর উদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তানের (জোন-বি) আঞ্চলিক সামরিক আইন। প্রশাসক নিয়ােগ করা হয়। ৩১ মার্চ ইয়াহিয়া খান নিজেকে দেশের প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করার কয়েক দিন পর মুজাফফর উদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নরের দায়িত্ব পান। আহসান ১ সেপ্টেম্বর গভর্নর হিসেবে শপথ নেন। মুজাফফর উদ্দিন দুই মাস পর পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলে তার জায়গায় চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ডারের দায়িত্ব পান মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের স্টাফ অফিসার হিসেবে বেসামরিক বিষয়গুলাের দেখভাল করতে থাকেন।
৪ আগস্ট ইয়াহিয়া অসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে ১০ সদস্যের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন বাঙালি—এ কে এম হাফিজুদ্দিন, শামসুল হক, আহসানুল হক, ডা. আবদুল মােতালেব মালেক ও অধ্যাপক গােলাম ওয়াহেদ চৌধুরী। ছয়জন বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তাকে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়। সব মন্ত্রণালয়ে নির্দেশ যায়, কোনাে পদ শূন্য হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেন বাঙালিদের নিয়ােগ দেওয়া হয়। | ইয়াহিয়া রাজনৈতিক নেতাদের একসঙ্গে ডেকে নিয়ে কোনাে সম্মেলন করেননি। তিনি আলাদা করে সবার সঙ্গে দেখা করে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। একটি সাধারণ নির্বাচন আয়ােজনের আগে তিনি চেয়েছিলেন সবার মন বুঝতে এবং মতামত যাচাই করে দেখতে। কিন্তু পরস্পরবিরােধী কথাবার্তা শুনে তিনি অনেক সময় হতবুদ্ধি হয়ে পড়তেন। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলােচনায় তিনটি বিষয় উঠে আসে, যা ইয়াহিয়াকে ভাবিয়ে তােলে। বিষয়গুলাে ছিল : প্রথমত, বাঙালিদের পক্ষ থেকে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের দাবি; দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রের সঙ্গে প্রদেশের সম্পর্ক কেমন হবে; এবং তৃতীয়ত, পশ্চিম পাকিস্তান ‘এক ইউনিট’ হিসেবে থাকবে কি থাকবে । গভর্নর আহসান ও মন্ত্রী জি ডব্লিউ চৌধুরী শেখ মুজিবকে বােঝানাের চেষ্টা করেন যে ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের দাবিগুলাের ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদনশীল এবং এটাই বাঙালিদের জন্য শেষ সুযােগ। শেখ মুজিব দৃশ্যত ইয়াহিয়ার ওপর ক্রমশ আস্থাশীল হয়ে উঠছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া ও আহসানকে এমনও বলেছিলেন যে তার ছয় দফা কোরআন বা বাইবেল নয় এবং একটি সমঝােতায় পৌছানাে খুবই সম্ভব। অধ্যাপক চৌধুরীর সঙ্গে আলােচনা করার সময় শেখ মুজিব দেয়ালে ঝােলানাে সােহরাওয়ার্দীর ছবির দিকে তাকিয়ে একদা বলেছিলেন, এই মহান নেতার শিষ্য হয়ে আমি পাকিস্তান ভাঙার কথা কেমন করে ভাবতে পারি?’ ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিব দুজনই আশাবাদী ছিলেন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিরাজমান জটিল সম্পর্কের একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভবপর হবে। 
রাজনীতিবিদদের মতানৈক্যের পটভূমিতে ইয়াহিয়া নিজেই ঠিক করলেন তার করণীয় কী? ২৮ নভেম্বর (১৯৬৯) দেশব্যাপী প্রচারিত এক বেতার ভাষণে তিনি কয়েকটি বিকল্প সম্ভাবনার উল্লেখ করেন। বিকল্পগুলাে হলাে : ১) একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিশন আহ্বান করা, যার কাজ হবে নতুন একটি সংবিধান তৈরি করা। এরপর কমিশন বিলুপ্ত হবে। ২) ১৯৫৬ সালের সংবিধান পুনর্বহাল করা। ৩) একটি সংবিধান তৈরি করে তার ওপর গণভােট আয়ােজন করা । ৪) আগের সংবিধানগুলাের বিশ্লেষণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের সঙ্গে আলােচনা এবং জনমতের ওপর ভিত্তি করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি আইনি কাঠামাে দেওয়া।  সব বিকল্পের সুবিধা-অসুবিধা বিচার করে ইয়াহিয়া চতুর্থ বিকল্পটি বেছে নেন। তিনি আরও ঘােষণা দেন, জনসংখ্যার অনুপাতে জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং এক কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদ হবে; পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল হবে এবং প্রদেশগুলাে পুনর্বহাল হবে। জাতীয় পরিষদে সবকিছু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােটে নির্ধারিত হবে। ইয়াহিয়া আশা করেন, সবাই এ বিষয়গুলাের ব্যাপারে একমত হবেন। ইয়াহিয়ার এই ভাষণ ছিল সুস্পষ্টভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ইতিবাচক। শেখ মুজিব এটাই চেয়েছিলেন। কেন্দ্রের সঙ্গে প্রদেশগুলাের সম্পর্ক কী রকম হবে, সে ব্যাপারে ইয়াহিয়া কিছু বলেননি। শেখ মুজিব চাননি যে ইয়াহিয়া এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিক। তিনি চেয়েছিলেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সিদ্ধান্ত নেবেন। এ জন্য ইয়াহিয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানে অনেকেই সমালােচনা করেন। এ ব্যাপারে ইয়াহিয়ার বক্তব্য ছিল পরিষ্কার :

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলােতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পূর্ণ অংশগ্রহণ নেই। এই পরিস্থিতিতে তাদের ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। এ জন্য দরকার জাতীয় সংহতি ও দেশের অখণ্ডতা বজায় রেখে পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা রাখা।

| কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলাের অন্যতম হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিষয়টি কীভাবে দেখা হবে। ফেডারেশন মানে শুধু আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভাগাভাগি নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশীদারির বিষয়টিও দেখতে হবে। তাই প্রদেশগুলাের চাহিদা এবং একই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের দিকে তাকিয়ে ন্যায্য দাবিগুলাের সুরাহা করতে হবে। পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের তাদের সম্পদ ও উন্নয়নের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে, যতক্ষণ না এটি কেন্দ্রীয়

সরকারের কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইয়াহিয়ার ২৮ নভেম্বরের ভাষণে বাঙালি নিয়ন্ত্রিত’ জাতীয় পরিষদের সম্ভাবনা দেখে সেনাসদরের কুশীলবেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা স্বায়ত্তশাসনের পরিধি সংজ্ঞায়িত করে একটি আইন জারি করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তারা প্রস্তাব দেন, সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বদলে ন্যূনতম ৬০ শতাংশ ভােটে সাংবিধানিক বিষয়গুলাের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়া দরকার। পূর্ব

পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিবিদও এই ধারণা সমর্থন করেন। কারণ, তাদের আশঙ্কা ছিল, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে না দিলে ছয় দফার জোয়ারে তারা ভেসে যাবেন। | শেখ মুজিব গভর্নর আহসানের মাধ্যমে সবাইকে সতর্ক করে দেন যে ‘এক ব্যক্তি এক ভােট’ এই নীতির কোনাে পরিবর্তন তিনি মেনে নেবেন না। আহসান ইয়াহিয়াকে ধারণা দেন যে শেখ মুজিবের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে পাকিস্তানের ঐক্য টিকিয়ে রাখা যাবে না। ইয়াহিয়া অবশ্য মনে করতেন, শেখ মুজিব হয়তাে ছয় দফা পরিমার্জন করতে রাজি হবেন। ওই সময় অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরী, যিনি সংবিধান বিষয়ে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো এই তিনজনের মতামত যাচাই করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে নির্বাচন হয়ে গেলে মুজিব ছয় দফা পরিমার্জন করবেন। অধ্যাপক চৌধুরীর ছােটাছুটি ও দূতিয়ালি এ পর্যায়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার বক্তব্য এ ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক : ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুজিব আমাকে বললেন, প্রস্তাবিত আইনি কাঠামােতে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের সঙ্গে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনও হতে হবে।
আমি বললাম, আইনি কাঠামাে কোনাে সংবিধান নয়। কীভাবে নির্বাচন ও সংবিধান তৈরি হবে, তার জন্য একটি পদ্ধতিগত নির্দেশনামাত্র। সংবিধান তৈরি হওয়ার পর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হতে পারে । মুজিব মুচকি হেসে বললেন, ‘আপনি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; আমি একজন রাজনীতিবিদ। ইয়াহিয়া কীভাবে আশা করেন যে আমি আমার দাবিগুলাে পরিবর্তন করব?’ | আমি এই ইঙ্গিত ইতিবাচক মনে করলাম। আমার ধারণা হলাে, তিনি একটি সর্বসম্মত সংবিধানের স্বার্থে ছয় দফা পরিমার্জন করবেন। আমি করাচি গেলাম। ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলতে। একই সময়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমি তার মনােভাব জানতে চাইলাম। ভুট্টো জানতে চাইলেন, এটি মুজিবের প্রস্তাব কি না। আমি জবাব এড়িয়ে গেলাম। বললাম, আমার কাজ হলাে সবার সঙ্গে কথা বলা। ভুট্টো প্রস্তাবে রাজি হলেন। বললেন, এটি হবে ঘােড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া। ইসলামাবাদে ফিরে আমি ইয়াহিয়াকে সব জানালাম। তিনি তখনই এটি মেনে নিলেন এবং আমাকে একটি আইনি কাঠামাের খসড়া তৈরি করতে বললেন। ইয়াহিয়া আরও বললেন, ‘এক ব্যক্তি এক ভােট’ বিষয়ে তিনি কোনাে আপস করবেন না। তাহলে সামরিক শাসকদের ওপর বাঙালিদের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। আর এতে পুরাে প্রক্রিয়াটাই বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং সেনাসদরের সবাইকে এটি গিলতে হলাে। জানুয়ারিতে এদের এক সভায় আমি বললাম, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিধি নির্ধারণ না করে পাকিস্তানের ঐক্য টিকিয়ে রাখার জন্য ন্যূনতম যা যা দরকার, তা উল্লেখ করা হবে। আহসান সমর্থন দিলেন। ইয়াকুব বললেন, তিনি খােলা মন নিয়ে আলােচনার পক্ষপাতী। পীরজাদা ভুট্টোর সঙ্গে যােগাযােগ করে। জানালেন, ভুট্টোর কোনাে আপত্তি নেই। ফলে পীরজাদা নিরপেক্ষ হয়ে গেলেন।
কেবল হামিদ, টিক্কা ও উমর মুজিবের প্রতি নরম’ মনােভাব দেখানাের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। আমি পাঁচটি নীতিসংবলিত একটি খসড়া তৈরি করলাম। জেনারেলরা এটি মেনে নিলেন। মনে হলাে, সংকট কেটে গেছে। নির্বাচনের পরবর্তী ঘটনাবলি
থেকে প্রতীয়মান হয়, মাত্র এক বছরের জন্য বিষয়টি স্থগিত ছিল। ১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) শিরােনামে একটি আইনি কাঠামাে ঘােষণা করা হলাে। পাঁচটি নীতিসংবলিত এই কাঠামােয় ছিল : ১) পাকিস্তানের আদর্শগত ভিত্তি হবে ইসলাম। ২) একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে। ৩) রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে হবে। ৪) দেশের দুই অংশের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য—বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে—দূর করতে হবে; এ জন্য যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে। ৫) কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার বিন্যাস এমন হবে, প্রদেশগুলাে যেন সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন পায় এবং একই সঙ্গে কেন্দ্রের হাতে যেন পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকে, যাতে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষা করা যায়। | এলএফওতে একটি ভূমিকা, ২৭টি ধারা এবং দুটি তালিকা ছিল। এটি ছিল একটি সংবিধানের মতােই; বলা যেতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। আইনি কাঠামােতে উল্লেখ করা হয়েছিল, জাতীয় পরিষদ যে সংবিধান তৈরি করবে, তা কার্যকর হতে প্রেসিডেন্টের সম্মতি লাগবে। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল পূর্ব । পাকিস্তান সফরে এলে ঢাকা বিমানবন্দরে একজন সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, প্রেসিডেন্টের সম্মতির বিষয়টি পদ্ধতিগত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আইনি কাঠামােতে বলা হয়েছিল, নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান তৈরি করবে। যদি তা না হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট নিজেই একটি সংবিধান দেবেন। ইয়াহিয়া মনে করতেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস থাকলেই পাকিস্তান টিকবে।
নির্বাচনের নামে জোচ্চুরি করে পাকিস্তানকে টেকানাে যাবে না। কিছুদিন পর ইয়াহিয়াকে একটি গােয়েন্দা প্রতিবেদন দেখানাে হয়। এর সঙ্গে ছিল টেপে ধারণকৃত শেখ মুজিবের কণ্ঠ। মুজিব বলছেন, ‘আমার লক্ষ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন হয়ে গেলে আমি এলএফও ছিড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলব। নির্বাচনের পর কে আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে?’ ইয়াহিয়া মুজিবের কণ্ঠস্বর শনাক্ত করতে পারলেন। বক্তব্যের সারমর্ম শুনে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। পরদিন সকালে অধ্যাপক চৌধুরী তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে ইয়াহিয়া বলেন, ‘মুজিব যদি বেইমানি করে, আমি তাকে দেখে নেব।’ মনে হলাে ইয়াহিয়ার একাধিক পরিকল্পনা আছে, যেমনটি আছে মুজিবেরও।১২  শেখ মুজিব সেনাশাসনকে শুধু অপছন্দই করতেন না, তিনি এটিকে রীতিমতাে ঘৃণা করতেন। ২৬ অক্টোবর (১৯৬৯) শেখ মুজিব কয়েক দিনের জন্য লন্ডন সফরে যান। সবাই জানত তিনি আগরতলা মামলা চলাকালে প্রবাসী বাঙালিদের এবং তার কৌসুলি স্যার টমাস উইলিয়ামকে কৃতজ্ঞতা জানাতে লন্ডনে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর নীলক্ষেত-বাবুপুরা ওয়ার্ড  আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আজিমপুর-নিউ পল্টন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম তালুকদারকে ইঙ্গিতে বলেন, ‘লাল ফিতা পেলেই ধরবে।’ লাল ফিতা বলতে তালুকদার বুঝলেন পাঞ্জাবি সেনা। ৩ নভেম্বর তালুকদার নীলক্ষেতে তার অফিসে বসে কাজ করছিলেন। সেখানে মন্টু, খসরু এবং আরও কয়েকজন ছিলেন। খবর এল, নিউমার্কেটের ভেতরে সেনা ঢুকেছে। কয়েকজনের গায়ে ইউনিফর্ম, বাকিরা সাদাপােশাকে তখন বেলা ১১টা। নিউমার্কেটের ১ নম্বর ও ২ নম্বর গেটের মাঝামাঝি জায়গায় তাদের ওপর। অতর্কিতে হামলা হলাে।
পিটিয়ে এবং ছুরি মেরে কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরে আয়ােজিত মীনাবাজার দেখে ওই অবাঙালি। সেনারা ফিরে আসছিলেন। ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম  হােসেন রাজার ভাষ্য অনুযায়ী দুজন ননকমিশন্ড অফিসার (এনসিও) ‘আওয়ামী লীগের গুন্ডাদের’ ছুরির আঘাতে নিহত হয়েছিলেন।১৪  লালবাগ থানায় মামলা হলাে। আসামি চারজন। তারা হলেন নুরুল ইসলাম | তালুকদার (হুকুমের আসামি), মােস্তফা মহসীন মন্টু, কামরুল আলম খান খসরু | ও সেলিম জাহান (মন্টুর বড় ভাই)। প্রথমে গ্রেপ্তার হন নুরুল ইসলাম  তালুকদার। ‘৭০ সালের মাঝামাঝি ইকবাল হল ঘেরাও করে মন্টু ও সেলিমকে। গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় খসরু ছাদে পানির ট্যাঙ্কের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন বলে।  গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছিলেন। তালুকদারকে পার্লামেন্ট ভবনে (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় স্থাপিত সামরিক আদালতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির করা হয়। বিচারক ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর তিরমিজি ও মেজর দেলােয়ার হােসেন বাট। তালুকদার তিরমিজি ও বাটের সঙ্গে আপসরফা করলেন।
প্রচুর টাকার বিনিময়ে তিনি মামলা থেকে খালাস পান। এয়ারপাের্টের কাছে ফলের দোকানে টাকা লেনদেন হতাে। তালুকদার টাকা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। খসরু, মন্টু ও সেলিমের ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। শেখ মুজিব তাদের বাচানাের যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এত দূর পর্যন্ত বলেছিলেন, যে তারিখে এ ঘটনা ঘটে সেই দিন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এমনকি গভর্নর আহসানও তাদের সঙ্গে ছিলেন। তারা তখন বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা উপদ্রুত ঢাকার মােহাম্মদপুর এলাকা সফর করছিলেন।১৫ পাকিস্তানি সেনা হত্যার মধ্য দিয়ে একটি ঝড়ের আভাস পাওয়া যায়। মনে হয়, আগামী দিনে অনেক রক্তারক্তি ঘটবে। | ৫ ডিসেম্বর (১৯৬৯) সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসে তার সমাধি প্রাঙ্গণে এক আলােচনা সভায় শেখ মুজিব একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। ইত্তেফাক-এ ছাপা হওয়া সংবাদটি ছিল : একসময় দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে…আমি ঘােষণা করিতেছি—আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ’।১৬ এ সময় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দুজন নেতা দল থেকে ছিটকে পড়েন। আমেনা বেগম ১৯৬৬-৬৮ সালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারি ছিলেন। ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন। শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন ১৯৬৫-৬৯ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের উপনেতা এবং আওয়ামী লীগ সংসদীয় গ্রুপের মুখপাত্র। তিনিও পদত্যাগ করেন।
এ সময় আতাউর রহমান খান পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ (পাকিস্তান জাতীয় লীগ) তৈরি করলে আমেনা বেগম ও শাহ আজিজ এই নতুন দলে যােগ দেন। | ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য রাজনীতির ওপর থেকে বিধিনিষেধ উঠে যায়। ঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রথম জনসভাটি হয় পল্টন ময়দানে ১১ জানুয়ারি। মঞ্চের সামনে খুব বড় করে লেখা ছিল ‘জয় বাংলা’। দুটি কাঠের তক্তার ওপর আলাদা করে শব্দ দুটি লিখে মঞ্চের সামনে পেরেক ঠুকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে ও পরামর্শে ‘বিজ্ঞাপনী’র শিল্পী কামাল আহমেদ এটি ডিজাইন করেছিলেন। ‘বিজ্ঞাপনী’র মালিক ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি মাযহারুল হক বাকী। সভা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সিরাজুল আলম খান বেশ কয়েকবার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি দেন। আওয়ামী লীগের কোনাে নেতা মঞ্চে স্লোগানটি উচ্চারণ করেননি। সভা শেষ হয়ে যাওয়ার পর মাযহারুল হক বাকী ও কামাল আহমেদ গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা করতে থাকেন। তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সিরাজুল আলম খান মাঝরাতে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করেন। গাড়ি তাদের দুজনকে কুমিল্লার একটি বাড়িতে পৌছে দেয় । বাড়িটির দেয়ালে ‘শর্মা 
কেমিক্যালস প্রাইভেট নামে একটি সাইনবোর্ড ছিলো। সেখানে তারা তিন দিন আত্মগোপন করে ছিলেন।
১৯৭০ সালের ৪-৫ জুন ঢাকায় ইডেন প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে ১ হাজার ১৩৮ জন কাউন্সিলর যােগ দেন। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে অধিবেশনে আলােচনা ও বিতর্ক হয়। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজের অনুসারী একটি গ্রুপ এলএফওর অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। অন্যদিকে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অন্য একটি গ্রুপ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে মত দেয়। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্টে অবশ্য বলা হয়, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে কোনাে ঐক্যজোটে যাবে না। অধিবেশনে দলের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার দেওয়া ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় বলেন : বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে একাই লড়ে যেতে হবে আওয়ামী লীগের কোনাে বন্ধু নেই। ছয় দফা কর্মসূচিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য রাজনৈতিক দলগুলাে সমর্থন করেনি। এমনকি গােলটেবিল বৈঠকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়নি।…হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগে দলাদলির কোনাে স্থান নেই ক্ষমতার জন্য যারা এসেছেন তারা চলে যেতে পারেন। কারণ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতার রাজনীতি করে না।
আওয়ামী লীগ চায় জনগণের মুক্তি। ছয় দফা জনগণের মুক্তিসনদ। এই ছয় দফার জন্য প্রয়ােজনে সবকিছু ত্যাগ। করতে আমি প্রস্তুত আছি। আপনারাও যেকোনাে পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকবেন। যেকোনাে ধরনের ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু কোনাে অবস্থাতেই আমি আপস করব না। চারদিক থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সাবধান। কাউন্সিলে শেখ মুজিব তৃতীয়বারের মতাে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে অন্য যারা নির্বাচিত হন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সহসভাপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও খন্দকার মােশতাক আহমদ; সাধারণ সম্পাদক : তাজউদ্দীন আহমদ; সাংগঠনিক সম্পাদক : মিজানুর রহমান চৌধুরী; প্রচার সম্পাদক : আবদুল মমিন; দপ্তর সম্পাদক : মুহম্মদুল্লাহ; শ্রম সম্পাদক : জহুর আহমদ চৌধুরী; সাংস্কৃতিক সম্পাদক : বেগম বদরুন্নেসা আহমদ; সমাজসেবা সম্পাদক : কে এম ওবায়দুর রহমান এবং কোষাধ্যক্ষ : মােহাম্মদ মহসিন। আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনােনয়ন। দেওয়ার জন্য সভাপতিকে প্রধান করে একটি পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠন করা হয়।
সম্মেলন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের জন্য নতুন একটি কর্মসূচি তৈরি করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ খসড়াটি সম্পাদনা করেন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে পরামর্শ করে তা চূড়ান্ত করা হয়। ৬ জুন কাউন্সিল সভায় কর্মসূচিটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।২০ এই কর্মসূচি তৈরির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন ওই সময়ে ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মােহাম্মদ আনিসুর রহমান। ১৯৭০ সালের মার্চে পাকিস্তানের ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিল চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির কাজে অংশ নেওয়ার জন্য অর্থনীতিবিদদের একটি প্যানেল গঠন করে। প্যানেলের বাঙালি সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক মােশাররফ হােসেন, ড. আখলাকুর রহমান ও ড. আজিজুর রহমান খান। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারে দুই অঞ্চলের অর্থনীতিবিদদের একমত হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা ছিল না। প্যানেলের সদস্যরা দুই ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা রিপাের্ট তৈরি করেন। আনিসুর রহমানের মন্তব্য ছিল, ‘আমি দেয়ালের লিখন পড়েছিলাম। মনে আছে প্যানেলের শেষ বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তানি সহকর্মীদের বিদায় জানিয়ে আমি বলেছিলাম, দুর্ভাগ্যের বিষয় যে তােমরা রাজি হলে । তােমাদের সঙ্গে আবার দেখা করতে হলে আমাদের ভিসার প্রয়ােজন হবে।’ এই প্যানেলে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বাঙালি অর্থনীতিবিদদের উপলব্ধি হয় যে তারা শেখ মুজিবকে অর্থনৈতিক বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবেন । অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, ড, আজিজুর রহমান খান, অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও স্বদেশ রঞ্জন বােস একসঙ্গে বসে একটি অর্থনৈতিক ম্যানিফেস্টো’ তৈরি করেন। শেখ মুজিবের কাছে এই ম্যানিফেস্টো পৌছে দেওয়া হয়। আনিসুর রহমান ঘনায়মান সংকট সম্পর্কে বলেন : পশ্চিম পাকিস্তানি বন্ধুরা আমাকে পশ্চিম পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তাঁদের একজন আমাকে বলেছিলেন, জেনারেলরা বসে ঠিক করেছেন কোনাে অবস্থাতেই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে না। প্রয়ােজনে। এই প্রদেশকে ‘ইন্দোনেশিয়া’ বানানাে হবে, মানে দশ লাখ লােককে মারা হবে, যেমনটি হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ায় এক ব্যক্তিগত সফরে ঢাকায় গিয়ে আমি শেখ মুজিবকে এ কথা জানিয়েছিলাম। স্বভাবসুলভ আত্মবিশ্বাসী ঢঙে তিনি বলেছিলেন, “ডাক্তার সাহেব, আমি জানি। ৬ জুন (১৯৭০) নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা। হয়। কমিটিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন সহসভাপতি : কাজী ফয়েজ মােহাম্মদ, মাস্টার খান গুল ও ব্যারিস্টার বরকত আলী সালমী; যুগ্ম সম্পাদক : মােহাম্মদ খান রহমানী ও শামসুল হক; সাংগঠনিক সম্পাদক : সৈয়দ খলিল আহমদ তিরমিজী; প্রচার সম্পাদক : আবদুল মান্নান; শ্রম সম্পাদক : মালিক ফররুখ শিয়ার আওয়াল; সমাজসেবা ও সংস্কৃতি সম্পাদক : মােস্তফা সরােয়ার; দপ্তর সম্পাদক : শফিউল আলম; কৃষি সম্পাদক : সৈয়দ এমদাদ মােহাম্মদ শাহ; মহিলা সম্পাদক : বেগম নুরজাহান মুরশিদ এবং কোষাধ্যক্ষ : অধ্যাপক হামিদুর রহমান।
একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথা বাতিল করে গণতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাম্যবাদী অর্থনীতি চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার কর্মসূচি ঘােষণা করে।২৩ কাউন্সিলের শেষ অধিবেশনে শেখ মুজিব দলে নবাগত দুজনকে উপস্থিত কাউন্সিলরদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারা হলেন ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তােফায়েল আহমেদ এবং শেরেবাংলা ফজলুল হকের ছেলে ফায়জুল হক। আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল সভায় ছাত্রলীগের সাবেক দুই সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খান প্রথমবারের মতাে কাউন্সিলর হিসেবে যােগ দিয়েছিলেন।২৪ | ১৯৭০ সালের ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারকাজ শুরু করেন। জনতার প্রতি আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভােট দেওয়ার আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি যদি কলাগাছকে নমিনেশন দিই, আপনারা তাকেই ভােট দেবেন।’ উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় ভারতের মুসলমানদের অনুরােধ করা হয়েছিল, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ যদি ল্যাম্পপােস্টকেও মনােনয়ন দিয়ে থাকে, তাকেই যেন ভােট দেওয়া হয়। ওই নির্বাচনকে মুসলিম লীগ বলেছিল যে এটি পাকিস্তান প্রশ্নে গণভােট’।
১৯৭০ সালের নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ ছয় দফার পক্ষে গণভােট হিসেবে প্রচার করে। বক্তৃতার একপর্যায়ে শেখ মুজিব জুতসই রূপক ব্যবহার করে একটি লােকজ। কবিতার দুটি লাইন উদ্ধৃত করেন : বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান এইবার ঘুঘু তােমার বধিব পরান। এই ঘুঘু হলাে পশ্চিম পাকিস্তানি শােষক এবং তাকে নির্মূল করার ঘােষণা দিয়ে শেখ মুজিব তার আসল বার্তাটি দিয়ে দিলেন। | রেসকোর্সের জনসভায় শেখ মুজিব সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ছয় পয়সা দামের একটি পােস্টকার্ড যার যার গ্রামে পাঠিয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিন।’ বিনয়ের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নেতা নই, কমী। নেতা ওই যে ঘুমিয়ে আছেন—শেরেবাংলা আর সােহরাওয়ার্দী।’ তিনি ঘােষণা করেন, পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী ‘আইয়ুব নগর’ এখন থেকে হবে শেরেবাংলা নগর’, রেসকোর্স হবে ‘সােহরাওয়ার্দী উদ্যান’। সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মােজাফফর আহমদ অনেক দিন ধরেই নির্বাচনী ঐক্যের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। শেখ মুজিব ঘােষণা দিলেন, ‘নেতার ঐক্য চাই না, চাই জনতার ঐক্য।’ আরও বলেন, ‘সাইনবাের্ড পাল্টে আওয়ামী লীগে চলে আসুন।’ এই জনসভায় শেখ মুজিব নিজ কণ্ঠে প্রথমবারের মতাে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন। একই সঙ্গে তিনি জয় পাঞ্জাব, জয় সিন্ধু, জয় সীমান্ত প্রদেশ, জয় বেলুচিস্তান এবং জয় পাকিস্তান স্লোগান দেন।২৫

৭ জুন রেসকোর্সে বক্তৃতা দেওয়ার আগে শেখ মুজিব ছয় দফার প্রতীক হিসেবে ছয়টা পায়রা ওড়ান। পাঁচটি ওড়ে, একটি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে তাঁর হাতেই ফিরে আসে। দৈনিক পূর্বদেশ-এ আবদুল গাফফার চৌধুরী তার তৃতীয় মত’ কলামে মন্তব্য করেন, তাহলে কি ইয়াহিয়ার পাঁচ দফাই (এলএফও) টিকে থাকবে? শুরু হয় কলম লড়াই। ইত্তেফাক এ খন্দকার আবদুল হামিদ স্পষ্টভাষী নামে তাঁর কলামে গাফফার চৌধুরীর সমালােচনা করেন। গাফফার চৌধুরী এর জবাব দেন, খন্দকার হামিদ আবার লেখেন । গাফফার চৌধুরী শেষমেশ খন্দকার হামিদকে ছেড়ে শেখ মুজিবের কড়া সমালােচনা করে লেখেন, শেখ মুজিব পলায়নমুখী মানসিকতার রাজনীতিবিদ, সব সময় বাক্স-পেটরা গুছিয়ে গ্রেপ্তারের আশায় বসে থাকেন। গাফফার চৌধুরী সম্ভবত পূর্বদেশ এর মালিক পিডিপি নেতা হামিদুল হক চৌধুরীকে খুশি করার জন্য এ মন্তব্য করেছিলেন। | বিরােধীদের নানা রকম প্রচারণা সত্ত্বেও শেখ মুজিব তত দিনে দেশের সবচেয়ে বড় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। তার চেয়ে যারা বয়সে বড় ও রাজনীতিতে জ্যেষ্ঠ এবং যারা তার সমসাময়িক, সবাইকে ছাড়িয়ে তিনি তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তিনি এ দেশের সাধারণ মানুষকে বােঝাতে পেরেছিলেন, ‘আমি তােমাদেরই লােক।

এ দেশের গরিব মানুষেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তাদের শ্রেণিভুক্ত মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মূল্যায়নটি প্রাসঙ্গিক : শেখ মুজিব মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই এসেছিলেন। উচ্চমধ্যবিত্ত নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত। প্রথম যখন ঢাকায় আসেন শহরে তার থাকার কোনাে স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। কিন্তু ওই শ্রেণিতে তিনি আটকে থাকেননি, বের হয়ে গেছেন, বের হয়ে গিয়ে পরিণত হয়েছেন জনগণের নেতাতে, তার জোরটা ছিল ওখানেই। কেবল মধ্যবিত্তের হলে ব্যক্তিগতভাবে উঠতেন নিশ্চয়ই, কিন্তু মহাকাব্যের নায়ক হতে পারতেন না।২৬ নির্বাচনে প্রার্থী মনােনয়ন করা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান চিন্তা ছিল, দলকে জেতাতে হবে। ওই সময় যারা আওয়ামী লীগের জেলা ও তৃণমূলের নেতা ছিলেন, তাঁরা অনেকেই পারিবারিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। যারা মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন, তাঁরা ছিলেন তুলনামূলকভাবে সম্পদশালী। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল সম্পর্কে একটি বিবরণ পাওয়া যায় চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৫৪ ও ১৯৬২ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য বেগম তােহফাতুন্নেসা আজিমের ছেলে আরিফ মইনুদ্দীনের কাছ থেকে। চট্টগ্রামে মনােনয়ন দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন : বঙ্গবন্ধু আমার আম্মাকে বলেছিলেন, আপনার মেয়ের জামাই তানভির আহমদ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগে নিয়া আসেন। আমি তাকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নমিনেশন দিব। আমি আর আম্মা গেলাম তানভির সিদ্দিকীর বাসায়। উনার নিক নেম নেপােলিয়ন। আম্মা বললেন, “নেপু, আমাকে তাে মুজিবুর বলল, তােমাকে নমিনেশন দিবে। তুমি চলে আসাে।’ তানভির সিদ্দিকী এনএসএফের ফাউন্ডার ট্রেজারার ছিলেন। বললেন, “দেখেন আম্মা, আমি তাে আওয়ামী লীগে জয়েন করতে পারি না। আমি ইন্ডিপেনডেন্ট ইলেকশন করব।’ আম্মা বললেন, তুমি ইন্ডিপেনডেন্ট করলে পারবা না। ছয় দফা অনেক ভােট পাবে এবং ছয় দফা পাওয়ারে আসবে।’ উনি আম্মার কথা শুনলেন না। সাত-আট দিন পর আমি আর আম্মা গেলাম চট্টগ্রামে, এয়ারপাের্টে বঙ্গবন্ধুকে সি-অফ করতে। উনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আম্মাকে দেখে দাড়ায়া গেলেন। বললেন, “আপা, কী হলাে, আপনার জামাই?” আম্মা বললেন, ‘মুজিবুর, ও তাে নাকি ইন্ডিপেনডেন্ট ইলেকশন করবে।’ বঙ্গবন্ধু দুই সেকেন্ড থেমে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আমি ওকে ডিফিট দিয়া দিব।’ উনি ঠিকই শামসুল হক সাহেবকে দিয়ে তানভির সিদ্দিকীকে ডিফিট দিলেন। চট্টগ্রামে দেখলাম, এম এ আজিজ ফটিকছড়িতে মীর্জা আবু মনসুরকে প্রাদেশিক পরিষদে নমিনেশন দিলেন। মির্জা আবু মনসুরের বাবা মির্জা আবু আহমেদ ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে সিক্সটি টু ও সিক্সটি ফাইভে মুসলিম লীগের এমপি ছিলেন। আতাউর রহমান কায়সার সাহেবকে এম এ আজিজ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে দিলেন। তার আব্বা ক্যাপ্টেন ইয়ার আলী খান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে মুসলিম লীগের মেম্বার ছিলেন। চট্টগ্রামে নমিনেশনে আমি যা দেখলাম, পুরা এম এ আজিজ সাহেবের চয়েস। বঙ্গবন্ধুর নমিনেশনের ফারসাইটেডনেস—মুসলিম লীগকে ভাঙতে হবে, আওয়ামী লীগকেও জিতাইতে হবে। চট্টগ্রামে মহিলা নমিনেশন হবে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে। আম্মা বললেন, ‘আজিজ দেখিস, ন্যাশনালে যেন আমার সিটটা থাকে।’ তুই করে বলতেন আম্মা। উনি বললেন, “চাচি, আপনি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আর সাজ্জনি (সাজেদা চৌধুরী) প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলিতে যাবে।’ এম এ আজিজ সাহেব মারা যাওয়ায় এটি আর হয়নি।
২৭ এ সময় আওয়ামী লীগের একটা নির্বাচনী পােস্টার সাধারণ মানুষের মধ্যে তুমুল আলােড়ন তােলে, যা হাজারটা বক্তৃতায়ও সম্ভব হতাে না। সােনার বাঙলা শ্মশান কেন’ শিরােনামে এই রঙিন পােস্টারটি তৈরি করেন আওয়ামী লীগের কর্মী নূরুল ইসলাম। এটি এঁকেছিলেন শিল্পী হাশেম খান।২৮ পােস্টারে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অসাম্যের ভয়াবহ রূপ ফুটে উঠেছিল। এই পােস্টারের একটি বাস্তব ভিত্তি ছিল। ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে। মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় ছিল ২৮৮ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৩৫১ টাকা, অর্থাৎ বৈষম্যের হার ছিল ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। ১৯৬৯-৭০ সালে মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তানে বেড়ে হয় ৩৩১ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে হয় ৫৩৩ টাকা। বৈষম্যের হার তিন গুণ বেড়ে হয় ৬১ শতাংশ। গােদের ওপর বিষফোড়ার মতাে। ছিল ভােগ্যপণ্যের উচ্চমূল্য। পাকিস্তান অর্থনৈতিক সমীক্ষার (১৯৬৯-৭০) তথ্য। অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে এক মণ চালের দাম ছিল ৪২ টাকা ৩৭ পয়সা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ২২ টাকা মণ দরে চাল পাওয়া যেত। সামাজিক অবকাঠামাের মধ্যেও বৈষম্য ছিল। ১৯৬৭-৬৮ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ২৮ হাজার ২২৫টি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৩৩ হাজার ২৭১টি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল অনেক ফারাক। ওই বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে ছাত্রসংখ্যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ৯ হাজার ৯৮৪ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪ হাজার ৪২৫ জন। ২৯ প্রার্থী মনােনয়নের পর দেখা গেল সবাই কলাগাছ নন। জাতীয় পরিষদের জন্য আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীদের মধ্যে ৪৭.৫৩ শতাংশ ছিলেন আইনজীবী, ১৯.১৩ শতাংশ ব্যবসায়ী, ৭ শতাংশ জোতদার এবং ৬.১৭ শতাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রার্থীদের ৮১.৪৩ শতাংশ ছিলেন ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রিধারী, যার মধ্যে ৬১ শতাংশ ছিল স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। বয়সের দিক থেকে 
প্রচারের ব্যবস্থা করে। রাজনৈতিক দলের নামের ইংরেজি বানানের প্রথম অক্ষরের ক্রম অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের রেকর্ডকৃত ভাষণটি সবার আগে ২৮ অক্টোবর (১৯৭০) প্রচার করা হয়। ৩০ মিনিটের এ ভাষণের খসড়া তৈরি করেছিলেন ড. কামাল হােসেন, রেহমান সােবহান ও তাজউদ্দীন আহমদ। ভাষণে দেওয়া দলের প্রতিশ্রুতিগুলাে ছিল :
ক) প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গােটা ভূমিব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস; খ) যমুনা নদীর ওপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেতু নির্মাণ এবং সিন্ধু, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলীর ওপর সেতু নির্মাণ; গ) প্রতি ইউনিয়নে একটি করে পল্লি চিকিৎসাকেন্দ্র এবং থানা সদরে
হাসপাতাল স্থাপন; ঘ) জাতীয় উৎপাদনের ন্যূনতম ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয়; ঙ) কোরআন-সুন্নাহবিরােধী কোনাে আইন তৈরি না করা; চ) স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ; ছ) ফারাক্কা বাঁধজনিত সমস্যার ন্যায়সংগত সমাধান; জ) ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন; ঝ) জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলােকে জনগণের
| মালিকানায় আনা; | ) উপজাতীয় এলাকা উন্নয়নের ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানাে; ট) জাতীয় জীবনের সঙ্গে মােহাজেরদের একাত্ম করা। নির্বাচনী প্রচারে অভিযােগ, গালাগাল, চরিত্রহনন সবই ছিল। ভুট্টো অভিযােগ করলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএর এজেন্ট এবং নির্বাচন নিয়ে তিনি ষড়যন্ত্রে মেতেছেন। জামায়াতে ইসলামী চীনের দিকে তর্জনী তুলে বলল, মাও সেতুং নির্বাচনে পিপলস পার্টির পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করছেন। ইসলামাবাদে মার্কিন ও চীনা রাষ্ট্রদূত এসব প্রচারণায় বিচলিত হন। পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে অনুযােগ করেন, বিদেশিদের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার তাঁদের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ইয়াহিয়া ব্যাপারটি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। জামায়াতের চীনবিরােধী প্রচার থেমে যায়। কিন্তু ভুট্টো মুখ বন্ধ করেননি। | এ সময় উপকূলীয় অঞ্চলে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। ১২ নভেম্বর রাতে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়। এদের সংখ্যা সঠিকভাবে কখনােই জানা যায়নি। মার্কিন ত্রাণ সংস্থাগুলাের অনুমান, ঝড়ে কমপক্ষে ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ মারা গেছে, যা কিনা দুর্গত এলাকার জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ।৩৪ লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে, গবাদিপশু সব ভেসে 

যায়। এক রাতের মধ্যেই অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। দুর্গত এলাকায় উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা ছিল দুর্বল ও অগােছালাে। প্রদেশে মাত্র একটি হেলিকপ্টার ছিল, যা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের চলাচলের জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছিল। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ৫৯টি হেলিকপ্টার অলস বসে ছিল।৩৫

ঘূর্ণিঝড়ের সময় ইয়াহিয়া এক সফরে চীনে ছিলেন। ফেরার পথে তিনি ঢাকায় এলেন। কিন্তু দুর্গত এলাকা সফর না করেই তিনি ইসলামাবাদে ফিরে যান। ফলে তিনি প্রচণ্ড সমালােচনার মুখে পড়েন। ২৬ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের সমালােচনা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের এই দুর্দিনে ওরা কেউ দেখতেও আসেনি। এটি প্রকৃতপক্ষে ঠান্ডা মাথায় খুন। তাদের চরম শাস্তি হওয়া দরকার। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি তাদের বিচার করতাম। কোটিপতি বস্ত্রকল মালিকেরা এক গজ কাপড় দিয়েও সাহায্য করেনি। ওদের এত বড় সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও লাশ দাফন করতে ব্রিটিশ মেরিনদের সাহায্য নিতে হয়েছে।’ শেখ মুজিব আরও বলেন যে এই ছুতােয় নির্বাচন পেছানাের চেষ্টা হলে গৃহযুদ্ধ বাধবে। পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। ১০ লাখ মানুষ ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। প্রয়ােজনে আরও ১০ লাখ মানুষ জীবন দেবে। | বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছিল। ইয়াহিয়া অবশ্য নির্বাচন পেছানাের দাবি মেনে নেননি। শুধু দুর্গত এলাকার ৯টি জাতীয় পরিষদের এবং ২১টি প্রাদেশিক পরিষদের আসনে নির্বাচনের তারিখ

পিছিয়ে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি ঠিক করা হয়। প্রাদেশিক ন্যাপের সভাপতি মােজাফফর আহমদ সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালােচনা করেন। ২৯ নভেম্বর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘কোন যুক্তিতে ও কী উদ্দেশ্যে সরকার ৭ ডিসেম্বর তারিখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাহা হৃদয়ঙ্গম করা দুষ্কর।…যে সকল দল নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলিয়া গণবিরােধী সরকারের ওই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত লইতে সাহায্য করিয়াছে তাহারাও যে পূর্ব বাংলার লাখ লাখ দুর্গত মানুষকে রক্ষা করার চাইতে মন্ত্রিত্বের গদিকে বড় মনে করে, তাহাও তাহাদেরই দাবি হইতে জনগণের নিকট পরিষ্কার হইয়াছে।’৩৭ 
নির্বাচনে তার দলের যে খুব সুবিধা হবে না, মওলানা ভাসানী সেটি বুঝতে পেরেছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের অজুহাত তুলে তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘােষণা দেন। আতাউর রহমান খানের দল পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানাের ঘােষণা দেয়। তিনিও দেয়ালের লেখা পড়তে পেরেছিলেন। নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে ছিল প্রচণ্ড উৎসাহ। কেননা এর আগে সারা দেশে কোনাে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ভােটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ছিল ২১ বছর । তবে অনেক কম বয়সী তরুণ বয়স বাড়িয়ে ভােটার হয়েছিলেন। সর্বত্র। ছিল উৎসবের আমেজ। নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের মধ্যেও ছিল প্রবল আগ্রহ ও কৌতূহল। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। মার্কিন দূতাবাসের কর্মীরা নিজেদের মধ্যে একটি লটারির আয়ােজন করেছিল।
প্রত্যেকে ১০ টাকা করে জমা দেয়। প্রশ্ন ছিল, কোন দল কত পারসেন্ট আসন পাবে? ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের অনুমান ছিল পিপলস পার্টি ও আওয়ামী লীগ নিজ নিজ প্রদেশে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ আসন পাবে। তার নিজস্ব ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ পাবে ৮৫ শতাংশ। ফলাফল ঘােষণার পর দেখা গেল, ইসলামাবাদ অফিসের এক নারী কর্মকর্তার পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে পূর্বাভাস সবচেয়ে কাছাকাছি হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাপারে ঢাকার একজন কর্মকর্তার পূর্বাভাস সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল । নির্বাচনের দুদিন আগে আর্চার ব্লডের সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হয়। মুজিব ছিলেন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। তিনি জানালেন, পিডিপির নুরুল আমিন এবং স্বতন্ত্র চাকমা প্রার্থী ত্রিদিব রায় ছাড়া বাকি সব আসন আওয়ামী লীগ পাবে।৩৮ অথচ অক্টোবরের ২১ তারিখ আর্চার ব্লাড তার সহকর্মী বব কার্লকে নিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মুজিব বেশ আস্থার সঙ্গেই বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৪০টি পাবে। এর সঙ্গে যােগ হবে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৭টি আসন, যার সবই আওয়ামী লীগ পাবে। এ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ চার থেকে ছয়টি আসন পেতে পারে। সেখানে আওয়ামী লীগের আটজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১০ জন তার সঙ্গে যােগ দিতে পারেন বলে মুজিব আশা করেন। ফলে তাঁর পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে। পূর্ব পাকিস্তানে অন্য কোনাে দল পাঁচটির বেশি আসন পাবে বলে তার মনে হয় না।৩৯ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে ভােটের হিসাব-নিকাশ কত উল্টে দিতে পারে, তার প্রমাণ দুই মাস পরই পাওয়া গেল। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের দুটি ছাড়া সব আসনে বিজয়ী হলাে।
আওয়ামী লীগের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উত্থান ঘটেছিল, তা মােকাবিলা করার ক্ষমতা অনেক দলে বিভক্ত ডানপন্থীদের ছিল না। ১৬২টি নির্বাচনী এলাকার এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১২৫টি এলাকায় আওয়ামী লীগবিরােধী ভােট একাধিক ডানপন্থী দলের মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল । ৪৮টি নির্বাচনী এলাকায় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রার্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন এবং স্বায়ত্তশাসনপন্থীদের পুরাে নজর ছিল আওয়ামী লীগের দিকে। মাত্র ২৪টি এলাকায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একজন প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনে বাম দলগুলাের প্রার্থীদের উপস্থিতি কম থাকায় আওয়ামী লীগ সুবিধা পেয়েছিল। ওয়ালি-ন্যাপের প্রার্থী ছিলেন ৩৬ জন। ভাসানী-ন্যাপের ১৫ জন এবং আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগের মাত্র ১৪ জন প্রার্থী ছিলেন। তারা অবশ্য পরে নির্বাচন বর্জন করেছিলেন।৪০ | পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ভুট্টোর পিপলস পার্টি পেল ৮১টি আসন। ভােট পড়েছিল ৫৭.৭ শতাংশ। মােট প্রদত্ত ভােটের ৩৮.৩ শতাংশ পেল আওয়ামী লীগ, ১৯.৫ শতাংশ পেল পিপলস পাটি। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ৭৪.৯ শতাংশ, পাঞ্জাবে ০.০৭ শতাংশ, সিন্ধুতে ০.০৭ শতাংশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ০.২ শতাংশ এবং বেলুচিস্তানে ১ শতাংশ ভােট পেল। পক্ষান্তরে পিপলস পার্টি পাঞ্জাবে ৪১.৬ শতাংশ, সিন্ধুতে ৪৪.৯ শতাংশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ১৪.২ শতাংশ এবং বেলুচিস্তানে ২.৩ শতাংশ ভােট পেল। পূর্ব পাকিস্তানে পিপলস পাটির কোনাে প্রার্থী ছিল না। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সবচেয়ে বেশি ভােট পায় জমিয়তে উলেমা ইসলাম (২৫.৪%)। বেলুচিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ সর্বাধিক ৪৫.১ শতাংশ ভােট পায় । | ৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর গণভােটের দাবি জানান।
মওলানা ভাসানীর কথায় ইয়াহিয়া গুরুত্ব দেননি। এ প্রসঙ্গে মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল আর্চার ব্লাডের মন্তব্য ছিল, বয়সের ভারে ন্যুজ নিলা রাজনীতিবিদ মওলানা ভাসানী তাঁর কাছ থেকে মুজিবের কাছে ছিনতাই হয়ে যাওয়া জনগণের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।৪২ | দুর্গত এলাকায় নির্বাচন হলাে জানুয়ারিতে। ৯টি আসনের সবই আওয়ামী লীগ পেল। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেল ২৮৮টি আসন। একেই বলে ভূমিধস বিজয়। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ৭টি সংরক্ষিত মহিলা আসনে আওয়ামী লীগের মনােনয়ন পেলেন নূরজাহান মুরশিদ, রাফিয়া আখতার ডলি, সাজেদা চৌধুরী, মমতাজ বেগম, রাজিয়া বানু, তসলিমা আবেদ ও বদরুন্নেসা আহমদ। প্রাদেশিক পরিষদের ১০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনে তখন পর্যন্ত মনােনয়ন দেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর মধ্যে রেষারেষি ছিল। নির্বাচনে এর প্রভাব পড়েছিল। বাঁশখালীতে প্রাদেশিক পরিষদের আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাকিরুল হক চৌধুরী পিডিপির। মওলানা আহমদ সগিরের কাছে হেরে যান। কক্সবাজারে প্রাদেশিক পরিষদের একটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মােজাম্মেল হক। আওয়ামী লীগের স্থানীয় তরুণ নেতা মােস্তাক আহমদ চৌধুরী ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান। তিনি জহুর আহমদ চৌধুরীর সমর্থন পেয়েছিলেন। নির্বাচনে মােস্তাক চৌধুরী জয়ী হন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিলেন মুসলিম লীগ ও জামায়াতের প্রার্থী। মােজাম্মেল হকের স্থান ছিল চতুর্থ।৪৪ | এত দিন চিন্তা ছিল নির্বাচন হবে কি হবে না। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর ফলাফলে এমন মেরুকরণ হলাে যে তা পাকিস্তানের ভিত্তিমূল রীতিমতাে কাঁপিয়ে  দিল।
প্রমাণিত হলাে, পাকিস্তানে জাতীয়ভিত্তিক কোনাে রাজনৈতিক দল নেই। দুটি আঞ্চলিক দল এখন পরস্পরের মুখােমুখি অবস্থান করছে। এটি ছিল একটি ঝড়ের পূর্বাভাস। | সেনাসদরের প্রভাবশালী একটি চক্র জেনারেল ইয়াহিয়াকে সব সময় খােশমেজাজে রাখার চেষ্টা করত। তারা একটি ধারণা দিয়েছিল যে দেশে অনেক রাজনৈতিক দল কিন্তু সেগুলাে কখনাে জোট বাঁধতে পারবে না। নির্বাচন হলেও একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হবে, কারও সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না। সুতরাং, ইয়াহিয়া ইচ্ছামতাে কলকাঠি নাড়াতে পারবেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল সব হিসাবনিকাশ গােলমাল করে দিল। | পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে ভাবতেও পারেনি, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এত বড় জয় পাবে। চতুর্দশ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজার অনুমান ছিল, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৭৫ ভাগ আসনে জয়ী হবে। এ কথা তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দপ্তরকে জানিয়েছিলেন। ঢাকার সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরের মেজর জেনারেল গােলাম জিলানী খানের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ শতকরা ৮৫ ভাগ আসন পাবে। জেনারেলদের ধারণা হয়েছিল, আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে হলে অন্যান্য দলের সাহায্য নিতে হবে। সে জন্য ছয় দফা থেকে তাদের সরে আসতে হবে। আইএসআই-এর মহাপরিচালক প্রতিদিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সিএমএলএ সদর দপ্তর এবং প্রেসিডেন্টের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠাতেন। তারা সত্যিকার অবস্থা ঠিকঠাকভাবে তুলে ধরেননি।৪৫ 
নির্বাচনের তিন দিন পর ইসলামাবাদে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ঢাকার কনসাল জেনারেলের অফিসে নিম্নবর্ণিত নির্দেশ পাঠালেন : বিষয় : নির্বাচনসংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া ১) এটি নিশ্চিত করতে হবে যে মার্কিন দূতাবাসের সব কর্মী যেন মন্তব্য করার ক্ষেত্রে কোনাে তৃতীয় পক্ষের কাছে কোনাে ভ্যালু জাজমেন্ট না দেন। ২) আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে, যাতে করে কেউ মনে না করে যে | মার্কিন সরকার ভুট্টোর জয়ে হতাশ কিংবা মুজিবের জয়ে তুষ্ট।৬ আর্চার ব্লাড ৩০ ডিসেম্বর সহকর্মী বব কার্লকে নিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে তাকে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানান। শেখ মুজিব ২৩ বছরের শােষণের ব্যাপারে তিক্ততা প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে স্বাভাবিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকাটা খুব দরকার এবং বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান-ভারত সহযােগিতার প্রয়ােজন আছে। তিনি ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান তৈরি করবেন এবং এ জন্য তিনি সবার সহযােগিতা চান। সহযােগিতা পেলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তারাই এটি করবেন এবং ইতিমধ্যে এর খসড়া তৈরি হয়ে গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত ভুট্টোর আসন্ন ঢাকা সফর সম্পর্কে মুজিব মন্তব্য করেন, তিনি এলে তাকে স্বাগত জানানাে হবে, যেমনটি অন্যদের বেলায়ও প্রযােজ্য। তাকে খুবই আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল।৪৭। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ছিলেন সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত একমাত্র অমুসলমান সদস্য। ১৯৬৯ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পাকিস্তানের ১২ শতাংশ এবং পূর্ব পাকিস্তানের ২০ শতাংশ মানুষ ছিলেন অমুসলমান।
ফলে ত্রিদিব রায়ের নির্বাচিত হওয়া ছিল নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। তা সত্ত্বেও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেননি। এ দেশে আওয়ামী লীগের ঘােষিত অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারার সঙ্গে এটি ছিল সাংঘর্ষিক। ত্রিদিব রায় ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতীয় পরিষদের জন্য বরাদ্দ একটিমাত্র আসনে তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী প্রার্থী। পাকিস্তান। কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী ত্রিদিব। রায়কে মুসলিম লীগের টিকিটে নির্বাচন করতে বলেছিলেন। তিনি এ জন্য ত্রিদির রায়কে এক লাখ টাকাও দিতে চেয়েছিলেন। রায় রাজি হননি। তিনি যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনােনয়নপত্র জমা দিতে তৈরি হচ্ছিলেন, সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম পান। বঙ্গবন্ধু তাকে ঢাকায় এসে দেখা করতে। বলেন। তাদের মধ্যকার কথােপকথন উঠে এসেছে ত্রিদিব রায়ের বয়ানে : রায় ; মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালাে না। কাপ্তাই বাঁধের কারণে যারা ভিটে হারিয়েছে, তারা এখনাে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এ মুহূর্তে তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক।
সুরক্ষা। মুজিব : আমার দল ক্ষমতায় এলে ওই এলাকায় উন্নয়ন করব। রায় : আমরা পার্বত্য এলাকার আলাদা মর্যাদা চাই। সংবিধানে নিরাপত্তা। চাই। মুজিব : রাজা সাহেব, আমাদের দরকার উন্নয়ন। কথা দিচ্ছি, আমি আপনাদের
উন্নয়নে সাহায্য করব। (তারপর জোরে হেসে উঠলেন) আমার দলে যােগ দিচ্ছেন না কেন? রায় ; আমরা দলীয় রাজনীতি ভালাে বুঝি না শেখ সাহেব। আপনার প্রস্তাবের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘােষণা দিয়েছি। এখন মত বদলালে লােকে এটিকে ভালােভাবে নেবে না। শেখ মুজিব আমার বিরুদ্ধে কোনাে প্রার্থী না দেওয়ার বিনিময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাদেশিক পরিষদের দুটি আসনে আমার সমর্থন চান। আমার উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শের পর আমি এ প্রস্তাব বাতিল করে দিই। দক্ষিণে আমরা অং সু কে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ওখানে আওয়ামী লীগের একজন ভালাে বাঙালি প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তিনি জিতলে আমাদের জন্য তা হতাে কবর খোঁড়ার শামিল। শেখ মুজিব আমার বিরুদ্ধে জাতীয় পরিষদের আসনে চারু বিকাশ চাকমাকে মনােনয়ন দেন।… ৪ জানুয়ারি (১৯৭১) আমি শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাসায় গেলাম আবার তার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আরও আন্তরি
কতার সঙ্গে আমাকে স্বাগত জানালেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবিধানিক মর্যাদার বিষয়টি আলােচনা করতে চাইলে তিনি বিষয়টি ঘুরিয়ে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কথা বলতে। থাকলেন। পার্বত্য এলাকার জন্য সাংবিধানিক রক্ষাকবচের ব্যাপারে তাঁর। আগ্রহ ছিল না। আমি তার কাছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উত্তর চাইলে তিনি আমাকে তার আইন ও সংবিধানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হােসেনের সঙ্গে দেখা করতে বললেন।
কামাল হােসেন সৌজন্য দেখালেন।…তার সঙ্গে বিভিন্ন ককটেল পার্টিতে আগে দেখা হয়েছে। তিনি ছিলেন উদার মনের মানুষ। তার স্ত্রী সিন্ধুর মেয়ে, পাকিস্তানের একজন সেরা কূটনীতিক ইকবাল আখুন্দের বােন। তাঁকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতেই তিনি সহানুভূতি দেখালেন। কিন্তু কাজের কথা কিছুই বলেননি। জানতাম, তিনি চাইলেও দলীয় রাজনীতিকদের চাপের কারণে কার্যকর কিছু করতে পারবেন না, এমনকি মুজিবও যদি সহানুভূতিশীল হন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর র