You dont have javascript enabled! Please enable it! 1967 | আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা - সংগ্রামের নোটবুক
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বর। আইয়ুব খান তার অফিসঘরে বসে আছেন। সামনে টেবিলের ওপর একটি গােয়েন্দা প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলা গঠন করার একটি ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের হােতা নৌবাহিনীর একজন বাঙালি কর্মকর্তা। তিনি ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় মিশন এবং আরও কয়েকজনের সহযােগিতায় সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য, বেসামরিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসহ অনেকেই এর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন, সক্রিয় সমর্থন দিয়েছেন, যদিও মশিউর রহমান ও মােহন মিয়া কোনােভাবেই এর সঙ্গে জড়িত নন। কীভাবে এর মােকাবিলা করা হবে, তদন্ত শেষ হলে তা নির্ধারণ করা হবে। আইয়ুব খানের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর কেউ নন, স্বয়ং সবুর খান। তিনি সবুর খানকে ডেকে পাঠালেন। সবুর খান বললেন, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আইয়ুব খান তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীনকে একটা চিঠি দিয়ে তার হতাশার কথা জানান। তার ধারণা, তার মন্ত্রিসভার বাঙালি মন্ত্রীদের কেউ কেউ তথ্য গােপন করছেন। খাজা শাহাবুদ্দীন প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন।
এ ধরনের একটি জটিল বিষয়ের সুরাহা করার জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা উচিত বলে তিনি পরামর্শ দেন। পরামর্শগুলাে ছিল : ১) এখন পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে, তাতে মনে হয় কোনাে রাজনৈতিক দল এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নয়। সুতরাং সরকারদলীয় কতিপয় নেতার কথা শুনে বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের ওপর অভিযােগ আনলে জনগণ এটির ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে। ২) জনগণ এমন মনে করতে পারে যে বিরােধী দলকে দমন করার জন্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এ নাটক সাজিয়েছে। ৩) জনগণ মনে করতে পারে, রাজনীতিকদের ফাঁসালে মূল শত্রু ভারত ছাড় পেয়ে যাবে এবং দেশ-বিদেশে এটিই মনে করা হবে, এ ঘটনার পেছনে জনসমর্থন আছে। ৪) বিরােধী সব রাজনৈতিক দল বা কোনাে একটি দলকে দায়ী করলে হিতে বিপরীত হতে পারে, তখন তারা অনন্যোপায় হয়ে আরও বেশি ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়ােজিত হবে। ৫) বিষয়টিকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার। বিষয়টি সব মন্ত্রী ও সরকারি মুখপাত্রকে জানিয়ে দেওয়া প্রয়ােজন এবং দলেরও উচিত হবে সব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বিষয়টি উপলব্ধি করানাে। 
২ জানুয়ারি (১৯৬৮) পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র দপ্তর প্রথম একটি ষড়যন্ত্রমূলক’ তৎপরতার কথা ঘােষণা করেছিল। বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে আসে ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দেওয়া একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় : পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার একটি ভারত-সমর্থিত ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযােগে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মােট ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।  একজন সরকারি মুখপাত্র সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে প্রকাশিত তালিকাটি এ-যাবৎ ধৃত ব্যক্তিদের পূর্ণ তালিকা।  আজকের ঘােষণায় সরকারের এর আগেকার একটি প্রেসনােটকেই বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। আগের প্রেসনােটে রাষ্ট্রবিরােধী তৎপরতার দায়ে কতিপয় লােককে গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়েছিল। সেই সংক্ষিপ্ত ঘােষণা দেশে নানা ধরনের জল্পনার সৃষ্টি করেছিল। আজকের ঘােষণায় ধৃত ব্যক্তিদের পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করায় সব রকম জল্পনার সমাপ্তি ঘটেছে।
এদের সবাইকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ধৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশই পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার এ ষড়যন্ত্রে তাদের নিজ নিজ ভূমিকার কথা স্বীকার করেছে। এদের কেউ কেউ কমপক্ষে একজন ভারতীয় কূটনীতিক মি, ওঝার সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছিলেন। এরা আগরতলার ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার লে. ক. মিশ্র এবং মেজর মেননের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ভারতের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহই এ সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল। তবে আজ যে ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের কোনাে ইচ্ছা প্রকৃতপক্ষে ভারতের নেই। কাশ্মীর বিরােধ ও অন্যান্য বিরােধ পাকিস্তানের প্রতি একটি গভীর শত্রুতারই প্রকাশ। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দুজন সিএসপি অফিসার আহমদ ফজলুর রহমান ও রুহুল কুদ্সকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, সামরিক শাসনামলে স্ক্রিনিং কমিটি এদের দুজনের প্রতি নােটিশ দিয়েছিল। পরে প্রেসিডেন্ট উভয়কেই ক্ষমা করেন এবং আরেকবার সরকারি কাজ করার সুযােগ দেন।  বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে স্বাভাবিকভাবে দেশের উভয় অংশের জনসাধারণের মধ্যে যে ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে, সরকার সে সম্পর্কে সচেতন। তাই সরকার তদন্তের ফলাফল, অগ্রগতি এবং এদের বিচার-সম্পর্কিত সব তথ্য জনসাধারণকে জানাবে।  এ ব্যাপারে তদন্ত সমাপ্তির পথে এবং বিচার শিগগিরই শুরু হবে। ধৃত ব্যক্তিরা হলেন অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থায় কর্মরত পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, মি. বিধান কৃষ্ণ সেন, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডাক্তার সাইদুর রহমান, সার্ভিস সিভিল ইন্টারন্যাশনালের (সুইজারল্যান্ড) পাকিস্তান শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এম আলী রেজা, আহমদ ফজলুর রহমান সিএসপি (স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৬৬ সাল থেকে ছুটি ভােগ করছেন), রুহুল কুদ্দুস সিএসপি (অবসর গ্রহণের প্রস্তুতির ছুটি ভােগ করছিলেন এবং একটি ট্রেনিং কোর্সের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন), মুহিবুর রহমান (সাবেক নেভাল স্টুয়ার্ড), কামাল উদ্দিন আহমদ। (সাবেক নেভাল পেটি অফিসার), সুলতান উদ্দিন আহমদ (সাবেক নেভাল লিডিং সি-ম্যান), মীর্জা এম রমিজ (পিআইএতে কর্মরত অবসরপ্রাপ্ত সাবেক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট), আমির হােসেন (পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক করপােরাল), খুরশীদ আলম (সাবেক নেভাল লিডিং সি-ম্যান), মােহাম্মদ মাহমুদ আলী, এ বি এম ইউসুফ, তাজুল ইসলাম, খুরশীদ মিয়া, দলিলুদ্দিন, মামুদ আর চৌধুরী, আনােয়ার হােসেন, পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, ডাক্তার। ক্যাপ্টেন খুরশিদুদ্দিন, এ এম সি সুবেদার আবদুর রাজ্জাক (পাকিস্তান সেনাবাহিনী), সার্জেন্ট এ এম এফ হক (বিমানবাহিনী), সার্জেন্ট শামসুদ্দিন (বিমানবাহিনী) ও হাবিলদার ইনসাফ আলী। ৬ জানুয়ারি ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি পি এন ওঝাকে পাকিস্তান সরকার বহিষ্কার করে। এর পাল্টা জবাবে ভারত সরকার দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের উপদেষ্টা এম আহমদকে এক দিনের মধ্যে ভারত ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ও পরিচালনার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কাজেই অন্যদের সঙ্গে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে । পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে তিনি আগে থেকেই জেলে ছিলেন। যত দূর জানা যায়, সশস্ত্র বাহিনীর ছােট্ট একটি বিক্ষুব্ধ গ্রুপ বাঙালি সেনা ও অফিসারদের স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে গােপনে একটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশন গড়ে তােলে। করাচির মনরাে দ্বীপে ১৯৬২ সালে এক কর্মকর্তার বাসায় প্রথম আনুষ্ঠানিক গােপন সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। লে. ক. মােয়াজ্জেম, স্টুয়ার্ড মুজিব, সিম্যান নুর মােহাম্মদ ও লিডিং সি-ম্যান সুলতান উদ্দিন এ সভায় ছিলেন। পরবর্তী সময়ে যাদের বিশ্বাস করা যায়, তাদেরই তারা এ সংগঠনের সদস্য করে নেন। সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন, সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘােষণা করতে হবে। এ আন্দোলনের একজন উচ্চপদস্থ নেতার প্রয়ােজন মনে করা হলে কর্নেল মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়। ওসমানী নৈতিক সমর্থন জানিয়ে ওই মুহূর্তে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, সশস্ত্র বিদ্রোহ করার মতাে যথেষ্ট ক্ষমতা বাঙালি রেজিমেন্টের এখনাে হয়নি, সেপাই সুরু মিয়া এখনাে হামাগুড়ি দেওয়ার উপযুক্ত হয়নি। আরও ১০টি বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা দরকার। বিদ্রোহীরা অতটা সময় অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন না। তারা রাজনৈতিক দলগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ শুরু করলেন। অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ও মওলানা ভাসানীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা। হলাে। শেখ মুজিবের সঙ্গে বিদ্রোহী দলের প্রথম যােগাযােগ হয় ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে করাচিতে।
মােয়াজ্জেম নিজে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং মােয়াজ্জেম তার পরিকল্পনা তুলে ধরেন। শেখ মুজিব তখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর প্রচার নিয়ে ব্যস্ত। তিনি মােয়াজ্জেমকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন এবং বলেন যে ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনে জিতলে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আর প্রয়ােজন হবে না। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহােরে বিরােধী দলগুলাের সম্মেলনে যাবেন, এ সংবাদ পেয়ে মােয়াজ্জেম তাকে লাহাের যাওয়া থেকে বিরত রাখার পরিকল্পনা করেন। তার ধারণা ছিল, লাহােরে শেখ মুজিব তাঁর দাবিদাওয়া উপস্থাপন করলে শেখ মুজিবের ওপর গােয়েন্দা নজরদারি অনেক বেড়ে যাবে এবং তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। আবদুল গাফফার চৌধুরীকে মােয়াজ্জেম তার আশঙ্কার কথা জানান এবং শেখ মুজিবকে এ কথা জানিয়ে দিতে অনুরােধ করেন। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য খুব উদ্গ্রীব ছিলেন। গাফফার চৌধুরীর কাছে মােয়াজ্জেমের নাম শুনেই শেখ মুজিব ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, “আমি তাকে চিনি। আমি জানি সে কী চায়। ইদানীং সে মানিক চৌধুরীর সঙ্গে মাখামাখি করছে। আমি মানিককে এসব পাগলামি থেকে দূরে থাকতে বলেছি। আমি তােমাকেও বলছি, এসব থেকে দূরে থাকো। আমাদের লড়াই হচ্ছে বাংলার মানুষের জন্য গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন আদায় করা। আমি সব সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, এর পরিবর্তে বাঙালি সামরিক জান্তাকে ক্ষমতায় বসানাের জন্য নয়। এরপর মােয়াজ্জেমের সঙ্গে শেখ মুজিবের আর কোনাে যােগাযােগ হয়নি।
মােয়াজ্জেম তার পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হন। তারা একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করেন। ১৯৬৬ সালের জুন মাসে তার চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ হাউজিং সােসাইটির বাসায় একটি জরুরি সভা ডাকেন। এ সভায় তিনি প্রস্তাবিত নতুন রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’, জাতীয় পতাকার ডিজাইন ও রাষ্ট্রীয় মূল নীতিগুলাে সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন। নীতিগুলাে ছিল : ১) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা; ২) যে কাজ করবে না, সে খাবে না—এ নীতি বলবৎ করা; ৩) সকল ব্যক্তিগত সম্পত্তি সরকারের মালিকানাধীন করা; ৪) কলকারখানা জাতীয়করণ করা; ৫) প্রতিটি নাগরিকের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা। অস্ত্রশস্ত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্যে মােয়াজ্জেম ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি পি এন ওঝাকে মানিক চৌধুরীর মাধ্যমে অস্ত্রের একটি তালিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওঝা ও মানিক চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগের ভার দেওয়া হয় সাবেক করপােরাল আবদুস সামাদকে। এ যােগাযােগ নিরাপদ ও সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য স্থান হিসেবে আহমদ ফজলুর রহমানের স্ত্রী হাসিনা রহমানের ঢাকাস্থ “গ্রীন ভিউ’ পেট্রল পাম্প নির্ধারণ করা হয়। আবদুস সামাদকে পেট্রল পাম্পের। ম্যানেজারের চাকরি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের সায়দুর রহমানের মাধ্যমে মােয়াজ্জেম ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে। ওঝার সঙ্গে পাঁচবার দেখা করেন। পঞ্চম বৈঠকে ওঝা জানান, ভারত সরকার অস্ত্র ও গােলাবারুদ সরবরাহের আগে বিপ্লবী দলের সঙ্গে ভারত সরকারের। কর্মকর্তাদের আলােচনা হওয়া দরকার বলে মনে করে। ওঝা আগরতলায় দুই পক্ষের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠকের প্রস্তাব করেন। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে এক জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত হয়, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান ও আলী রেজা প্রতিনিধি। হিসেবে আগরতলায় যাবেন। ১২ জুলাই প্রতিনিধিদল বিলােনিয়া হয়ে আগরতলায় পৌছায়। কিন্তু প্রতিনিধিদলের সদস্যরা নিম্নপদস্থ হওয়ায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে আলােচনায় রাজি হয়নি। এ বৈঠক না হওয়ায় মােয়াজ্জেম নিজেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলােচনার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৮ সালের ১৬ জানুয়ারি বৈঠকের দিন ঠিক করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে মােয়াজ্জেম প্রথমে নেপালে যাবেন এবং সেখান থেকে দিল্লি পৌছাবেন। তাঁর সঙ্গী হবেন আহমদ ফজলুর রহমান। কিন্তু এ পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৬৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি কর্মসূচি ছিল। একই সময় চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হচ্ছিল। পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তার চট্টগ্রামে আসার কথা ছিল। বিপ্লবীরা এ সুযােগে সেনাপ্রধানসহ সব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার এবং অন্যান্য সেনানিবাসে যুগপৎ আক্রমণ করে দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বিপ্লবী পরিষদের দলত্যাগী। কোষাধ্যক্ষ করপােরাল আমির হােসেনের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এ পরিকল্পনার তথ্য সরকারের গােয়েন্দা বাহিনীর কাছে চলে যায়। ফলে চট্টগ্রামের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। গােপন তথ্যের ভিত্তিতে সরকার অতি গােপনে কিছু কিছু গ্রেপ্তার করার কাজ শুরু করে।১০
দলের এক সভায় মােয়াজ্জেম বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে আমির হােসেনের প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দেন। এটি কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আশরাফ আলীকে। আশরাফ আমির হােসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি আমির হােসেনকে সতর্ক করে দেন। ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে প্রাণ বাঁচানাের উদ্দেশ্যে আমির হােসেন রাওয়ালপিন্ডিতে নিরাপত্তা ও গােয়েন্দা অফিসে নিজেই হাজির হয়ে সবকিছু ফাঁস করে দেন। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গণগ্রেপ্তার শুরু হয়। গ্রেপ্তার পর্ব প্রায় শেষ হয়ে গেলে ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর। একটি প্রেসনােট দিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ করে। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আরেকটি ঘােষণায় শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুর রহমান খান সিএসপিকে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার অভিযােগে আটক করা হয়। মুজিব আগে থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে বন্দী ছিলেন।১১  এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শেখ মুজিবের নাম জড়ানাে নিয়ে লুকোচুরি খেলা হয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান এ ব্যাপারে জোরালাে ভূমিকা। রাখেন। যখন ‘ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয়, তিনি তখন মুজিবকে এ সুযােগে দেশদ্রোহী হিসেবে কলঙ্কিত করার সুযােগটি হাতছাড়া করতে চাননি। গ্রেপ্তার হওয়া অনেককে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়, যাতে তারা মুজিবকে জড়িয়ে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ঢাকার মগবাজারে একটি সেফ হােমে’ ধরে এনে তাদের দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকেই রাজসাক্ষী হতে রাজি হন।১২
পুরাে বিষয়টি তখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কাছে গােপন রাখা হয়েছিল। সবকিছু গুছিয়ে আনার পর প্রেসিডেন্টের সম্মতির প্রয়ােজন দেখা দেয়। আইয়ুব খান স্বৈরশাসক হলেও আইনি ব্যাপারে ছিলেন খুঁতখুঁতে স্বভাবের।
সুতরাং সামরিক গােয়েন্দা বাহিনী যে ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করেছে, তার যথার্থতা নিয়ে। আইয়ুব নিঃসন্দেহ হতে চাইলেন, যাতে করে এটি আদালতে প্রশ্নের মুখে না পড়ে। ইয়াহিয়া তখন আইয়ুবের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়ােগের চেষ্টা করেন। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে আইয়ুব পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তার চন্দ্রঘােনা কাগজের কল দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। সামরিক গােয়েন্দা সূত্রে বলা হলাে, প্রেসিডেন্ট যে বিমানে চড়ে চট্টগ্রামে যাবেন, ষড়যন্ত্রকারীরা বােমা মেরে তা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আইয়ুব তার চট্টগ্রাম যাত্রা বাতিল করে দেন। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ষড়যন্ত্রের কথা জেনে তিনি মুষড়ে পড়েন। তথ্যসচিব আলতাফ গওহরকে তিনি সখেদে বলেন, ‘ওরা আমাদের সঙ্গে আর থাকবে না।’ আইয়ুব চেয়েছিলেন একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এর বিচার হােক। ইয়াহিয়া তখন কয়েকজন মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে সেনাসদরে একটি সভা করেন। ইয়াহিয়া দাবি করেন যে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শেখ মুজিব জড়িত। তিনি একটি প্রকাশ্য বিচারের প্রস্তাব করেন, যাতে করে বিষয়টি প্রচার পায়। আলতাফ গওহর দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, তাহলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম হুমড়ি খেয়ে পড়বে এবং মামলার দুর্বলতা ও ত্রুটিগুলাে। খুঁজে বের করবে। ইয়াহিয়া আলতাফ গওহরকে আশ্বস্ত করে বলেন, চিন্তার কারণ নেই, মামলাটি একেবারেই নিচ্ছিদ্র। আলতাফ জবাবে বলেন, তাহলে প্রচারও হবে নিচ্ছিদ্র।১৩ আলতাফ গওহর আইয়ুব খানকে ইয়াহিয়ার সঙ্গে এ বৈঠকের বিষয়টি জানিয়ে বলেন, শক্ত প্রমাণ ছাড়া মুজিবকে এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়ালে বিপদ হতে । পারে। আইয়ুবের পরামর্শে তখন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে মুজিবের। নাম বাদ দেওয়া হয়। কয়েক দিন পর যখন স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রেসনােট দেওয়া। হলাে, দেখা গেল মুজিবের নামটি রয়েছে তালিকার শীর্ষে। ইয়াহিয়া যেভাবেই। হােক এ ব্যাপারে আইয়ুবকে রাজি করাতে পেরেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত ছিল খুব। দুঃখজনক এবং এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী ।
ইয়াহিয়া নিশ্চয়ই জানতেন যে মামলাটি হবে প্রচণ্ড রকম বিস্ফোরক, যা সরকারের সব সুনাম ধুলায় মিশিয়ে দেবে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, সম্ভবত চিরদিনের জন্য।১৪  প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ২৫ জানুয়ারি (১৯৬৮) আলতাফ গওহরকে ডেকে পাঠান। আইয়ুব তখনাে তার হৃদ্‌রােগের ধাক্কা সামলে ওঠেননি। আলতাফ। গওহর সরাসরি আইয়ুবের শােবার ঘরে চলে যান। তাদের কথােপকথন ছিল এ রকম : আলতাফ : বাঙালিরা সম্ভবত ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। আইয়ুব : বাঙালিদের কথা উঠলেই তােমার মধ্যে আশঙ্কা জেগে ওঠে।
আলতাফ : বাঙালিরা সম্ভবত খুব আবেগপ্রবণ এবং সংগত কারণেই তাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। সংবিধান অনুযায়ী তারা তাদের প্রাপ্য পাচ্ছে। জাতীয় পরিষদ এবং এর সচিবালয় ঢাকায় থাকার কথা, যা কিনা হবে দ্বিতীয় রাজধানী। তাদের একটা ভুতুড়ে শহর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পরিষদের সব কাজ হয় ইসলামাবাদে এবং পরিষদের কর্মচারীরাও এখানে স্থায়ীভাবে থাকে। আইয়ুব : আমার প্রিয় বন্ধু, শােননা । আমি তাদের দ্বিতীয় রাজধানী দিয়েছি। কারণ, একদিন তাদের এটি দরকার হবে। তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে না।১৫ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারী ও নেতা ছিলেন পাকিস্তান নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন। সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করার সময় তাকেই প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করেছিল। পরে এই মামলায় শেখ মুজিবকে জড়ানাে হলে মােয়াজ্জেমকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। কমান্ডার মােয়াজ্জেমের পরিকল্পনা সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী কোহিনূর হােসেন : এটি ১৯৬৪ সালের কথা। আমার বয়স কম। ক্লাস টেনে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায়। অনেক কিছুই বুঝতাম না। করাচিতে ড্রিগ রােডে মােহাম্মদ আলী কলােনির বাসায় তার কাছে অনেকেই আসতেন। কথা বলতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হয়তাে মাঝরাতে এসে আমাকে বললেন, ‘এতজনকে খাওয়াতে হবে।’ বলতাম, ঘরে তাে তেমন কিছু নেই, কী খাওয়াব? উনি বলতেন, ‘আলুভর্তাডিম, যা কিছু হােক, কেউ না খেয়ে যাবে না। মাঝে মাঝে বিরক্ত হতাম। মামলা চলার সময় এদের অনেককে দেখে আমি চিনতে পেরেছি।
একদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে বললেন, ভালাে কিছু আয়ােজন করাে, একজন বিশেষ অতিথি আসবেন।’ আমি কয়েক পদ রান্না করলাম। তারপর কে বা কারা এল, দেখিনি। সকালে উনি বললেন, ‘জানাে কে এসেছিল, শেখ মুজিব!’ বললাম, আমাকে একটু ডাকলেই পারতে, ওনাকে দেখতাম। শেখ মুজিব দুবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন। শুনেছিলাম, রুহুল কুদুস সাহেব আর আহমদ ফজলুর রহমান সাহেব শেখ মুজিবের সঙ্গে যােগাযােগ করিয়ে দিয়েছিলেন। উনি প্রায়ই উইকএন্ডে ঢাকায় যেতেন। শনিবার গিয়ে সােমবারে চলে আসতেন। বলতেন, অফিসের কাজ থাকে। তারপর উনি বদলি হলেন। তখন আমরা বরিশালে। উনি ডেপুটেশনে বিআইডব্লিউটিএতে। বললেন, বরিশালে থাকলে সুবিধা, প্রতি সপ্তাহে ঢাকা যাওয়া যায়। আবার একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ভাত আর রুটি এক থালায় রাখা যায় না। পশ্চিম পাকিস্তানিদের উনি একদম দেখতে পারতেন না।এটি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি হবে হয়তাে। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম, উনি বসে কোরআন তিলাওয়াত করছেন। বললাম, এত রাতে? নিজের মনেই বললেন, এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা বিলােনিয়া ক্রস করেছে। এই মামলার শিরােনাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’। ১৯৬৩ সালের ফৌজদারি আইন সংশােধনীর (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অর্ডিন্যান্স) ৪ ধারা অনুযায়ী ২১ এপ্রিলের (১৯৬৮) এক বিজ্ঞপ্তি দ্বারা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। মামলার বিবরণীতে বলা হয় : গােপন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের অনুসরণে এমন একটি ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করা হয়, যার মাধ্যমে ভারত কর্তৃক প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ও অর্থ ব্যবহার করে পাকিস্তানের একাংশে সামরিক বিদ্রোহের দ্বারা ভারতের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কতিপয় ব্যক্তিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা। আইনের আওতায় এবং কতিপয় ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চাকরির সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয় ।…তাদের প্রধান কর্মপরিকল্পনা ছিল সামরিক ইউনিটগুলাের অস্ত্রশস্ত্র দখল। করে সেগুলাে অচল করে দেওয়া। কমান্ডাে স্টাইলে অভিযান চালিয়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।১৭ অধিকাংশ নেতা জেলে আটক থাকার কারণে আওয়ামী লীগের তখন ছন্নছাড়া। অবস্থা। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে সক্রিয় জনমত গড়ে তােলার মতাে অবস্থা তখন দলটির ছিল না। এ মামলার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটি উচ্চারিত হয় ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের মুখে। মামলায় শেখ মুজিবকে জড়ানােয় ছাত্রলীগের কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি কাজী ফিরােজ রশীদ ও সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইফুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা একটি মিছিল বের করেন। এই মিছিলের পর পুলিশ জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতাদের ওপর খেপে ওঠে। মফিজুর রহমান, কাজী ফিরােজ রশীদ, সাইফুদ্দীনসহ অন্য নেতাদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ হন্যে হয়ে ওঠে। ছাত্রনেতারা একের পর এক গ্রেপ্তার হন।১৮ মামলায় ৩৫ জন অভিযুক্ত এবং ২৩২ জন সাক্ষীর তালিকা দেওয়া হয়। অভিযুক্তদের মধ্য থেকে ১১ জনকে ক্ষমা করে রাজসাক্ষী বানানাে হয়। অভিযােগপত্রে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা ছদ্মনাম ব্যবহার করে তাদের গােপন তৎপরতা চালাতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান (পরশ), লে. ক, মােয়াজ্জেম হােসেন (আলাে), আমির হােসেন মিয়া (উস্কা), ক্যাটারিং লে. মােজাম্মেল হােসেন (তুহিন), সাবেক লিডিং সি-ম্যান সুলতান উদ্দিন আহমদ (কামাল), স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান (মুরাদ), রুহুল কুদ্স সিএসপি (শেখর) ও
লিডিং সি-ম্যান নুর মােহাম্মদ (সবুজ)।১৯ অভিযােগপত্রে কর্নেল ওসমানীর নাম উল্লেখ থাকলেও তাকে আসামি কিংবা সাক্ষী করা হয়নি।
১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসের ভেতর একটি ঘরে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। পত্রপত্রিকায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে সংবাদ পরিবেশন করা হতে থাকে। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি শেখ আবদুর রহমান এবং অন্য দুজন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি এম আর খান ও মুকসুমুল হাকিম। তারা দুজনই ছিলেন বাঙালি।
মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষ সমর্থন করার জন্য আইনজীবী নিয়ােগের। প্রক্রিয়ার শুরুটা ছিল হতাশাব্যঞ্জক। আইনজীবীদের অন্যতম ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিবরণ থেকে জানা যায়, কে জেড আলম, সাখাওয়াত হােসেন, আবুল খায়ের খান ও মওদুদ এই চারজন তরুণ ব্যারিস্টার শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা কেউ আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন না। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা তখন জেলে। সংগঠন বলতে কিছুই ছিল না। বাইরে যারা ছিলেন, তারা প্রায় সবাই নিশ্চুপ। এই চারজন আইনজীবী বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডের বাসায় যান। বেগম মুজিব প্রথমে তাদের কথা বিশ্বাস করেননি। তিনি বলেছিলেন, আমার বাড়ির ওপর দিয়ে এখন কাক পর্যন্ত ওড়ে না । আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবেরা এই রাস্তা দিয়ে আর যায় না, আমাদের বাড়ি এড়াবার জন্য অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যায়। বন্ধুবান্ধবেরা যারা তার (মুজিবের) কাছ থেকে উপকার পেয়েছে তারাও আর আসে না, আপনাদের তাে আমি চিনি না।’
এরপর তারা চারজন মানিক মিয়ার সঙ্গে আলাপ করে তাকে নিয়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন এবং মানিক মিয়ার বাসায় কয়েকটি বৈঠক করেন। বেগম মুজিব তাদের বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। এর প্রায় এক মাস পর তিনি তার এক আত্মীয়কে নিয়ে মওদুদের কায়েতটুলীর বাসায় মাঝরাতে এসে শেখ মুজিবের সই করা একটি ওকালতনামা দিয়ে তাদের উদ্যোগ নিতে বলেন। ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবীদের নিয়ে একটি কমিটি করার চেষ্টা প্রথমে ব্যর্থ হয়। সিনিয়র আইনজীবীরা কেউ ওকালতনামায় সই দেননি। মওদুদ তখন লন্ডনে তার বন্ধুদের শরণাপন্ন হন। জাকারিয়া খানের নেতৃত্বে লন্ডনের বাঙালিরা স্যার টমাস উইলিয়ামের সঙ্গে আলােচনা করে তাকে নিয়ােগ করে। টমাস উইলিয়াম আসছে জেনে ঢাকায় অনেক আইনজীবী উৎসাহ দেখান। শেষ পর্যন্ত আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে আইনজীবীদের একটি ডিফেন্স কাউন্সেল’ গঠন করা সম্ভব হয়। ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে আইয়ুব খান চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। যে হােটেলে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, প্রথম দিনই ওই হােটেলের সামনে পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। যেভাবেই হােক তারা শেখ মুজিবকে বাঁচানাের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ছাত্ররা ‘রাইটস অব ইস্ট পাকিস্তান ডিফেন্স ফ্রন্ট গঠন করেন এবং বিলেতের খ্যাতনামা আইনজীবী টমাস উইলিয়াম কিউসিকে ঢাকায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে আইনজীবীদের সঙ্গে যােগ দেওয়ানাের ব্যবস্থা করেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যমও এ মামলার ব্যাপারটি পছন্দ করেনি। দ্য টাইমস-এর মন্তব্য ছিল, এমন সময় মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযােগ আনা হয়েছে, যখন তিনি জেলে বন্দী। ঢাকা সেনানিবাসে আদালত বসানােয় মনে হয় এর পেছনে সেনাবাহিনীর কারসাজি আছে।২২ মামলা চলাকালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনকে বিচারকক্ষে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পছন্দমতাে আইনজীবী নিয়ােগের সুযােগ পান।

 

শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি নিযুক্ত হয়েছিলেন আবদুস সালাম খান। টমাস উইলিয়াম শেখ মুজিবের পক্ষে মামলার বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। তাকে সহায়তা দিয়েছিলেন আমীর-উলইসলাম ও মওদুদ আহমদ। অন্য আইনজীবীদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন আতাউর রহমান খান, খান বাহাদুর মােহাম্মদ ইসমাইল, আমিনুল হক, খান বাহাদুর নাজিরুদ্দিন আহমেদ, মীর্জা গােলাম হাফিজ, বদরুল হায়দার চৌধুরী, জহিরুদ্দিন, মােল্লা জালালউদ্দিন, জুলমত আলী খান প্রমুখ। সরকারপক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল মঞ্জুর কাদের। তাঁর সহযােগী ছিলেন বাঙালি আইনজীবী টি এইচ খান।২৩

টমাস উইলিয়াম ঢাকায় এক সপ্তাহ ছিলেন। সরকার তাকে নানাভাবে হয়রানি করে। গােয়েন্দারা সব সময় তাকে অনুসরণ করত। এমনকি তার ঘরে ঢুকে ব্যাগ খুলে কাগজপত্র তছনছ করা হয়। তিনি লন্ডনে ফিরে যান। লন্ডন টাইমস এর সংবাদদাতা পিটার হ্যাজেলহাষ্ট টমাস উইলিয়ামের হয়রানি ও আগরতলা মামলা সম্পর্কে কয়েকটি রিপাের্ট পাঠিয়েছিলেন। এর ফলে বিদেশিরাও মামলা সম্পর্কে জানতে পারেন।২৪
মামলা চলাকালে ২৯ আগস্ট আকস্মিকভাবে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বিচারকক্ষে হাজির হন। তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবীদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে বসেন। কাঠগড়ায় শেখ মুজিবকে দেখে তিনি দ্রুত তাঁর কাছে যান এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। গুঞ্জন শােনা যায়, ভুট্টো শেখ মুজিবের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামবেন। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় পরিষদের সদস্য গােলাম মােস্তফা খার। সরকারপক্ষের প্রধান কৌসুলি মঞ্জুর কাদেরও ভুট্টোর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। একপর্যায়ে ভুট্টো কাঠগড়ার পাশে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে ১০ মিনিট কথা বলেন। তারা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে কথা বলছিলেন। এরপর ভুট্টো বিচারকক্ষ ছেড়ে চলে যান। তিনি শেখ মুজিব বা অন্য । কোনাে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে ওকালতনামায় সই করেননি।২৫
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দেওয়া জবানবন্দি এবং আইনজীবীদের সওয়াল-জওয়াব পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল নিয়মিত। ফলে একদিকে অভিযােগের নানা অসংগতি ফুটে উঠছিল, অন্যদিকে মানুষ জানতে পারছিল, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে স্বীকারােক্তি আদায় করার জন্য কী অমানুষিক নির্যাতন চালানাে হয়েছিল। মামলার ২ নম্বর অভিযুক্ত লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে তার ওপর চালানাে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, এক গােপন মিশনে যাওয়ার কথা বলে তাকে ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর সেখানে পৌছালে বিমানবন্দর থেকে সাদাপােশাকে সামরিক গােয়েন্দা সংস্থার লােকজন। তাকে সেনাসদরের জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ছয় দফা কর্মসূচি সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত অভিমত জানতে চাওয়া হয়। জবানবন্দিতে তিনি বলেন : আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আমি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে চিনি কি না।…এরপর আমাকে পরামর্শ দেওয়া হলাে যে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে প্রদত্ত জবানবন্দিতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাদের নির্দেশমতাে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে আমাকে বলতে হবে যে আমি তাদের চিনি। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার যােগাযােগ আছে। তিনি আমাকে সামরিক বাহিনীতে কর্মরত এবং সাবেক লােকদের তার পার্টির সমর্থনে সংগঠিত করতে বলেছিলেন। তাঁর নির্দেশে আমার নেতৃত্বে এই সংগঠন চলবে এবং এই সংগঠনের জন্য ভারত থেকে অর্থসাহায্য পাওয়া যাবে।
রাত প্রায় চারটার সময় কর্নেলদ্বয় (কর্নেল হাসান ও কর্নেল আমীর) আমাকে দেখতে এলেন। তারা আমাকে অফিসকক্ষে নিয়ে পুনরায় আলােচনা শুরু করলেন। সেদিন ছিল প্রথম রমজান। আলাপ-আলােচনার এ পর্যায়ে আমি সেরির জন্য বললাম। আমাকে এই কথা বলা হলাে যে বাঙালি মুসলমানদের জন্য রােজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়। কারণ, তারা হিন্দুদের জারজ সন্তান। আমি প্রকৃতই মুসলমান কি না সে বিষয়ে তাদের নিশ্চিত হওয়া প্রয়ােজন এবং তাঁদের। কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য আমাকে জোর করে উলঙ্গ করা হলাে। দুঘণ্টা ধরে এই জিজ্ঞাসাবাদ চলে এবং পুরাে সময়টাই আমাকে হাঁটুতে ভর দিয়ে দুই হাত ওপরে তুলে থাকতে হয়েছে। আমার অবস্থার একটু নড়চড় হলেই তারা কিলচড়, লাথি-ঘুষি এবং লাঠি দিয়ে আঘাত করছিলেন।…একদিন নির্যাতনের সময় তারা আমাকে চেয়ারের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে চোখের সামনে অত্যুজ্জ্বল ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে দেন। আমি তাদের অনুরােধ করলাম নির্যাতনের এ পদ্ধতি। বাদ দিতে। কারণ, আমার চোখে সমস্যা ছিল এবং ডাক্তারের পরামর্শ ছিল কড়া রােদে খালি চোখে না যাওয়ার। তারা আমার অনুরােধ উপেক্ষা করলেন। উপরন্তু কর্নেল হাসান আমার চুলের মুঠি ধরে মাথা সােজা করে রাখেন, যাতে
আমার চোখে-মুখে পুরােপুরি লাইট পড়ে। আমি যখনই চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছেন।…২৬ গােড়ার দিকে ট্রাইব্যুনালে ২২৭ জন সাক্ষীর তালিকা জমা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত আড়াই শর বেশি সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। নির্যাতনের ভয় ও অন্যান্য প্রলােভন দেখিয়ে এসব সাক্ষী দাঁড় করানাে হয়। মামলার শুনানি চলার সময় একজন রাজসাক্ষী এবং তিনজন সরকারি সাক্ষীকে বৈরী ঘােষণা করা হয়। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন কামালউদ্দিন আহমেদ। তিনি ছােটখাটো একটি ব্যবসা করতেন। তিনি ছিলেন অন্যতম অভিযুক্ত সুলতান উদ্দিন আহমদের বােনের স্বামী।
সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য কামালউদ্দিনকে প্রচণ্ড রকম নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি সাক্ষ্য দিতে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে এসে তিনি নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। এর ফলে জনমত বিরূপ হয়ে ওঠে। তার জবানবন্দির কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হলাে। জোর করে আমার কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করল। ইন্সপেক্টর কে। আহমদ আমায় বলল, ‘ভারতের সঙ্গে যােগসাজশে তােমরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে যারা জড়িত আছ সকলের নাম লিখে স্টেটমেন্ট করে দিচ্ছি, সই করে দিতে হবে।’আমি বললাম, আমি এসবের কিছুই জানি না, আপনারা আমায় অযথা হয়রানি করছেন।
কাজ হাসিল হলাে না দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল সে, আমাকে ঘাড় ধরে মাটিতে ফেলে দিল। পরদিন আমাকে মিলিটারির হাতে তুলে দিল ।…ওরা এক থেকে পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত নির্যাতন চালাল আমার ওপর। একদিন তাে কানের কাছে এমন প্রচণ্ড চড় কষাল যে এখনাে কানে ভালাে শুনতে পাই না। কয়েকটি নখে সুই ঢুকিয়ে দিয়েছে কতবার, রুল দিয়ে মেরে মেরে আঙুল ভেঙে দিয়েছে। আঙুলগুলাে আর নাড়তে পারছি না। এতেও ওদের নির্যাতন শেষ হলাে না। আমাকে উলঙ্গ করে গুহ্যদ্বারে ব্যাটন ঢুকিয়ে জোর করে হাঁটিয়েছে। সে যে কী অসহ্য যন্ত্রণা কী বলব। কতবার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছি। আরেক দিন মাটিতে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে উপুড় করে রুল দিয়ে গুহ্যদ্বারে। কতগুলাে বরফের টুকরা ঢুকিয়ে দিল। তারপর চলল জিজ্ঞাসাবাদ : বল তােদের নেতা কে? মুজিবুর রহমান? ইন্ডিয়ায় কার সাথে যােগসাজশ আছে? ঢাকায় ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে কার সঙ্গে যােগাযােগ আছে? কোথায় কোথায় তােদের ঘাঁটি আছে, বল? আমি জ্ঞান হারাতে হারাতে শুধু বলতে পেরেছি, আমি এসবের কিছুই জানি ।
দিনের পর দিন ওরা নিত্যনতুন নির্যাতন চালিয়েছে। খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ছুরি দিয়ে শরীরের নানা স্থান কেটে কেটে কাটা জায়গায় নুন আর লঙ্কার গুড়া ছিটিয়ে দিয়েছে।…আরেকবার একজন সিপাই খুঁটির সঙ্গে বেঁধে শরীর থেকে। কাপড় খুলে নিল। তারপর আমার পুরুষাঙ্গ ধরে প্রবলভাবে টানাহেঁচড়া করতে। লাগল। অণ্ডকোষ দুই হাতে রগড়ে পিষে দিতে লাগল। অসহ্য যন্ত্রণায় বিকট চিকার করে উঠলাম। মাথা ঘুরে গেল। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল । জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম সঁতসেঁতে একটি মেঝেতে পড়ে রয়েছি।…। ..একজন মিলিটারি অফিসার বলল, ‘…যদি স্টেটমেন্ট না দাও, তােমার স্ত্রী আর মেয়েদের এনে তােমার সামনে উলঙ্গ করে চাবুক দিয়ে শরীর কেটে কেটে লঙ্কা-নুন ছিটিয়ে দেব। তােমার রূপসী স্ত্রীকে তােমার চোখের সামনে ন্যাংটা করে সাধারণ সেনাদের লেলিয়ে দেব তাকে ধর্ষণ করার জন্য।…’ তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, না, না, ওদের কিছু করবেন না, আমি স্টেটমেন্ট দেব।… ১৫ ডিসেম্বর ওরা আমাকে দিয়ে একটি দলিলে সই করিয়ে নিল।২৭ ট্রাইব্যুনালে শেখ মুজিব তার জবানবন্দিতে কথিত ষড়যন্ত্রের অভিযােগ অস্বীকার করে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে তার আপসহীন লড়াইয়ের জন্যই তাকে এ মামলায় জড়ানাে হয়েছে।
তার জবানবন্দির কিছু অংশ ছিল এ রকম: আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। ইহা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল—দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচি রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নই। আমি দেশের উভয় অংশের জন্য ন্যায়বিচার চাহিয়াছিলাম—ছয় দফা কর্মসূচিতে ইহাই বিধৃত হইয়াছে। দেশের জন্য আমি যা মঙ্গলকর ভাবিয়াছি, আমি সর্বদাই তাহা। নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডির ভিতরে জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছি এবং এই নিমিত্ত আমাকে সর্বদাই শাসকগােষ্ঠী এবং স্বার্থবাদীদের হাতে নিগৃহীত হইতে হইয়াছে। তাহারা আমাকে এবং আমার প্রতিষ্ঠানকে দমন করিয়া পাকিস্তানের জনগণের, বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর শােষণ ও নিষ্পেষণ অব্যাহত রাখিতে চায়।২৮ মামলার বিস্তারিত বিবরণ, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের জেরা, কৌসুলি, অভিযুক্ত ও সাক্ষীদের মধ্যে সওয়াল-জবাব, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতনের বিবরণ ইত্যাদি পত্রিকায় বিস্তারিতভাবে ছাপা হতে থাকে। ধীরে ধীরে। জনমত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন জাতীয় বীর। পুরাে মামলাই সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দাড়ায়।
শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীর সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করেন। মামলার কার্যবিবরণী সংগ্রহের জন্য অনেক সাংবাদিক ট্রাইব্যুনাল কক্ষে উপস্থিত থাকতেন। তাদের একজনের মাধ্যমে মুজিব ভাসানীকে আন্দোলন তৈরি করার অনুরােধ জানান। ভাসানী রাজনীতিতে ভিন্নমত পােষণ করলেও শেখ মুজিবের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। তাদের সম্পর্ক ছিল অনেকটা গুরু-শিষ্য কিংবা পিতাপুত্রের মতাে। খবর পেয়েই ভাসানী বলে ওঠেন, ‘শেখ মুজিব বলেছে, আমাকে যেতে হবে। সরকার এদের সবাইকে ফাঁসি দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। ২৯ | ভাসানী ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে জনসভা করেন। তিনি মামলা বাতিল করে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন এবং ১২ ডিসেম্বর হরতাল ডাকেন। তার দলের অন্যতম নেতা ও সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ তােয়াহা হরতালের বিরােধিতা করেন। সভা শেষ করে ভাসানী যখন মিছিল নিয়ে গভর্নর হাউসের সামনে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন পুলিশের বাধার মধ্যে পড়েন। পুলিশের সঙ্গে তাঁর বচসা হয়। তিনি তখনই ঘােষণা দেন, ‘আগামীকাল ৭ ডিসেম্বর হরতাল।’ ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে পিকেটারদের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়। সকাল ১০টার দিকে স্টেডিয়ামের গেটের কাছে মােটরসাইকেলে মােহাম্মদ তােয়াহাকে দেখা গেলে পিকেটাররা তাকে ধাওয়া করে। তিনি দ্রুত সরে পড়েন। বেলা ১১টায় পুলিশ নীলক্ষেতে জনতার ওপর গুলি চালায়।
গুলিতে পাক ইলেকট্রিক শপের ম্যানেজার আবদুল মজিদ ও কর্মচারী আবদুল হক আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর মজিদের মৃত্যু হয়। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে গুলিস্তান এলাকায় পুলিশের গুলিতে এক বালক ঘটনাস্থলেই নিহত এবং আরও তিনজন গুরুতরভাবে আহত হয়। বেলা ১টা ১৫ মিনিটে সচিবালয়ের দ্বিতীয় গেটের কাছে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে সােহেল আহমদ নামে একজন আহত হন। বিকেল পাঁচটায় নবাবপুর রেলক্রসিংয়ের কাছে জনতার ওপর পুলিশ আবারও গুলি ছুড়লে আবদুস সাত্তার নামে এক ব্যক্তি আহত হন। সারা দিনে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত এবং ৩০ জন আহত হন, গ্রেপ্তার করা হয় তিন শর বেশি মানুষকে।৩০ হতাহতের প্রতিবাদে পরদিন ৮ ডিসেম্বর প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। পরপর দুদিনের হরতালে জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক মােড় পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে সারা দেশে। | ১৩ ডিসেম্বর প্রদেশব্যাপী আবারও হরতাল পালিত হয়। ওই দিন চট্টগ্রামে এক মিছিলে পুলিশের গুলিতে ১২ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের একজন পরদিন মারা যান। ১৭ ডিসেম্বর সম্মিলিত বিরােধী দলের এক কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি আটটি রাজনৈতিক দল মিলে আট দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ডেমােক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন করে। ডাকের সদস্যরা ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, জামিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পিডিএমপন্থী পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), নেজামে ইসলাম, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও জামায়াতে ইসলামী। ওই দিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবের বাসভবনে আয়ােজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডাকের ঘােষণাপত্র প্রকাশ করা হয়।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে গণ-আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারাে দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে। একাধিক ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে একই কর্মসূচির ভিত্তিতে একসঙ্গে কাজ করার প্রক্রিয়াটি শুরু করা সহজ ছিল না। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে ঐক্য ও সমঝােতা গড়ে তুলতে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক মােহাম্মদ ফরহাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আত্মগােপনে থাকা অবস্থায় তিনি ছাত্র ইউনিয়নকে কৌশলগত পরামর্শ দিতেন এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে একযােগে কাজ করতে উৎসাহিত করতেন। ষাটের দশকজুড়ে তিনি ছাত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল।” | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর ১ জানুয়ারি পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছােড়ার প্রতিবাদে ২ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা আহ্বান করা হয়েছিল। ইকবাল হলের ছাত্র সংসদ কার্যালয়ে ২ জানুয়ারি থেকে পরপর তিন দিন ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও ডাকসু নেতাদের সভা হয়। একপর্যায়ে ওই সভায় জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের (এনএসএফ) কয়েকজন নেতাও যুক্ত হন। প্রতিটি ছাত্রসংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কর্মসূচি তৈরির জন্য আলােচনা শুরু হলে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ছয় দফা শব্দটি উল্লেখ করার ব্যাপারে আপত্তি জানায়। এই পরিস্থিতিতে ছয় দফা উল্লেখ না করে ছয় দফার দাবিগুলাে ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ হিসেবে সংযুক্ত করার প্রস্তাব দিলে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার সম্মতি দেন। পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিলসংক্রান্ত বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ আপত্তি জানালে ‘এক ইউনিট বাতিল শব্দগুলাে বাদ দিয়ে বেলুচ, পাঠান, সিন্ধি ও পাঞ্জাবিদের স্বায়ত্তশাসন দিয়ে একটা সাব-ফেডারেশন করার কথা লেখা হয়। অনেক আলােচনার পর বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে এভাবেই এগারাে দফা কর্মসূচি তৈরি হয়।
এগারাে দফা কর্মসূচি যখন প্রথম প্রকাশ করা হয়, তখন এর সঙ্গে ছয়জন ছাত্রনেতার নাম যুক্ত ছিল। তারা হলেন ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা, ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী এবং ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার ও প্রচার সম্পাদক নুর মােহাম্মদ খান। এগারাে দফার মধ্যে স্পষ্টভাবে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’সহ সব মামলা প্রত্যাহারের দাবিটিকে সংযােজনের জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তাব করে। একই সাথে ডাকসু ও এনএসএফকে অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের বিষয়ে ৮ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) নুর মােহাম্মদ খানের পরিবর্তে সহসম্পাদক দীপা দত্তের নাম অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। ডাকসুর সহসভাপতি তােফায়েল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরীর নাম যােগ করে কর্মসূচিটি ছাপিয়ে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত হয়। ১০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত এক সাধারণ ছাত্রসভায় ছাপানাে এগারাে দফা কর্মসূচি বিতরণ করা হয়। তােফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সমবেত ছাত্রছাত্রীরা হাত তুলে এ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানান। ওই সভায় এনএসএফের সাবেক নেতা মাহবুবুল হক দোলনও বক্তৃতা করেন। ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা থাকায় তিনি আত্মগােপনে ছিলেন। এ জন্য এগারাে দফা কর্মসূচিতে তার স্বাক্ষর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। পরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভাগুলােয় তিনি নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন এবং বক্তৃতা করতেন।৩৪। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কোনাে আহ্বায়ক ছিলেন না।৩৫ সচরাচর চার সংগঠনের পক্ষ থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ক্রমে বক্তৃতা করতেন। ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে তােফায়েল আহমেদ সভায় সভাপতিত্ব করতেন। সভা শেষে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী সভার প্রস্তাব পাঠ করতেন।

সূত্রঃ   আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ