You dont have javascript enabled! Please enable it!
পুনর্জন্ম
রাজনৈতিক দলগুলাে মাঝেমধ্যে এমন কিছু কাজ করে, যার ফল হয় সুদূরপ্রসারী। এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৩ সালে। আইয়ুবি শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য ১৯৬২ সালে যখন এনডিএফ তৈরি করা হয়, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এই প্রক্রিয়ার অংশীদার ছিল। এ সময় ন্যাপের কয়েকজন নেতা একটি উদ্যোগ নেন। লাহােরে পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলী কাসুরীর বাসায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার পীরজাদার সঙ্গে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ ও আহমদুল কবীরের একটা গােপন বৈঠক হয়। এ বৈঠকের সূত্র ধরেই ১৯৬৩ সালের ২ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর দেখা ও কথা হয়। জাতীয় পরিষদে ন্যাপের সদস্য মশিউর রহমান আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়েন। আইয়ুব-ভাসানী সমীকরণ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে বিরােধী দলের রাজনীতির মােড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এ সাক্ষাতের পরপরই ৩০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর (১৯৬৩) ঢাকায় ন্যাপের কার্যকরী কমিটির সভায় মাহমুদ আলী কাসুরী এনডিএফ থেকে বেরিয়ে এসে ন্যাপ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে প্রস্তাব দেন। সেপ্টেম্বরের শেষে সরকারি একটি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে মওলানা ভাসানী পিকিংয়ে (বেইজিং) যান এবং ১ অক্টোবর চীনের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান দেখেন। প্রতিনিধিদলে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন জাতীয় পরিষদের সদস্য মশিউর রহমান ও আখতারউদ্দিন আহম্মদ, ড. জাভেদ ইকবাল, ব্যারিস্টার শওকত আলী খান, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা খাজা মােহাম্মদ কায়সার ও জেনারেল হাবিবুল্লাহ। চীনে মওলানা ভাসানীকে অনেক খাতিরযত্ন করা হয়। তিনি বেইজিংয়ে একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যান। পরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের সঙ্গে ভাসানীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়। ওই সাক্ষাতের সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত 
লক্ষ্যে গণকনভেনশন’ ডাকার জন্য জাতীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানায়। নভেম্বরের মাঝামাঝি ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের এক কর্মিসম্মেলনে। রাজনৈতিক দলগুলাের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে মত দেওয়া হয়। এই সম্মেলনে পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের দাবি জানানাে হয়। আওয়ামী লীগের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা দলের পুনরুজ্জীবন চাননি। ২০। নভেম্বর (১৯৬৩) আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদ ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন : এনডিএফ প্রতিষ্ঠার মূলনীতি ছিল এই যে দেশে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম না হওয়া অবধি রাজনৈতিক দলগুলাে পুনরুজ্জীবিত না করা। আমাদের এ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলাে পুনরুজ্জীবিত না করার ব্যাপারে আমরা জনসাধারণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ রকম এক পরিস্থিতিতে কোনাে অজুহাতে আমাদের সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করার কাজটি দেশের রাজনীতিতে এক। গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করবে। কাজেই এ কাজ সম্ভব নয়। এনডিএফের মতাে অবয়বহীন একটা সংগঠনের প্রতি শেখ মুজিবুর। রহমানের আস্থা ছিল না।
তার চিন্তাভাবনা ছিল সােজাসাপটা। এ বিষয়ে তিনি। ১৭ মার্চ (১৯৬৩) পল্টন ময়দানে এক জনসভায় খােলামেলা বক্তব্য দিয়েছিলেন : ১০ মাস আগে, একই পল্টন ময়দানে নয়জন নেতার বৈঠকের পর আমরা। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আবেদন জানাই। আমরা সেই মতাে প্রস্তাবও গ্রহণ করি, কিন্তু হুজুররা আমাদের কথায় কান দেননি—আমাদের সকল আবেদন ও দাবিদাওয়া উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই শুধু বক্তৃতা ভাষণ শুনে ঘরে ফিরে নাকে। তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে কাজ হবে না। এ জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন লড়াই…। পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে শেখ মুজিবের কোননা। রাখঢাক ছিল না। জাতীয় পরিষদের ফরিদপুরের একটি নির্বাচনী এলাকায়। উপনির্বাচনের কাজে সফর করে ১৯৬৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে তিনি। এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন : পরিস্থিতির চাপে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করে যে তারা এখন এক উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। এই উপনিবেশের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হলে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হবে। সরকারযন্ত্রের পাঁচ স্তম্ভ : আমলাতন্ত্র, ফেডারেল রাজধানীর অবস্থান, পুঁজি গঠন, সশস্ত্র বাহিনী ও রাজনৈতিক সমতার। কোনােটিতেই পূর্ব পাকিস্তানের অংশীদারি নেই। সমতা বলতে কেবল জাতীয় পরিষদের আসনসংখ্যায় সমান প্রতিনিধিত্বকেই বােঝায় না, বরং জাতি ও রাষ্ট্রের সব বিষয়ে সমতাকে বুঝিয়ে থাকে।
১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের একটি হােটেলে সােহরাওয়ার্দী মারা যান। দুদিন পর তার মৃতদেহ ঢাকায় এনে ফজলুল হকের কবরের পাশে দাফন করা হয়। যত দিন বেঁচে ছিলেন, দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কে অনেক টানাপােড়েন ছিল। মৃত্যুর পর তাঁরা প্রতিবেশী হলেন। সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগে পুনরুজ্জীবনবাদীদের প্রধান বাধাটি সরে গেল। ডিসেম্বরে (১৯৬৩) কাশ্মীরে হজরতবাল মসজিদে রাখা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র কেশ চুরি যাওয়াকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধে। তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে ঢাকায়। আতাউর রহমান খান এই দাঙ্গাকে একতরফা হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন : এটা দাঙ্গা নয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাে বলাই চলে না। একতরফা ব্যাপার। এক সম্প্রদায়ের দুর্বল লােকের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে।…এতে না আছে শৌর্যবীর্য, না আছে পৌরুষ। আছে ঘৃণা কাপুরুষতা-লুটতরাজ করার প্রবৃত্তি। এক সম্প্রদায়ের লােক ধরে এনে হত্যা করা। বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া। কোনাে প্রতিবাদ নেই, প্রতিরােধ করার ক্ষমতা নেই। এমনকি করুণা ভিক্ষারও অবকাশ নেই। বাজার থেকে মাছ কিনে এনে তাকে আঁশ বঁটিতে ফেলে টুকরা করার মতাে। এক থানায় এক মৌলভি রীতিমতাে অজু করে ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর’ বলে সারি দিয়ে শােয়াননা কয়েকজন মানুষকে কোরবানি দেয়। | একে কি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা চলে? হিংস্র পশুও এমন নির্মম ব্যবহার করতে পারে না। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটি দলকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এ সভায় উপস্থিত ছিলেন।
৯ জানুয়ারি (১৯৬৪) একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ডাকেন। সভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগদলীয় সদস্যদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়। ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি শেখ মুজিবের বাসায় সভা হয়। সভার ব্যাপারে কোনাে আগাম পরামর্শ করার অজুহাতে আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদ সভায় যােগ দেননি। ২৬ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী ছয় সপ্তাহের মধ্যে দলের কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হবে। অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং ড. আলীম আল রাজী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বেগম রােকেয়া আনােয়ার, আবদুর রহমান খান ও তাজউদ্দীন আহমদকে সদস্য করে দলের ম্যানিফেস্টো লেখার জন্য একটি উপকমিটি তৈরি করা হয়। সভায় স্থানীয় কমিটিগুলােকে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করতে বলা হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবগুলাে ছিল : ক) গণতান্ত্রিক সংসদীয় সংবিধান; খ) সর্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার; গ) প্রত্যক্ষ নির্বাচন; । ঘ) পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসন; ঙ) পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যকার দূরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বি অর্থনীতিব্যবস্থা গ্রহণ; চ) পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করা; ছ) চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন; জ) এবডাে, রাজনৈতিক দলবিধি ও নিরাপত্তা আইন বাতিল; ঝ) রাজবন্দীদের মুক্তি ও হুলিয়া প্রত্যাহার; ঞ) পাটের ন্যূনতম বাজারদর নির্ধারণ; ট) মূল্যস্ফীতি রােধ; ঠ) জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও কর্মীদের মুক্তি। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকার গ্রিন রােডে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সাবেক আইনমন্ত্রী বিচারপতি মােহাম্মদ ইব্রাহিমের আমবাগানে এক সমাবেশে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদ দলের পুনরুজ্জীবনের বিপক্ষে থেকে যান। এ সময় ন্যাপ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীও পুনরুজ্জীবিত হয়। কৃষক-শ্রমিক পার্টি পুনরুজ্জীবিত হলাে না। এর নেতা-কর্মীরা এনডিএফের নামে সাংগঠনিক কাজকর্ম চালু রাখেন। 
মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়েছিলেন। শেখ মুজিব মানিক মিয়াকে সভাপতি হিসেবে চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন, ‘সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর একবার আমি নিজে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার জন্য অনুরােধ জানিয়েছিলাম। মানিক ভাই হেসে বলেছিলেন, “সংগঠন আপনাদের, কলম আমার।” প্রত্যাখ্যানের কী অপূর্ব সুন্দর পদ্ধতি!’১২  শেখ মুজিব বিচারপতি মােহাম্মদ ইব্রাহিমকেও আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিতে অনুরােধ করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের ২৮ জানুয়ারি বিচারপতি ইব্রাহিম তার ডায়েরিতে লেখেন, ‘শেখ মুজিব আমাকে আওয়ামী লীগে যােগ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে বলেছেন। তিনি তাৎক্ষণিক জবাব চাননি, তবে বিষয়টা ভেবে দেখতে বলেছেন এবং আবার আমার সঙ্গে যােগাযােগ করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি ইত্তেফাক-এর সম্পাদক মানিক মিয়াকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন।’ ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে শেখ মুজিব আবারও যােগাযােগ করে আওয়ামী লীগে যােগ দিতে চাপ দেন। বিচারপতি ইব্রাহিম দুসপ্তাহের সময় নেন।১৩
সম্মেলন উদ্বোধন করেন। মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে। অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বিচারপতি ইব্রাহিম উপস্থিত ছিলেন। মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যােগ। দেন এবং সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। সম্মেলনে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে কার্যনির্বাহী কমিটির পুনর্বিন্যাস করা হয়।১৪ সম্মেলনে ৯৪৪ জন কাউন্সিলর ও ডেলিগেট যােগ দিয়েছিলেন।১৫ এনডিএফের খােলস ছেড়ে আওয়ামী লীগের নবযাত্রা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শেখ মুজিব। দলের তরুণেরা তার পক্ষে ছিলেন। প্রবীণ নেতাদের অনেকেই ছিলেন সনাতন ধারার সােহরাওয়ার্দীপন্থী। যেহেতু সােহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের বিরােধী ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুর পরও কেউ কেউ এনডিএফ ছেড়ে আসতে চাননি। শেখ মুজিবকে তাঁরা মনে করতেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ক্ষমতালােভী’।
১৯৬৪ সালের মার্চে ঢাকায় এনডিএফের প্রাদেশিক সম্মেলনে আবুল মনসুর আহমদ এক লিখিত ভাষণে বলেছিলেন পার্টি যারা রিভাইভ করিয়াছেন, তারা দেখাইয়াছেন তাহাদের কাছে দেশের চেয়ে পার্টি বড়।…মার্শাল ল উঠামাত্র পার্টি করিবার প্রথম সুযােগেই আমরা নেতৃত্ব লইয়া কামড়াকামড়ি শুরু করিয়াছি। গাছে কাঁঠাল ধরিবার অনেক আগেই আমরা শুধু গোঁফে তেল দিতে নয়, একে অন্যের গোঁফ ধরিয়া টানাটানি শুরু করিয়াছি। মন্ত্রিত্ব ও নেতৃত্বের লােভে যারা একদিন শেরেবাংলার নেতৃত্বে গঠিত জনগণের যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক বিজয়কে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিল, তাহারাই আজ তেমনি নেতৃত্বের লােভেই সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সংগঠিত এনডিএফকে ভেঙ্গে চুরমার করিয়া দিতেছে। একদিকে আইয়ুব খানের ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’, অন্যদিকে সিনিয়র নেতাদের রাজনীতিতে সক্রিয় না হওয়া, এর মধ্যেই শেখ মুজিব ছাত্রলীগকে সম্বল করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ছাত্রদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছিল। এ সময় ছাত্রদের একটা স্লোগান নিয়মিতই শােনা যেত ‘আইয়ুবশাহি ধ্বংস হােক। | জাতীয় পরিষদের শূন্য আসনে উপনির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল। ছাত্রসংগঠনগুলাের পক্ষ থেকে এ সময় কাজী জাফর আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন), সিরাজুল আলম খান (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ), রেজাউল হক সরকার (পাকিস্তান ছাত্রশক্তি) ও আবদুল হালিম (জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন) উপনির্বাচন উপলক্ষে একটা যৌথ বিবৃতিতে গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট প্রার্থীদের ভােট দেওয়ার এবং ছদ্ম সরকারি প্রার্থীদের বিরােধিতা করার জন্য বিডি মেম্বারদের প্রতি আহ্বান জানান।১৭
গভর্নর আবদুল মােনায়েম খান ছিলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের খুবই  অনুগত ও আস্থাভাজন। তিনি ছাত্রদের তােপের মুখে পড়েন। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে। গভর্নরের এডিসি মেজর এস ডি জিলানীর বর্ণনা থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলাে : স্থান কার্জন হল, সময় সকাল ১০টা।…প্রধান গেটের সামনে কিছু ছাত্রের বিরূপ স্লোগানের ধ্বনি শােনা গেল। আমরা তাদের পাশ কাটিয়ে হলের পাশের কামরায় প্রবেশ করলাম। গভর্নর সেখানে কনভােকেশনের রেওয়াজ অনুযায়ী পােশাকাদি গাউন, টুপি ইত্যাদি পরে নিলেন। ছাত্রদের গতিবিধি, বিরূপ স্লোগান, ইত্যাদি দেখে-শুনে আমরা প্রমাদ গুনলাম। ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম ও গনির চেহারা মলিন হয়ে উঠল। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি এম এ হক এগিয়ে এসে গভর্নরকে প্যান্ডেলে যেতে নিষেধ করলেন এবং অনুষ্ঠান বাতিল করার জন্য পরামর্শ দিলেন। শুনে গভর্নর মােনায়েম খান দারুণ গােস্যা ও উন্মা প্রকাশ করলেন। ডিআইজিকে বললেন, ‘আপনারা ঠিকমতাে দায়িত্ব পালন করছেন না।’
এই বলে তিনি, ভাইস চ্যান্সেলর, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের সমভিব্যাহারে প্যান্ডেলের দিকে রওনা হলেন। আমি এবং গভর্নরের মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল এম আই করিম তার পেছনে পেছনে চললাম। প্যান্ডেলে প্রবেশ করতেই বুঝতে পারলাম অবস্থা বেগতিক।…ছাত্ররা স্লোগান দিতে লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ভাঙচুর শুরু করে দিল । .চ্যান্সেলর মােনায়েম খান দাড়িয়ে তার লিখিত ভাষণ পড়তে শুরু করলেন। উত্তেজিত ছাত্ররা বাইরের দিক থেকে প্রধান দরজা দিয়ে প্যান্ডেলে ঢােকার জন্য হুড়-হাঙ্গামা শুরু করল। সশস্ত্র পুলিশ…একপর্যায়ে তারা লাঠিচার্জ করল এবং শেষ পর্যন্ত টিয়ার গ্যাস ছুড়তে বাধ্য হলাে।…ড. এম ও গনি আমাকে ডেকে বললেন আমি যেন গভর্নরকে তার ভাষণ সংক্ষেপ করতে বলি।
আমি গভর্নরের কানের কাছে গিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের কথাটি বলতেই তিনি আমাকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন এবং ভাষণের শেষ শব্দটি পর্যন্ত পড়ে তারপর বসলেন।… এ সময় আমাদের প্রধান কর্তব্য সাব্যস্ত হলাে গভর্নরকে প্যান্ডেল থেকে নিরাপদে বের করে গভর্নর হাউসে পৌছে দেওয়া।…গভর্নর হাউসে পৌছেই মােনায়েম খান গােলযােগ সৃষ্টিকারী ছাত্রদের শাস্তি বিধানের জন্য কঠোর আদেশ জারি করলেন। সুতরাং, সেই রাতেই আন্দোলনের ঘাটি ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ঘেরাও করা হলাে। সমাবর্তনে গােলযােগ সৃষ্টি করার অপরাধে অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ ফজলুল হক মণি ও আসমত আলী শিকদারের এমএ ডিগ্রি বাতিল করে দেয়। ছাত্রলীগের সভাপতি কে এম ওবায়দুর রহমান, ডাকসুর সহসভাপতি রাশেদ খান মেনন, এ কে।
বদরুল হক ও সওগাতুল আলমকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। হায়াত হােসেন, আনােয়ারুল হক চৌধুরী, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আনােয়ার আলী হায়দার খান ও শহীদুল হক তিন বছরের জন্য বহিষ্কৃত হন। গিয়াসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মনসুরউদ্দিন আহমদ, জাকি আহমদ, আবদুল করিম, সৈয়দ মতিউর রহমান, আবদুর রাজ্জাক মিয়া, সিরাজুল আলম খান, কাজী মােজাম্মেল ইসলাম, আতিকুর রহমান, হুমায়ুন কবীর, কামালউদ্দিন শিকদার ও ফেরদৌস আহমদ কোরেশীকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ২০ জন ছাত্রকে নিজ নিজ অভিভাবকের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সদাচরণের অঙ্গীকারনামাসহ চিঠি নিয়ে আসতে বলা হয়।১৯ জাকি আহমদ ও আহমদ ফারুকের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কর্তৃপক্ষের ছাত্র বহিষ্কারের আদেশ বাতিল করে দিয়েছিলেন।২০ অভিযুক্ত ছাত্রদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এস আর পাল। ১৯৬৪ সালের ৫ জুন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক জরুরি সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এগারাে দফা দাবি উপস্থাপন করেন। অনেক আলােচনার পর প্রস্তাবগুলাে গৃহীত হয়। প্রস্তাবগুলাের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের একটি ফর্মুলা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছিল। প্রস্তাবগুলাে সংক্ষেপে ছিল : ১) ফেডারেশন অব পাকিস্তান’ নামে সত্যিকার অর্থে ফেডারেল পদ্ধতি প্রণয়ন। ২) প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গণতন্ত্র কায়েম ও যুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সামরিক বাহিনীসহ সকল সরকারি উচ্চপদে মেধা অনুসারে বাঙালিদের নিয়ােগ। ৪) পাকিস্তানের উভয় অংশে বৃহৎ শিল্পকারখানা জাতীয়করণ ।
৫) মােহাজেরদের জন্য সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রণয়ন । ৬) ফেডারেশনে বিভিন্ন জাতিভিত্তিক কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ সাধনে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি প্রণয়ন। ৭) পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কায়েমের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জন্য | পৃথক মুদ্রার ব্যবস্থাসহ পৃথক অর্থনীতি প্রণয়ন। ৮) পাকিস্তানের সকল প্রদেশের জন্য পৃথক বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন। ৯) বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব-নিকাশ ও আয়-ব্যয়ের পূর্ণ অধিকার প্রদেশের হাতে ন্যস্তকরণ । ১০) পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠাসহ দেশরক্ষার উদ্দেশ্যে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন। ১১) ছাত্রদের দাবিদাওয়াসহ শ্রমিক-কৃষকদের ন্যায্য দাবিসমূহ পূরণ ।২২
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এগারাে দফা দাবিনামাসহ খসড়া ম্যানিফেস্টো  প্রকাশ করে। এই ম্যানিফেষ্টোই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের সব কর্মসূচি ও আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। শেখ মুজিব ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতীক। লক্ষ্যের প্রতি আস্থা, একাগ্রতা, একরােখা মনােভাব, সাহস এবং মেরেকেটে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছিল। তাঁর সাহসের বর্ণনা দিতে গিয়ে অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের (এপিপি) চিফ রিপাের্টার আমানউল্লাহ একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন : শেখ মুজিবের মধ্যে একটা ডেয়ার ডেভিল ভাব ছিল, যা অন্য কোনাে রাজনীতিবিদের মধ্যে ছিল না। একবার মুসলিম লীগের রাগিব আহসান একদল গুন্ডা নিয়ে পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের মিটিংয়ে হামলা করে। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। উপস্থিত সবাই যে যেদিকে পারে ছুটে পালায়। ওই সময় কারােরই থাকার কথা নয়। একটা ঢিল এসে আমার কবজিতে লাগল, একটু আঘাতও পেলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, ডায়াসের ওপর শুধু একজন দাঁড়িয়ে আছে, শেখ মুজিব। হি ওয়াজ কারেজিয়াস।২৩ ১৯৬৪ সালের ২১-২২ জুলাই ঢাকায় কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিনের বাড়িতে বিরােধী দলের নেতাদের একটা সভা হয়। সভায় আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রতিনিধিরা যােগ দেন। সভায় পাঁচ দলের সমন্বয়ে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি (কপ) তৈরি হয়। কপের পক্ষ থেকে নয় দফা | কর্মসূচির ভিত্তিতে সকল স্তরে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হয়, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কপের পক্ষ থেকে একজন প্রার্থী মনােনয়ন দেওয়া হবে। নয় দফার আট নম্বর দফায় ইসলামী মূলনীতির কথা বলা হয় । এই দফায় ছিল : কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ অনুযায়ী সত্যিকার ইসলামি সমাজব্যবস্থা ও শরিয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান। এই পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক আইন সংশােধন।
আইয়ুব খান ‘পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১’ জারি করেছিলেন এটা ছিল একটা যুগান্তকারী সংস্কারমূলক আইন, সমাজে যার প্রভাব ছিল ইতিবাচক। এই আইনের ফলে বহুবিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকারের প্রচলিত শরিয়াভিত্তিক আইনে মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ ছিল এই আইনের পক্ষে। নতুন আইনকে তারা আধুনিক, প্রগতিশীল ও মানবিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী ছিল এই আইনের বিরুদ্ধে তাদের মতে, এটা ইসলামবিরােধী। রাজনৈতিক ঐক্যের স্বার্থে
আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ জামায়াতের দাবি ‘বিষ গেলার মতাে স্বীকার করে নেয় ।২৪  সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করল। নির্বাচনী সূচি অনুযায়ী অক্টোবর নভেম্বরে (১৯৬৪) হবে ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন, ২ জানুয়ারি (১৯৬৫) | প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, মার্চে জাতীয় এবং এপ্রিলে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী বা বিডি মেম্বারকে  নিয়ে প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের জন্য গঠন করা হলাে ‘ইলেক্টোরাল কলেজ। ঢাকায় এক সভায় সিদ্ধান্ত হলাে, কপ ও এনডিএফ একসঙ্গে বিরােধী দল হিসেবে নির্বাচনে লড়বে।  আইয়ুব খানের ধারণা ছিল, বিরােধী দলগুলাে নির্বাচনে ঐকমত্যের প্রার্থী  দিতে পারবে না। প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে অবশ্য একটু নাটক হয়েছিল। শেষমেশ কপের প্রার্থী ঠিক করা হলাে ফাতেমা জিন্নাহকে এই মনােনয়নের প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব কুদরতউল্লাহ শাহাবের বর্ণনায় বিরােধী দলের পক্ষে প্রথম কাজ ছিল আইয়ুব খানের সমকক্ষ একজন প্রার্থী মনােনীত করা । দুটি নাম বিবেচনায় এল। একটি কায়েদে আজমের বােন মিস ফাতেমা জিন্নাহ এবং দ্বিতীয়টি পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আজম খান। আজম খান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সমান জনপ্রিয় ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
জুলফিকার আলী ভুট্টো এ ব্যাপারে দারুণ এক চাল চাললেন।  ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা জনাব মশিউর রহমানের (যাদু মিয়া) সঙ্গে ভুট্টোর ছিল গভীর সম্পর্ক। মওলানা ভাসানীর ‘ডান হাত’ বলে কথিত মশিউর রহমান ছিলেন তাঁর (ভুট্টোর) পানাহারের সঙ্গী। জাতীয় পর্যায়ে তেমন খ্যাতির অধিকারী না হলেও রাজনীতির বাজারে বেচাকেনা কিংবা দর-কষাকষির কৌশল তিনি জানতেন। শােনা যায়, ভুট্টো তাঁকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলেন। মশিউর রহমানের চাপে মওলানা ভাসানী সম্মিলিত বিরােধী দলের ওপর এই শর্ত আরােপ করলেন যে এমন কোনাে ব্যক্তিকে বিরােধী দলের পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মনােনীত করা যাবে , যিনি কোনাে না কোনােভাবে সামরিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। আজম খান একসময় সামরিক সরকারের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন। কাজেই মওলানা ভাসানীর শর্তের কারণে তাঁর নাম আপনাআপনি খারিজ হয়ে গেল।  মশিউর রহমান ভুট্টোর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন। সম্মিলিত বিরােধী দল আইনবিশারদদের পরামর্শক্রমে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থিতার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার গােপন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। কেননা, বেতনভুক্ত ফিল্ড মার্শাল হিসেবে তিনি আইনত কোনাে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। মশিউর রহমান আগেভাগে ভুট্টোর কাছে ওই তথ্য ফাঁস করে দিলেন। আইয়ুব খান বিরােধী দলের মামলা করার আগেই ফিল্ড মার্শাল নিযুক্তির আইনগত দিক পেছনের তারিখ থেকে কার্যকারিতা দিয়ে সংশােধন করিয়ে নিলেন।
ব্যক্তিস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। প্রথমে একজন বিখ্যাত পীর ঘােষণা করলেন, তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি বলে জানতে পেরেছেন যে আল্লাহ তাআলা সম্মিলিত বিরােধী দলের ওপর সন্তুষ্ট নন। এরপর কয়েকজন আলেম ফতােয়া দিলেন, ইসলাম নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সমর্থন করে না।২৫ জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গােলাম আযমের বিবরণ থেকে জানা যায়, ফাতেমা জিন্নাহর নাম প্রস্তাব করেছিলেন মওলানা ভাসানী। জামায়াত ছাড়া সব দল এই প্রস্তাব সমর্থন করে। জামায়াত বৈঠক মুলতবির অনুরােধ জানিয়ে বলে, একজন মহিলাকে প্রার্থী করার ব্যাপারে শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মতামত নেওয়ার জন্য এক দিন সময় দরকার। কপের একটি প্রতিনিধিদল ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে তার সম্মতি চান। ফাতেমা শর্ত দেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এক বছরের মাথায় আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। দেশকে স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি এক বছর দায়িত্ব পালনে রাজি আছেন। জামায়াতের নেতারা পাকিস্তানের শীর্ষ আলেম মওলানা মুহাম্মদ শফির সঙ্গে দেখা করলে তিনি ব্যাখ্যা দেন, গণতন্ত্রে ফিরে আসার পথে একটা মধ্যবর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিলে দেশে নারী নেতৃত্ব কায়েম হয়েছে, এটা বলা যাবে না। সুতরাং ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেওয়া যেতে পারে। জামায়াতের আমির মওলানা মওদুদী তখন কারাগারে। তার মতামত নেওয়া হলাে। মওদুদীর মন্তব্য ছিল, ‘পুরুষ হওয়া ছাড়া আইয়ুব খানের আর কোনাে গুণ নেই। আর মহিলা হওয়া ছাড়া ফাতেমা জিন্নাহর আর | কোনাে দোষ নেই।২৬  ভােটারদের ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে ভােট চাওয়ার ব্যাপারে বিরােধী  দলও পিছপা হয়নি। আজম খান ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারে নামলেন। তার বক্তৃতায় ইসলামি জোশের কমতি ছিল না।
বিভিন্ন সভায় আজম খান বক্তব্য। দিতে দাড়িয়েছেন। উর্দুতে বলছেন : ভাইসব, আল্লাহ হুকুম করলেন, আয় ফাতেমা খাড়া হাে যাও। তিনি দাঁড়ালেন। আবার আল্লাহ হুকুম করলেন। আয় পাঁচ পাটি, ইনকো তায়িদ করাে—অর্থাৎ সমর্থন দাও। পাচ পার্টিও নেমে গেল সমর্থন দিতে। এখন আপনাদেরও ফরজ মিস ফাতেমাকে সমর্থন করা। সভাস্থ সকলে হাত তুলে সমর্থনের ওয়াদা করল। আজম খানও হাত তুলে বললেন, সােবহান আল্লাহ, ইয়ে ইনসান। নেহি—ফেরেশতা হ্যায়। বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তাআলা যেমন রাসুলুল্লাহর মদদের জন্য ফেরেশতা নাজেল করেছিলেন, এখনাে এই যুদ্ধে তিনি লাখ লাখ ফেরেশতা পাঠিয়েছেন।২৭  নির্বাচনী প্রচারে আইয়ুব খানের কঠোর সমালােচনার জন্য ৭ নভেম্বর (১৯৬৪) শেখ মুজিবকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান। নির্বাচন নিয়ে ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে আলােচনার জন্য তিনি ২২ নভেম্বর করাচি যান। ঢাকায় ফিরে আসার পর ৩ ডিসেম্বর জননিরাপত্তা আইনে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। পরে অবশ্য তিনি জামিনে ছাড়া পান।
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আইয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহ ছাড়াও দুজন অখ্যাত প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনে আইয়ুব খান জয়ী হন। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রধান সংবাদ শিরােনাম ছিল দশ কোটি মানুষের পরাজয়’।২৮ | আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে ৫৩.১২ শতাংশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৬৩.৩১ শতাংশ ভােট পান। ফাতেমা জিন্নাহ পান পূর্ব পাকিস্তানে ৪৬.৫০ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ২৬.০৭ শতাংশ ভােট। অন্য দুজন প্রার্থী কে এম কামাল ও মিয়া বশির আহমদ পান ১ শতাংশেরও কম ভােট। মােট ৭৮ হাজার ৮৯০ জন বিডি মেম্বার ভােট দেন। ৮১০টি ভোেট বাতিল হয়েছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও করাচি বিভাগে ফাতেমা জিন্নাহ আইয়ুব খানের চেয়ে বেশি ভােট পেয়েছিলেন।৩০ কপের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এই নির্বাচনে ন্যাপের মধ্যকার চীনপন্থী কমিউনিস্টরা ফাতেমা জিন্নাহকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়নি। | যদি সরাসরি ভােটে নির্বাচন হতাে, তাহলে ফাতেমা জিন্নাহ অনায়াসে জিততেন বলেই বাঙালিদের ধারণা। ফলে নির্বাচনব্যবস্থার ওপর বাঙালিরা একেবারেই আস্থা হারিয়ে ফেলে।৩২

সূত্রঃ   আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!