ত্রিপুরা মিশন
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি অনেক বাঙালিই মেনে নেননি। কথাটি মুখ ফুটে বলার মতাে পরিস্থিতি ছিল না। পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার জন্য শেখ মুজিব যে কত বেপরােয়া ছিলেন, তার একটা বিবরণ পাওয়া যায় ছাত্রলীগের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ডাকাবুকো নেতা শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনের কাছ থেকে। প্রসঙ্গ একটি প্রচারপত্র। শাহ্ মােয়াজ্জেমের ভাষ্য উদ্ধৃত করা হলাে : উনি (মুজিব) নিজে লিফলেট ড্রাফট করছেন। পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট’ নাম দিয়া সাইকেলে প্যাডেল কইরা প্রেসে গিয়া নিজেই ছাপছেন। আমাকে একটা সাইকেল প্রেজেন্ট করছিলেন। উনি আমাকে ডাকলেন। আমি ওই সাইকেল চালিয়েই গেলাম। উনি বললেন, “তাের বিশ্বস্ত লােক নিয়া এগুলি ডিস্ট্রিবিউট করবি।’ তখন মার্শাল ল, ধরা পড়লে। আমি নিজে, ওবায়েদকে নিলাম, সিরাজকে নিলাম, মণিকে নিলাম, আর ফরিদপুরের আনিস, ছাত্রলীগ করত পাঁচজনকে নিয়া টিম করলাম। রাত বারােটার পর আমরা বেরােতাম। ধরা পড়লে স্ট্রেট ফাঁসি। কিন্তু নেতার নির্দেশে আমরা এটা করছি। চাদর গায়ে দিয়া সাইকেল নিয়া বিভিন্ন অ্যাম্বেসির গেটের সামনে ফালায়া দিয়া সাইকেল চালায়া চইলা আসতাম। দিস উই ডিড। এবং উনারই নির্দেশে।
এখন অনেকেই স্বাধীনতার কথা নানাভাবে মনের মাধুরী মিশাইয়া বলে। বাট দিস ইজ দ্য ফ্যাক্ট। বাংলাদেশ পন্থী কেউ ছিল না, আমরাই ছিলাম। শেখ সাহেবের অনুসারীরাই ছিলাম। আমাদের বলত ওরা (কমিউনিস্টরা) ইললিটারেট গ্র্যাজুয়েটের শিষ্য। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কয়েকটি গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভাগুলােয় আওয়ামী লীগের পক্ষে শেখ মুজিব ও মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে মণি সিংহ ও খােকা রায় উপস্থিত ছিলেন। প্রথম বৈঠকেই তারা আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার ব্যাপারে একমত হন। এসব বৈঠক সম্পর্কে খােকা রায় বলেছেন :
…শেখ মুজিবুর রহমান বারবার বলেছিলেন যে পাঞ্জাবের ‘বিগ বিজনেস’ যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল, তাতে ‘ওদের সাথে আমাদের থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; আন্দোলনের প্রােগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে’, ইত্যাদি। তখন আমরা (আমি ও মণিদা) শেখ মুজিবকে বুঝিয়েছিলাম যে কমিউনিস্ট পার্টি নীতিগতভাবে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করে, কিন্তু সে দাবি নিয়ে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পরিস্থিতি তখনাে ছিল না। ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি নিয়ে ওই সব আলােচনায় পরের বৈঠকে শেখ মুজিব আমাদের বলেছিলেন, ‘ভাই, এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের নেতাও (অর্থাৎ সােহরাওয়ার্দী সাহেব) আপনাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। তাই এখনকার মতাে সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কথাটা থাকল।
‘স্বাধীন পূর্ববঙ্গ’ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে আলােচনা ছিল। ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে গৃহীত ‘কেন্দ্রীয় কমিটির রিপাের্ট ও প্রস্তাবাবলি’তে বিষয়টির উল্লেখ আছে। স্বাধীন পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির মনােভাব কেন্দ্রীয় কমিটির রিপাের্ট থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলাে : ১৯৫৯-৬১ সালে স্বায়ত্তশাসন দাবির অঙ্গ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে গণ্য করা এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলাইয়া একটি কনফেডারেশনের’ দাবি উত্থাপিত হইয়াছিল। এমনকি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি চিন্তাও ১৯৫৯ সাল হইতে এখানকার বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত মহলে দেখা যাইতেছিল।… এই অবস্থায়, স্বাধীন পূর্ববঙ্গ দাবি সম্পর্কে পার্টির আশু করণীয় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামাে ভবিষ্যতে কী রূপ গ্রহণ করিতে পারে তাহা বিচার করিয়া পার্টির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে আলােচনার জন্য ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠক হইয়াছিল। ওই বৈঠকের ‘স্বাধীন পূর্ববঙ্গ দাবি সম্পর্কে আশু করণীয় বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি একটি রাজনৈতিক চিঠি (১৪ জুলাই ১৯৬২) পার্টির ভিতর প্রচার করিয়াছিল। সে রাজনৈতিক চিঠিতে ধর্মীয় ভিত্তিতে গঠিত বহুজাতিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের জাতি সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠা ‘আমাদের মূল লক্ষ্য এবং সে। পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ‘এক ইউনিট বিলােপ ও ওখানকার বিভিন্ন জাতির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আমাদের বর্তমান দাবি’ প্রভৃতি ব্যাখ্যা করিয়া স্বাধীন পূর্ববঙ্গ দাবি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, এই দাবির মধ্যে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নটি নিহিত রহিয়াছে এবং ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র গড়িয়া উঠা আমরা অস্বাভাবিক বা অসম্ভব বলিয়া মনে করি না।
কিন্তু, বর্তমানে যেভাবে “স্বাধীন পূর্ব বাংলার দাবি উঠিতেছে তাহা রাজনৈতিক দিক হইতে যুক্তিসংগত ও সমর্থনযােগ্য নয়। তাহা ছাড়া, বর্তমানে এইরূপ দাবি উত্থাপন করা আমরা অপরিপক্ক ও অসময়ােচিত মনে করি।… পূর্ব বাংলার জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের প্রধান শক্তি হইবে এখানকার শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষরা।’ কিন্তু এই ব্যাপক জনসাধারণ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কথা চিন্তা করেন না। এই পরিস্থিতিতে “স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি একটি হঠকারী দাবি।’ তাই, ‘বর্তমানে আমরা পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করিব।’ কিন্তু, যাহারা “স্বাধীন পূর্ব বাংলা” দাবি উত্থাপন করিবেন আমরা তাহাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকিব। আমাদের খেয়াল রাখিতে হইবে যে এই দাবির মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ রহিয়াছে, যদিও বর্তমান অবস্থায় এই দাবি হঠকারী, আমরা এই কথা তাহাদের বুঝাইতে চেষ্টা করিব। পাকিস্তানের বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামাে স্থায়ী হওয়ার কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। এই রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা যত বৃদ্ধি পাইবে এবং জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলন যত। জোরদার হইবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শগত ভিত্তিও তত দুর্বল হইয়া পড়িবে । এই অবস্থায়, বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতি বিশেষত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মতাে দুটি পৃথক অঞ্চল নিয়া একটি মাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি থাকিবে বলিয়া মনে হয় । সুতরাং, ভবিষ্যতে পাকিস্তান রাষ্ট্র একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হইয়া পড়িতে পারে (জেলা ইউনিটগুলির নিকট প্রেরিত কেন্দ্রীয় কমিটির দলিল, ২৮ আগস্ট ১৯৬২)।’
শেখ মুজিব তখনকার মতাে চুপচাপ থাকাই ভালাে মনে করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা তার মাথায় থেকে গেল। এ নিয়ে দলের মধ্যে কথাবার্তা বলার মতাে অনুকূল পরিবেশ ছিল না। সম্ভবত দলে তিনি আস্থাভাজন এমন কাউকে পাননি, যার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে মন খুলে কথা বলা যায়। এবার তিনি অন্য রকম একটা উদ্যোগ নিলেন। এটাকে উদ্যোগ না বলে অভিযান’ বলাই ভালাে। প্রথাগত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে গিয়ে এ ধরনের একটি পরিকল্পনা এর আগে এ দেশে আর হয়নি। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল শেখ মুজিবের। এ জন্য তিনি ভারতের সাহায্য নেওয়া প্রয়ােজন মনে করেছিলেন। ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করার জন্য তিনি গােপনে আগরতলায় গিয়েছিলেন। তার এ গােপন মিশন এতই রােমাঞ্চকর ছিল যে তা যেকোনাে গােয়েন্দা কাহিনিকেও হার মানায়। এ গােপন মিশন সম্পর্কে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা রেজা আলীর বক্তব্য শােনা যাক : মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ বা ২ তারিখের দিকে উনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন, “তুই আমার সঙ্গে একখানে যাবি। যত দূর মনে পড়ে, ৩ তারিখেই রওনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোথায় যাব, আমাকে এ ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই বলা হয়নি।
যাওয়ার আগের মুহূর্তে আমাকে তিনি বলেছিলেন একটা ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট ঠিক করতে। তখনকার দিনে কুপে হতাে। দুজন থাকতে পারত। নারায়ণগঞ্জ থেকে দুজন কুপেতে উঠবে। এই অ্যাডভেঞ্চারমূলক কাজে তখন আমি মর্তুজাকেও জড়িয়েছিলাম। আমি গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাই টঙ্গী স্টেশনে। গাড়ি চালিয়েছিল অন্য দুজন। স্টেশনের পেছন দিকে তখন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে আমরা দাড়িয়ে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা দুজন নেমে গিয়েছিল। আমি আর মুজিব ভাই ট্রেনে উঠে পড়ি। আমার দায়িত্ব ছিল মুজিব ভাইকে নিয়ে সিলেটের ট্রেনে উঠে যাওয়া। উনি তখনাে বলেননি কোথায় নামবেন। সারা রাত আমরা ট্রেনে বসে ছিলাম। রাত তিন-চারটার দিকে গাড়ি যখন শ্রীমঙ্গলে এসে থামল, তখন তিনি বললেন, “তুই দরজাটা খুলে একটু দাড়া।’ দরজা খুলেই দেখি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন মােয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী । উনি ওখানে থাকবেন, সেটা আমি জানতাম না। তিনি সম্পর্কে আমার মামা হন, তাে তার হাওলায় মুজিব ভাইকে দিয়ে আমি সিলেটে চলে গেলাম। তখন আমার সন্দেহ হয়েছিল, কেন ওখানে যাচ্ছিলেন উনি। আমাকে যেহেতু কিছু বলেননি, সে জন্য আমি জিজ্ঞেসও করিনি কখনাে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে এটা তার ইন্ডিয়ায় যাওয়ার একটা উদ্যোগের অংশ। শুধু ফরহাদ ভাইকে বিশ্বাস করে বলেছিলাম যে মুজিব ভাই তাকে একটা জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। শেখ মুজিবের এই রেল ভ্রমণের কোনাে রেকর্ড রেলওয়ে বিভাগের কাছে ছিল । ছাত্র ইউনিয়নের নেতা গােলাম মর্তুজা ও তার সঙ্গীর নামে কেনা টিকিটে তিনি এবং রেজা আলী রেলে চড়েছিলেন। গােপনীয়তার ব্যাপারটিতে কোনাে ফাক ছিল না। উল্লেখ্য, মােয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী কনভেনশন মুসলিম লীগ করতেন।
তিনি ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ঘটনা থেকে বােঝা যায়, শেখ মুজিবের একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক ছিল। এর সঙ্গে দলের কোনাে সম্পর্ক ছিল না। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও গােপনীয়তার অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল এই নেটওয়ার্ক। ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি শেখ মুজিবের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে দেশে আর। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাঁর মনে হলাে, আইয়ুব খান অনেক বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেন। এ জন্যই তিনি মােনায়েম খানের মতাে একজন বশংবদকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বানিয়েছেন। তখন থেকেই শেখ মুজিব স্বাধীনতার কথা চিন্তা করছিলেন। শেখ মুজিবের জীবনীকার এস এ করিমের (বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রসচিব) বিবরণ থেকে জানা যায়, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান তিক্ত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ভারতের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তিনি ভারতের কাছ থেকে একটা।
রেডিও ট্রান্সমিটার পেতে চাইছিলেন, যাতে করে সীমান্তের কাছে ভারতের মাটিতে এটা ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে যাওয়া যায়। এ লক্ষ্যে মুজিব ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে নাসের নামের একজন বিশ্বস্ত লোেককে ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তার কাছে পাঠান। ওই কর্মকর্তা গােয়েন্দাকাজে নিয়ােজিত ছিলেন। গােয়েন্দা নজরদারি থাকায় মুজিবের পক্ষে ওই কর্মকর্তার সঙ্গে যােগাযােগ করা সম্ভব ছিল না। ঠিক হয়, আগরতলায় একজন পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে মুজিবের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে। তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, বিশেষ করে শিল্পপতি সাইদুল হাসান তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। ১৯৬২ সালের শেষ দিকে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ২৭ জানুয়ারি (১৯৬৩) শেখ মুজিব চারজন সঙ্গীকে নিয়ে টঙ্গী স্টেশন থেকে রাতের ট্রেনে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হন। ভাের চারটার দিকে তিনি শ্রীমঙ্গলে পৌছান। দুজন সিলেটের দিকে চলে যায়, বাকি দুজনকে নিয়ে মুজিব ট্রেন থেকে নামেন এবং ডিনস্টোন চা-বাগানে এসে উপস্থিত হন। ফিনলে কোম্পানির এ বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক কায়েস চৌধুরী তাদের প্রাতরাশের ব্যবস্থা করেন। একটা ল্যান্ডরােভার গাড়িতে চড়ে তারা আহমদুল কবিরের মধুপুর চা-বাগানে এসে উপস্থিত হন। সেখান থেকে বাগানের এক কুলি সরদার পথ দেখিয়ে তাদের ত্রিপুরা সীমান্তে নিয়ে যায়। ভাের হওয়ার একটু আগে তারা সীমান্তে পৌঁছান। তখন যথেষ্ট শীত পড়েছে, চারদিক কুয়াশায় ঢাকা, বন্য শূকরের উপদ্রব ছিল আশপাশের জঙ্গলে। কোনাে দুর্ঘটনা ছাড়াই তারা পৌছাতে সক্ষম হন। তাঁরা সীমান্তবর্তী খােয়াই মহকুমার সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে পড়েন। ওখানকার এসডিও মুজিবের এ মিশন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।
তিনি আগরতলায় মুখ্য সচিবের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। মুখ্য সচিব তাদের সীমান্তের ওপারে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বাদ সাধেন। মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ ১৯৯১ সালে লেখক-প্রকাশক মফিদুল হকের সঙ্গে আলাপচারিতায় ঘটনাটি এভাবে লিখে দিয়েছিলেন : ১৯৬৩ ইং আমার ভাই এমএলএ শ্রী উমেশ লাল সিং সমভিব্যাহারে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ১০ জন ত্রিপুরার পালম জেলার খােয়াই মহকুমা দিয়া আমার আগরতলার বাংলােয় রাত ১২ ঘটিকায় আগমন করেন। প্রাথমিক আলাপ-আলােচনার পর আমার বাংলাে বাড়ি হইতে মাইল দেড়েক দূরে ভগ্নি হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়িতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তারপর মুজিবুর ভাইয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করি। আমার সঙ্গে ছিলেন শ্রী শ্ৰীমন চিফ সেক্রেটারি। তাঁকে (শ্রীরমনকে) বিদেশসচিব শ্ৰীভাণ্ডারিয়ার রুমে রাখিয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি। তিনি মুজিবুর রহমানকে ত্রিপুরায় থাকিয়া প্রচার করিতে সম্মত হন নাই। কারণ, চীনের সঙ্গে লড়াইয়ের পর এত বড় ঝুঁকি নিতে রাজি হন নাই। তাই ১৫ দিন থাকার পর তিনি ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। রেজা আলীর বর্ণনা এবং এস এ করিমের বিবরণে সময় ও তারিখের ফারাক লক্ষ করা যায়। এতে মনে হয়, তিনি দুবার ত্রিপুরা গিয়েছিলেন।
প্রথমবার ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৬৩ সালে জানুয়ারির শেষে। শেখ মুজিব ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় চার মাস জেলে আটক ছিলেন। সুতরাং ওই সময় তার ত্রিপুরা যাওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি একবারই ত্রিপুরা গিয়েছিলেন এবং তা ১৯৬৩ সালে। রেজা আলীর বর্ণনায় তারিখ বিভ্রাট হতে পারে। শেখ মুজিব সেবার সােনামুড়া হয়ে কুমিল্লা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌছান। ফেরার সময় কোনাে প্রস্তুতি বা আয়ােজন তার ছিল । ফিরে আসার পথ ছিল খুব কষ্টের। তার পা ফুলে গিয়েছিল। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ করার যে উদ্যোগ শেখ মুজিব নিয়েছিলেন, তার একটা বিস্ময়কর বিবরণ পাওয়া যায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপহাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির কাছ থেকে। ব্যানার্জি পুরান ঢাকার চক্রবর্তী ভিলা’য় থাকতেন। পাশের বাড়িতেই ছিল দৈনিক ইত্তেফাক এর অফিস। ১৯৬২ সালের ২৪ মার্চ মাঝরাতে ইত্তেফাক-এর সম্পাদক মানিক মিয়া একটি ছেলেকে পাঠিয়ে তাঁকে ইত্তেফাক অফিসে ডেকে নিয়ে আসেন। মানিক মিয়ার সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটাই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। প্রায় দুঘন্টা ধরে তাঁরা কথাবার্তা বলেন। ব্যানার্জি দেখলেন, একপর্যায়ে শেখ মুজিব ও মানিক মিয়ার কথার ধরন বদলে গেল। তারা কিছু একটা বলতে বা দেখাতে চাইছেন। ব্যানার্জি জানতে চাইলেন, তাঁরা উচ্চ পর্যায়ের কোনাে কর্তৃপক্ষের কাছে কোনাে বার্তা পৌছাতে চাচ্ছেন কি না। মুজিব মুখ খুললেন। বললেন, এই বৈঠক ডাকার উদ্দেশ্য হলাে, তারা ব্যানার্জির মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা গােপনীয় চিঠি পাঠাতে চান। মুজিব চিঠিটা ব্যানার্জির হাতে দিলেন। তাঁর মধ্যে তাড়াহুড়াে ছিল ।
ব্যানার্জি বললেন, চিঠিটা পাঠানাের আগে দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তাকে সেটা দেখাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে যখন চিঠিটা যাবে, তখন তার অনুলিপি পৌছে যাবে দিল্লিতে পররাষ্ট্রসচিব ও গােয়েন্দা ব্যুরাের পরিচালকের কাছে। একটু ইতস্তত করে তিনি দূতাবাসের দুই কর্মকর্তার নাম বললেন। একজন হলেন উপহাইকমিশনার সূর্য কুমার চৌধুরী এবং অন্যজন হলেন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় গােয়েন্দা বাহিনীর স্টেশন চিফ কর্নেল এস সি ঘােষ। তারা চিঠির ব্যাপারটি গােপন রাখার অঙ্গীকার করলেন।” গােপনীয় চিঠিটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে ব্যক্তিগতভাবে সম্বােধন করে লেখা। চিঠিতে ছােট একটা ভূমিকার পর সরাসরি একটা কর্মপরিকল্পনার উল্লেখ করা হয়েছিল। মুজিব নিজেই বললেন, তিনি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সূচনা করতে চান। তিনি লন্ডনে গিয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করবেন। মানিক মিয়া ঢাকায় থাকবেন এবং ইত্তেফাক-এ লেখনীর মাধ্যমে প্রচারকাজ চালাবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চের মধ্যে মুজিব লন্ডনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করে প্রবাসী সরকার গঠন করবেন। চিঠির শেষ প্যারায় নৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সমর্থন ও সাজসরঞ্জাম চেয়ে নেহরুকে অনুরােধ জানানাে হয়। এ বিষয়ে আলাপ করার জন্য মুজিব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গােপনে দেখা করতে ইচ্ছুক চিঠি পাঠানাে হলাে।
ভারত তখন চীনের সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত। নেহরু তাঁর জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠক ডেকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তারা কেউ তখন দিল্লিতে ছিলেন না, কেউ কেউ ছিলেন দেশের বাইরে। দিল্লি থেকে খবর পাঠানাে হলাে, মুজিবের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় আছে, তবে তাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। মুজিব ভাবলেন, ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের আমলাদের কারণেই দেরি হচ্ছে। ধৈর্য হারিয়ে তিনি কৌশল পাল্টালেন। গােপনে সীমান্ত পেরিয়ে তিনি আগরতলায় যান। ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংয়ের সঙ্গে তার কয়েক দফা বৈঠক হয়। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যােগাযােগ করতে চান। তবে এ কথা বলতে ভুললেন না যে তিনি ইতিমধ্যে ঢাকায় ভারতের দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন। আগরতলায় কিছু সময় অপেক্ষা করার পর দিল্লি থেকে জবাব এল । দেরি হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মুজিবকে পরামর্শ দেন, এর পর থেকে যেন ঢাকায় ভারতের দূতাবাসের মাধ্যমেই যােগাযোেগ করা হয়, আগরতলার মাধ্যমে নয়। আগরতলাতেই মুজিবকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাকে সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং তা ঢাকা ভারতীয় মিশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।১২
শেখ মুজিবের আগরতলা মিশন সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার, এমনকি তাঁর দলের সহকর্মীরাও ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। ১৯৬৩ সালের পর তিনি আর আগরতলা গিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। ভারতের সাহায্য নিয়ে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার রাজনৈতিক কৌশল তিনি সম্ভবত পরিবর্তন করেছিলেন।
সূত্রঃ আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ