১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাত আটটায় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারি করে ফিরােজ খান নুনের মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন ঢাকাস্থ সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ওমরাও খান। ১১ অক্টোবর পুলিশের সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল জাকির হােসেনকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। অনেক রাজনীতিবিদ গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় ছিলেন। শেখ মুজিব কয়েক দিনের জন্য গা-ঢাকা দেন। এ প্রসঙ্গে তার অনেক দিনের রাজনৈতিক সাথি তৎকালীন ন্যাপ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির সঙ্গে সঙ্গে আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে আত্মগােপনের পরামর্শ দিয়েছিলাম। কারণ, সামরিক সরকার শেখ সাহেবকে গ্রেপ্তার করতে দৃঢ়সংকল্প ছিল। আমরা একটা গাড়িতে চড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু অন্য সঙ্গীদের সেখানে রেখে তিনি দেশের ভেতরে চলে এসেছিলেন। গ্রেপ্তার বরণের জন্য তিনি তৈরি হয়েই ছিলেন। তিনি হয়তাে আত্মগােপনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। ১০ অক্টোবর রাতে আবুল মনসুর আহমদকে দুর্নীতি দমন আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। একই অভিযােগে শেখ মুজিব ১২ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন। মওলানা ভাসানীকে ১২ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডির একটি সরকারি বাসায় অন্তরীণ করে রাখা হয়। ২০ অক্টোবর জেলে থাকা অবস্থায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে শেখ মুজিবকে নিরাপত্তাবন্দী হিসেবে দেখানাে হয়। এই আইনে তিনি জামিন-অযােগ্য বলে বিবেচিত হন।
নিম্ন আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে নয়টি মামলা হয়েছিল। আটটি মামলাই খারিজ হয়ে যায়। একটি মামলায় ঢাকার জেলা ও সেশন জজ আবদুল মওদুদ ১৯৬০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দেওয়া রায়ে দুর্নীতির দায়ে শেখ মুজিবকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। তার মামলা পরিচালনা করেছিলেন সােহরাওয়ার্দী। ১৯৬১ সালের ২১ জুন শেখ মুজিব হাইকোর্টের রায়ে ওই মামলা থেকে মুক্ত হন। জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করার পরপরই প্রেসিডেন্ট মির্জা বুঝতে পারলেন, ক্ষমতার চাবিটি তিনি অজান্তেই হাতছাড়া করে ফেলেছেন। ক্ষমতা এখন সেনাবাহিনীর হাতে এবং জেনারেল আইয়ুবের হাতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ। মির্জার আর কিছু করার ছিল না। ২৭ অক্টোবর রাতে তাকে সরিয়ে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্টের গদি দখল করলেন। মির্জাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হলাে। আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে কোনাে বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ হয়নি। পাকিস্তানের জাতির পিতা প্রয়াত মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বােন ফাতেমা জিন্নাহ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘রাজনীতি থেকে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার বিদায় পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে নতুন যুগের সূচনা হলাে।
১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট প্রেসিডেন্ট আইয়ুব দুটো অধ্যাদেশ জারি করেন। একটি হলাে ‘পােডাে’ (PODO—পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার) এবং অন্যটি হলাে এবভাে’ (EBDO-ইলেক্টিভ বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার)। পােড়াে আইন প্রয়ােগ করে অনেক সাবেক মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদকে বিচারের মুখােমুখি করা হয়। এই আইনে বলা ছিল, কেউ যদি আদালতে দোষী প্রমাণিত হন, তাহলে এবডাে আইনে তিনি ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনাে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। ১৯৫৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের ৪২ জন রাজনীতিবিদকে এবডাের মাধ্যমে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর (১৯৫৯) ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করে সামরিক আদালতে সাজা দেওয়া হয়। লেখালেখির ব্যাপারে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবেন—এই আশ্বাস দেওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দুর্নীতির মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতে পারে এই আশঙ্কায় অনেক রাজনীতিবিদ এবডাে মেনে নিয়ে রাজনীতি থেকে তখনকার মতাে অবসরে চলে। যান। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন এ কে ফজলুল হক, হােসেন শহীদ। সােহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন ও মৌলভি তমিজুদ্দিন খান। ১৯৫৯ সালের ৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আদালতে দুর্নীতির একটি মামলা সচল থাকে। ১৯৬০ সালের ১৮ জুলাই সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে এবডাে প্রয়ােগ করা হয়। সামরিক আইন জারির দুদিন পর ১০ অক্টোবর (১৯৫৮) এক সংবাদ সম্মেলনে আইয়ুব খান ঘােষণা করেছিলেন, জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তবে অন্য কোনাে দেশের সংবিধানের নকল নয়, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় এনে দেশজ একটি ব্যবস্থা উদ্ভাবনের মাধ্যমে। ১৯৫৯ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ১ মে করাচিতে এবং একই বছর ১২-১৩ জুন নাথিয়াগালিতে গভর্নরদের সম্মেলনে নতুন শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনা। ও সিদ্ধান্ত হয়। ২৬ অক্টোবর আইয়ুব খান নিজেই নিজেকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে পদোন্নতি দেন। ‘বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপনের প্রাক্কালে ২৬ অক্টোবর তিনি ‘বেসিক ডেমােক্রেসি’ বা মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের ঘােষণা দেন। ইউনিয়ন বাের্ডকে ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং জেলা বাের্ডকে জেলা কাউন্সিল নাম দেওয়া হয়। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি।
পাকিস্তানের দুই অংশ থেকে ৪০ হাজার করে মােট ৮০ হাজার ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। তাদের মৌলিক গণতন্ত্রী বা বেসিক ডেমােক্র্যাট (সংক্ষেপে বিডি মেম্বার) নামে অভিহিত করা হলাে। প্রতিটি ইউনিয়নে নির্বাচিত বিডি মেম্বাররা তাদের মধ্য থেকে একজন করে চেয়ারম্যান নির্বাচন করলেন। সমালােচকেরা বললেন, আইয়ুব খান ৮০ হাজার ফেরেশতা পয়দা করেছেন। ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি গণভােটের আয়ােজন করা হয়। ভােটারদের কাছে একটাই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খান, হিলাল-ই-পাকিস্তান, হিলাল-ই-জুরত-এর ওপর আপনার কি আস্থা আছে? বিডি মেম্বাররাই শুধু ভােটার। তারা হা-না ভােট দিলেন। ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিডি মেম্বারের ‘আস্থা ভােট’ পেয়ে আইয়ুব খান ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। পাকিস্তানের জন্য নতুন একটা। সংবিধান তৈরির লক্ষ্যে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সংবিধান কমিশন গঠন করেন। কমিশন ১৯৬১ সালের ৬ মে। প্রেসিডেন্টের কাছে রিপাের্ট জমা দেয়। মৌলভি তমিজুদ্দিন খান পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার ঘাের বিরােধী। আইয়ুব খানের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে তার খােলামেলা কথা হয়। আইয়ুব খানের বর্ণনায় বিষয়টি উঠে এসেছে : আইয়ুব : আপনার আপত্তিটা কোথায়? তমিজ ; মুসলিম ইতিহাস এবং আমাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সব সময় এক ব্যক্তির শাসন দেখেছি।
আমার ভয় হয় পাছে আমরা ওই অবস্থায় ফিরে যাই, যদিও আমরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পেয়েছি। আইয়ুব : যদি এটা মুসলমানদের রক্তের মধ্যেই থাকে, কীভাবে এ থেকে বেরিয়ে আসবেন? আপনি কি একজন একনায়ক এবং একজন। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মধ্যে পার্থক্য দেখেন না? যুক্তরাষ্ট্রে কি প্রেসিডেন্ট নেই এবং যুক্তরাষ্ট্র কি গণতান্ত্রিক নয়? আপনি কেমন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বলেন, যেখানে মুসলিম লীগ ছাড়া দশপনেরােটা রাজনৈতিক দলের কোনােটারই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচি নেই? তমিজ ; শুধু দুটো দল থাকবে এমন একটা আইন আমরা করতে পারি। আইয়ুব : তমিজুদ্দিন সাহেব, আইন করে যদি মানুষের বিবেক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে সব মুসলমানকে এক গােত্রে নিয়ে আসেন না কেন? মুসলমানদের মধ্যে ৭২টা ফেরকা আছে, যদিও সবাই কোরআন থেকে প্রেরণা খোঁজে। আইনের কৌশল দিয়ে মানুষের বিবেক নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তমিজ ; তবুও আমি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চাই কথাবার্তা বলার জন্য আমি যাদের দাওয়াত দিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে। নুরুল আমিনও ছিলেন। তিনি ছিলেন চুপচাপ। আমার মনে হয় তিনি এই বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৌলভি তমিজুদ্দিন কথা বলছিলেন আন্তরিক বিশ্বাস থেকেই, যদিও তা ছিল অবাস্তব। আমি তার সাহসের প্রশংসা করি । আসল কথা হলাে, সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকর হয় যদি সুসংগঠিত দল থাকে, অল্পসংখ্যক দল এবং যাদের আছে সুনির্দিষ্ট আর্থসামাজিক কর্মসূচি।…একটা দায়িত্বশীল সরকার জনমতের স্বেচ্ছাচারের কাছে বন্দী থাকতে পারে না।
আপনাকে থাকতে হবে জনগণের সামনে এবং জনগণকে আপনার নির্দেশিত পথে পরিচালনা করতে হবে। আমার লক্ষ্য হলাে জনগণের ঐক্য এবং দেশের উন্নয়ন। এসব লক্ষ্য হাসিল করার জন্য দরকার একটা স্থিতিশীল ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার, প্রশাসনের ধারাবাহিকতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সুচিন্তিত কর্মসূচি। ধর্ম ও আদর্শের প্রয়ােজনীয় নীতিগুলাের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে জাতিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে দ্রুত নিয়ে যেতে হবে। ইতিহাসের ক্ষতগুলাে সারিয়ে ফেলার কথা বলা সহজ। বাস্তবে এটা নিয়ে কাজ করা কঠিন। আপনি কেমন করে সংসদীয় ব্যবস্থার কথা বলেন, যখন আপনার দেশে বড় জোতদাররা হাজার হাজার ভােটকে প্রভাবিত করে? যখন দশ-পনেরােটা রাজনৈতিক দল কোনাে কর্মসূচি ছাড়াই কথা বলে, তখন কীভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র কিংবা স্থিতিশীলতা আসবে? কীভাবে আপনি সংসদীয় গণতন্ত্র চালু রাখবেন, যেখানে পীর-ফকিররা মানুষকে পরােক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে? আমরা যেখানে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর্যায়ে পৌছাতে পারিনি, সেখানে কেমন করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকবে?
প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য সবচেয়ে সহজ হলাে ইংরেজ, মার্কিন কিংবা রুশদের কিছু পাঠ্যবই হাতে নিয়ে বলা যে, তারা এভাবে এটা করেছে এবং আমরা তাদের অনুসরণ করব না কেন। মােদ্দা কথা হলাে, এটা কি কার্যকর হবে? মানুষ কি এটা মন থেকে মেনে নেবে? তারা কি এটাকে নিজেদের মনে করবে? যদি না করে, তাহলে আমাদের সব চেষ্টা বিফলে যাবে।১০। ১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় আতাউর রহমান খানের বাসায় এক গােপন বৈঠকে সােহরাওয়ার্দী, মানিক মিয়া, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক শাসন ও খসড়া সংবিধানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকা থেকে করাচি ফিরে যাওয়ার পর ৩০ জানুয়ারি সােহরাওয়ার্দীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। ছাত্র আন্দোলনের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, কোরবান আলী, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, শেখ ফজলুল হক মণি, বদরুল হক বাচ্চু, কে এম ওবায়দুর রহমান, গাউস কুতুবউদ্দিন, আবদুর রশীদসহ অনেকেই গ্রেপ্তার হন।
আইয়ুব খানের প্রথম মন্ত্রিসভায় মনজুর কাদের ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তারা দুজনই ছিলেন শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পক্ষে। মনজুর কাদের প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে বােঝাতে পেরেছিলেন যে জনমত’ হচ্ছে একটা বিপজ্জনক মিথ এবং একে উৎসাহ দেওয়া ঠিক হবে না। আইয়ুব খান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা—শুধু এই তিনটি বিষয়ের দেখভাল করবে। কিন্তু ভুট্টো চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সর্বময় ক্ষমতা দিতে। তিনি প্রদেশে কোনাে আইনসভাও রাখতে চাননি। তার যুক্তি ছিল, প্রাদেশিক সরকার হবে প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি এবং প্রেসিডেন্টের হাতে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। সামরিক সরকারের আইনমন্ত্রী বিচারপতি মােহাম্মদ ইব্রাহিম পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের একজন গােড়া সমর্থক ছিলেন। খসড়া সংবিধানের ওপর তিনি ১৯৬১ সালের ৫ মে প্রেসিডেন্টের কাছে লিখিতভাবে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার মন্তব্য ছিল, একসঙ্গে থাকার ইচ্ছার ওপর জাতীয় সংহতি নির্ভর করে। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভীতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা দরকার। তিনি প্রদেশগুলােকে আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করার দাবি জানান। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেন :
১) কেন্দ্রীয় সরকার শুধু দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, আন্তপ্রদেশ যােগাযােগ ও মুদ্রা—এ কয়টি বিষয় দেখবে। বাকি সব বিষয় প্রাদেশিক সরকারের আওতাধীন থাকবে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হবে এবং সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদ গঠন করতে হবে। প্রাদেশিক গভর্নরকে ওই প্রদেশের অধিবাসী।
হতে হবে। ৩) প্রদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনা করে প্রাদেশিক বিষয়গুলাে নিয়ে
প্রদেশের জন্য আলাদা সংবিধান হতে পারে । ৪) জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নিজ নিজ বাজেট তৈরি করবে। ৫) অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় রেখে কেন্দ্রে ও প্রদেশে আইনসভায়
১০০ জনের বেশি সদস্য থাকার দরকার নেই। ৬) কেন্দ্রীয় সরকারের খরচের উৎস নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। কেন্দ্রীয়
সরকারের খরচের ন্যায্য অংশ প্রদেশগুলাে পাবে। ৭) দুই প্রদেশ থেকে পালাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ পূরণ
করতে হবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় দুই প্রদেশের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকবে। ৮) জাতীয় পরিষদের স্থায়ী ঠিকানা হবে ঢাকা, যা হবে দ্বিতীয় রাজধানী। ৯) কেন্দ্রীয় সরকারের সব চাকরিতে সমতা আনতে হবে। ১০) জরুরি অবস্থায় বা আক্রান্ত হলে মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ নিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। ১১) প্রেসিডেন্ট ও গভর্নরের অপসারণের (ইমপিচ) ব্যবস্থা থাকতে হবে।
১২) প্রয়ােজনে সংবিধান মাঝেমধ্যে সংশােধনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। গভর্নর লে. জেনারেল আজম খানের সঙ্গে বিচারপতি ইব্রাহিমের সখ্য ছিল। আজম খান পূর্ব পাকিস্তানের দাবিদাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বিচারপতি ইব্রাহিমের ৪ ও ৯ মার্চের (১৯৬২) ডায়েরি থেকে জানা যায় :
গভর্নর আজমের সঙ্গে প্রায় সাড়ে নয়টায় সাক্ষাৎ হলাে।…আমি বললাম, আমার রিঅ্যাকশন পরিষ্কার। এই কনস্টিটিউশন পাকিস্তানকে মরণ আঘাত দিয়েছে ।…প্রেসিডেন্ট সেদিন আমাকে রিজাইন না দিতে অনুরােধ করায় দিই নাই । কিন্তু এখন কী করি? আমার আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছা করছে না। আজম বলল, ‘এ কে খানের সঙ্গে বুঝে দেখুন । হাফিজুর রহমানের সঙ্গে বুঝে দেখুন। (তারা দুজন তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী)। আমি পশ্চিম পাকিস্তান যাচ্ছি, সেখানকার অবস্থা দেখে এসে পরে বলব।’ হঠাৎ আজম জিজ্ঞাসা করল, ‘জিওসি ওয়াসিউদ্দিন সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?’ আমি বললাম, তার বাবাকে (খাজা শাহাবুদ্দীন) চিনি, কিন্তু ওয়াসিউদ্দিন সম্বন্ধে আমার কোনাে ধারণা নেই।
আজমের কথায় বুঝলাম ওয়াসিউদ্দিন জুলুম করে আন্দোলন থামানাের পক্ষপাতী এবং এ বিষয়ে আজমের সঙ্গে তার মতানৈক্য হয়েছে।… আজমের কাছে শুনলাম, জাকির হােসেন মােসলেম হলের (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) ছাত্রদের জন্য ৫০০ মশারি নিয়ে আসছে। ঘুষ! কিন্তু ঘুষে কুলাবে কি?… আজ (৯ মার্চ) এ কে খান করাচি যাওয়ার পথে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি বললেন, ‘ইলেকশনে দাঁড়াব।’ অল্প দিনে এত পরিবর্তন! আমি বললাম, আপনি না বলেছিলেন কনস্টিটিউশন প্রবর্তন করার পর আমার সঙ্গে রিজাইন দেবেন? তখন আর জবাব নেই—চুপ। বিচারপতি ইব্রাহিম ১৯৬২ সালের ১১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। ২০ এপ্রিল আজম খান পদত্যাগপত্র জমা দেন।১৫। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানে নতুন সংবিধান চালু করা হয়। সেই সঙ্গে চালু হয় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা। নতুন সংবিধান অনুযায়ী ৮০ হাজার বিডি মেম্বারের ভােটে ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ এবং ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়। জাতীয় পরিষদের আসন ছিল ১৫০টি। এ ছাড়া মহিলাদের জন্য অতিরিক্ত ছয়টি আসন ছিল। এই আসনের অর্ধেক ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দলীয় ভিত্তিতে ১৬ | জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ৮ জুন (১৯৬২)। ওই দিন সামরিক আইন তুলে নেওয়া হয়। প্রথম অধিবেশনে ফরিদপুরের মৌলভী তমিজুদ্দিন খান স্পিকার নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে হলেও আওয়ামী লীগের ১২ জন এই পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে নির্দলীয় আরেকজন আওয়ামী লীগে যােগ দেন। আওয়ামী লীগের সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন এ এইচ এম কামারুজ্জামান (রাজশাহী), সােহরাব হােসেন (যশাের), এম আর সিদ্দিকী (চট্টগ্রাম) ও মিজানুর রহমান চৌধুরী (কুমিল্লা)।১৭ | ৬ জুন (১৯৬২) শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে ছাড়া পান। আইয়ুব খানের দেওয়া সংবিধান গ্রহণযােগ্য নয়, এ ঘােষণা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নয়জন রাজনৈতিক নেতা ১৯৬২ সালের ২৪ জুন একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে সই দেন মুসলিম লীগের নুরুল আমিন ও মােহন মিয়া, আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান, কৃষক-শ্রমিক পার্টির হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হােসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) ও পীর মােহসেনউদ্দিন (দুদু মিয়া) এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাহমুদ আলী।১৮ বিবৃতিতে বলা হয় : স্থায়ী ও সহজে কার্যক্ষম শাসনতন্ত্রই জাতীয় সংহতি ও স্থায়িত্বের পূর্বশর্ত। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সত্যিকার গণপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক প্রণীত না হইলে কোনাে শাসনতন্ত্রই টেকসই হইতে পারে না ।…
রাজনৈতিক দলই হইল প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু ।…রাজনৈতিক দলবর্জিত পরিষদ ও স্বার্থ শিকার ব্যতীত অন্য কোনাে দায়িত্ববােধ সদস্যদের প্রভাবিত করিতে পারে না।…এমতাবস্থায় দেশে রাজনৈতিক দল গড়িয়া উঠার পথে যা কিছু অন্তরায়, উহার অবসান ঘটাইতে হইবে।…” ১৯৬২ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বিনা বিচারে আটক অনেক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯ আগস্ট সােহরাওয়ার্দী জেল থেকে ছাড়া পান। তিনি নয়জন নেতার বিবৃতিকে সমর্থন করেন। মওলানা ভাসানী অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি পান ৩ নভেম্বর।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের পরপরই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের একটি কনভেনশন ডাকেন। কনভেনশনে যােগ দেওয়া অধিকাংশ লােকই ছিলেন মুসলিম লীগের। ৪ সেপ্টেম্বর (১৯৬২) অনুষ্ঠিত এই কনভেনশনে আইয়ুব খান মুসলিম লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন। সভাপতি হন চৌধুরী খালেকুজ্জামান। পরে অবশ্য আইয়ুব খান নিজেই সভাপতির পদটি নিয়ে নেন। এর পর থেকে মুসলিম লীগের এই অংশটি ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’ নামে পরিচিত হয়। মুসলিম লীগের যারা এই কনভেনশনে যােগ দেননি, তারা ২৭ নভেম্বর (১৯৬২) একটি কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ পুনর্গঠন করেন। এর সভাপতি হন খাজা নাজিমুদ্দিন। মুসলিম লীগের এই অংশটি কাউন্সিল মুসলিম লীগ’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৬১ সালের শেষ দিকে ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক মানিক মিয়ার উদ্যোগে শেখ মুজিবের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির যােগাযােগ হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকবার বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে কমিউনিষ্ট পার্টির পক্ষ থেকে মণি সিংহ ও খােকা রায় অংশ নেন। মণি সিংহ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার জন্য শেখ মুজিবকে অনুরােধ করেছিলেন।২০ | পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল এবং ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে ঐক্য ও সমঝােতার ব্যাপারে তারা আন্তরিক ছিলেন। ছাত্রলীগের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে মােহাম্মদ ফরহাদ অনুঘটকের কাজ করেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের দেখভাল করতেন।২১ ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব এস এম শরীফের নেতৃত্বে ১০ জন শিক্ষাবিদকে সদস্য করে সরকার একটি জাতীয় শিক্ষানীতি
তৈরির ঘােষণা দেয়। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে শরীফ কমিশন প্রেসিডেন্টের কাছে তার রিপাের্ট জমা দেয়। পাকিস্তানের সংহতির কথা মাথায় রেখে এই রিপাের্টে একটা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। সামরিক আইন | উঠে যাওয়ার পর শরীফ কমিশন রিপাের্ট বাতিলের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র
আন্দোলন হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে এই আন্দোলন করে। তারা ১৭ সেপ্টেম্বর (১৯৬২) হরতাল ডাকে। ওই দিন ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে বাবুল ও মােস্তফা ঘটনাস্থলেই নিহত এবং ওয়াজিউল্লাহ নামে একজন আহত হন। ওয়াজিউল্লাহ পরদিন মারা যান। তিন দিনের মাথায় সরকার শরীফ কমিশনের রিপাের্টের বাস্তবায়ন স্থগিত ঘােষণা করে।২৩ | শিক্ষা কমিশন রিপাের্টে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দুই বছরের স্নাতক পাস কোর্স তিন বছরের করার প্রস্তাব ছিল। ছাত্রদের বিরােধিতার ফলে কমিশনের রিপাের্ট আর কার্যকর করা হয়নি। ইতিমধ্যে যারা স্নাতক পাস কোর্সে তৃতীয় বর্ষে উঠেছিলেন, তাঁদের বিনা পরীক্ষায় স্নাতক-উত্তীর্ণ হিসেবে ঘােষণা দেওয়া হয়। এর ফল হয় মারাত্মক। পরীক্ষা না দিয়ে অটোপ্রমােশন পাওয়া এসব ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্র পরে নানা অসুবিধায় পড়েছিলেন। আন্দোলন যে সব সময় যৌক্তিক ছিল,
তা বলা যাবে না। তবে এই আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রনেতারা আইয়ুববিরােধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোয়ার তৈরির একটা সুযােগ পেয়ে যান। বিরােধীদলীয় নেতাদের উপলব্ধি হলাে, একটা দলহীন ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ তৈরি করা দরকার। এ প্রক্রিয়ায় শামিল হলাে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। তারা একসঙ্গে বসে ৪ অক্টোবর (১৯৬২) ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) তৈরি করল। ২৮ অক্টোবর (১৯৬২) কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী আবদুল মােনায়েম। খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। মােনায়েম খান ১৯৬৩ সালে স্বাধীনচেতা অধ্যাপক ড. মাহমুদ হােসেনকে সরিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ওসমান গণিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়ােগ করেন। ড. ওসমান গণি মােনায়েম খানের অনুগত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে নিয়ে সরকারপন্থী একটি চক্র গড়ে তােলেন। এই চক্রের সদস্য ছিলেন গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আজিজ, রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও সলিমুল্লাহ হলের প্রভােস্ট অধ্যাপক ড. মফিজুল্লাহ, গণিতের শিক্ষক ও ঢাকা হলের (পরে শহীদুল্লাহ হল) প্রভােস্ট ড. মুশফিকুর রহমান এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। গতিক সুবিধের নয় দেখে মতিন চৌধুরী আণবিক শক্তি কমিশনে একটি কাজ জুটিয়ে করাচি চলে যান এবং আইয়ুব সরকারের পতনের পর ভােল পাল্টে ফেলেন।২৪ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময়ের একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শেষ করা । ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে শহীদ মিনারের। পরিকল্পনা ও নকশা তৈরির জন্য স্থপতি হামিদুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল আজম খান শহীদ মিনার তৈরির ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম এই শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।২৫
সূত্রঃ আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ