You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভাঙাগড়া
মওলানা ভাসানী ১৯৫৪ সালে সুইডেনের স্টকহােমে একটি শান্তি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর বেশ কিছুদিন লন্ডনে ছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল, দেশে ফিরলে তাকে হয়রানি করা হবে, এমনকি তাকে মেরে ফেলা হতে পারে। ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি কলকাতায় পৌছে টাওয়ার হােটেলে ওঠেন। সেখান থেকে তিনি দলের কাউন্সিল ডেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম বিষয় ছিল আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক দলে রূপান্তরিত করা। তার মনে হয়েছিল, কাউন্সিল সভা ডাকা নিয়ে টালবাহানা হচ্ছে। ১৫ এপ্রিল (১৯৫৫) দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে পাঠানাে এক চিঠিতে তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেন। চিঠিটি নিচে উদ্ধৃত করা হলাে : টাওয়ার হােটেল কলকাতা ১৫,৪.৫৫ প্রিয় মজিবর রহমান, আমার দোয়া, ছালাম সকলে গ্রহণ করিও। আগামী ১১ই, ১২ই জুন ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা ডাকিবে। আমি ইনশা আল্লাহ ১০ই জুন ঢাকায় পৌছিব। এই সময়ের মধ্যে সমস্ত জেলা মহকুমায় ইউনিয়ন সমিতি গঠনের কাজ শেষ করিতে আপ্রাণ চেষ্টা করিবে। কোন অবস্থাতেই উক্ত তারিখ পিছান না হয়। সরকার আমার উপর যে ভাবই পােষণ করুক না কেন আমি আল্লাহ ভরসা করিয়া উক্ত তারিখে দেশে উপস্থিত হইবই হইব। সভার এজেন্ডা থাকিবে
১) নতুন কর্মকর্তা নির্বাচন
২) আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়ীক করণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ
৩) ২১ দফা দাবী কার্যকরী করিবার উপায় নির্ধারণ
৪) বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি
৫) বিবিধ
যদি আরও দফা দেওয়া সাব্যস্ত মনে কর তাহা দিও। আওয়ামী লীগকে যদি বাচাইতে চাও এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ আদায় করিতে চাও তাহা হইলে কালবিলম্ব না করিয়া আমার নির্দেশ মােতাবেক মিটিং ডাকিতে কোন প্রকার ত্রুটি করিও না। আমি তােমাকে এবং আতাউর রহমান সাহেব ও অন্যান্য সকল ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বারদের পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থের জন্য আমার নির্দেশ মানিতে অনুরােধ জানাইতেছি। অন্যথায় আওয়ামী লীগ ধ্বংস হইবে । পূ. পাক আওয়ামী লীগ ধ্বংস হইলে আর নূতন কোন সংগঠন গড়া।
মােটই সম্ভব হইবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ শহীদ সাহেবের পকেটেই আছে কোনাে কাজকর্ম নাই ভবিষ্যতেও কিছু আশা নাই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই এ রকম প্রতিষ্ঠান ছিল, যাহা দ্বারা শহীদ সাহেবের ইজ্জত এবং গােটা পাকিস্তানের ইজ্জত রক্ষা হইত। বিশেষ দুঃখের সহিত জানাইতেছি যে যদি তােমরা কাউন্সিলের মিটিং উক্ত তারিখে না ডাক তাহা হইলে আমি সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়া নিজেই মিটিং ডাকিতে বাধ্য হইব। খােদা হাফেজ। মাে. আবদুল হামিদ খান ভাসানী।১
সােহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় পাকিস্তান সরকার ভাসানীর ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর ভাসানী ২৫ এপ্রিল (১৯৫৫) ঢাকায় আসেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মােড় পরিবর্তনের সূচনা হয় ১৯৫৪ সালের পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক সহযােগিতা চুক্তির মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভীষণ। ১৯ মে (১৯৫৪) করাচিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খান এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কেনেথ ইমারসন দুই দেশের মধ্যে মিউচুয়াল ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট নামে একটি সামরিক সহযােগিতা চুক্তি সই করেন। এই চুক্তির আওতায় মার্কিন বিমানবাহিনী পেশােয়ার শহরের চার মাইল দক্ষিণে বাদাবের নামক স্থানে একটা গােপন ঘাঁটি বানানাে শুরু করে। এই ঘাঁটি থেকে মার্কিন গােয়েন্দা বিমান সােভিয়েত ইউনিয়নের পরমাণু কর্মসূচির ওপর নজরদারি করত। এই ঘাঁটিতে কোনাে পাকিস্তানির প্রবেশাধিকার ছিল না।
৮ সেপ্টেম্বর (১৯৫৪) ম্যানিলায় এক সম্মেলনে পাকিস্তান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সাউথ-ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন (SEATO) গঠন করে। এটা ছিল একটি বহুপক্ষীয় সামরিক চুক্তি। ১৯৫৫ সালের ১ জুলাই বাগদাদে পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (CENTO) নামে আরেকটি সামরিক জোট গঠন করে। প্রথমে এর নাম ছিল ‘বাগদাদ প্যাক্ট’। পরে ইরাকে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ব্রিগেডিয়ার আবদাল করিম কাসেম রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে বাগদাদ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলে এই চুক্তির নাম CENTO করা হয় এবং জোটের সদর দপ্তর বাগদাদ থেকে আঙ্কারায় নিয়ে যাওয়া হয়। এসব চুক্তি ও জোটে যােগ দিয়ে পাকিস্তান তার জোটনিরপেক্ষ চরিত্র হারায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক রণকৌশলের ছাতার তলায় আশ্রয় নেয়। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটে রূপমহল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে দুটো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখা হয়। মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার ব্যাপারে সােহরাওয়ার্দীর প্রবল আপত্তি ছিল। কিন্তু মওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। সােহরাওয়ার্দীর গোড়া সমর্থক বলে পরিচিত শেখ মুজিবের জন্য ব্যাপারটা ছিল খুবই বিব্রতকর। অনেক আলাপ-আলােচনার পর সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে, ২২ অক্টোবর, সােহরাওয়ার্দী তার আপত্তি তুলে নেন। শেখ মুজিব এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অলি আহাদ লিখেছিলেন, ‘কোনাে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী মতান্তর ও মনান্তর নিরসনে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন একমাত্র সেতুবন্ধ।”৬ দলের বার্ষিক রিপাের্ট উপস্থাপন করার সময় এ প্রসঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন : এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রয়ােজনে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়, তখন আমাদের সংগঠনটিকে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের রূপ দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানি জনগণের ধর্মবিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে মুসলিম লীগ ইসলামকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্বীয় ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখে। এ ছাড়া মুসলিম লীগ যে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে, তা থেকে জনগণ তখনাে সম্পূর্ণরূপে নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে যদিও আমাদের সংগঠনটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার রূপ দেওয়া সম্ভব ছিল, তথাপি তা মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবকে মােকাবিলা করতে ব্যর্থ হতাে। দলের নামটি অসাম্প্রদায়িক করার ব্যাপারে সবাই একমত ছিলেন না। এ ব্যাপারে ভাসানী সবার মতামত জানতে চান। উপস্থিত কাউন্সিলররা দুহাত তুলে স্লোগান দিয়ে প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। তখন রংপুরের আহমদ আলী মােক্তার ও খুলনার জনৈক কর্মী চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা মুসলিম কাটা আওয়ামী লীগে থাকব না।’
সম্মেলনে মওলানা ভাসানী ২১ দফা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্য কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের লেজুড়বৃত্তির অভিযোেগ আনেন। তিনি পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহযােগিতা চুক্তিরও সমালােচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি দলীয় সমর্থন প্রায় পুরােপুরি পেয়েছিলেন। কাউন্সিল অধিবেশনে এ সম্পর্কে একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছিল। প্রস্তাবে বলা হয় : পাকিস্তান সরকার গত কয়েক বছর পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সকল চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যে সকল চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হইয়াছে
এই কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান দলের। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবারও নির্বাচিত হন। অন্যান্য পদে নির্বাচিত ব্যক্তিরা হলেন আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ ও খয়রাত হােসেন (সহসভাপতি), অলি আহাদ (সাংগঠনিক সম্পাদক), অধ্যাপক আবদুল হাই (প্রচার সম্পাদক), আবদুস সামাদ (শ্রম সম্পাদক), তাজউদ্দীন আহমদ (সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক), সেলিনা বানু (মহিলা সম্পাদক), মুহম্মদুল্লাহ (দপ্তর সম্পাদক) ও ইয়ার মােহাম্মদ খান (কোষাধ্যক্ষ)।
কার্যনির্বাহী কমিটিতে সভাপতি কর্তৃক মনােনীত ২৫ জন সদস্যের মধ্যে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল আজিজ ও অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহম্মদ (চট্টগ্রাম), আবদুল জব্বার খদ্দর (নােয়াখালী), আবদুল বারী (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া ও মাওলানা আলতাফ হােসেন (ময়মনসিংহ), হাতেম আলী খান (টাঙ্গাইল), আবদুল হামিদ চৌধুরী (ফরিদপুর), সৈয়দ আকবর আলী (সিরাজগঞ্জ), শেখ আবদুল আজিজ ও মােমিনউদ্দিন আহমদ (খুলনা), মশিউর রহমান (যশাের), সাদ আহমদ (কুষ্টিয়া), তহুর আহমদ চৌধুরী (রাজশাহী), কাজী গােলাম মাহবুব ও আমিনুল হক চৌধুরী (বরিশাল), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও আমজাদ হােসেন (পাবনা), ডা. মজহার উদ্দিন আহমদ (রংপুর), রহিমউদ্দিন আহমদ (দিনাজপুর), আকবর হােসেন আখন্দ (বগুড়া), দবিরউদ্দিন আহমদ (নীলফামারী), পীর হাবিবুর রহমান (সিলেট) ও কামরুদ্দিন আহমদ (ঢাকা)।১০ পুরােনাে কমিটি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন আবদুস সালাম খান। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমবারের মতাে নির্বাহী কমিটিতে জায়গা পেলেন। পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদের তৈরি খসড়া সংবিধান পূর্ব বাংলার মানুষকে। বিক্ষুব্ধ করে তােলে। সংবিধানে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও যুক্ত নির্বাচনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালের ১৬ মার্চ ‘দাবি দিবস পালনের ঘােষণা দেয়। পল্টন ময়দানে জনসভা ডাকা হয়।
একই দিন মােহাজের নেতা মাওলানা রাগিব আহসান পল্টনে জনসভা ডাকেন গােলমাল এড়ানাের জন্য শেখ মুজিব ও অলি আহাদ রাগিব আহসানের বাসায় যান এবং একটা সমঝােতা করেন। সমঝােতা অনুযায়ী রাগিব আহসান বিকেল চারটা পর্যন্ত সভা করবেন এবং এরপর আওয়ামী লীগের সভা হবে। কিন্তু সাড়ে চারটা বেজে যাওয়ার পরও রাগিব আহসানের সভা শেষ হওয়ার কোনাে লক্ষণ দেখা গেল না। এর পরের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন অলি আহাদ ; আমাদের অনুরােধে কর্ণপাত না করায় আওয়ামী লীগের কর্মী ও জনগণের ধৈর্যচ্যুতি দেখা দিল। সভামঞ্চে দাঁড়াইয়া আমাদের একনিষ্ঠ তরুণ কর্মী মােহাম্মদ নুরুল ইসলাম মাইক্রোফোন টেস্টিং’ বলা মাত্র মােহাজের সমাবেশের একাংশ ক্ষিপ্ত হইয়া আমাদের উপর ঝাপাইয়া পড়ে ও সভামঞ্চ তছনছ করিয়া ফেলে। লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়া যাইবার কিছুক্ষণের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াই হতভম্ব হইয়া পড়িলেন বটে, তবে ক্ষণিকের মধ্যেই স্বীয় কর্তব্য স্থির করিয়া নিজ হাতে একটি লাঠি ও আমার হাতে একটি লাঠি দিয়া রণক্ষেত্রের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে রওয়ানা হইলেন। আমাদের সহকর্মীরা তখনাে এদিক-ওদিক অর্থাৎ নিরাপদ দূরত্ব হইতে উকিঝুঁকি মারতেছিলেন। সভাস্থলে আমাদের পদার্পণমাত্র জনতা চতুর্দিক হইতে সভামঞ্চের দিকে ধাবিত হইলাে এবং নিমেষের মধ্যে নিজেদের উদ্যোগে সভামঞ্চ পুনরায় নির্মাণ করিয়া ফেলিল।১১ এ ঘটনা থেকে শেখ মুজিবের চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। তিনি ছিলেন উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন, অত্যন্ত সাহসী ও একরােখা। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি তাকে সামাল দিতে হতাে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা এ কে ফজলুল হক ও আতাউর রহমান খানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এ সময় গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ ঢাকায় আসেন। তার নজর কাড়ার জন্য এ দুই বাঙালি নেতার একটা লজ্জাজনক ভূমিকা দেখা যায়।
গভর্নর জেনারেলকে ঢাকা বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে দুজনই হাজির হয়েছিলেন এবং তারা ফুলের মালা হাতে ঘণ্টার পর ঘন্টা রােদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গভর্নর জেনারেল অবশ্য দুজনকেই পুরস্কৃত করেছিলেন। পরে ফজলুল হক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও গভর্নর হয়েছিলেন এবং অন্যজন হয়েছিলের মুখ্যমন্ত্রী।১২ ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানে নতুন সংবিধান চালু হলাে। পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলাে। সংবিধানে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হলেন ইস্কান্দার মির্জা। এর আগেই ৯ মার্চ (১৯৫৬) কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফজলুল হককে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করা হয়েছিল। ২৩ মার্চ প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে গভর্নর হাউসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হলাে। আওয়ামী লীগ এই অনুষ্ঠান বয়কট করেছিল।১৩ | নতুন সংবিধান চালু হওয়ার পর পূর্ব বাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান। মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেন। এসবের মধ্যে ছিল একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘােষণা, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার স্থাপন, রাজবন্দীদের মুক্তি, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের লক্ষ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ সরকারি ছুটি ঘােষণা ইত্যাদি।
এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ১৬ মে (১৯৫৬) ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে এক জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন, ‘দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে বাঁচানাের উদ্দেশ্যে খাদ্য আমদানির জন্য টাকা বরাদ্দের দাবিতে অনশন ধর্মঘট করছেন। যদি তাঁর কিছু হয়, তাহলে বাংলায় আগুন জ্বলবে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে সে দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে।’ ১৯-২০ মে (১৯৫৬) ঢাকার নবাবপুর রােডে মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় খাদ্যসংকট মােকাবিলায় সর্বদলীয় খাদ্য আন্দোলন কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব উঠলে শেখ মুজিবের বিরােধিতার কারণে তা নাকচ হয়ে যায়। তার বক্তব্য ছিল : কোনাে অবস্থাতেই আওয়ামী লীগ খাদ্যসংকট কেন, কোনাে সংকটেই সর্বদলীয় জোট গঠন করে সংগ্রামে যাবে না। আওয়ামী লীগ একা চলবে। অবশ্যই আদর্শ। ও নীতির ক্ষেত্রে জোট বাঁধা চলে। কিন্তু মৌলিক নীতিগত পার্থক্য থাকলে জোট গঠন বরং দলের জন্য অভিশাপ ডেকে আনে। যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আমরা চরম অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।১৪ এই কাউন্সিল সভায় পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং সিয়াটো ও সেন্টো থেকে পাকিস্তানের সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়। সােহরাওয়ার্দী এই প্রস্তাবের এতটাই বিরােধী ছিলেন যে প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের ডেকে নিয়ে তিনি বকুনি দিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে সরকার বদলের পালা চলছিল। আওয়ামী লীগ ফজলুল হকের আশীর্বাদপুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা দেওয়ার তােড়জোড় করে। আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ভগ্নাংশ থেকে অনেক সদস্য আওয়ামী লীগে যােগ দেন। ৩০ আগস্ট (১৯৫৬) আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। ৬ সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের নেতা আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী হন এবং মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রিসভায় আবুল মনসুর আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। এটাও ছিল একটা জোট সরকার। আওয়ামী লীগ ছাড়াও গণতন্ত্রী দল, কফিলউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক পার্টির একটি উপদল, জাতীয় কংগ্রেস ও ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি (ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গ্রুপ) জোট সরকারের অংশীদার ছিল।
 ঢাকায় মন্ত্রিসভা গঠন করেই মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ২১ দফার অঙ্গীকার অনুযায়ী জননিরাপত্তা আইন বাতিল করেন এবং বিনা বিচারে আটক। সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তির আদেশ দেন। ৮ সেপ্টেম্বর (১৯৫৬) তিনিমন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত থেকে মুক্তি পাওয়া ৫৯ জন রাজবন্দীকে স্বাগত জানান।১৫ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলী পদত্যাগ করলে ১২ সেপ্টেম্বর (১৯৫৬) ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে এক গােপন সমঝােতায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে। মির্জার পৃষ্ঠপােষকতায় গড়ে ওঠা রিপাবলিকান পার্টির সমর্থনে মাত্র ১৩ জন সদস্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।১৬
আওয়ামী লীগ এত দিন ছিল বিরােধী দল। সরকার গঠন করে দলটি নিত্যনতুন। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সরকার ও দল যে এক বিষয় নয়, এটা অনেকে বুঝতে চাননি। কখনাে কখনাে সরকার দলের ওপর খবরদারি করে, আবার কখনাে-বা দল সরকারের ওপর। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এই বাস্তবতার মুখােমুখি হলাে । মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের অভিজ্ঞতা ছিল এ রকম : মন্ত্রিত্ব গঠনের কয় দিন পর মওলানা ভাসানী ঢাকায় এসে আমাকে তলব করলেন। টেস্ট রিলিফের কাজে মজুরদের যে হারে মজুরি দেওয়া হচ্ছে, তা অত্যন্ত অসংগত। সরকারি কর্মচারীদের বলেছিলেন বাড়িয়ে দিতে, তারা কথা শােনে না।
বললাম, তারা পারে না। অসুবিধাও আছে। নীতি সম্পূর্ণ বদলাতে হবে। আইনও বদলাতে হবে। বদলান। কিন্তু এর বিরুদ্ধে এত দিন বক্তৃতা করেছেন, তীব্র নিন্দা করেছেন সরকারের। আর আপনার সরকারের বেলায় চুপ করে বসে আছেন। বললাম, জনাব, আমি এসব বক্তৃতা করিনি। অসম্ভব কথা বলা আমার অভ্যাস নয়। সরকারের নিন্দা করেছি, সমালােচনা করেছি, যা আমি ক্ষমতা পেলেও করতে পারব না, তা কাউকে করার তাগিদ দিইনি। আপনারা ওসব বলছেন। কাজেই আমারও তার দায়িত্ব গ্রহণ করতেই হবে। বললেন, এখন দরকারবােধে আইনের বিধান বদলান। এর কয়েক দিন পর ছােট্ট একটা চিঠি পেলাম মওলানা সাহেবের। লিখেছেন, পত্রপাঠ অমুক জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটকে অপসারণ করিবেন, নতুবা পদত্যাগ করিব। কোনাে সরকারের আমলে কর্মচারী আমাকে এমন অপমান করে নাই, যাহা আপনার কর্মচারী করিয়াছে। তৎক্ষণাৎ টেলিফোন করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী? তিনি চমকে গেলেন বলে মনে হলাে। বললেন, ‘কিছুই জানি না। আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না, কোথায় তাকে আমি অপমান করেছি।’ কয়েক দিন পর মওলানা ঢাকায় এলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছিল? বললেন, আমি টেলিগ্রাম করেছিলাম, তার ওপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লিখেছেন, মওলানা নিশ্চয়ই আইনের বিধান জানেন না। আমার আদেশই ঠিক। হতে পারে, আপনি আইনের বিধান জানেন না। সব আইনের মালিক আপনারা সবাই আইনজ্ঞ। এরপর দেখব, যাতে আইন জানা লােক পরিষদ সদস্য হয়ে না আসতে পারে।” | প্রশাসন সম্পর্কে আতাউর রহমান খানের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। এখানে তার একটি পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা হলাে : আমলাতন্ত্রের দম্ভ অসাধারণ-পদ, ক্ষমতা ও যােগ্যতার ।
যে যে বিভাগে কাজ করে, সে একটা মূর্তিমান বিশেষজ্ঞ—এক্সপার্ট। তার মতামত অলঙ্ঘনীয়। অথচ দেখা গেছে উচ্চাঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা অক্ষম। কিন্তু তা মানতে রাজি নয়। যাহােক, একটা কিছু টাইপ করে গুছিয়ে নম্বর দিয়ে লিখে আনলেই জনগণের যারা প্রতিনিধি, তারা স্বীকার করে নেবে। তারা চোঙা ফুকে অকারণে জিন্দাবাদ সংগ্রহ করে করে মন্ত্রী হয়ে বসেছে, আসলে কিছু জানা নেই। কাজেই মুরব্বিয়ানা করা চলে।১৮ মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ওজারতির তিক্ত অভিজ্ঞতার এখানেই শেষ নয়। প্রায় প্রতিদিনই নিত্যনতুন আবদার আর আপদের মুখােমুখি হতে হয়েছিল। তাকে। তার আরেকটি অভিজ্ঞতা এ রকম :
এক জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি এলেন বিশেষ কয়টি অভিযােগ নিয়ে। থানার দারােগা এক ডাকাতি মামলায় ইচ্ছামতাে তদন্ত করেছে। তিনি যে পরামর্শ দিলেন, দারােগা তা শুনল না। বললাম, তার কাজে আপনি হাত দিতে গেলেন কেন? তার কাজে এটি বা অবহেলা দেখলে তার ওপরওয়ালার কাছে অভিযােগ করবেন। তা না করে আপনি গেলেন থানায়?
যাব না? তাহলে আর পরিষদের সদস্য হয়ে লাভ কী? এটা ইস্তফা দিয়ে দিই? এর কিছুদিন আগে এরই দস্তখত করা প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী সভার একটি। প্রস্তাবের নকল আমার হাতে পড়ে। অতঃপর সরকারের বিভিন্ন বিভাগে যেসব পদ খালি হবে, তা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দ্বারা পূরণ করা হােক। প্রস্তাব। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান শুধু দলই নিয়ন্ত্রণ করতেন না, সরকারেও তার প্রভাব ছিল অপরিসীম। আতাউর রহমান খান দলের সিনিয়র সহসভাপতি এবং সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হলেও শেখ মুজিব তাকে খুব একটা মেনে নিতে পারেননি। একটি ঘটনার বর্ণনা দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন এ এইচ এম শামসুদ্দোহা। মুসলিম লীগ সরকারের সময়ই তিনি ওই পদে বহাল হন। তখন তিনি বিরােধী দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্মম আচরণ করতেন বলে অভিযােগ। ছিল। প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরপরই শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নিলেন, শামসুদ্দোহাকে সরাতে হবে। কিন্তু বিষয়টা মুখ্যমন্ত্রীর এখতিয়ারে। পরে একদল সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ করার সময় শেখ মুজিব বর্ণনা করেছিলেন, তিনি কীভাবে শামসুদ্দোহাকে সরিয়েছিলেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের (এপিপি) প্রতিনিধি আমানউল্লাহ এবং ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির (এনা) সম্পাদক হাসান সাঈদ।
শেখ মুজিব যা বলেছিলেন : আতাউর রহমান কি ডিসিশন নিতে পারে? আমি তার কামরায় ঢুইকাই চেয়ারগুলা সরাইয়া নিতে বললাম। আতাউর রহমান সাহেবরে কইলাম, যা কওয়ার আমি কব, আপনে চুপ থাকবেন। দোহারে ডাকলাম। সে আইস্যা দেহে ঘরে কোনাে চেয়ার নাই। সে বুঝতে পারছে। ঝানু অফিসার ছিল তাে। দাঁড়াইয়া একটা স্যালুট দিল। আগে তাে কইত মজিবর । এহন স্যালুট দিয়া স্যার কইল। কতক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকল। আমি কইলাম, দোহা সাহেব, এইহানে তাে অনেক দিন আমাদের খেদমত করলেন, এহন কয় দিন করাচি গিয়া থাহেন। ওইহানে আপনার অনেক আপনজন আছে না? দোহা আতাউর রহমানের দিকে চাইয়া কইল, স্যার কী বলেন? আমি কইলাম, আমি যা কইছি, এইডা উনারই কথা। তারপর কড়া কইরা কইলাম, যান। দোহা মন খারাপ কইরা চইলা গেল।(২০) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা এবং দলীয় পদে থাকার বিধান ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। সাংগঠনিক কিছু বিষয়ে মতভেদ দেখা দেওয়ায় তিনি মন্ত্রিসভা গঠনের এক দিন আগে সভাপতি মওলানা ভাসানীকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘অসুস্থতার কারণে আমার পক্ষে আপনার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়। আশা করি, এই চিঠিটি আপনি আমার পদত্যাগপত্র হিসেবে বিবেচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রহণ করবেন, তা না হলে সংগঠনের ক্ষতি হবে। তাঁর এই ‘পদত্যাগ কার্যকর হয়নি। শেখ মুজিব আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় যােগ দেন এবং বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্য, শিক্ষা, শ্রম ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।  সােহরাওয়ার্দী তার মার্কিনঘেঁষা নীতি সত্ত্বেও কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক গড়ে তােলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে চীন সফর করেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা সফর করেন তার সম্মানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একটি সংবর্ধনা সভার 
৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৫৭) মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে কাগমারীতে আফ্রোএশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ড. কুদরত-ই-খুদা, ড. এস হেদায়েত উল্লাহ, ড. ওসমান গণি, ড. শামসুদ্দিন আহমদ, ড. নুরুল হুদা, ড, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড, কাজী মােতাহার হােসেন, অধ্যাপক এ বি এ হালিম (করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য), ড. মাহমুদ হােসেন, কবি ফয়েজ আহমদ। ফয়েজ, ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবির, লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবােধ কুমার সান্যাল, সুফিয়া ওয়াদিয়া প্রমুখ যােগ দেন। সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইল থেকে কাগমারী পর্যন্ত রাস্তায় কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মাও সেতুং, স্ট্যালিন, ইস্কান্দার মির্জাসহ অনেকের নামে তােরণ তৈরি করা হয়। এসব কাজে প্রচুর টাকা খরচ হয়েছিল। সম্মেলনের অর্থ কমিটির দায়িত্বে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার বন্ধু ও বিশিষ্ট শিল্পপতি সদরি ইস্পাহানী। প্রেসিডেন্ট মির্জার ধনাঢ্য বন্ধুরা খরচের একটা অংশ জোগান দিয়ে থাকতে পারেন। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিবাদ হলে তার সুফল তিনি (মির্জা) পাবেন, এটা অনুমান করা যায়। মির্জার আসল লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে কোণঠাসা করা। ভাসানী যে মির্জার হাতের পুতুলে পরিণত হচ্ছেন, এই সন্দেহ তখন অমূলক ছিল না।২২
আয়ােজন করেছিল। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান চৌ এন লাইকে স্বাগত জানিয়ে একটি মানপত্র পাঠ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে দলের মধ্যে সমালােচনা হচ্ছিল। মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা ডাকেন। ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি সভার তারিখ ঠিক করা হয়। সম্মেলনের আগের দিন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা বসে। মওলানা ভাসানীর অনুরােধে সােহরাওয়ার্দী নির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় অলি আহাদ সিয়াটো ও বাগদাদ চুক্তি থেকে পাকিস্তানের সদস্যপদ প্রত্যাহার করার প্রস্তাব তুললে কেউ তাকে সমর্থন করেননি। ৭
১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর সফর উপলক্ষে ঢাকায় আওয়ামী লীগের দেওয়া সংবর্ধনা সভায় মানপত্র পাঠ করছেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। বাঁয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাসানী পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্যনীতি
কার্যকর না হলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলবে। এর অর্থ হলাে, | পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে না।
মারী সম্মেলনটি এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যখন সােহরাওয়ার্দী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর’ নিয়ে আলােচনার জন্য জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধিকে একটি বিশেষ অধিবেশন আয়ােজন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেসব দেশের সরকার সােহরাওয়ার্দীর বিদেশনীতির সঙ্গে একমত নয়, ভাসানী বেছে বেছে তাদের এই সম্মেলনে দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন, যদিও তারা সম্মেলনে যােগ দেননি। কাগমারী সম্মেলনে শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অলি আহাদের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ চেষ্টা করেছিল। তাদের প্রকাশ্য যুক্তি ছিল, শেখ মুজিব একই সঙ্গে মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক থাকতে পারেন না। তারা আশা করেছিলেন, হয়তাে মন্ত্রীর লােভনীয় পদটি তিনি ছাড়বেন না; বরং দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটিই ছেড়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক হওয়া সহজ হবে। ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ অলি আহাদ ভাসানীর সঙ্গে টাঙ্গাইলে দেখা করেন। রাতে ভাসানী তার হাতে একটি পদত্যাগপত্র দিয়ে সেটি দৈনিক সংবাদ এর সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীর কাছে পৌছে দিতে বলেন। পদত্যাগপত্রটি এখানে উদ্ধৃত করা হলাে :
জনাব পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি সাহেব, ঢাকা আরজ এই যে, আমার শরীর ক্রমেই খারাপ হইতেছে এবং কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এইবার খুলিতে হইবে, তদুপরি আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার লিডার সদস্যদের কাছে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব ২১ দফা ওয়াদা অনুযায়ী জুয়া, ঘােড়দৌড়, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি হারামি কাজ বন্ধ করতে, সামাজিক ও ধর্মীয় বিবাহ বন্ধনের ওপর ট্যাক্স ধার্য করা জনমত অনুযায়ী বাতিল করিতে আবেদন জানাইয়া ব্যর্থ হইয়াছি। ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটেরও কোনাে প্রতিকার দেখিতেছি না। ২১ দফা দাবি ও অন্যান্য দফা যাহাতে অর্থ ব্যয় খুব কমই হবে তাহাও কার্যকরী করার নমুনা না দেখিয়া আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ হইতে পদত্যাগ করিলাম। আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিয়া বাধিত করিবেন। স্বা: মাে: আবদুল হামিদ খান ভাসানী কাগমারী ১৮-৩-৫৭২৪ শেখ মুজিবের ধারণা হলাে, অলি আহাদ দলের মধ্যে কোন্দলের চেষ্টা করছেন। ভাসানীর পদত্যাগপত্র সাধারণ সম্পাদকের কাছে না দিয়ে কেন জহুর হােসেন চৌধুরীর কাছে দেওয়া হলাে, এই প্রশ্নও উঠল। আওয়ামী লীগের ৫৬ সিমসন রােডের অফিসে ৩০ মার্চ (১৯৫৭) কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযােগে অলি আহাদকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। সভায় কমিটির ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে ৩০ জন উপস্থিত ছিলেন। ৯ জন সদস্য বহিষ্কারের প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইয়ার মােহাম্মদ খান। (কোষাধ্যক্ষ), আবদুল হাই (প্রচার সম্পাদক), আবদুস সামাদ (শ্রম সম্পাদক), সেলিনা বানু (মহিলা সম্পাদক), দবিরউদ্দিন আহমদ (সভাপতি, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ), হাতেম আলী খান, অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ এবং আকবর হােসেন আখন্দ (সভাপতি, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ)। ৫ এপ্রিল নির্বাহী কমিটির সভায় মওলানা ভাসানীকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরােধ জানানাে হয়। সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলােচনা না হওয়া পর্যন্ত ভাসানী পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করবেন না বলে জানিয়ে দেন। ৩১ মে শেখ মুজিব মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৩-১৪ জুন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা ডাকেন। প্রথমে ঢাকার পিকচার প্যালেসে (পরবর্তী নাম শাবিস্তান) এবং পরে গুলিস্তান সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সােহরাওয়ার্দী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিতর্ক হয়।২৫
সম্মেলনে উপস্থিত কাউন্সিলররা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে সােহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি অনুমােদন করেন। ভাসানী আবার ভােটাভুটি দাবি করেন। দ্বিতীয়বার ভােট নেওয়া হলে সােহরাওয়ার্দীর পক্ষে আরও বেশি ভােট পড়ে। তিনি ৮০০ ভােট পান। ভাসানীর পক্ষে মাত্র ৩৫টি ভােট পড়ে। আওয়ামী লীগের কোনাে সম্মেলনে এটাই ছিল ভাসানীর শেষ উপস্থিতি।৬ | যে নয়জন সদস্য এর আগে অলি আহাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করেছিলেন, তারা পদত্যাগ করেন। তাদের জায়গায় নতুন নয়জনকে নির্বাহী কমিটিতে নেওয়া হয়। তাঁরা হলেন জসিমউদ্দিন আহমদ (সিলেট), আমজাদ হােসেন (পাবনা), মুজিবর রহমান (রাজশাহী), দেওয়ান মহিউদ্দিন আহমদ (বগুড়া), রওশন আলী (যশাের), শামসুল হক (ঢাকা), আজিজ আহমদ (নােয়াখালী) ও মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। কমিটির বিভিন্ন পদে কিছু রদবদল হয়। আবদুল হামিদ চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক, জহুর আহমদ চৌধুরীকে শ্রম সম্পাদক, হাফেজ হাবিবুর রহমানকে প্রচার সম্পাদক এবং মেহেরুন্নেসা খাতুনকে মহিলা সম্পাদক করা হয়। মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন। ১৪ জুন আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে একটি জনসভা করে। সভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী ঘােষণা দেন, পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে।২৭।
১৭ জুন (১৯৫৭) এক ঘােষণায় মওলানা ভাসানী ২৫-২৬ জুলাই ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মিসম্মেলন আয়ােজনের কর্মসূচি দেন। ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল গাফফার খান, পাঞ্জাবের মিয়া ইফতেখারউদ্দিন আহমদ, সিন্ধুর জি এম সৈয়দ, বেলুচিস্তানের আবদুস সামাদ আচকজাই এবং পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী অংশ নেন। সম্মেলন পণ্ড করার জন্য আওয়ামী লীগ। ভাড়াটে গুন্ডা ব্যবহার করে বলে অভিযােগ ছিল। সম্মেলনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও মাহমুদুল হক ওসমানীকে সাধারণ সম্পাদক করে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে মওলানা ভাসানী ও মাহমুদ আলী। খান আবদুল গাফফার খান ও মাহমুদ আলী কাসুরী পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ২৯ জন সদস্য ন্যাপে যােগ দেন এবং প্রাদেশিক সরকারের ওপর থেকে সমর্থন। প্রত্যাহার করে নেন।২৮
সম্মেলনের পর ন্যাপ পল্টন ময়দানে একটি জনসভা করে। সভায় বহিরাগত কিছু লােক গােলমাল বাধানাের চেষ্টা চালায়। তারা সভামঞ্চে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে। এক দল ভেঙে অন্য দল করলে নতুন দলের লােকদের হয়রানি করা এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য।২৯ রাজনীতিতে আদর্শের কথা বড় গলায় বললেও ক্ষমতার ব্যাপারটা বরাবর উহ্যই থেকে যায়। নানা ধরনের ইহজাগতিক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা প্রণােদনা হিসেবে কাজ করে। যুক্তফ্রন্টের প্রধান দুই শরিক আওয়ামী লীগ ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির (কেএসপি) মধ্যে তাই শুরু থেকেই টানাপােড়েন ছিল। ওপরে ওপরে ঐক্যের একটা পলেস্তারা থাকলেও ভেতরের গাথুনিটা মজবুত ছিল না। ফলে সমীকরণটা হোঁচট খেত বারবার। আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরলে কৃষক-শ্রমিক পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকারে যােগ দিতে চেয়েছিল। কেএসপির কয়েকজন নেতা এ জন্য সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যােগাযোেগ করেন এবং সােহরাওয়ার্দী রাজি হন। কৃষক-শ্রমিক পার্টির সঙ্গে জোট করার ব্যাপারে শেখ মুজিবের ঘােরতর আপত্তি ছিল। বিষয়টি কেএসপি নেতা বি ডি হাবীবুল্লাহর ছেলে আমানউল্লাহর নজর এড়ায়নি। তিনি একটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং বাকিটা শুনেছিলেন তার বাবার কাছে। আমানউল্লাহ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এভাবে : এটা ইন্টারেস্টিং, ইনভলভিং সােহরাওয়ার্দী অ্যান্ড ফজলুল হক, অ্যান্ড মাই ফাদার। অন্য আরও ছিল। শেরেবাংলা তখন গভর্নর। তখন সােহরাওয়ার্দীর দিক থেকে একটা প্রস্তাব এল যে, আমাদের মধ্যে যে ডিফারেন্সেস, এটা আমরা সর্ট আউট করে ফেলব। লেট আস ডিসকাস। এইদিক থেকে একটা আগ্রহ ছিল, পাওয়ারে যাবে। এদের সবার তাে ক্ষমতার লিঙ্গা! আমার বাবা হতে আরম্ভ করে সবাই । আদর্শবাদ, ওই কিনা, কমিউনিস্ট লিডার মণি সিং, ওইসব এরা কেউ মণি সিং ছিল না। একটা প্রস্তাব এল। সােহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন, আমি তাে এই স্টেজে ঢাকা আসতে পারতেছি না। সুতরাং তােমাদের একটা ডেলিগেশন পাঠাও।
আমরা আলােচনা করি। লেট আস ট্রাই টু সর্ট আউট আওয়ার ডিফারেন্সেস অ্যান্ড ইউনাইট। শেরেবাংলা তখন বেশ বুড়াে। কিন্তু মাথায় বুদ্ধি…! আমার বাবা, মােহন মিয়া, নান্না মিয়া কেএসপি লিডাররা গভর্নর হাউসে পরামর্শ করতে গেল বিফোর লিভিং ফর করাচি। আমার বাবার সঙ্গে আমিও গেলাম, আউট অব কিউরিয়সিটি। আমি কথাবার্তা শুনেছি। শেরেবাংলা সাধারণত কথা বলতেন বরিশালের কথ্য ভাষায়। বললেন, ‘হােনাে, সােবরায়ার্দীরে তােমরা চেনাে না। আমি চিনি। তারে দেখছি। ধুরন্ধর, এক্কেরে ধুরন্ধর । অর লগে কথা কইতে গেলে সাবধানে কবা। কী করবা তােমরা?’ তারপর কয়টা পরামর্শ দিলেন, এই এই স্ট্র্যাটেজি। কথা বলবা, কথার মাঝামাঝি জায়গায় তােমরা বলবা যে, আমরা একটু চিন্তা কইরা দেহি স্যার কইয়া সময় নেবা ওই সময় আমারে টেলিফোন করবা। আমি কইয়া দিমু কী করতে অইবে।’ এই তাে ফার্স্ট পার্ট গেল সেকেন্ড পার্টটা ফ্রাসট্রেটিং এইটা। সােহরাওয়ার্দীর ট্যাকটিকসও হইতে পারে। অথবা ন্যাচারালও হইতে পারে মারাত্মক ইতিহাস এইটা ওনারা তাে গেলেন। টপ লিডার যারা, পাঁচ-ছয়জন বােধহয়, ইনকুডিং মাই ফাদার। সমারসেট হাউসে থাকে তখন সােহরাওয়ার্দী ওইখানে মিটিং হবে। কেএসপির নেতৃত্ব দেন সম্ভবত আবু হােসেন সরকার। সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শেখ সাহেবও ছিলেন। আওয়ামী লীগের অন্য লিডাররাও ছিলেন। কিন্তু শেখ সাহেব বেশ ডমিন্যান্ট, অ্যাজ আ স্ট্রং সাপাের্টার অব সােহরাওয়ার্দী  আলােচনা মােটামুটি সাকসেসফুল।
মানে আ কাইন্ড অব এগ্রিমেন্ট ওয়াজ রিড়। সােহরাওয়ার্দী বললেন, এই এগ্রিমেন্টের ভিত্তিতে একটা ড্রাফট করা হােক। কেএসপির লােকেরা ড্রাফট তৈরি করছে। এইটা নিয়া আবার মিটিং করছে সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সােহরাওয়ার্দী শেখ সাহেবকে বললেন, ‘মুজিব দেখাে তাে?’ শেখ সাহেব পড়লেন। তারপর ভাজ কইরা দুই হাতে ছিড়া ফেইলা দিলেন। সােহরাওয়ার্দী বললেন, ‘আই অ্যাম সরি। তবে আর একবার চেষ্টা করতে তাে কোনাে দোষ নাই।’ এরপর কেএসপির লােকেরা কয়, ‘হালার পাে হালা…’ ওই ধরনের রিঅ্যাকশন আর কি…! লাভের মধ্যে এইটা হইল, আসার সময় আমার বাবা করাচি থিকা কিছু ফুটস নিয়া আসছিল, শুকনা বেদানা । বরিশালে গেলেন।
ফল ভাইঙ্গা দেহি, অধিকাংশই খারাপ।৩১ কৃষক-শ্রমিক পার্টিকে নিয়ে সােহরাওয়ার্দী তার ক্ষমতার ভিত মজবুত করতে চেয়েছিলেন। এটা তাকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধা দিত। ওই সময় রিপাবলিকান পার্টি ন্যাপের সঙ্গে একজোট হয়ে পররাষ্ট্রনীতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিটের সমালােচনা শুরু করে দেয়। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা জানতেন, সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী থাকলে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন হবেই। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীর মধ্যে যতই দলাদলি থাকুক না কেন, তারা কেউই একটা সাধারণ নির্বাচনের মুখােমুখি হতে চায়নি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের ভরাডুবি দেখে তাদের মনে হয়েছিল, জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন হলে তাদের জন্য এটা হবে আত্মহত্যার শামিল।৩২। মির্জা পাকিস্তানের সাংবিধানিক অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার মতলব আঁটছিলেন। তিনি একটা সুযােগ পেয়ে গেলেন। তার ইঙ্গিতে রিপাবলিকান পার্টি সােহরাওয়ার্দী সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। সােহরাওয়ার্দী। ১১ অক্টোবর (১৯৫৭) পদত্যাগ করেন। তাঁর মন্ত্রিসভা ১৩ মাস টিকেছিল।
পদত্যাগের আগে জুন মাসে (১৯৫৭) সােহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তান চা-বাের্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। মন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার পর দলের সাধারণ সম্পাদকের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তার একটা নিয়মিত আয়ের দরকার ছিল। এই চাকরির সুবাদে সমস্যার একটা আশু সমাধান হয়। এ সময় তার সঙ্গে পাকিস্তানের ধনী পরিবারগুলাের অন্যতম ইউসুফ হারুনের যােগাযােগ হয়। তারা দুজনই পাকিস্তান গণপরিষদের (পরে নাম হয় জাতীয় পরিষদ) সদস্য ছিলেন। ইউসুফ হারুন পরে তার মালিকানাধীন আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানির ঢাকা অফিসে শেখ মুজিবকে ম্যানেজার পদে বহাল করেন। বেতন মাসে দুই হাজার টাকা। ইউসুফ হারুন শেখ মুজিবের মধ্যে ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক সম্ভাবনা দেখেছিলেন।৩৪। আওয়ামী লীগে ভাঙন এবং কেন্দ্রে সােহরাওয়াদী মন্ত্রিসভার পতনের ফলে। ক্ষমতার পালাবদল চলে দ্রুত লয়ে। প্রেসিডেন্ট মির্জা মুসলিম লীগ নেতা ইসমাইল ইব্রাহিম চুন্দ্রিগড়কে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। চুন্দ্রিগড় দুই মাস টিকে ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে রিপাবলিকান পার্টির নেতা মালিক ফিরােজ খান নুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পূর্ব পাকিস্তানে তখন চলছে ভাঙাগড়ার খেলা। ১৯৫৮ সালের মার্চে প্রাদেশিক আইন পরিষদের ১৯৫৮-৫৯ সালের খসড়া বাজেট উপস্থাপন করা হয়। মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পাটি ও ন্যাপের।
সদস্যরা অতিরিক্ত কর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এককাট্টা হন। তাদের সুরে সুর মেলান। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলাের আওয়ামী লীগের ১১ জন সদস্য। গভর্নর ফজলুল হক ৩১ মার্চ আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করে কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবু হােসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠন করার সুযােগ করে দেন। এতে সােহরাওয়ার্দী খুবই মনঃক্ষুন্ন হন। ওই রাতে তিনি প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নুনকে টেলিফোনে হুমকি দিয়ে বলেন, যদি আধা ঘণ্টার মধ্যে গভর্নর ফজলুল হক ও আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ নুন সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেবে। এই হুমকিতে কাজ হলাে । ফজলুল হক চার ঘণ্টার মধ্য বরখাস্ত হলেন। তার জায়গায় পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি হামিদ আলীকে অস্থায়ী গভর্নর নিযুক্ত করা হলাে। ৩১ মার্চ রাতে ১২ ঘন্টার মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার বিদায় নিলেন। ১ এপ্রিল। আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা পুনর্বহাল হলাে। কিন্তু সংকট চলতেই থাকল। ১৮ জুন একটা প্রস্তাব পরিষদে পাস হলাে না। ১৯ জুন একটি কাটমােশনে’ হেরে যাওয়ার ফলে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভার পতন হলাে। ইতিমধ্যে হামিদ আলীর জায়গায় সুলতান উদ্দিন আহমদ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়েছেন।
তিনি আবু হােসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেন। এ মন্ত্রিসভার আয়ু ছিল তিন দিন। ২১ জুন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। প্রস্তাবটি ১৫৬-১৪২ ভােটে পাস হয়। ২৩ জুন আবু হােসেন সরকার পদত্যাগ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের শাসন জারি হলাে। দুই মাস পর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ঘােষণা দিলেন ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হবে। ২৫ আগস্ট (১৯৫৮) আতাউর রহমান খান আবার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। | প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার আবদুল হাকিমের ওপর আওয়ামী লীগের আস্থা ছিল না। ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পরিষদের অধিবেশনে তুমুল হট্টগােল হয়। স্পিকার অধিবেশন ছেড়ে চলে যান। জাতীয় কংগ্রেস সদস্য পিটার পল গােমেজ স্পিকার আবদুল হাকিমকে বদ্ধ উন্মাদ বলে একটা প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা ভােটে পাস হয়। ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পরদিন ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল চারটায় অধিবেশন আবার বসবে বলে ঘােষণা দিলে পরিষদকক্ষে মারামারি বেধে যায়। শাহেদ আলী কৃষক-শ্রমিক পার্টির সদস্য ছিলেন। হঠাৎ একদিন দল বদল করে তিনি আওয়ামী লীগের কোয়ালিশনে যােগ দেন। বিরােধী দলগুলাের চোখে তিনি তাই হয়তাে বিশ্বাসঘাতক পরিগণিত হয়েছিলেন এবং তাদের ক্রোধের লক্ষ্য হয়েছিলেন।৩৬।
আজিজুল হক শাজাহান ছিলেন এ কে ফজলুল হকের ব্যক্তিগত সহকারী। আইন পরিষদের সভা চলাকালে তিনি গভর্নরের গ্যালারিতে উপস্থিত থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। তার বর্ণনা থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলাে। …সর্বজনাব আবদুস সালাম খান, খন্দকার মােশতাক আহমদ, হাশিম উদ্দিন। আহম্মদ, খালেক নেওয়াজ প্রমুখ ১৪ জন সংসদ সদস্য সরকারি দল থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে। ট্রেজারি বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে অর্থবিল পাস করা অসম্ভব হেতু সরকার চালু রাখা ও সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে অপারগ হওয়ায় ক্ষমতাসীন দল সংসদ অধিবেশনের পূর্বের রাত্রে বাদশাহ গুন্ডার নেতৃত্বে ঢাকার কিছু গুন্ডাকে ‘আর্মস গার্ড’ নাম দিয়ে লালবাগ থানা থেকে পুলিশের খাকি পােশাক পরিয়ে সাইকেলের চেইন হাতে দিয়ে বিরােধী দলের সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দেয়। তৎকালীন পুলিশ বিভাগের প্রধান জনাব মােহাম্মদ ইসমাইলের নেতৃত্বে সংসদ ভবনের মাঝে পুলিশ ঢুকিয়ে দেয়। গুন্ডাদের সাইকেলের চেইনের আঘাতে মােহন মিয়ার পিঠের চামড়াসহ পাঞ্জাবি ছিড়ে রক্ত বের হতে থাকে। আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে উপুড় করে তার পিঠের ওপর চড়াও হয়। নান্না মিয়া, মােহন মিয়া, লতিফ বিশ্বাস, পীর দুদু মিয়া, হাশিম উদ্দিন আহম্মদ প্রমুখকে মেরে বেহুশ করে ফেলা হয়।
আহত হন এম এ মতিন, শহীদুল্লাহ, খালেক নেওয়াজ, বি ডি হাবীবুল্লাহ, মিয়া হাফিজসহ বিরােধীদলীয় বহু সংসদ সদস্য…। চট্টগ্রাম থেকে কংগ্রেসের সংসদ সদস্য দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্তের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তকে বারান্দায় এনে মেরে ফুলের বাগানের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। একমাত্র ইত্তেফাক বাদে অন্য সব পত্রিকার ক্যামেরাগুলাে পিটিয়ে ভেঙে ফেলা হয় ।. এ সময় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর কন্যার বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল…। তিনি শাসক দলের (আওয়ামী লীগ) পক্ষে কাজ করবেন বলে চাপ দেওয়া হলাে ।… পরের দিন সংসদ শুরু হয়। অধিবেশন শুরু হলে শাহেদ আলী স্পিকারের আসনে উপবিষ্ট হলেন। চারদিক থেকে ছি ছি ওঠে, তাকে আসন ত্যাগ করতে বলা হয়। তিনি বসে থাকেন। শুরু হয় লড়াই শুরু হয় তাণ্ডব ঘটনা।…স্পিকার আবদুল হাকিমকে তার কক্ষে আবদ্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। গন্ডগােলের একপর্যায়ে সংসদ সদস্য কোরবান আলী একটা চেয়ারের হাতল ভেঙে সেই হাতলটি মােহন মিয়ার দিকে নিক্ষেপ করেন। ওটা ছুটে আসতে দেখে মােহন মিয়া মাটিতে বসে পড়েন। হাতলটি সােজা এসে বসে থাকা স্পিকারের নাকে লেগে ছিটকিয়ে নিচে পড়ে যায়। আহত অবস্থায় শাহেদ আলী টেবিলে মাথা নিচু করে থাকেন। রক্তক্ষরণ চলতে থাকে, কক্ষে গন্ডগােল চলতে থাকে। একপর্যায়ে। শাহেদ আলী অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে যান। তখন তাঁকে ধরাধরি করে। গাড়িতে করে মেডিকেল কলেজে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসা হয়, কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘােষণা দেন। বলেন, বহুমূত্র রােগী, অনেক রক্তক্ষরণ ও বিলম্বে আনা মৃত্যুর কারণ…।। আজিজুল হক শাজাহানের বিবরণটি একটু একপেশে। আওয়ামী লীগ ও কেএসপি উভয় দলের সদস্যরা মারামারিতে যােগ দিয়েছিলেন। বি ডি হাবীবুল্লাহ ছিলেন কেএসপির এমপি। অন্যদিকে তাঁর ছােট ভাই এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ ছিলেন আওয়ামী লীগের। দুজনই আহত হন।৩৮ 
ঢাকা জেলার কালিয়াকৈরের সংসদ সদস্য শামসুল হক বাদী হয়ে ঢাকার দক্ষিণ মহকুমা হাকিমের আদালতে ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযােগ দায়ের করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন মােহন মিয়া, আবদুল লতিফ বিশ্বাস, নান্না মিয়া, বি ডি হাবীবুল্লাহ, পীর দুদু মিয়া, আবদুল মতিন (পাবনা), শহীদুল্লাহ (মনােহরদী), আবদুল আলীম চৌধুরী, সৈয়দ মােস্তাগাউসুল হক (খুলনা), মিয়া আবদুল হাফিজ (রংপুর), আবু হােসেন সরকার, মাহমুদুন্নবী চৌধুরী (চট্টগ্রাম), আশরাফউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী (কার্তিকপুর)। পরে তারা জামিনে ছাড়া পান।৩
এদিকে করাচিতে শুরু হয় অন্য খেলা প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নুনকে আওয়ামী লীগের কয়েকজনকে মন্ত্রিসভায় নিতে বলেন। সােহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী না রাখায় আওয়ামী লীগের নেতারা প্রথমে মন্ত্রিত্ব নিতে রাজি হননি। সােহরাওয়ার্দী পরে প্রেসিডেন্ট মির্জার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরউদ্দিন, নুরুর রহমান, দিলদার আহমদ, আদেলউদ্দিন আহমদ, আব্দুর রহমান খান এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক কংগ্রেসের পিটার পল গােমেজ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কৃষক-শ্রমিক পার্টির হামিদুল হক চৌধুরী ফিরােজ খান নুনকে সমর্থন করলে তাকে অর্থমন্ত্রী করা হয়। আমজাদ আলীকে আগেই অর্থমন্ত্রী করা হয়েছিল। এ নিয়ে সমস্যা হলাে। ফিরােজ খান নুন ৭ অক্টোবর (১৯৫৮) মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাস করলেন। আওয়ামী লীগ সদস্যদের কয়েকটা গুরুত্বহীন মন্ত্রণালয় দেওয়া হলাে। এর প্রতিবাদে তারা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন।৪০ রাতে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারি করেন। সাঙ্গ হলাে সংসদীয় গণতন্ত্রের পিচ্ছিল পথে হাঁটাহাঁটি, এক দশকের চড়াই-উতরাই।
সামরিক শাসন হঠাৎ করে আসেনি। এর পরিকল্পনা চলছিল অনেক দিন ধরেই। সামরিক আইন জারির বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই জানত। প্রেসিডেন্ট মির্জা অভ্যুত্থানের চার দিন আগেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস ল্যাংলিকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন এবং সামরিক সরকার গঠিত হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি যাতে নতুন করে না চাইতে হয়, এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। ৪ অক্টোবর রাত দুটোয় রাষ্ট্রদূত ল্যাংলি ‘নাইট অ্যাকশন’ নামে ওয়াশিংটনে একটা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বার্তাটি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে পৌছে সকাল ৬.৪২ মিনিটে। বার্তায় ল্যাংলি লিখেছিলেন : মির্জা সম্ভবত এক সপ্তাহের মধ্যেই সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে নেবেন এবং সামরিক আইন জারি করবেন। সংবিধান স্থগিত করা হবে এবং নতুন সংবিধানের জন্য একটা কমিশন গঠন করা হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারির (১৯৫৯) নির্বাচন হবে না । জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন। সঙ্গে থাকবেন পূর্ব পাকিস্তানে তার সহকারী জেনারেল ওমরাও খান। এ দুজন এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল মুসা, তারাই হলেন উল্লেখযােগ্য ব্যক্তি যারা প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনাটা জানেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খান যখন দেশের দখল নিচ্ছেন, শেখ মুজিব তখন আকাশে, প্লেনে ঢাকার পথে। কী ঘটে গেল, তিনি জানতেও পারলেন না। ৮ নভেম্বর সকালে ঢাকায় পৌছে খবরের কাগজ পড়ে তিনি জানতে পারলেন, দেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য তৈরি হলেন।৪২ 
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন, আবার কেউ কেউ থেকে গেছেন আড়ালে। যার শ্রম, মেধা, বিত্ত ও ত্যাগের ওপর ভিত্তি করে দলটি দাঁড়াতে পেরেছিল, তিনি হলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মােহাম্মদ খান। তাকে নিয়ে খুব একটা লেখালেখি হয়নি। ওই সময়ের বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতি বর্ণনা করেছেন তার স্ত্রী বেগম জাহানারা খান, যা দিয়ে ইতিহাসের একটা পর্বের মালা গাঁথা যায় :
বুড়া মানুষ (মওলানা ভাসানী), খুব খারাপ লাগত, বাসায় আসত। আমিও থাকতে কইলাম । রাজনীতিও করি না, এগাে সেবা করছি আর কি। পাকিস্তানি লিডাররা আসত। মাহমুদ আলী কাসুরী, মাহমুদুল হক ওসমানী, অনেকেই আসত ভাসানী সায়েবের কাছে। উনি আবার আমারে ডাকত, ‘মা, এদিকে আয়।’ পরিচয় করাইলেন। হক সায়েবকে, সােহরাওয়ার্দী সায়েবকে, তাদের সবাইকে দেখছি আর কি।
অফিস (আওয়ামী লীগ অফিস) একতলায় ছিল, আমি তিনতলায়। দোতলা ভাড়া ছিল। ওই যে, মুজিবর রহমান খান, আজাদ এর এডিটর ছিলেন, তিনি ভাড়া থাকতেন। | শেখ সাহেব তাে একতালা থেইক্যাই বলত, আজকে আমরা চারজন, পাঁচজন। বড় বড় কড়াই ভইরা তরকারি থাকত। বুয়ারে খালি কইতাম ভাত
বসা। সব খাইত, হইচই করত। অনেক বছর তাে ছিল ওই রকম। শামসুল হকও আইত, জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। আফিয়ার (শামসুল হকের স্ত্রী) সাথে তাে আমার আলাদাভাবে পরিচয়, বার্মায় । আমরা বার্মায় ছিলাম। পরে একসঙ্গে ঢাকায় ইডেন কলেজে পড়ছি। তারপর একদিন শেখ সাহেব এল। কয়, “এহন কী করি, ওরা (শেখ মুজিবের পরিবার) চইলা আসছে। চইলা আসছে তাে কী করি মানে? লেখাপড়া করবে না ওরা? দেশে পইড়া থাকব সারা জীবন? বাসা করেন, বাসা কইরা রাখেন। পড়াশােনা তাে করাইবেন। নাজিরাবাজারে (ইয়ার মােহাম্মদ খান) বাসা ভাড়া কইরা ওদের রাখল। কিছুদিন পর আবার এল । শেখ সাবের ওয়ারেন্ট বাইর হইছে। তাে ওয়ারেন্ট বাইর হইছে, ধরা দেন, চুরি-ডাকাতি তাে করেন নাই। তার পরে গেল, ধরা দিল। বউরে কইল, “তুমি দেশে চইলা যাও। তুমি কী করবা?” তার পরে শেখ সাবের বউ আসছে। কয়, “আমারে একটু দেখা করান। তারপর তাে পারমিশন নিয়া দেখা করাইতে নিয়া গেল, জেলগেটে। গেছে পরেই (ইয়ার মােহাম্মদ খানকে) ভেতরে ঢুকাইল। উনি কয়, ‘মুজিবরে দেখতে আসছি।’ ঢুকাইব তাে ওরা বুঝে নাই, ওয়ারেন্ট দেখাইয়া ঢুকাইয়া দিল। থাকল। শেখ সাবের বউ কাইন্দা-টাইন্দা অস্থির। দেখাই করল না। সে মনে করছে, তার সাথে (ইয়ার মােহাম্মদ খান) গেছে দেইখা ধরছে। আসলে যে ওয়ারেন্ট ছিল আগে উনি এইডা বুঝে নাই। বাসায় আইসা কান্না বেচারির। অনেক বুঝাইয়া তার পরে ঠিক করলাম । তারপর তাে দুজন (শেখ মুজিব ও ইয়ার মােহাম্মদ খান) থাকল নয় মাস জেলখানায়। আর শেখ সাবের বউ নাজিরাবাজারের বাসায়। আমি আর আমার দুই দেবর রােজ সন্ধ্যার পরে যাইতাম। দেখাশােনা করতাম। তারপর তাে বাইর হইল, নয় মাস পরে। ইত্তেফাক-এর কথা কইবা না। এই মানিক মিয়া, কত নামীদামি মানুষ! একদিন ভাসানী সায়েব আইসা কয় যে, ‘মা, আমি যে একটা কাম করলাম, তুই তাে রাগ করবি।’ কী করছেন রাগ করব আমি? কয়, “রােজ দেখি একটা সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা লােক বইসা থাকে। ফ্লোরে বসে সবাই পার্টি অফিস, নওয়াবপুরে। আমি (ভাসানী) ডাইকা জিজ্ঞাস করলাম, তুমি কে, কোথেকে আসছ? তখন কইল, আমি বরিশালের, ছােটখাটো পত্রিকায় লেখালেখি করি। তখন সে কয় কি, আমি তাে একটা পত্রিকা বাইর করছি, ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক, পারবা চালাইতে? কইল যে হ্যা চেষ্টা করুম। তারে বাসায় নিয়া আইছি।’ তারপরে নিয়া আইল। নিচের ঘরে থাকে লুঙ্গি পরা, খড়ম পায়ে দিয়া সকালে উঠানে ঘুরত। ওই গাফফার ছিল কাজের ছেলেটা। ওরে কইত, গাফফার, চাইর আনার মুড়ি আর এক কাপ চা আইন্যা দে।’ মানিক মিয়া আনাইয়া খাইত। তখন। ইত্তেফাক সাপ্তাহিক। ভাসানী হইল প্রতিষ্ঠাতা আর আমার সাহেব হইল প্রিন্টার পাবলিশার। হাটখােলা থিকা ছাপা হইত, প্যারামাউন্ট প্রেস। কেমনে যে কী করল মানিক মিয়া, বুঝলাম না। নিজের নামে কইরা ফেলল। সবাই কইল কেইস করেন। কয়, “আমি তাে ছােটলােক হই নাই। কেইস কইরা আবার আমি নিব? দরকার নাই আমার।’ আর রােজ রাতে আমার ডিউটি ছিল, সন্ধ্যার পরে আমি আর আমার দুই দেবর মিলে তিনজন যাইতাম। খবর নিতাম। এক
দিন গেলেই ওর (কামালের) মা কইত, আজকে একটু ইলিশ-পােলাও রান্ধি?’ বলতাম রান্ধেন। খুব মজার রানত ইলিশ-পােলাও। খাইয়া-দাইয়া আসতাম। আতাউর রহমান খান কোনাে ফকিরের কাছে গেছে, পীরের কাছে। পীর দেখাইয়া আসার পর ইয়ার মােহাম্মদ খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘পীরের কাছে গেলেন যে, কী খবর?’ আতাউর রহমান খান বললেন, ‘পীর বলছে হীরা পইরা দেখতে, সম্ভাবনা আছে (মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার)।’ তারপর (ইয়ার মােহাম্মদ খান) আঙুল থিকা আংটি খুইলা দিল। তখনকার প্লাটিনাম সেট করা আংটি, পাশে আটটা হীরা, মাঝখানে একটা বড় হীরা। পাকিস্তানের প্রথম দশকের রাজনীতি ছিল নানান ঘটনাপ্রবাহে টালমাটাল। সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত ছিল দুর্বল এবং নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ানাে নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযােগ ওঠে। এই প্রেক্ষাপটেই জারি হয় সামরিক শাসন।

সূত্রঃ   আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!