You dont have javascript enabled! Please enable it!
যুক্তফ্রন্ট
পাকিস্তানের রাজনীতিতে চলছিল ভাঙাগড়ার খেলা। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অস্থিরতা ও ধারাবাহিকতা না থাকার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করেন। বগুড়ার মােহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মােহাম্মদ আলী যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং মার্কিনপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ পান, সেদিন সােহরাওয়ার্দী ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা করার সময় তার প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে স্বাগত জানান। অন্যদিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের নিন্দা করে এই আদেশকে অবৈধ বলে উল্লেখ করেন। ১৯৫৩ সালের প্রথম দিকে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক এবং অন্য রাজনৈতিক নেতারা কারাগার থেকে মুক্তি পেতে শুরু করেন। শামসুল হক অসুস্থ থাকায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে থাকেন। দলের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই ঢাকার নবাবপুর রােডে মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে বেশ দলাদলি হয়। অনেকেই এই পদে শেখ মুজিবকে চাইতেন না। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং শেখ মুজিবকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি তৈরি হয়।
অন্যান্য পদে নির্বাচিত ব্যক্তিরা ছিলেন আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান ও খয়রাত হােসেন। (সহসভাপতি), কোরবান আলী (সাংগঠনিক সম্পাদক), আবদুর রহমান (প্রচার সম্পাদক), মুহম্মদুল্লাহ (দপ্তর সম্পাদক) ও ইয়ার মােহাম্মদ খান (কোষাধ্যক্ষ)। মওলানা ভাসানী কমিটিতে ২৩ জন সদস্যকে মনােনীত করেন। তাঁরা হলেন মুজিবুর রহমান ও শামসুল হক (রাজশাহী), মশিউর রহমান, আবদুল হাই ও আবদুল খালেক (যশাের), ডা. মাজহার উদ্দিন আহমদ (রংপুর), ক্যাপ্টেন। মনসুর আলী ও সৈয়দ আকবর আলী (পাবনা), রহিমুদ্দিন আহমদ (দিনাজপুর), মজিবর রহমান ও আকবর হােসেন আখন্দ (বগুড়া), জহুর আহমদ চৌধুরী ও আবদুল আজিজ (চট্টগ্রাম), আবদুর রহমান খান ও আবদুল বারী (কুমিল্লা), জসিমউদ্দিন আহমদ (সিলেট), সিরাজুদ্দিন আহমদ (নােয়াখালী), এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ ও আবদুল মালেক (বরিশাল), আবদুল হামিদ (ময়মনসিংহ), আছমত আলী খান (ফরিদপুর), খােদা বক্স (টাঙ্গাইল) ও শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা)। ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে অলি আহাদ আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগ দেন। ১৯৫৪ সালের ১ এপ্রিল কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আবদুর রহমানকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং তার জায়গায় অলি আহাদ প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এ সময় এ কে ফজলুল হককে নিয়ে একটু নাটক হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান। সরকারের অ্যাডভােকেট জেনারেলের পদে চাকরি করতেন। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি কোনাে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিলেন না। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি অ্যাডভােকেট জেনারেলের পদ ছেড়ে দিয়ে মুসলিম লীগে যােগ দেন। মুসলিম লীগে তখন দলাদলি চরমে উঠেছে। নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে মােহন মিয়া একটা উপদল তৈরি করে ফজলুল হককে মুসলিম লীগের সভাপতি করতে চেয়েছিলেন।
১৯৫৩ সালের ৯ মে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় মুসলিম লীগের দুই গ্রুপে মারামারি হয়। নুরুল আমিনের গ্রুপ জয়ী হয় এবং মােহন মিয়া তার দলবলসহ বিতাড়িত হন। শেখ মুজিব তখন ফজলুল হককে আওয়ামী লীগে যােগ দিতে অনুরােধ করেন। চাঁদপুরে এক জনসভায় তিনি যােগদান করলেনও। সভায় তিনি ঘােষণা দিলেন, ‘যারা চুরি করবেন তারা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যারা ভালাে কাজ করতে চান তারা আওয়ামী লীগে যােগদান করুন। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের পাঁচ বছরের মেয়াদ ১৯৫২ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি নিশ্চিত হয়ে যায় যে শিগগিরই পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফজলুল হক তার জন্য তৈরি হলেন। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই তিনি কৃষক-শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) গঠন করেন। এটা ছিল কৃষক-প্রজা পার্টিরই রূপান্তর । জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার ফলে প্রজা শব্দটি রাখার আর কোনাে কারণ ছিল না। কৃষক-শ্রমিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক হলেন আবদুল লতিফ বিশ্বাস।  আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও কৃষক-শ্রমিক পার্টি একসঙ্গে নির্বাচনী জোট বাঁধবে, এমন চিন্তাভাবনা করছিলেন কেউ কেউ। ফজলুল হককে বলা হলাে, তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে আওয়ামী লীগের নেতা হবেন, সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গণপরিষদের নেতা থাকবেন। কেউ কেউ ফজলুল হককে বােঝালেন, আলাদা দল করে যুক্তফ্রন্ট করলে সুবিধা হবে, আওয়ামী লীগে গেলে তাকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হবে না। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্ট করার পক্ষে ছিলেন না।
ভাসানী শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, ‘যদি হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন, তবে তাকে গ্রহণ করা হবে। এবং উপযুক্ত স্থান দেওয়া যেতে পারে। আর যদি অন্য দল করেন, তবে কিছুতেই তার সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করা চলবে না। যে লােকগুলাে মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছে, তারা এখন হক সাহেবের কাধে ভর করতে চেষ্টা করছে।’ এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৩ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল সভা বসে। সভায় সােহরাওয়ার্দীও উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিবের শেষ প্রস্তাব ছিল, ‘ইলেকশন এলায়েন্স করা যেতে পারে। যেখানে হক সাহেবের দলের ভালাে লােক থাকবে, সেখানে আওয়ামী লীগ নমিনেশন দেবে না। আর যেখানে আওয়ামী লীগের ভালাে লােক থাকবে, সেখানে তারা নমিনেশন দেবে না।  শেখ মুজিবকে না জানিয়েই শেরেবাংলা ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানী দস্তখত করে যুক্তফ্রন্ট করে ফেলেন। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট তৈরি হয়। ফ্রন্টের প্রধান দুই শরিক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান কৃষক-শ্রমিক পার্টি ছাড়াও ফ্রন্টে পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফতে রব্বানী পার্টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সােহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের সভাপতি মনােনীত হন। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির কফিলউদ্দিন চৌধুরীকে যুগ্ম সম্পাদক এবং কামরুদ্দিন আহমদকে দপ্তর সম্পাদক করা হয়। ঢাকার ৫৬ নম্বর সিমসন রােডে যুক্তফ্রন্টের অফিস খােলা হয়। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে একটা ২১ দফা কর্মসূচি তৈরি করেন আবুল মনসুর আহমদ। ২১ দফা রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন তিনি এভাবে : যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতাহার রচনার ভার আমার ওপরই পড়ে। আমি ইতিপূর্বেই আওয়ামী লীগের ৪২ দফার একটি নির্বাচনী ইশতাহার রচনা করিয়াছিলাম। উহাকেই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতাহার করিবার কথা মওলানা সাহেব বলিলেন। কৃষক-প্রজা পার্টির নেতারা বলিলেন তাদের একমাত্র আপত্তি এই যে ঐ ইশতাহারে দফার সংখ্যা বড় বেশি। উহাকে কাটিয়া-ছটিয়া পঁচিশত্রিশের মধ্যে আনিতে হইবে। তাদের সঙ্গে আলােচনা করিয়া দেখিলাম যে ৪২ দফাকে কমাইয়া ২৮ দফা করিলেই তাদের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। এরপর বিনা-বাধায় রচনা শেষ করার জন্য আমাকে একলা ঘরে বন্দী করা হইল।
আমি মুসাবিদায় হাত দিলাম। মুসাবিদা করিতে-করিতে হঠাৎ একটা ফন্দি আমার মাথায় ঢুকিল। এটাকে ইন্সপিরেশন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে চিরস্থায়ী করিবার জন্য শহীদ মিনার নির্মাণ, ২১ শে। ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার সেবাকেন্দ্র করার তিনটি দফা আওয়ামী লীগের ৪২ দফায়ও ছিল। এই তিনটি দফাকে যুক্তফ্রন্টের ইশতাহারের অন্তর্ভুক্ত করিতে কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতারা রাজি হইয়াছেন। সুতরাং তা হইবে। তা হইলে যুক্তফ্রন্টের মতেও ২১ শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব-বাংলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কাজেই ২১ ফিগারটাকে কর্মসূচি করিলে কেমন হয়? ৪২ দফা কাটিয়া ২৮ দফা করা গেলে ২৮ দফাকে কাটিয়া ২১ দফা করা যাইবে না কেন? নিশ্চয় করা যাইবে। তাই করিলাম। অতঃপর আমার কাজ সহজ হইয়া গেল। ইতিহাস বিখ্যাত ২১ দফা রচনা হইয়া গেল। ২১ দফা কর্মসূচির ১৯ নম্বর দফায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের একটা পরিষ্কার রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। এই দফায় বলা হয় : লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌম করা হবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় পূর্ব বাংলার সরকারের হাতে আনা হবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।
যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মতাে একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দল। এ কে ফজলুল হক, সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী একটি অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে প্রচারে নামার ফলে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়।  ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সব সময় প্রচার করত, মুসলিম লীগের বিরােধিতা মানেই ইসলামের বিরােধিতা। কথায় কথায় তারা বলত, ইসলাম গেল, ইসলাম ডুবল। এতে সাধারণ মানুষ অনেক সময় বিভ্রান্ত হতাে। ১৯৫৩ সালের ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এ কে ফজলুল হকের উপস্থিতিতে তার অনুরােধে কেএসপি নেতা বি ডি হাবীবুল্লাহ তাঁর ভাষণে মুসলিম লীগের অপপ্রচারের জবাব দিতে গিয়ে একটি গল্প বলেন : ইসলাম মােড়ল নদীতে পড়ে গিয়ে চিকার করতে লাগল-ইসলাম ডােবে, ইসলাম ডােবে। লােকজন তাকে পাড়ে তুলে বলল, তােমার কাছে
কোরআন-কেতাব আছে নাকি? নতুবা তােমার সঙ্গে ইসলাম ডােবে কী। করে? লােকটা বলল, আমার নামই ইসলাম। এ গল্পে জনতা বুঝে গেল কেন মুসলিম লীগ ‘ইসলাম ডুবল’ বলে চিৎকার শুরু করেছে। জনতা আরও শুনতে চাইল।  আবার আমি বললাম, বার্ধক্য হেতু শিকার করতে অপারগ হয়ে বিড়াল এক ভণ্ড পীর সেজে বসে গেছে, কিন্তু ইদুর তবু তার ধারে আসে না। এখন সে কপট অশ্রুপাত করে বলতে লাগল, তােমরা কেন আমার কাছে আসাে না? আমি যে নিরামিষ ধরেছি। দুনিয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে হজে যাব বলে মনস্থ করেছি। তােমাদের সঙ্গে করমর্দন করে পশ্চিমে রওনা হব। এ কথায় ভুলে একটি বেকুব ইদুর কাছে এসে করমর্দনের চেষ্টা করতেই বিড়ালতপস্বী তাকে খপ করে কামড়ে ধরল। বেচারা ইঁদুর একটা বুদ্ধি করে বাঁচার চেষ্টা করে বলল, ভাই, মরার আগে। আমাকে আলহামদু, আরাইতাল্লাজি, আলামতারার যেকোনাে একটা সুরা শােনাও।
কারণ, ওর যেকোনাে সুরা পড়তে গেলেই মুখ খুলতে হয় এবং তাহলে ইদুর ছুটে যায়। অতএব বিড়াল দাঁত খিচুনি দিয়ে পড়ল, কুলহু আল্লাহু আহাদ’—তখন ইদুরের প্রাণ শেষ। ‘আল্লাহুচ্ছামাদ’ বলে তাকে একদম গিলে ফেলল। অতএব লীগ মাথায় পাগড়ি বেঁধে যতই বলুক ধর্মের কথা, একবার খপ্পরে গেলে ওই ইদুর গেলার মতােই গিলবে।” ৮-১২ মার্চ (১৯৫৪) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ‘নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। ২৩৭টি মুসলমান আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা ২২৮টি আসনে জয়ী হন। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩টি, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ৪৮টি, নেজামে ইসলাম ২২টি, গণতন্ত্রী দল ১৩টি ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি ২টি আসনে জয়ী হয়। ৭২টি সাধারণ (অমুসলিম) আসনে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস ২৫টি, তফসিলি ফেডারেশন ২৭টি, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট ১৩টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি ও গণতন্ত্রী দল ৩টি আসন পায়। কমিউনিস্ট পার্টি এ নির্বাচনে মুসলমান ও অমুসলমান মিলিয়ে ৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এই আসনগুলােতে যুক্তফ্রন্ট কোনাে প্রার্থী দেয়নি। নেজামে ইসলাম অবশ্য তিনটি মুসলমান আসনে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছিল। অমুসলমান পাঁচটি আসনে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ সংখ্যালঘু’ প্রার্থী দাঁড় করায়। এ সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণেন্দু দস্তিদার, সুধাংশু বিমল দত্ত, বরুণ রায় ও অজয় বর্মণ—এই চারজন জয়ী হন। ইয়াকুব মিয়া, নগেন সরকার, জমিয়ত আলী ও আবদুল হক হেরে যান। এ ছাড়া আওয়ামী মুসলিম লীগ ও গণতন্ত্রী দলের টিকিটে কমিউনিস্ট পার্টির ১৬-১৭ জন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত সদস্যদের একটা সভা মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।১২ সােহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতে এ সভায় ফজলুল হক সর্বসম্মতিক্রমে যুক্তফ্রন্টের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় আরেকটি প্রস্তাবে পুরােনাে প্রাদেশিক আইনসভার যেসব সদস্য নির্বাচনে হেরে গেছেন, কেন্দ্রীয় গণপরিষদ থেকে তাদের পদত্যাগ দাবি করা হয়।১৩। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ফজলুল হককে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মন্ত্রিসভায় যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। ফজলুল হক শেখ মুজিবের ওপর নানা কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি তাকে মন্ত্রিসভায় নিতে অস্বীকার করেন। ফলে আওয়ামী লীগের কেউ প্রথমে মন্ত্রিসভায় যােগ দেননি। ৩ এপ্রিল তিনজনকে মন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত হয়। তাঁরা হলেন আশরাফ আলী চৌধুরী, আবু হােসেন সরকার ও সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া)। নান্না মিয়া ছিলেন ফজলুল হকের ভাগনে। ১৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগের পাঁচজন প্রতিনিধি নিয়ে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, শেখ মুজিবুর রহমান ও হাশিমুদ্দীন আহমদ। এ কে ফজলুল হক সােহরাওয়ার্দীকে খুবই অপছন্দ করতেন। অখণ্ড বাংলার রাজনীতিতে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। শেখ মুজিব সােহরাওয়ার্দীর খুব অনুগত ছিলেন এবং ফজলুল হকের প্রতি তার তেমন সমীহ ছিল না বলে ফজলুল হক মনে করতেন।
সােহরাওয়ার্দীর ব্যাপারে ফজলুল হকের মনােভাব কিছুটা আঁচ করা যায় প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে। ১৯৬১ সালের ৯ ডিসেম্বর ফজলুল হকের জীবনীকার বি ডি হাবীবুল্লাহ তার একটি পাণ্ডুলিপির জন্য আশীর্বাদ চাইতে গেলে ফজলুল হকের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতায় বিষয়টি উঠে আসে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বি ডি হাবীবুল্লাহ যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। আলাপচারিতার সময় তার ছেলে (পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক) আমানউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে আমানউল্লাহ দুজনের কথােপকথনটি এভাবে বর্ণনা করেছেন : হাবীবুল্লাহ : কেমন আছেন? হক : না, ভালা না। হাবীবুল্লাহ : ভালাই তাে আছেন দেহি। খানটান কী? হক : এই স্যুপ-টুপ এডা ওডা দেয়। হাবীবুহ : ভালাই তাে খান। হক : হাতির কি কলাগাছ না অইলে চলে?
হাবীবুল্লাহ : আপনার অসুবিধা কী? আমি কিছু মনে রাখতে পারি না। এই ধরাে, সােহরাওয়ার্দী যে অনেক অপকর্ম করছে, আমি এগুলা মনে রাখতে চাই, কিন্তু পারি , ভুইল্যা যাই। হাবীবুল্লাহ : এহন আর ওগুলা মনে রাইখ্যা লাভ অইবে কী?
হক : ঠিক কইছ।১৪ যুক্তফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে ফজলুল হকেরও আপত্তি ছিল বলে জানা যায়। তিনি শেখ মুজিবের ওপর নারাজ ছিলেন। কারণ, কিছুদিন আগে শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন বলে তার অভিযােগ ছিল। একদিন বিডি হাবীবুল্লাহ ও তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া ফজলুল হকের কে এম দাস লেনের বাসায় আলাপ করতে যান। তাঁদের সঙ্গে আমানউল্লাহ (বি ডি হাবীবুল্লাহর ছেলে) ছিলেন। তিনি ফজলুল হকের সাথে মানিক মিয়ার আলাপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : শেরেবাংলা বললেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনাে জোট হবে না। সেদিন তাঁর কথার মাধ্যমে তার যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি, তাতে মনে হলাে, এই বৃদ্ধ। নেতা শেখ মুজিবের অতীতের কিছু আচরণের জন্য খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন। মানিক। মিয়া তার রাগ থামানাের জন্য বিনয়ের সঙ্গে অনুরােধ করে যাচ্ছিলেন, তখন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘শেখ মুজিবুর আমার লগে যে বেয়াদবি করছে, হে আর কী কমু।’ অতীতের কোনাে আচরণের অভিযােগে তাকে ইমােশনালি এক্সাইটেড মনে হচ্ছিল। মানিক মিয়া হক সাহেবের রাগ থামাতে বলেছিলেন, ‘মুজিবুর তাে আমনের (আপনার) পােলার মতাে। আমনের নিজের পােলায় যদি কিছু করত, হেইলে আমনে কি হের উপর এ রহম রাগ অইতে পারতেন? আমনে কি আমনের পােলারে মাপ করতেন না?’ মানিক মিয়ার এই কথার পর হক সাহেবের রাগ পড়ে গেল। তিনি বললেন, ‘এহন যাও, দ্যাহাে, হগলডি মিল্লা কী করতে পারাে। তােমাগাে মতাে আমিও তাে চাই হগলডি মিল্লা মুসলিম লীগরে এক্কেরে ডুবাইয়া দেই।’ এ সময় হক সাহেবের ভাগনে কেএসপি নেতা আজিজুল হক নান্না মিয়া এবং আমার বাবা সেখানে ছিলেন। আমি তখন বিএম কলেজের ছাত্র  বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম তাঁর নেতার কাছে।১৫ যুক্তফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে সমঝােতার মূল্য দিতে গিয়ে অনেক আসনে। আওয়ামী লীগকে তার দলের যােগ্য প্রার্থীকেও বসিয়ে রাখতে হয়েছিল। চট্টগ্রামের হালিশহরের একজন শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের এম এ আজিজ শহর আওয়ামী লীগের নেতা তােহফাতুননেসা জানিয়েছেন, ওই আসনে কেএসপির মাহমুদুন্নবী চৌধুরীকে মনােনয়ন দেওয়া হয়েছিল।
শেরেবাংলা ফজলুল হকের তহবিলে বিশ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে নবী চৌধুরী মননানয়ন পেয়েছিলেন।১ বরিশালের কেএসপি নেতা বি ডি হাবীবুল্লাহর মন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল । নবী চৌধুরী ফজলুল হককে টাকা দিয়ে মন্ত্রী হয়ে যান। হাবীবুল্লাহ বাদ পড়েন।১৭ | যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের আগে ও পরে কয়েকটি ঘটনা ঘটে, যার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অনেক। ২৩ মার্চ (১৯৫৪) চন্দ্রঘােনা কাগজের কলে বাঙালি-অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়। এ সময় ফজলুল হক চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়েছিলেন। ৪ মে (১৯৫৪) কলকাতায় এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাগ হয়েছে, কিন্তু বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি আর বাঙালিত্বকে কোনাে শক্তিই কোনাে দিন ভাগ করতে পারবে না; দুই বাংলার বাঙালি চিরকাল বাঙালিই থাকবে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা কালাহান ফজলুল হকের একটা সাক্ষাৎকার নেন এবং তার প্রতিবেদনে ফজলুল হকের বক্তব্যে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের ইঙ্গিত দেন। এই সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ার পর রাজনৈতিক মহলে হইচই পড়ে যায়। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, দেশদ্রোহী’ ফজলুল হককে বরখাস্ত করে পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন চালু করা হবে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের সঙ্গে বােঝাপড়ার জন্য ফজলুল হক করাচি যান। সােহরাওয়ার্দীও কয়েকজন মন্ত্রীকে করাচিতে ডেকে পাঠান।১৯ ফজলুল হকের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, নান্না মিয়া, মােহন মিয়া ও আশরাফ উদ্দিন। চৌধুরী করাচি যান।২০ ২৯ মে (১৯৫৪) ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান। ও নান্না মিয়া করাচি থেকে রাতের প্লেনে রওনা হয়ে পরদিন ঢাকায় পৌঁছান। ৩০ মে বেলা তিনটায় শেখ মুজিব টেলিফোনে জানতে পারেন, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গণপরিষদে গৃহীত অস্থায়ী সংবিধানের ৯২(ক) ধারা প্রয়ােগ করে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন জারি করেছে। কেন্দ্রীয় দেশরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মির্জাকে গভর্নর ও নিয়াজ মােহাম্মদ খানকে চিফ সেক্রেটারি নিয়ােগ করা হয়েছে।২২ সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরােপ করা হলাে।
শেখ মুজিবসহ পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ৩৫ জন সদস্য এবং হাজারের ওপর লােক গ্রেপ্তার হন। এ কে ফজলুল হককে নিজের বাড়িতে অন্তরীণ করা হয়। পুলিশ যুক্তফ্রন্টের ৫৬ নম্বর সিমসন রােডের অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়।  ৯২(ক) ধারা জারি করে প্রাদেশিক সরকার বাতিল করে দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে ৯২(ক) ধারা প্রয়ােগ করে সিন্ধুর আইনসভা বাতিল করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের শুরুতেই গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার বাতিল করে গভর্নরের শাসন জারি করেছিলেন। কেন্দ্রে ও প্রদেশে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ও বিধিবিধানের তােয়াক্কা না করাটা ক্রমেই কেন্দ্রীয় সরকারের একটা অভ্যাসে দাড়িয়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের কাহিনিটি বেশ মজার। তার অনুপস্থিতিতে পুলিশ তার বাড়িতে এসেছিল। তিনি তখন ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, নান্না মিয়া—সবার কাছে দৌড়াচ্ছেন এবং শেষে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে দরকারি কাগজপত্র সরিয়ে নেন। তারপর সরকারি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশায় চড়ে বাসায় ফেরেন। খাবার খেয়ে কাপড়-বিছানা প্রস্তুত করে তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াহিয়া খান চৌধুরীকে ফোন করে বলেন, ‘আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল বােধ হয় আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি, গাড়ি পাঠিয়ে দেন।’ এই পরিস্থিতিতে নেতাদের দোদুল্যমানতা ও কাপুরুষতা দেখে শেখ মুজিব বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হন। তাঁর অনুভূতি ছিল এ রকম : কী করা দরকার বা কী করতে হবে, এই অত্যাচার নীরবে সহ্য করা উচিত হবে কি না, এ সম্বন্ধে নেতৃবৃন্দ একদম চুপচাপ। 
একমাত্র আতাউর রহমান খান কয়েক দিন পরে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন। ৯২(ক) ধারা জারি হওয়ার কয়েক দিন পূর্বে মওলানা ভাসানী বিলেত গিয়েছেন। শহীদ সাহেব (সােহরাওয়ার্দী) অসুস্থ হয়ে জুরিখ হাসপাতালে, আমি তাে কারাগারে বন্দী। নীতিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। দেড় ডজন মন্ত্রীর মধ্যে আমিই একমাত্র কারাগারে বন্দী । যদি ৬ জুন সরকারের অন্যায় হুকুম অমান্য করে (হক সাহেব ছাড়া) অন্য মন্ত্রীরা গ্রেপ্তার হতেন, তাহলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন শুরু হয়ে যেত। দুঃখের বিষয়, একটা লােকও প্রতিবাদ করল না।২৪ ফজলুল হক অন্তরীণ অবস্থায় ২৩ জুলাই (১৯৫৪) রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন। ১১ ডিসেম্বর সােহরাওয়ার্দী জুরিখ থেকে করাচি ফিরে আসেন। তার চেষ্টায় শেখ মুজিব ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের বিরােধিতা সত্ত্বেও সােহরাওয়ার্দী ২০ ডিসেম্বর মােহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী হিসেবে যােগ দেন। যুক্তফ্রন্ট জোড়াতালি দিয়ে করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষ যুক্তফ্রন্টের পেছনে এককাট্টা হলেও আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির মধ্যে বৈরী সম্পর্কের কারণে যুক্তফ্রন্টের আয়ু ফুরিয়ে আসে।
আগে একটা সমঝােতা হয়েছিল যে কেন্দ্রে সােহরাওয়ার্দীকে কৃষক-শ্রমিক পার্টি সমর্থন দেবে এবং প্রদেশে আওয়ামী লীগ ফজলুল হককে সমর্থন দেবে। গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ সােহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেন, মােহাম্মদ আলীর সরকার একটা কেয়ারটেকার সরকার। শিগগিরই সােহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। তবে এখন তাকে আইনমন্ত্রী হয়ে একটা সংবিধান দিতে হবে।২৫ সােহরাওয়ার্দী নয় মাস মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৫ সালের আগস্টে তাকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে হয়।২৬  দলের মধ্যে সােহরাওয়ার্দীর আচরণ ছিল একনায়কসুলভ। ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি মােহাম্মদ আলীর অধীনে মন্ত্রী হয়েছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ আবার কী? আমিই আওয়ামী লীগ। সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করেন, এটা কি আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোবিরােধী না?’ জবাবে সােহরাওয়ার্দী বলেন, ‘আমিই আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো।২৭।  ১৯৫৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে করাচি যান।
এ সময় ফজলুল হকও পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। লাহােরে একজন সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, সােহরাওয়াদী যুক্তফ্রন্টের কেউ নন, তিনিই (ফজলুল হক) নেতা। এটা শুনে শেখ মুজিব খুবই ক্ষুব্ধ হন। সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরামর্শ করে শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন। শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান ও মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ যুক্তফ্রন্টের সংসদীয় দলের নেতা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে। অনাস্থা জানানাের উদ্যোগ নেন। ১৯৫৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক আইন। পরিষদে শেখ মুজিব অনাস্থা প্রস্তাবের নােটিশ দেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের অনেকেই এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের ৩৫ জন পরিষদ সদস্য ফজলুল হকের কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে যােগ দেন। মানিক মিয়া ও আবুল মনসুর আহমদও অনাস্থা দেওয়ার বিরােধিতা করেছিলেন। দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী তখন কলকাতায়। অনাস্থা দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৫৫) প্রাদেশিক আইন পরিষদের স্পিকার ফজলুল হকের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবটি ভােটে দেন। ১১৯-১০৫ ভােটে প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী-ফজলুল হক। দ্বন্দ্বের কারণে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। কৃষক-শ্রমিক পাটি, নেজামে ইসলাম পাটি ও গণতন্ত্রী দল ফজলুল হকের সঙ্গে থাকে। আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের ২০ জন পরিষদ সদস্যের একটি গ্রুপ ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে থেকে যায়। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের বৃহত্তর অংশটি প্রাদেশিক পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংগঠিত হয় ।২৮ | যুক্তফ্রন্ট ভাঙার পেছনে শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে ফজলুল হক মনে করতেন। ১৯৫৪ সালে গােপালগঞ্জে নির্বাচনী লড়াইয়ের কথা স্মরণ করে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন।
তাঁর সহকর্মী বি ডি হাবীবুল্লাহর নিচের উদ্ধৃতিতে এই আক্ষেপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে : যখন দুর্ধর্ষ ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে আওয়ামী দলের সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান দুরন্ত ভােট সংগ্রামে লিপ্ত, তখন বাঁশবাড়ীর সভায় শেরেবাংলা বললেন, ‘আওয়ামী-কৃষক-নেজামে সব এক। মুজিবুর রহমানকে ভােট দিলেও আমি পাব।’ আর মুজিবুর রহমানই যুক্তফ্রন্ট ভেঙে চৌচির করে দিয়েছিল। ২৯ | যুক্তফ্রন্ট ও শেরেবাংলা ফজলুল হক সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মনােভাব পরিষ্কার বােঝা যায় ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া বার্ষিক রিপাের্টে। যুক্তফ্রন্টের ইতিহাস এবং এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন :…পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রিত্বের গদিকে নিষ্কন্টক করবার জন্যে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের তদানীন্তন সদস্য জনাব ফজলুল হককে পূর্ব বাংলা সরকারের অ্যাডভােকেট জেনারেলের চাকরি দিয়ে তাহার পরিষদ সদস্য পদের ইস্তেফাপত্র গ্রহণ করা হলাে। তারপর হতেই জনাব ফজলুল হক সুদীর্ঘকাল মুসলিম লীগ কর্তৃক নিযুক্ত অ্যাডভােকেট জেনারেল হিসেবে অত্যাচারী মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক প্রতিটি অত্যাচার ও অন্যায়কে সমর্থন দিতে গিয়ে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের প্রতি অন্যায় গ্রেফতারাদেশ হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পস মামলায় ন্যায় ও আইনত বলে প্রমাণ করবার কোশেশ করেছেন।
এরূপে পরােক্ষভাবে তিনি নির্বাচনের পূর্বে তাহার পদত্যাগ পর্যন্ত জুলুম শাহীর প্রতিটি কার্যকে আইনের গণ্ডীর ভিতর দিয়ে সমর্থন জুগিয়েছেন। যখন মুসলিম লীগের সরকার গণদাবির চাপে পূর্ববঙ্গ আইন সভার নির্বাচন ঘােষণা করলাে, তখন তিনি অ্যাডভােকেট জেনারেলের চাকরি ছেড়ে রাতারাতি দেশপ্রেমিক বনে, তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন। সরলপ্রাণ জনসাধারণ হক সাহেবের এই রাজনৈতিক চাতুর্যপূর্ণ বিবৃতি দেখে ও শুনে কিছুটা বিভ্রান্ত হলাে। ফল দাঁড়ালাে এই যে তিনি যেখানেই সভা করতেন, সেখানেই বিপুল জনসমাবেশ হতাে। এর কারণস্বরূপ এ কথা বলা যায় যে, সুদীর্ঘ এগারাে বছর পরে তিনি যখন রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হলেন এবং সস্তা জনপ্রিয় বুলি আওড়াতে শুরু করলেন, তখন জনসাধারণ ভেবে নিল যে তিনি তার এই জীবন সায়াহ্নে জনগণের খেদমত করতে করতে জীবনের বাকি কটি দিন বােধ হয় কাটিয়ে দিতে চান। হক সাহেবের সস্তা জনপ্রিয় উক্তিসমূহের জন্যে তাকে সর্ববৃহৎ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে করে জনগণ হক-ভাসানীর মিলন দাবি জানালাে ।… | …নির্বাচনে মনােনয়ন দেয়ার ব্যাপারে যে কিভাবে টাকার ছড়াছড়ি হয়েছিল সে ঘৃণ্য ও কুৎসিত ইতিহাস আমি আলােচনা করতে লজ্জাবােধ করছি।…জনাব হক যখন বরিশাল জেলায় নির্বাচনী প্রচার উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা সফর করছিলেন, তখন তদানীন্তন পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মি, মােহাম্মদ আলীর গােপন আমন্ত্রণ পেয়ে বরিশাল জেলার নির্বাচনী সফরসূচি বাতিল করে তিনি রাজধানী ঢাকার বুকে ফিরে এলেন এবং মি. মােহাম্মদ আলীর সঙ্গে এক গােপন চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন যে, জনাব হক। উত্তরবঙ্গে কোনাে নির্বাচনী প্রচার চালাবেন না এবং হক সাহেবের দলের যে কয়জন লােক নির্বাচনে জয়ী হবে তাদের নিয়ে জনাব হক মুসলিম লীগের বিজয়ী প্রার্থীদের সাথে মিলিতভাবে পূর্ব বাংলায় কোয়ালিশন সরকার কায়েম করবেন। জনাব হকের এই ঘৃণ্য গােপন চুক্তির কথা প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের মুখপত্র দৈনিক ডন কাগজের মারফতে আপনারা অনেকেই হয়তাে জানতে পেরেছেন।
জনাব হক এগারাে বছর পর্যন্ত জনগণের সঙ্গে থেকে দূরে থাকার ফলে এ কথা ভাবতে পারেননি যে যুক্তফ্রন্ট পার্টি এইরূপ ঐতিহাসিক বিজয়ের অধিকারী হবে, এবং তিনি তা ভাবতে পারেননি বলেই মি. মােহাম্মদ আলীর সঙ্গে এরূপ এক গােপন আঁতাত করতে পেরেছিলেন।… সব চাইতে বেশি মূল্য দিতে হলাে আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগের প্রায় বারশত কর্মী ও নেতা এবং প্রায় তিরিশজন সদস্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলাে।…এই সময়ে জনতা জনাব হকের নেতৃত্বের প্রতি একদৃষ্টে তাকিয়েছিল, কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে…তিনি সবকিছু ভুলে গিয়ে মি, মােহাম্মদ আলীর প্রেরিত দূতের মারফতে এক গােপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ব্যক্তি স্বার্থপরতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে…সমস্ত অভিযােগ স্বীকার করে নিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের ললাটে কলঙ্ক লেপন করে রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করলেন।…৩০ ১৯৫৫ সালের ২৮ মে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ গণপরিষদ। অধ্যাদেশ জারি করেন। এই আদেশের বলে পাকিস্তানের দুই অংশ থেকে ৪০ জন করে মােট ৮০ জন সদস্য রাখার বিধান করা হয়। ৩১ মে পাঞ্জাবের মারিতে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ভােটে কেন্দ্রীয় গণপরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৪০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমান খান-শেখ মুজিব গ্রুপের ১৩ জন, আবদুস সালাম খান। গ্রুপের ২ জন, কৃষক-শ্রমিক পার্টির ১০ জন, নেজামে ইসলাম পার্টির ২ জন ও গণতন্ত্রী দলের ২ জন নির্বাচিত হন। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে কেন্দ্রীয় গণপরিষদে মনােনীতি কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র সদস্য ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ থেকে এবং ফজলুর রহমান স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। অমুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৯টি আসনের মধ্যে জাতীয় কংগ্রেস ৪টি, তফসিলি ফেডারেশন ৩টি এবং ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি ২টি আসন পায়। ১৯৫৫ সালের ২ জুন গভীর রাতে পূর্ব বাংলা থেকে ৯২(ক) ধারা প্রত্যাহারের ঘােষণা দেওয়া হয়। ৬ জুন ফজলুল হকের নির্দেশে কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয়। ৮ জুন সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে সােহরাওয়ার্দী বলেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় শেরেবাংলা সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে এবং এই সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলবে। শেরেবাংলা এক মুখে অনেক কথা বলছেন।’ ৫ আগস্ট স্পিকার পদে কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবদুল হাকিম আওয়ামী মুসলিম লীগের মশিউর রহমানকে (যশাের) ১৭০-৯২ ভােটে হারিয়ে দেন। ডেপুটি স্পিকার পদে আওয়ামী লীগের বেগম বদরুন্নেসাকে ১৭১-৯৯ ভােটে হারান যুক্তফ্রন্টের শাহেদ আলী পাটোয়ারী।৩২ কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে সােহরাওয়ার্দীর দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলাের খসড়া তৈরি করা, যার ভিত্তিতে সংবিধান তৈরি হবে। একটি সংবিধানের জন্য সােহরাওয়ার্দী যেকোনাে ধরনের আপস করতে রাজি ছিলেন। অনেক বিতর্কিত বিষয়ে দর-কষাকষির পর একটা পাঁচ দফা নীতিমালার ব্যাপারে গণপরিষদে ঐকমত্য হয়।
এই পাঁচটি নীতি ছিল :
১) পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি ইউনিট করা; ২) দেশের দুই অংশের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন; ৩) দুই অংশের মধ্যে সব বিষয়ে সমতা, যেমন : বৈদেশিক সাহায্য, চাকরি, | উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ; ৪) যুক্ত নির্বাচন-পদ্ধতি; ৫) বাংলা ও উর্দু দুটোকেই রাষ্ট্রভাষা করা। পূর্ব বাংলা দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষের আবাসভূমি হওয়া সত্ত্বেও সমতার নীতিটি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি ছিল। সােহরাওয়ার্দী পশ্চিম। পাকিস্তানি নেতাদের তাদের আন্তরিকতা দেখানাের একটা সুযােগ দিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সব দলের নেতারা এই নীতিমালার ব্যাপারে সম্মতি দেন। পূর্ব বাংলার পক্ষে আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদ সই দেন। ফজলুল হকও পরে স্বাক্ষর করেছিলেন।
সিন্ধু, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানকে এক করে পশ্চিম পাকিস্তান নাম দিয়ে একটি প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে আরেকটি প্রদেশ হবে বলে আলােচনা চলছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লােভে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের আস্থা লাভের জন্য সােহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলার স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সংখ্যাসাম্য’ নীতি চাপিয়ে দিয়েছিলেন বলে সমালােচিত হন। সমতার নীতি ও পশ্চিম পাকিস্তানকে এক ইউনিট হিসেবে গণ্য করার বিষয়টা শেখ মুজিবের পছন্দ হয়নি। পূর্ব বাংলা নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখার ব্যাপারেও তাঁর আপত্তি ছিল। ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে দেওয়া ভাষণে স্পিকারের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন: মহােদয়, আপনি দেখবেন যে পূর্ব বাংলা’ নামের বদলে তারা পূর্ব পাকিস্তান’ বসাতে চায়। আমরা কতবার দাবি জানিয়েছি যে এটা হবে বাংলা।
বাংলার একটা ইতিহাস আছে, এর নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। জনগণের সঙ্গে আলােচনা করেই কেবল এটা বদলানাে যায়। যদি আপনারা এটা পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আমরা বাংলায় ফিরে যাব এবং মানুষকে বলব তারা এটা গ্রহণ করবে কি না।৩৪ শেখ মুজিবের কথায় স্ববিরােধিতা লক্ষ করা যায়। একদিকে তিনি পূর্ব । বাংলা’ নামটি প্রদেশের জন্য বহাল রাখতে চাচ্ছেন, অন্যদিকে তার দল জন্ম থেকেই পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি ব্যবহার করে আসছে। আওয়ামী লীগের নামের আগে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে পূর্ব বাংলা রাখা নিয়ে তেমন কোনাে জোরালাে বক্তব্য কেউ কখনাে দিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিত্যনতুন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল। অসুস্থতার অজুহাতে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদকে ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়। ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব নেন ইস্কান্দার। মির্জা। ছুটিতে থাকা অবস্থাতেই গােলাম মােহাম্মদের মৃত্যু হয়। ইস্কান্দার মির্জা। পাকাপাকিভাবে ক্ষমতায় বসে যান। তিনি মােহাম্মদ আলীকে সরিয়ে পাঞ্জাবের চৌধুরী মােহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। এর আগে সােহরাওয়ার্দীকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। মির্জা কথা রাখেননি। এ ব্যাপারে জেনারেল আইয়ুব খানের হাত ছিল। রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষ নেওয়ার জন্য সােহরাওয়ার্দী আইয়ুব খানের কোপানলে পড়েছিলেন। এ ছাড়াও একটি কারণ ছিল।
মির্জা গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই এ কে ফজলুল হক ঘােষণা দিয়েছিলেন, “মির্জা একজন বাঙালি, যদিও তার গায়ে রাজরক্ত।’ মির্জা মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফরের বংশধর ছিলেন। যেহেতু তিনি বাঙালি, তাই প্রধানমন্ত্রী হতে হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। এই বিবেচনায় চৌধুরী মােহাম্মদ আলীকে নিয়ােগ দেওয়া হলাে। ফজলুল হক মির্জাকে দেওয়া বাঙালিত্বের প্রত্যয়নপত্রের জন্য পুরস্কৃত হলেন। মির্জা তাকে চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ দেন।৩৫ ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গণপরিষদে এক ইউনিট আইন পাস হয়। ফলে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান—এই চারটি প্রদেশ একীভূত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান নামে একটি প্রদেশ তৈরি হয়। সরকারি গেজেট অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৪ অক্টোবর (১৯৫৫)।৩৬
পূর্ব বাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে হলাে পূর্ব পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠীর এই প্রদেশের নেতারা দুটো কাজ করলেন। প্রথমত তারা পশ্চিমের বিচ্ছিন্ন চারটি প্রদেশকে একীভূত করে তাকে প্রবল প্রতিপক্ষ হওয়ার সুযােগ করে দিলেন। দ্বিতীয়ত, সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে নিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানটি বিসর্জন দিলেন। এটা হলাে গাছের ডালে বসে নিজের হাতেই ডালটা কেটে দেওয়া। বাঙালির স্বার্থবিরােধী এই অপকর্মটি হলাে সােহরাওয়ার্দীর উৎসাহে ও সমর্থনে। এ জন্য বাঙালিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।

সূত্রঃ   আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!