You dont have javascript enabled! Please enable it!
ছাত্রলীগের জন্ম
ভারতের মুসলমানের সনাতন মনস্তত্ত্বে ‘উম্মাহ’ ছিল, কিন্তু ইউরােপীয় ধাঁচের আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা ছিল না। দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হলাে পাকিস্তান। ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ পাকিস্তান পেয়ে আবেগে ভেসে গেল। কিন্তু ধর্ম-বর্ণ-গােত্রনির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে সমঅংশীদারির ভিত্তিতে একটা জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন যখন উঠল, তখন দ্বিজাতিতত্ত্বের সঙ্গে এই বাস্তবতার দ্বন্দ্ব সামনে চলে এল। দ্বিজাতিতত্ত্বের লজিকটা তখন আর কাজ করছিল না। | ১৯৪০-এর দশকে মুসলিম লীগ যখন প্রবল প্রতাপে বিরাজমান, তখন মূলধারার বাইরে কিছু কিছু রাজনৈতিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছিল। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলিম লীগের বামধারার কর্মীদের উদ্যোগে ঢাকায় ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এ সংগঠনের আহ্বায়ক মনােনীত হন ঢাকার মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় কর্মী কামরুদ্দিন আহমদ। এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। তারা মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন এবং এ দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিচর্চার চিন্তা করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পরবর্তী কাজ কী হবে তা আলােচনার জন্য কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হােটেলে সমবেত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী), কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লা কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ। তারা পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার জন্য উপযুক্ত সংগঠন তৈরি করা দরকার বলে একমত হন। ঢাকায় এসে তারা কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ, তসন্দুক আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, নূরুদ্দীন আহমদ, আবদুল ওদুদ, হাজেরা মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং রাজনৈতিক কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য একটি সম্মেলন আয়ােজনের ব্যাপারে একমত হন। ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন তখনাে ছিল। কিন্তু কমিউনিস্টদের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে মুসলমান ছাত্ররা তাতে। যােগ দিতে চাইতেন না । ৬ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭) বেলা দুইটায় ঢাকায় খান সাহেব। আবুল হাসনাতের বাসায় তসন্দুক আহমদের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হয়। ৭ সেপ্টেম্বর ২৫ জন সদস্য নিয়ে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের পূর্ব পাকিস্তান সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়।
যুবলীগ শুরুতেই দলাদলির মধ্যে পড়ে। সংগঠনের লক্ষ্য কী হবে, এ নিয়ে সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির সভাতেই মতভেদ দেখা দেয়। সাবজেক্ট কমিটির অন্যতম সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণনায় পাওয়া যায় : আলােচনার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মীও। যােগদান করেছে।…আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা…যাকে ইংরেজিতে বলে কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা। অনেকেই এই মত সমর্থন করল, কিন্তু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন দলটা বলল, আরও প্রােগ্রাম নেওয়া উচিত, যেমন অর্থনৈতিক প্রােগ্রাম। আমরা বললাম, তাহলে তাে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে। অনেক আলােচনার পর ঠিক হলাে, একটা সাব-কমিটি করা হবে, তারা কর্মসূচি প্রণয়ন করবেন এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে তা পেশ করবেন।…কয়েক দিন পর কার্যকরী কমিটির এক সভায় ড্রাফট কর্মসূচি পেশ করা হলাে, যাকে পরিপূর্ণ একটা ম্যানিফেস্টো বলা যেতে পারে। আমি ভীষণভাবে বাধা দিলাম এবং বললাম, কোনাে ব্যাপক কর্মসূচি এখন গ্রহণ করা হবে না। একমাত্র কমিউনাল হারমনির জন্য কর্মীদের ঝাপিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনাে কাজই আমাদের নাই। শেখ মুজিবুর রহমান তখনাে মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগ সদস্যদের একই সঙ্গে অন্য কোনাে রাজনৈতিক সংগঠনে যােগ দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাকে না জানিয়ে কার্যকরী কমিটির এক সভায় কমিটির সদস্যসংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়। ফলে কমিটিতে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়ে যায়। শেখ মুজিব এক সভায় বললেন, মুসলিম লীগের কোনাে কর্মী আপনাদের সাথে থাকবে না। যুবলীগও আজ থেকে শেষ । আপনাদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা আমাদের জানা আছে। ঢাকার মােগলটুলীতে যুবলীগের অফিস ছিল।
শেখ মুজিব এবং তার সমর্থকেরা অফিস থেকে যুবলীগের সাইনবাের্ড নামিয়ে ফেলেন। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার আগেই। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ভারতভাগের পরিকল্পনা ঘােষণা করেন, বাংলাভাগের বিষয়টি তখনই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। জুন মাসের প্রথম দিকেই সংবাদপত্রে খবর বেরােয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন। বেশ কয়েকজন বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী এর বিরােধিতা করে প্রবন্ধ লেখেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মােতাহার হােসেন, আবুল মনসুর আহমদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবদুল হক, ফররুখ আহমদ, আবুল হাশিম প্রমুখ। উর্দুর বিরােধিতা করে এবং বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছিলেন আবদুল হক। বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শিরােনামে তার লেখাটি দৈনিক ইত্তেহাদ-এর রবিবাসরীয় বিভাগে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন দুই কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা শীর্ষক তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ৩০ জুন দৈনিক আজাদ-এ ছাপা হয় । আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দিলে জুলাইয়ের (১৯৪৭) শেষ দিকে তার বিরােধিতা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দৈনিক আজাদ-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।
সুতরাং বলা চলে, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল, তার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। ১ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র ‘তমদুন মজলিস’ নামে নতুন একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু শিরােনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এতে লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক কাজী মােতাহার হােসেন এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ এর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং তমদুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম ভাষা বিষয়ে একটি প্রস্তাব লেখেন। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা, আদালত ও অফিসের ভাষা হবে বাংলা। এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে বাংলা ও উর্দু।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির উত্তাপ ছড়াতে থাকে। মুসলমান ছাত্ররা অনেকেই এত দিন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এর সভাপতি শামসুল হুদা চৌধুরী রেডিও পাকিস্তানে চাকরি নেন। সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মুখমন্ত্রী (অখণ্ড বাংলায় বলা হতাে প্রধানমন্ত্রী) খাজা নাজিমুদ্দিনের অনুসারী ছিলেন। কাউন্সিল সভার মাধ্যমে এই সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা তেমন ছিল না। কলকাতার মুসলিম লীগের সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের অনুসারী তরুণ ও ছাত্ররা নতুন একটি ছাত্রসংগঠন তৈরির কথা ভাবলেন। এই উদ্দেশ্যে তারা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে একটি ছাত্র-কর্মী সভা ডাকেন। ঘটনাচক্রে ওই দিন ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক নাজমুল করিম সেখানে উপস্থিত হলে তাকে সভাপতি করে সভার কাজ শুরু হয়। সবাই একমত হয়ে সেদিন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহী থেকে আসা নইমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যের একটি অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়। কমিটির সদস্য হন নইমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী), আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), অলি আহাদ (কুমিল্লা), আজিজ আহমদ (নােয়াখালী), আবদুল মতিন (পাবনা), দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর), শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা), নওয়াব আলী (ঢাকা), নূরুল কবির (ঢাকা শহর), আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নূরুল আলম (ময়মনসিংহ) ও আবদুল কুদুস চৌধুরী (চট্টগ্রাম)। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়িয়ে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে প্রথম কমিটির অন্যতম সদস্য অলি আহাদের ভাষ্য হলাে : শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকায় ছিলেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সাংগঠনিক কমিটিতে তাহার অন্তর্ভুক্তি তিনি সানন্দেই গ্রহণ করিবেন। এবং তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা অনীহা প্রকাশ না করিয়া বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়ােগ করিয়াছিলেন উল্লেখ্য যে অধুনা অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া প্রচার করিতেছেন ইহা ইতিহাসের বিকৃতি মাত্র। | ঢাকার ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে মুসলিম লীগের সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের তরুণ কর্মীরা মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস করা হলাে এখানেই। শেখ মুজিব কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে এখানেই থাকতেন। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে : ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভেতর আমি প্রায় সব জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম । যদিও নইমুদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সবকিছুই আমাকেই করতে হতাে। নতুন একটি ছাত্র সংগঠন তৈরির প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করে ১৯৪৮ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আবেদন শিরােনামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়। অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির ১৪ সদস্যের নামে প্রকাশিত প্রচারপত্রে ধারণা দেওয়া হয়, ছাত্রসংগঠনে কোনাে অছাত্র থাকতে পারবে না এবং ছাত্রসংগঠন দলীয় রাজনীতিতে অংশ নেবে না।”
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করার সময় মােহাম্মদ তােয়াহা ও অলি আহাদ ‘মুসলিম শব্দটি সংগঠনের নামের সঙ্গে ব্যবহার করার বিরােধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম’ শব্দটি রাখার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, ওই মুহূর্তে এটা রাখা দরকার। তা না হলে মুসলিম লীগ সরকার। তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবে। এ জন্য কেউ কেউ শেখ মুজিবকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বানানােরও চেষ্টা করেছেন। যদিও শেখ মুজিব এটা কৌশল হিসেবেই নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার মত ছিল : এখনাে সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই যায়-আসে না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হলাে পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।” ইতিমধ্যে ভাষা নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে বিরােধী দলের পক্ষে কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি নিয়ে আলােচনা হয়। প্রস্তাবের সমালােচনা করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন : পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরােধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।১২ গণপরিষদের কোনাে বাঙালি মুসলমান সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব সমর্থন করেননি। গণপরিষদের সহসভাপতি তমিজুদ্দিন খানও প্রস্তাবটির বিরােধিতা করেন।১৩
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঢাকায় ফিরে এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে সংবর্ধনা দেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রশীদ বিল্ডিংয়ে তমদুন মজলিসের অফিসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনােনীত হন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র শামসুল আলম। সভায় ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে আরও প্রতিনিধিত্বশীল করার লক্ষ্যে ২ মার্চ (১৯৪৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আয়ােজিত এক সভায় পাকিস্তান তমদুন মজলিস, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণআজাদী লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদ এবং কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি তৈরি করা হয়। ১১ মার্চের হরতালকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে কমিটি ৩ মার্চ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। বিবৃতিতে সই দেন শামসুল আলম (আহ্বায়ক, রাষ্ট্রভাষা। সংগ্রাম পরিষদ), অধ্যাপক এম এ কাসেম (সম্পাদক, তমদুন মজলিস), নইমুদ্দিন আহমদ (আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ), তফাজ্জল আলী (মেম্বার অব লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি-এমএলএ), আনােয়ারা খাতুন। (এমএলএ), কামরুদ্দিন আহমদ (সাবেক অফিস সম্পাদক, ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ), শামসুল হক (সংগঠক, মুসলিম লীগ), এ সালাম (দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান), এস এম বজলুল হক (সম্পাদক, কাফেলা), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (সহসভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ), মােহাম্মদ তােয়াহা (সহসভাপতি, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদ), অলি আহাদ (আহ্বায়ক, ঢাকা শহর মুসলিম ছাত্রলীগ) ও আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (সম্প” ইনসান)। বিবৃতিতে তারা বলেন : বাংলা সমগ্র পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা। লজ্জার বিষয় যে এই ভাষাকেই রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করিতে আন্দোলনের প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে।…ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার জন্যই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদুন মজলিস ১১ মার্চ রােজ বৃহস্পতিবার সাধারণ হরতাল। ঘােষণা করিয়াছে।
এই গণতান্ত্রিক দাবিকে দমন না করিয়া বাংলা ভাষাকে মানিয়া লইলে, আমরা বিশ্বাস করি ইহাই হইবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের
একতার ভিত্তি ১৫ ১১ মার্চের হরতালকে সামনে রেখে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৪ ও ৫ মা (১৯৪৮) সভায় মিলিত হয়ে বিস্তারিত কর্মসূচি নেয়। ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অলি আহাদের মন্তব্য হলাে, ১১ মার্চ সাধারণ হরতালের আহ্বানের সংবাদ পত্রিকায় পাঠ করিয়া আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিবার নিমিত্ত শেখ মুজিবুর রহমান গােপালগঞ্জ হইতে ১০ই মার্চ রাত্রে ঢাকায় আসেন।১৬ | অলি আহাদের বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে, হরতালের প্রস্তুতিপর্বে শেখ মুজিবের অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু শেখ মুজিব বলছেন ভিন্ন কথা। তার বর্ণনামতে : ১১ মার্চকে বাংলা ভাষার দাবি’ দিবস ঘােষণা করা হলাে। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশাের হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ওই তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম ।…রাতে কাজ ভাগ হলাে—কে কোথায় থাকবে এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেব।
১১ মার্চ ভােরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পােস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল।…সকাল আটটায় জেনারেল পােস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হলাে। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেক দল হাজির হতে লাগল ।নয়টায় ইডেন বিন্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হলাে। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার…এম এ ওয়াদুদ গুরুতররূপে আহত হলাে।…এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে।…আমাদের ওপর।  কিছু উত্তম-মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। হক সাহেবকে পূর্বেই জিপে তুলে ফেলেছে। বহু ছাত্র গ্রেপ্তার ও জখম হলাে। কিছুসংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ৩০-৪০ মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসল। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেপ্তার হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন, তােয়াহা ও অনেককে গ্রেপ্তার করতে পারে নাই। আমাদের প্রায় ৭০-৭৫ জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১১ মার্চের পুলিশি হামলার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ আইনসভা থেকে সদস্যদের পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। কিন্তু তিনি নিজে পদত্যাগ করেননি। ১৫ মার্চ (১৯৪৮) আইনসভায় বাজেট অধিবেশন চলাকালে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। উভয় পক্ষ একসঙ্গে বসে একটি আট দফা চুক্তির খসড়া তৈরি। করে।
খসড়া চুক্তিটি নিয়ে কামরুদ্দিন আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেম। কারাগারে আটক নেতাদের সঙ্গে আলােচনার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। বন্দীদের পক্ষে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদ খসড়া চুক্তিটি দেখে দেওয়ার পর সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দিন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দিন আহমদ চুক্তিতে সই দেন। চুক্তিনামায় ছিল :১) ২৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) হতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাদের গ্রেপ্তার করা  হয়েছে, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। ২) পুলিশি অত্যাচারের অভিযােগ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে এই বিষয়ে বিবৃতি দিবেন। ৩) ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে বেসরকারি।
আলােচনার জন্য নির্ধারিত তারিখে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এবং একে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় চাকরির পরীক্ষা দিতে সেন্ট্রাল সার্ভিসেস এক্সামিনেশনে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। ৪) পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে এপ্রিল মাসে একটি প্রস্তাব আনা হবে যে প্রদেশের অফিস-আদালতের ভাষা ইংরেজির বদলে বাংলা হবে। ৫) আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কারও বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।
৬) সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। ৭) ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে পূর্ববঙ্গের যে সকল অংশে ভাষা আন্দোলনের কারণে
১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হবে। ৮) সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলােচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছি।  যে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি। চুক্তির আট নম্বর দফাটি নাজিমুদ্দিন নিজ হাতে লিখেছিলেন।১৯ চুক্তি অনুযায়ী ১৫ মার্চ (১৯৪৮) বিকেলেই ১১ মার্চে আটক হওয়া বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল পূর্ববঙ্গ আইনসভা ভবনের দিকে যায়। মিছিলকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে। ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন অবস্থা বেগতিক দেখে সেনাবাহিনীর সাহায্য চান। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ছিলেন মেজর জেনারেল আইয়ুব খান। তিনি নিজেই এসেছিলেন আইন পরিষদ ভবনে। এ প্রসঙ্গে জেনারেল আইয়ুব খানের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হলাে : পুলিশের মনােবল অবশ্যই নিচু হয়ে গিয়েছিল। আমি পরিষদে গেলাম এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যােগাযােগ করলাম।
আমি তাকে বললাম যে সন্ধ্যা হয়ে আসছে এবং ছেলেরা আমার বাহিনীর কাছাকাছি এসে গেছে। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি কী করব?’ আমি বললাম, ‘সভা বন্ধ করে বাড়ি চলে যান।’ তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তাে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের মাঝপথে আছি।’ তিনি আমার মুখ দেখে বুঝলেন যে আমি মজা পাচ্ছি এবং বললেন, “ঠিক আছে, আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিন। এরপর তিনি সভায় গিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলে ফিরে এলেন এবং বললেন, ‘আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি, কিন্তু এখান থেকে বের হব কীভাবে?’ আমি মেজর পীরজাদাকে বললাম মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি পরিষদ ভবনের পেছনে নিয়ে আসতে। আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে বের করে নিয়ে এলাম। কাজ শেষ করে বেরিয়ে এসে আমি ছেলেদের বললাম, পাখি উড়ে গেছে। তারা সবাই জোরে হেসে উঠল এবং একটু আগের উত্তেজনা খুশির বন্যায় ভেসে গেল। ফজলুল হক বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে নিয়ে বেরিয়ে আসলেন এবং ছাত্রদের আবার উত্তেজিত করার চেষ্টা করলেন। আমি মােহাম্মদ আলীর কাঁধে টোকা দিয়ে বললাম, আপনি কি গুলি খেতে চান? তিনি প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আপনি রূঢ় আচরণ করছেন।’ আমি গােলমাল আর বাড়াতে চাইলাম না, তাই জোরের সঙ্গেই তাকে বাড়ি চলে যেতে বললাম।
১৯ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমবারের মতাে ঢাকা সফরে আসেন। ২১ মার্চ বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় । জিন্নাহ তার এক ঘণ্টার ভাষণে অনেক বিষয়ে কথা বলেন, ভাষার প্রশ্নটিও বাদ যায়নি। তাঁর বক্তব্য ছিল ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি আক্রমণাত্মক এবং সাম্প্রদায়িক জিগিরে ভরা। তিনি বলেন : আমাদের ঐতিহাসিক দুশমনদের এজেন্ট এবং অনেক কমিউনিস্ট আমাদের মাঝে ঢুকে পড়েছে । এরা পূর্ব বাংলাকে ভারতের সঙ্গে মিশিয়ে দেখতে চায়  আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ষড়যন্ত্রকারীরা দিবাস্বপ্ন দেখছে । এই পাকিস্তানে আমরা যে যেখানেই বাস করছি, তারা কেউই এখানে। আদিবাসী নন। সুতরাং আমরা বাঙালি, আমরা পাঠান, আমরা পাঞ্জাবি বলে কী লাভ? আমাদের সকলের প্রথম পরিচয় আমরা মুসলমান।
ভাষাকে ইস্যু করে, যা কিনা আমি আগেও বললাম, মুসলমানদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে।…আবারও বলছি, এ প্রদেশের অধিবাসীরাই তাদের প্রাদেশিক ভাষা যথাসময়ে নির্ধারণ করে নিতে পারবেন। কিন্তু আমি আপনাদের কাছে এ কথাটা পরিষ্কার করে জানিয়ে রাখতে চাই, নিখিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হতে হবে। কোনাে প্রাদেশিক ভাষা রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। আর এ ব্যাপারে আপনাদের যারা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে, তারা অবশ্যই পাকিস্তানের জানি দুশমন। রেসকোর্সের বক্তৃতার পর ছাত্রদের মধ্যে জিন্নাহর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে যায়। এর প্রকাশ ঘটে ২৪ মার্চ জিন্নাহর সম্মানে আয়ােজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। কার্জন হলে আয়ােজিত অনুষ্ঠানে জিন্নাহ তার মৌখিক ভাষণে বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের যােগাযােগের ভাষা হিসেবে একটি ভাষা থাকবে এবং সে ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়। জিন্নাহর বক্তৃতার এই পর্যায়ে কিছু ছাত্র না, না’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। যারা চিক্কার করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন আবদুল মতিন ও এ কে এম আহসান।২৪
জিন্নাহ ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমেদের সরকারি বাসায় (পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট ভবন ও রাষ্ট্রীয় অতিথি। ভবন সুগন্ধা’) রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মাে. তােয়াহা, নইমুদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় জিন্নাহ বলেন, একাধিক রাষ্ট্রভাষা জাতীয় সংহতির পক্ষে
ক্ষতিকর এবং পাকিস্তানের সংহতির জন্য প্রয়ােজনবােধে মাতৃভাষা পরিবর্তন করতে হবে। সভা শেষে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘বঙ্গভাষাকে পাকিস্তানের। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হউক।’২৫  জিন্নাহর মনে হয়েছিল, ছাত্র আন্দোলনের পেছনে এ কে ফজলুল হকের হাত আছে। তিনি ফজলুল হকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মােহাম্মদ আফজালকে ফজলুল হকের কাছে পাঠালেন। ফজলুল হক জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী ছিলেন না। বললেন, ‘জিন্নাহ আলেকজান্ডারের মতাে রাজ্য জয় করে এসেছে, আমি পরাজিত রাজা পুরু। আমার সঙ্গে তার দেখা হলে সে যে তার ক্ষমতার বহর দেখাবে তা আমি হজম করতে পারব না।’ নাজিমুদ্দিন একসময় অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকের অধীনে মন্ত্রী ছিলেন শেষমেশ তিনি গেলেন।
তাঁর অনুরােধে ফজলুল হক জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। পরদিন সকালে তিনি তাঁর অনুচর আজিজুল হক শাজাহান, খন্দকার চুনু মিয়া, মকবুল মুন্সি ও ওফার্চাদ ড্রাইভারকে নিয়ে একটা বেবি অস্টিনে চড়ে জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। গেটে সেনাবাহিনীর জিওসি আইয়ুব খান, পুলিশের আইজি জাকির হােসেন এবং বারান্দায় জিন্নাহ, নাজিমুদ্দিন ও জিন্নাহর ছােট বােন ফাতেমা জিন্নাহ পায়চারি করছিলেন। ফজলুল হক গাড়ি থেকে নেমে বারান্দায় উঠে জিন্নাহর সঙ্গে একটা। ঘরে ঢুকলেন। ঘরের কপাট বন্ধ হলাে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে ফজলুল হক বেরিয়ে এসে কিছু না বলে সরাসরি গাড়িতে উঠলেন। বললেন, “আমি তাে যেতে চাচ্ছিলাম না। জানতাম এমনই হবে।’ পরে জানা গেল জিন্নাহ-হক সংলাপের বৃত্তান্ত । আজিজুল হক শাজাহানের বিবরণে তাদের বাক্যালাপ এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে : জিন্নাহ : পাকিস্তান তাে তুমি কোনাে দিন চাওনি। সব সময় বিরােধিতা করে এসেছ। হক : প্রস্তাবটি তাে আমিই করেছিলাম। কিন্তু ওটার খতনা করা হয়েছে। এটা আমি চাইনি। জিন্নাহ : পাকিস্তানের এই অংশ বেঁচে থাক তা তুমি চাও না। তাই ভারত থেকে কংগ্রেসের কাছ থেকে টাকা এনে ছাত্রদের মাথা খারাপ করে দিয়েছ। তারা আমাকে হেস্তনেস্ত করছে। হক : আমি এখানে কোনাে রাজনীতি করি না। হাইকোর্টে শুধু মামলা নিয়ে চিন্তা করি। আইন-আদালত নিয়ে থাকি। জিন্নাহ : জাননা, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ? হক : আমি আমার এক পুরােনাে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি।

জিন্নাহ : নাে নাে, ইউ আর টকিং উইথ দ্য গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান। হক : একজন কনস্টিটিউশনাল গভর্নর জেনারেলের কতটুকু ক্ষমতা তা আমি

জানি। জিন্নাহ : জানাে, তােমাকে আমি কী করতে পারি? হক; (ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে) তুমি আমার এ্যাই করতে পারাে।

মি, জিন্নাহ ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে এটা বাংলাদেশ এবং তুমি রয়েল

| বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে কথা বলছ ২৬ উত্তেজনা চরমে পৌছাল। ফাতেমা জিন্নাহ প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হক সাহেব বললেন, তিনি কলকাতায় যাবেন এবং বিবৃতি দিয়ে বিলেতে পড়ার সময় জিন্নাহ কী করে বেড়িয়েছেন তা সবাইকে জানাবেন। তিনি কোনাে দিন মুখ খােলেননি, এবার তা করবেন। জিন্নাহ এরপর ঢাকার বাইরে গেলেন। সিলেট-চট্টগ্রাম সীমান্ত দেখে চুপসে গেলেন। অবাঙালি পুলিশ সবাই অপশন দিয়ে ভারতে চলে গেছে। বর্ডার একেবারে ফাঁকা। মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড আর নৌবাহিনীর কিছু লােক কাজ চালাচ্ছে। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ফ্রেডরিক বার্নকে বললেন, যেভাবেই হােক ফজলুল হককে ম্যানেজ করতে হবে। গভর্নরের। অনুরােধে ফজলুল হক আবার জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করলেন। আলােচনা শেষে

ফজলুল হক খুশিমনে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিনের বন্ধুর কাছে গিয়ে পর্বত মুহূর্তে গলে বন্ধুত্বের সাগরে পরিণত হয়ে গেছে। আমি অতীতের সব কথা ভুলে গিয়ে আমার বুকে ঝােলানাে কোরআন শরিফ ধরে বলেছিলাম, এ অঞ্চলের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আমি আমার জীবনের শেষ রক্ত বিলিয়ে দেব।’২৭ জিন্নাহর প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ছিল। তার ঢাকা সফরের পর ভাষা আন্দোলনে ভাটা পড়ে। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর ১১ সেপ্টেম্বর (১৯৪৮) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জিন্নাহ ভাষা প্রশ্নে আর কোনাে কথা বলেননি। জিন্নাহর মৃত্যুর পর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাকে সংবর্ধনা দেন। তার সম্মানে একটি মানপত্র পড়ে শােনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক গােলাম আযম। মানপত্রে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানাে হয়। মানপত্রে বলা হয় : আমরা উর্দুকে যােগাযােগের ভাষা (লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা) হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমরা জোরগলায় দাবি করছি যে, ৬২ শতাংশ মানুষের ভাষা বাংলাকেও ন্যায্য স্থান দেওয়া হােক এবং উর্দুর সঙ্গে একে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হােক। তা না হলে পূর্ব পাকিস্তান চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে থাকবে।২৮
এদিকে মুসলিম লীগ সরকার দ্বারা ছাত্র নির্যাতন ও গ্রেপ্তার সমানে চলছিল। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর এক সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট ও সভার মাধ্যমে জুলুম প্রতিরােধ দিবস’ পালনের ডাক দেয়। ওই দিন ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে জমায়েত হন। নইমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ছাত্রসভায় বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম ও অলি আহাদ। পরে সলিমুল্লাহ হলের ১২ নম্বর কামরায় দলের সাংগঠনিক কমিটির সভায় অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসংগঠন করা এবং সব ধর্মের ছাত্রদের এই সংগঠনের সদস্য হওয়ার সুযােগ দেওয়ার দাবিতে প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রহমান চৌধুরী ও নইমুদ্দিন আহমদের বিরােধিতার মুখে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। অলি আহাদ সভায় পদত্যাগপত্র জমা দিলে শেখ মুজিব তা ছিড়ে ফেলেন। ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার ও বাহাউদ্দিন চৌধুরী অলি আহাদকে ছাত্র ফেডারেশনে যােগ দিতে অনুরােধ জানালে অলি আহাদ বলেন, ‘পদত্যাগ করিলেও আমি ছাত্রলীগের সহযােগী। হিসেবেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিব।’২৯
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে কাজ করা। দুই মাস না যেতেই এর কর্মপরিধি আরও বেড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন আয়ের (চতুর্থ শ্রেণির) কর্মচারীরা কয়েকটি দাবি জানিয়ে এক মাসের নােটিশ দিয়ে ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করেন। ছাত্রলীগের সদস্যরা তাদের সমর্থন জানান ও সহযােগিতা করেন। কর্তৃপক্ষ ১১ মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ঘােষণা করে।
দবিরুল ইসলাম (আইনের ছাত্র), আবদুল হামিদ চৌধুরী। (এমএ ক্লাস), অলি আহাদ (বিএ দ্বিতীয় বর্ষ), আবদুল মান্নান (বিএ ক্লাস), উমাপতি মিত্র (এমএসসি পরীক্ষার্থী) ও সমীর কুমার বসু (এমএ ক্লাস)—এই ছয়জনকে চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৫ জনকে বিভিন্ন হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রহমান চৌধুরী (আইনের ছাত্র), মােল্লা জালালউদ্দিন (এমএ ক্লাস), দেওয়ান মাহবুব আলী (আইনের ছাত্র), আবদুল মতিন (এমএ ক্লাস), আবদুল মতিন খান চৌধুরী। (আইনের ছাত্র), আবদুর রশীদ ভুইয়া (এমএ ক্লাস), হেমায়েতউদ্দিন আহমদ (বিএ ক্লাস), আবদুল মতিন খান (এমএ পরীক্ষার্থী), নূরুল ইসলাম চৌধুরী। (এমএ ক্লাস), সৈয়দ জামাল কাদেরী (এমএসসি ক্লাস), আবদুস সামাদ (এমকম ক্লাস), সিদ্দিক আলী (এমএ ক্লাস), আবদুল বাকী (বিএ ক্লাস), জে, পাত্ৰনবিশ (এমএসসি ক্লাস) ও অরবিন্দ বসু (আইনের ছাত্র)। পাঁচজনকে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান (আইনের ছাত্র), কল্যাণ দাশগুপ্ত (এমএ ক্লাস), নইমুদ্দিন আহমদ (এমএ ও আইনের ছাত্র), নাদেরা বেগম (এমএ ক্লাস) ও আবদুল ওয়াদুদ (বিএ ক্লাস)। লুলু বিলকিস বানুর (আইনের ছাত্রী) ১০ টাকা জরিমানা হয়েছিল ।৩০ লুলু ছাত্রলীগ মহিলা শাখার আহ্বায়ক ছিলেন। 
ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা মুচলেকা দিয়ে কাজে যােগ দিতে থাকেন। তাদের ধর্মঘটের পেছনে সাধারণ ছাত্রদের জোরালাে সমর্থন ছিল না। সাধারণ ছাত্ররা নিয়মিত পড়ালেখা করতে চাইতেন। এখানেই আন্দোলন শেষ। যেসব ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই মুচলেকা দিয়ে শান্তি প্রত্যাহার করিয়ে নেন। ছাত্রনেতাদের দোদুল্যমানতা ও আপসকামী মনােভাব প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে : ১৬ এপ্রিল খবর পেলাম, ছাত্রলীগের কনভেনর নইমুদ্দিন আহমদ ছাত্রলীগের আরেক নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী (এখন অ্যাডভােকেট)=ভিপি সলিমুল্লাহ হল, দেওয়ান মাহবুব আলী (এখন অ্যাডভোেকট) আরও অনেকে গােপনে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বন্ড দিয়েছেন। যারা ছাত্রলীগের সভ্যও না, আবার নিজেদের প্রগতিবাদী বলে ঘােষণা করতেন, তাঁরাও অনেকে বন্ড দিয়েছেন। ২৭ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বন্ড দিয়ে দিয়েছেন। কারণ, ১৭ তারিখের মধ্যে বন্ড দিলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকবেন না।  ছাত্রলীগের কনভেনর ও সলিমুল্লাহ হলের ভিপি বন্ড দিয়েছেন খবর রটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের মনােবল একদম ভেঙে গিয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি কয়েকজনকে নিয়ে নইমুদ্দিনকে ধরতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাকে পাওয়া কষ্টকর, তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। সে এক বাড়িতে লজিং থাকত। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে তাকে ধরতে পারলাম। তিনি স্বীকার করলেন আর বললেন, ‘কী করব, উপায় নাই। আমার অনেক অসুবিধা।’ তাঁর সঙ্গে আমি অনেক রাগারাগি করলাম এবং ফিরে এসে নিজেই ছাত্রলীগের সভ্যদের খবর দিলাম, রাতে সভা করলাম । অনেকে উপস্থিত হলেন। সভা করে তাদের বহিষ্কার করা হলাে এবং রাতের মধ্যে প্যামপ্লেট ছাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করলাম। কাজী গােলাম মাহবুবকে (এখন অ্যাডভােকেট) জয়েন্ট কনভেনর করা হয়েছিল। তিনি নিঃস্বার্থভাবে কাজ চালিয়েছিলেন। এ সময় ড. ওসমান গনি সাহেব সলিমুল্লাহ হলের প্রভােস্ট ছিলেন। তিনি। এক্সিকিউটিভ কমিটির সভায় আমাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে অনুরােধ করলেন। তাকে সমর্থন করলেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ।
কিন্তু কমিটির অন্য সদস্যরা রাজি হলেন না। ১৮ তারিখ বিকেলে ঠিক করলাম, ধর্মঘট করে বােধহয় কিছু করা যাবে না। তাই ১৮ তারিখে শােভাযাত্রা করে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে গেলাম এবং ঘােষণা করলাম, ‘আমরা এখানেই থাকব, যে পর্যন্ত শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার না করা হয়।’ ১০০ জন করে ছাত্র রাতদিন ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে বসে থাকবে। তাঁর বাড়ির নিচের ঘরগুলােও দখল করে নেওয়া হলাে। একদল যায়, আরেক দল থাকে। ১৮ তারিখ রাত কেটে গেল; শুধু আমি জায়গা ত্যাগ করতে পারছিলাম না। কারণ শুনলাম, তিনি পুলিশ ডাকবেন। ১৯ তারিখ বেলা তিনটায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি বিরাট একদল পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন। আমি তাড়াতাড়ি সভা ডেকে একটা সংগ্রাম পরিষদ করতে বলে দিলাম। সবার মতাে আমাকেও দরকার হলে গ্রেপ্তার হতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ মিনিট সময় দিলেন আমাদের স্থান ত্যাগ করে চলে যেতে।…পাঁচ মিনিট পরে এসে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের গ্রেপ্তারের হুকুম দিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ আটকা পড়েছেন। তাঁকে নিষেধ করা হয়েছে গ্রেপ্তার না হতে। তাজউদ্দীন বুদ্ধিমানের মতাে কাজ করলেন। বলে দিলেন, “আমি প্রেস রিপাের্টার।’ একটা কাগজ বের করে কে কে গ্রেপ্তার হলেন, তাদের নাম লিখতে শুরু করলেন। আমি তাকে চোখ টিপ মারলাম আমাদের গাড়িতে তুলে একদম জেলগেটে নিয়ে এল ।…জুন মাসের প্রথম দিক থেকে দু-একজন করে ছাড়তে শুরু করে ।
শেষ পর্যন্ত শুধু আমি ও শাহাবউদ্দিন চৌধুরী রইলাম।৩২ ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে কারাগারে যাওয়ার পরপরই শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্ররাজনীতির ইতি ঘটে। ওই বছর ২৩ জুন ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ২৭ জুন শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পান। শুরু হলাে নতুন দলের রাজনীতি।  পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল সভা ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে শুরু হয়। সম্মেলনে দবিরুল ইসলাম ও খালেক নেওয়াজ খানকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি করা হয়। এটি ছিল ছাত্রলীগের সঙ্গে শেখ মুজিবের শেষ আনুষ্ঠানিক বৈঠক। সভাপতির ভাষণে তিনি ঘােষণা দেন, তিনি যেহেতু আর ছাত্র নন, এই প্রতিষ্ঠানে তিনি আর সদস্য হিসেবে থাকবেন না।৩৪

সূত্রঃ   আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!