রামগড়-ফটিকছড়ি-নারায়ণহাট-নাজিরহাট-হাটহাজারী-চট্টগ্রাম শহর
ফেনী-জোরারগঞ্জ-মিরসরাই-সীতাকুণ্ড-কুমিরা-ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম শহর অক্ষের ফ্ল্যাংক প্রােটেকশন ফোর্স হিসেবে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মুজিব ব্যাটারিকে রামগড়-ফটিকছড়ি-নারায়ণহাট-নাজিরহাট-হাটহাজারী-চট্টগ্রাম অক্ষে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। যৌথ বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ এ সময় হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হাটহাজারীকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অগ্রসর হন। তিনি এ পর্যায়ে ক্যাপটেন জাফরের ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানি ও যৌথ বাহিনীর দলকে সীতাকুণ্ডে রেখে হাটহাজারী অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানান। ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপের কথামতাে ক্যাপটেন জাফর ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হন। এ সময় ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন লে. দিদারুল আলম। ক্যাপটেন জাফর তার সৈন্যদের নিয়ে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে হাটহাজারী পৌছেন। ইতােমধ্যে ক্যাপটেন আবদুল গাফফারের নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নাজিরহাটে পৌছে। পরে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক ধরে হাটহাজারীর অনতিদূরে অবস্থান নেয়। ক্যাপটেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরে হাটহাজারীর কাছে পৌছে। ১৫ ডিসেম্বর হাটহাজারীর পুলিশ স্টেশনে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনী ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি অফিসার মেজর হাদী ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ব্রাভাে কোম্পানি নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তারপর মুক্তিবাহিনী এ স্থান থেকে হাটহাজারীচট্টগ্রাম সড়ক ধরে অগ্রসর হয়ে নয়াপাড়ায় পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
মিজোরাম-রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম শহর
ভারতীয় বাহিনীর একটি স্পেশাল ফোর্স মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের নেতৃত্বে এ অক্ষে অগ্রাভিযান চালায়। আসাম রাইফেল ও অন্যান্য ইউনিট এবং মিজো হিলরেঞ্জ হেডকোয়ার্টারস থেকে অন্য বাহিনীসহ আনুমানিক ২,০০০ সৈন্যের এ বাহিনী গঠন করা হয়। উল্লেখ্য, এ বাহিনী পার্বত্যাঞ্চল দিয়ে অগ্রসর হওয়ার কারণে প্রশাসনিক অসুবিধার কথা বিবেচনা করে হেলিকপটার ও ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফট’-এর মাধ্যমে সরবরাহ ও সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ বাহিনী মিজোরাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এ বাহিনী ৩টি কলামে বিভক্ত হয়ে দুর্গম ভূমির কঠিন বাধা অতিক্রম করে। উত্তর-পূর্ব, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে অগ্রসর হয়ে যথাক্রমে রামগড়, রাঙামাটি ও দক্ষিণ পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। লক্ষণীয়, স্পেশাল ফোর্সের ১টি কলাম রাঙামাটি থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে রাঙামাটি-রামগড় অক্ষ হয়ে প্রথমে রামগড় পেীছে এবং এখান থেকে যৌথ বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে। হাটহাজারীর দিকে অগ্রসর হয় দ্বিতীয় কলামটি রাঙামাটি হয়ে রাঙামাটিহাটহাজারী অক্ষ বরাবর অগ্রসর হয় এবং পরিকল্পনা মােতাবেক পূর্ব দিক থেকে চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে এসে চট্টগ্রাম শহরকে অবরােধ করে রাখে। তবে এ কলামটির মূল উদ্দেশ্য ছিল রাঙামাটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি কমান্ডােদের ধ্বংস। করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তৃতীয় কলামটি রাঙামাটি-কাপ্তাই হয়ে দক্ষিণে কক্সবাজারের দিকে অগ্রসর হয়।
এ কলামটির মূল উদ্দেশ্য ছিল কাপ্তাইয়ে অবস্থানরত কমান্ডােদের ধ্বংস করে আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বার্মায় পলায়নের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা। তবে কলামগুলাের মধ্যে কক্সবাজারের দিকে আগুয়ান কলামটি পথে খুব সীমিত আকারে তাদের লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়। কারণ, ঐ এলাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকা চূড়ান্ত যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়। তা ছাড়া। পাকিস্তানি বাহিনীর ২ কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন কাপ্তাইয়ে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। উপরন্তু এ ব্যাটালিয়নের কিছু অংশ চট্টগ্রাম শহর প্রতিরক্ষাসহ চট্টগ্রাম-কাপ্তাই অক্ষেও নিয়ােজিত ছিল। উল্লেখ্য, এ ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানির কিছু বেশি সৈন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষায়। নিয়ােজিত ছিল। এখানে বলা প্রয়ােজন যে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তখন মিজোরামের বিদ্রোহীরা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষাবল করে।
তাই পাকিস্তানি বাহিনী বিদ্রোহী মিজোদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে এবং প্রশিক্ষণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে রাঙামাটিতে উন্নতমানের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে। মিজোরাম থেকে ভারতীয় যে কলামটি পূর্ব দিক থেকে রাঙামাটির দিকে অগ্রসর হয়েছিল, সে বাহিনীর রাঙামাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের বিষয়টি জানা ছিল না। তাই রাঙামাটির উপকণ্ঠে পৌছে পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডাে সৈন্যের উপস্থিতিতে তাদের হতভম্ব না হয়ে কোনাে উপায় ছিল না। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে সমর্থ হয়। পাকিস্তানি বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের এক-চতুর্থাংশ জুড়ে নিয়ােজিত থাকলেও ভারতীয় বাহিনী তথা যৌথ বাহিনী কৌশলগত দিক দিয়ে তেমন কোনাে সুবিধা অর্জন করতে পারে নি। তবে তারা ২ কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন ও ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কিয়দংশকে পর্যুদস্ত করতে সমর্থ হয়। ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী রাঙামাটি থেকে পশ্চাদপসরণ করার ফলে যৌথ বাহিনীর ৮৩ ব্রিগেড রাঙামাটি দখল করে নেয়। পরে এ বাহিনী রােমিও ফোর্সের সহায়তায় কক্সবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরােধ গড়ে তােলে। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে বার্মায় (বর্তমানে মায়ানমার) পলায়ন করতে না পারে, সে জন্য প্রয়ােজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় (Singh, 1988: 169-70)।
কলকাতা-কক্সবাজার (বঙ্গোপসাগর)
মিত্রবাহিনী সদর দপ্তর অবগত হয়েছিল যে, পাকিস্তানি সেনারা হয়তাে কক্সবাজার হয়ে বার্মায় পলায়ন করবে। মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে খবর পাওয়া যায় যে, কিছু পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্য কক্সবাজার দিয়ে স্থলপথে বার্মায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি জলপথে জাহাজে করে পালানাের চেষ্টাও করছে অনেকে। কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজে অবলােকন বিভ্রান্তকর রং লাগিয়ে অথবা অন্য দেশের পতাকা লাগিয়ে বিদেশি জাহাজের ছদ্মাবরণে কয়েকটি জাহাজকে অবরােধ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। ভারতের ইস্টার্ন ফ্লিটকে এ সংবাদ পাঠালে। তারা সতর্ক হয়ে যায় । এ রকম ভুয়া পরিচয়ে সরিয়ে নেয়ার সময় বেশ কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজ আইএনএস ভীক্রান্তের গােলার আঘাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই ব্যর্থ হয় তাদের পালাবার প্রচেষ্টা (রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম ১৯৯৬: ৩৬৬)। পাকিস্তানি সেনারা যাতে পলায়ন করে বার্মায় যেতে না পারে, সে জন্য। তাদের অবরােধ করতে যৌথ বাহিনী কক্সবাজারে রােমিও ফোর্স’ নামক ১টি ফোর্স কলকাতা বন্দর থেকে পাঠায়। এ ফোর্সের উদ্দেশ্য ছিল, কলকাতা থেকে জাহাজে করে বঙ্গোপসাগর হয়ে কক্সবাজারে এসে পাকিস্তানি বাহিনীকে অবরােধ করা। অবশ্য এ ফোর্সের সাহায্যার্থে যুদ্ধবিমান ক্যারিয়ার ভীক্রান্তকে বঙ্গোপসাগরে রাখা হয়।
রােমিও ফোর্সের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ: ১. সদর দপ্তর (এডহক) ২. ১টি ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ন ৩, ২টি ইনফ্যান্ট্রি কোম্পানি। ৪. ১টি হালকা আর্টিলারি ব্যাটারি ৫. ১টি প্লাটুন ইঞ্জিনিয়ার্স ৬. প্রশাসনিক ইউনিটসমূহ ৭. এয়ার কন্ট্রাক্ট টিমসহ ১টি টোকল ৮, আইএনএস গুলডার, ঘড়িয়াল, ব্রহ্মপুত্র, বিইস এবং এমভি বিশ্ববিজয়। (Singh, 1988: 170-71) পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, এ ফোর্স কক্সবাজারে এসে জাহাজ থেকে নামার পর যৌথ বাহিনীর ৪র্থ কোরের নিয়ন্ত্রণে থেকে যুদ্ধ করবে। এ ফোর্সের বিপরীতে পাকিস্তানি বাহিনীর ইউনিটগুলাে ছিল নিম্নরূপ: ১, ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ১টি কোম্পানি; ২. রেঞ্জারের ১টি কোম্পানি; ৩. পূর্ব পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ১টি কোম্পানি; ৪. দোহাজারী-চিড়িঙ্গি-কক্সবাজার অক্ষ হয়ে বার্মায় পলায়নপর সৈনিকবৃন্দ। (Singh, 1988: 171) | রােমিও ফোর্স ১০-১১ ডিসেম্বর রাতে কলকাতায় জমায়েত হয় এবং ১২ ডিসেম্বর পৌনে ৫টায় আইএনএস গুলডার এবং ঘরিয়াল জাহাজে করে রওনা দেয়। এ জাহাজ ২টি ১৪ ডিসেম্বর পৌনে ৩টায় আরভিতে (মিলন স্থানে) পৌছে এবং সকালের মধ্যে সৈন্যরা স্থানান্তরিত হয়ে অপেক্ষাকৃত হালকা জাহাজে ওঠে।
কিন্তু অপারেশনটি চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ, রােমিও ফোর্স অপারেশন পরিচালনা সম্পর্কিত প্রয়ােজনীয় তথ্য যেমন: উপকূলের তটরেখা, স্রোতের গতি অবতরণ ক্রাফটের জন্য প্রয়ােজনীয় ঢাল, পানির প্রয়ােজনীয় গভীরতা, প্রশিক্ষণ বা রিহার্সাল ব্যতীত সৈন্য নিয়ে অপারেশনে অংশগ্রহণ, বিশেষ করে উভচর অপারেশনের কলাকৌশল সম্পর্কিত প্রয়ােজনীয় জ্ঞান ইত্যাদির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল না। এ জন্য অপারেশনটির শুরুতেই কয়েকজন ডুবে মৃত্যুবরণ করে। এতৎসত্ত্বেও রােমিও ফোর্স দেশীয় নৌকা করে সমুদ্রতীরে অবতরণ করতে সমর্থ হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, পাকিস্তানি সেনারা ঐ সময় আত্মসমর্পণ না করতে এবং ভারতীয় বিমানবাহিনী দীর্ঘক্ষণ ধরে বিমান আক্রমণ চালিয়ে যেতে সমর্থ না হলে রােমিও ফোর্সের ভাগ্য খুবই খারাপ হতে পারতাে। এ ফোর্স পরে কক্সবাজারের দক্ষিণে উখিয়ার বিপরীতে অবতরণ করে এবং রামুর দিকে চলমান রাস্তায় রােড ব্লক স্থাপন করে। এ ফোর্স পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনী। এবং ৮৩ ব্রিগেডের সাথে চট্টগ্রামে মিলিত হয় (Sing/1, 1988: 171-72)।।
মুক্তি ও যৌথ বাহিনীর সুপরিকল্পিত অগ্রাভিযান জনিত উপযুক্ত চতুর্মুখী প্রথাগত আক্রমণের ফলে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। প্রকৃতপক্ষে, এ বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল সুদীর্ঘ ৯ মাসে দেশমাতৃকার জন্য নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিবাহিনীর অনন্যসাধারণ, শৌর্যমণ্ডিত এবং কুশলী গেরিলা তৎপরতার কারণে। সমগ্র বাংলাদেশের মতাে চট্টগ্রামও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এ খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে তাদের সেই সাহসের ইতিবৃত্ত বর্ণিত। তৃতীয় খণ্ডে সন্নিবেশিত দলিলাদিতে তার প্রমাণ উপস্থাপিত। এদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড এবং ডিসেম্বরে যৌথ বাহিনীর চূড়ান্ত সামরিক অগ্রাভিযানের সম্মিলিত প্রয়াসের ফল এ দেশের রাহুমুক্তি ও বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের স্বাধীনতা।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড