You dont have javascript enabled! Please enable it!
চট্টগ্রাম অঞ্চলে যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযান
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সহযােগী বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনীর কাঠামাে অনুমােদিত হওয়ার পর সুষ্ঠুভাবে চূড়ান্ত যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি অপারেশন সেক্টরে বিভক্ত করে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা করা হয়। পরে যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী সেক্টরভিত্তিক সৈন্যসমাবেশ করা হয়। এ সেক্টরগুলাে ছিল যথাক্রমে দক্ষিণ সেক্টর, উত্তর সেক্টর, মধ্য সেক্টর ও পূর্ব সেক্টর। পূর্ব সেক্টর তথা চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত জেলাগুলাে যেমন: চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নােয়াখালী ও সিলেট নিয়ে গঠিত ছিল। এ যুদ্ধ এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর ৪র্থ কোর এবং মুক্তিবাহিনীর ১, ২, ৩, ৪ ও ৫ সেক্টরের সেক্টর ট্রপস, ‘এস’ ফোর্স, ‘কে’ ফোর্স ও ‘জেড’ ফোর্সের অংশবিশেষ পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে (এ এস এম সামছুল আরেফিন, ১৯৯৫: ৪৫৪-৫৫)। মিত্র বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলে অগ্রাভিযানের সময় যে অক্ষগুলাে অনুসরণ করে, সেগুলাে হলাে:
ক. ফেনী-জোরারগঞ্জ-মিরসরাই-সীতাকুণ্ড-কুমিরা-ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম
খ, রামগড়-ফটিকছড়ি-নারায়ণহাট-নাজিরহাট-হাটহাজারী-চট্টগ্রাম শহর। গ, মিজোরাম-রাঙামাটি-চট্টগ্রাম শহর। ঘ. কলকাতা-বঙ্গোপসাগর-কক্সবাজার-চট্টগ্রাম শহর।
ফেনী-জোরারগঞ্জ-মিরসরাই-সীতাকুণ্ড-কুমিরা-ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম শহর ফেনী থেকে চট্টগ্রাম শহরের দূরত্ব ৬৫ মাইল। এ দূরত্বে গিয়ে কিলাে ফোর্স ও ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেড অগ্রাভিযান চালায়। তবে ৮৩ ব্রিগেডকে কিলাে ফোর্সের সম্পূরক ফোর্স হিসেবে রাখা হয়। প্রথমে কিলাে ফোর্স চট্টগ্রাম শহরকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অগ্রসর হয়। এ ফোর্সের সংগঠন ছিল নিম্নরূপ:  ২টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন (এ ব্যাটালিয়নগুলাে ভারতের পার্বত্য মিজো নিয়ে গঠন করা হয়); ২টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট; ১টি বিএসএফ ব্যাটালিয়ন; ৬টি মুক্তিবাহিনী কোম্পানি; ১টি মাউন্টেন রেজিমেন্ট (ব্যাটারি ব্যতীত); ১টি মুজিব ব্যাটারি; ২টি ৩.৭ ইঞ্চি বিএসএফ হাউইটজারস; ১টি ফিল্ড কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ার (প্রাক্তন ২৩৪ রেজিমেন্ট থেকে)। এ ছাড়া অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সদর যেমন: যােগাযােগ ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সাহায্য দেওয়ার জন্য নিয়ােজিত। (Singh, 1988: 168) কিলাে ফোর্সের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ কাউন্টার ইন্টারজেন্সি অপারেশনসংক্রান্ত ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ থাকায় তাকে কিলাে ফোসের দায়িত্ব। দেওয়া হয়। ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেড লাকসাম দখলের জন্য অগ্রাভিযান চালিয়ে। লাকসামকে শত্রু মুক্ত করার সময় ফেনীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী সেখান থেকে পালিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে দক্ষিণে চলে আসে (Jacob, 1999: 122)।।
ফলে কিলাে ফোর্সও আরও দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকে এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানকে বিলম্বিত করার জন্য ফেনী নদীর ওপর রােড ও রেল উভয় ধরনের ব্রিজই ধ্বংস করে দেয়। ফলে কিলাে ফোর্সকে নদী অতিক্রম। করার ইঞ্জিনিয়ার্স ইউনিটের সাহায্যে শুভপুরে ফেনী নদীর ওপর পলটন ব্রিজ তৈরি করতে হয় (Singh, 1988: 168-9)। | অন্যদিকে, ৮ ডিসেম্বর ক্যাপটেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ক্যাপটেন আব্দুল গাফফারের নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে (মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি, ১৯৯৩ ৩১৭)। কিলাে ফোর্স ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে জোরারগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুখােমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং অবধারিতভাবে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে জোরারগঞ্জ ও করেরহাট দখল করে নেয়। এ সময়। বাংলাদেশ ফোর্সের ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর রফিক করেরহাটে সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন করেন। তারপর তিনি তার বাহিনী নিয়ে করেরহাট থেকে দক্ষিণে মিরসরাইয়ের দিকে আরও ৬ মাইল দূরে অবস্থিত জোরারগঞ্জ পর্যন্ত সমস্ত । এলাকা দখল করে নেন। উল্লেখ করা প্রয়ােজন, শুভপুরে ফেনী নদীর ওপর রেলওয়ে ও সড়ক ব্রিজ দুটি পাকিস্তানিরা ধ্বংস করে দেওয়ায় এগুলাে উপযুক্তভাবে মেরামত করে যানবাহন। চলাচলের উপযােগী করে তােলা যায় নি বলে ব্যাপকভাবে রসদসামগ্রী সরবরাহ ছিল এ অঞ্চলে যুদ্ধের প্রধান সমস্যা। ফলে মুক্তিবাহিনীকে খাদ্যসামগ্রী, অস্ত্র, গােলাবারুদ এবং অন্যান্য সরবরাহের জন্য শুভপুর ব্রিজ থেকে আরও প্রায় ৫০ মাইল দূরে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনীর মূল সাপ্লাই বেইজের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হতাে।
উল্লেখ্য, ঐ সময় শুভপুর ব্রিজের উত্তরের ঐ ৫০ মাইল রাস্তা ছিল খুবই অনুন্নত। এতে মুক্তিবাহিনীর সার্বক্ষণিক সরবরাহ নিশ্চিত করা ছিল অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। ফলে সরবরাহের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে সংকটের সৃষ্টি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। ফলে যৌথ বাহিনীর সৈন্যদের অগ্রাভিযানও ছিল কিছুটা মন্থর গতির।  এদিকে যৌথ বাহিনীর লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম শহরকে দ্রুতগতিতে দখল করা, যাতে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের জাহাজগুলাে পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগেই চট্টগ্রাম শহর থেকে শত্রুদের বিতাড়িত করা যায়। এজন্য যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযান দ্রুততর করার জন্য শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড ধরেই অগ্রাভিযান সীমাবদ্ধ রাখে নি। উপরন্তু প্রয়ােজনে তারা আশপাশের পাহাড়ি এলাকা অতিক্রম করেও শত্রু সৈন্যদের নিধনের লক্ষ্যে সম্মুখে অগ্রসর হয়েছে (রফিকুল। ইসলাম, বীর উত্তম, ১৯৯৬: ৩৫১-৫২)।  যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানকালীন মুক্তিবাহিনী জোরারগঞ্জ দখল করার পর গেরিলাদের সহায়তায় মিরসরাইতে গােপন ঘাঁটি স্থাপন করে এবং সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চোরাগুপ্তা কিন্তু সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। যুদ্ধের এ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের এ অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি। বাহিনী তাদের কোনাে প্রতিরক্ষাতেই বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে নি।  তখনকার সামগ্রিক পরিস্থিতি পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিকূলে থাকায়, গেরিলা আক্রমণ সুতীব্র ও সফল হওয়ায় এবং সাহায্য ও সহযােগিতা দেওয়ার মতাে কেউ
থাকায় মুক্তি ও যৌথ বাহিনী সহজেই তাদের পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছিল।
সে জন্যই লক্ষ্য করা গেছে, আলােচ্য যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানকালে সংশ্লিষ্ট এলাকার গেরিলারা তাদের সাথে অনায়াসে সম্মিলিত হতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিবাহিনী মিরসরাইতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত থাকাবস্থায় ৯ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়ক পথে গেরিলারা তাদের বিভিন্ন গােপন বেইস থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে মিলিত হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে মুক্তি ও যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানের মুখে পাকিস্তানি  বাহিনী বাধ্য হয়ে মিরসরাই থেকে পশ্চাদপসরণ করে ১২ মাইল দক্ষিণে সীতাকুণ্ড গিয়ে প্রতিরােধ গড়ে তােলে (প্রাগুক্ত: ৩৬১)।  মুক্তিবাহিনীর পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জানার ব্যাপারটা ছিল খুবই সহজ। রাস্তাঘাট সম্পর্কে ভালােভাবে জানা ছিল বলে রাতের অন্ধকারে অথবা। যথার্থ আড়াল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের খুব নিকটে যাওয়া তাদের জন্য। কোনাে কঠিন ব্যাপার ছিল না। সে কারণে পাকিস্তানি বাহিনী যেখানেই তাদের। শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে, সেখানেই বিরূপ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পরাজয়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বার বার পশ্চাদপসরণ করে। প্রতিরােধের শেষ প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হয়েছে। চট্টগ্রামে আলােচ্য অগ্রাভিযানের এ পর্যায়ে ক্যাপটেন জাফরের নেতৃত্বাধীন ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তার ওপর। অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করার পর ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে মূল বাহিনীর সাথে সীতাকুণ্ডে এসে মিলিত হয়। পরে ১১ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ডে পাকিস্তানি ডিফেন্স ভেঙে শত্রু মুক্ত করা হয়। এ অবস্থায় যৌথ বাহিনী দুটি অক্ষে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করে।
তন্মধ্যে মূল বাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে সীতাকুণ্ড-ফৌজদারহাটচট্টগ্রাম শহর অক্ষে এবং অন্যটি হাটহাজারী-চট্টগ্রাম অক্ষে অগ্রাভিযান পরিচালনা করে। এ সময় ৪র্থ কোর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিং চট্টগ্রাম শহরকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে দখল করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং এ জন্য তিনি ১২ ডিসেম্বর ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের সমাবেশ ঘটিয়ে কিলাে ফোর্সের। শক্তিবৃদ্ধি করেন। পরে এ সম্মিলিত বাহিনী আরও সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কুমিরার সন্নিকটে পৌছে। | পাকিস্তান বাহিনী ১২-১৩ ডিসেম্বর রাতে কুমিরায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তােলে। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি এবং ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের আরও ১টি কোম্পানি কুমিরায় প্রতিরক্ষাতে নিয়ােজিত ছিল (Singh, 1988: 169)। এখানে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। অত্যন্ত সুদৃঢ়। কারণ ভূমির বৈশিষ্ট্যের জন্য এ এলাকা প্রতিরক্ষার জন্য খুবই । উপযােগী ছিল। এ স্থানটি ছিল একটি সংকীর্ণ এলাকা। এর পূর্ব দিকে সীতাকুণ্ড। পাহাড়সারি আর পশ্চিমে মাত্র কয়েক’শ গজ দূরে বঙ্গোপসাগর। ফলে ভূমির। রণকৌশলগত সুবিধাদি কাজে লাগানাের জন্য কুমিরায় পাকিস্তানি বাহিনী একটি খালের ওপর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে ব্রিজের দক্ষিণে রাস্তার দুই পাশে এমনভাবে। প্রতিরক্ষা গড়ে তােলে, যাতে যে-কোনাে অগ্রসরমাণ বাহিনীকে সহজেই প্রতিরােধ করা যায়।  খালটিতে পানি ছিল খুবই কম। রাস্তার পূর্ব পার্শ্বের পাহাড়ে অবস্থিত যক্ষ্মা হাসপাতালে পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগান বসানাে ছিল। এখানে পাকিস্তানি। বাহিনীর সাথে যৌথ বাহিনীর এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ২৪ ঘণ্টাব এ যুদ্ধে ভারতীয় বহু সৈন্য হতাহত হয়।
পরে যৌথ বাহিনী ১৪ ডিসেম্বব ভাবতে পাকিস্তানি সেনাদের পর্যদস্ত করে কুমিরা দখল করে। উল্লেখ্য, যক্ষ্মা হাসপাতালেও পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। এ প্রতিরক্ষা অবস্থানটি কীভাবে যৌথ বাহিনীর দখলে আসে, তা এখানকার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন মুক্তিযােদ্ধার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় । সাক্ষাৎকারটির সারমর্ম নিমে দেওয়া হলাে:
..কুমিরা রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বে পাহাড়ের ওপর কুমিরা টিবি হাসপাতাল অবস্থিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা এখানে একটি শক্তিশালী। ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। মিত্রবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানি সেনাদের এ ক্যাম্পটি ধ্বংস করে কুমিরা এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচলের পথ নিরাপদ রাখা। সুতরাং অপারেশন পরিচালনার সুবিধার্থে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে (সম্ভবত ১৩ ডিসেম্বর) ক্যাপটেন মাহফুজ তাঁর সহযােগী লে, মনসুর, পুলিশের হাবিলদার মুসলিম উদ্দিন, সিপাহি মাে. আবু তাহের, আবু বকর, ইব্রাহীম, আজিজ, নজরুল ইসলাম, স্থানীয় রেলওয়ে কর্মচারী হাসেম মিস্ত্রী (মৃত), আবদুর রউফ খালাসি ও স্থানীয় কয়েকজন কাঠুরিয়াকে নিয়ে ক্যাম্পটির আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন।
উল্লেখ্য, স্থানীয় কাঠুরিয়ারা জীবিকানির্বাহের লক্ষ্যে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য ক্যাম্পটির আশপাশের জঙ্গলে প্রতিদিনই যাওয়া আসা করতেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের লক্ষ্য করত। ক্যাপটেন মাহফুজ তাই ঠিক করেন যে, কাঠুরিয়ার বেশ ধারণ করেই দিনের বেলায় পর্যবেক্ষণ করা হবে। ক্যাপটেন মাহফুজ তাঁর সহযােগীদের নিয়ে কাঠুরিয়ার বেশে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ক্যাম্পটির আশপাশের জঙ্গলে যান। সেখানে গিয়ে রেকি শেষে সংগৃহীত কাঠ নিয়ে প্রত্যাবর্তনকালীন পথিমধ্যে তাদের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের একটি রেশনবাহী ট্রাক এসে পড়ে। ক্যাপটেন মাহফুজ হঠাৎ ট্রাকটি দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তবু তিনি তার। সহযােগীদের ভয় না পাওয়ার জন্য ইশারা দেন।
ট্রাকটিতে ৩জন পাকিস্তানি সেনা ছিল। তারা ট্রাকটির নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে ছিল । ট্রাকটি এসে মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে দাঁড়ানাে মাত্রই ১জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযােদ্ধাদের বলেন যে, তােমরা রেশনগুলাে ক্যাম্পের ভিতর পৌছে দাও। মুক্তিযােদ্ধারা এ অভাবিত সুযােগ প্রাপ্তিতে মনে মনে খুশি। এ সুযােগ হেলায় হারানাে যাবে না। তাই কালবিলম্ব না করে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্য থেকে লে. মনসুর, আবু তাহের, আবু বকর, ইব্রাহীম, আজিজ ও নজরুল রেশনের ৬টি বস্তা নিয়ে। ক্যাম্পের ভিতর যান। অন্যরা আর সেখানে অবস্থান না করে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে। যান। রেশনের বস্তা নিয়ে একেবারে ক্যাম্পের ভিতর চলে যাওয়ার সুবাদে সেখানে শতাধিক পাকিস্তানি সেনাসহ ক্যাম্পের সঠিক অবস্থা দেখার সুযােগ পান, যা তাদের পরবর্তীকালে অপারেশন পরিকল্পনা সফলভাবে প্রণয়নে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ক্যাপটেন মাহফুজের নেতৃত্বে আনুমানিক ১২০জন মুক্তিযােদ্ধা রাত প্রায় ১২টার পর মিরসরাই ক্যাম্প থেকে স্থানীয় ট্রাকে করে এবং আনুমানিক ২৫০জন ভারতীয় সৈন্য তাদের নিজস্ব সামরিক গাড়িতে করে একই সাথে অপারেশন স্থল কুমিরার দিকে রওনা দেয়। এ সময় মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রাকগুলাে সবার সামনে এবং ভারতীয় সৈন্যদের সামরিক গাড়িগুলাে ছিল পিছনে। পরিকল্পনা মােতাবেক মুক্তিযােদ্ধারা বাড়বকুণ্ড কাসেম জুট মিলের সামনে এসে ট্রাক থেকে নেমে যান। এখানে তারা দুটো দলে বিভক্ত হন। ক্যাপটেন মাহফুজের নেতৃত্বে ১টি দল ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড দিয়ে কুমিরা রেল স্টেশনের দিকে হেঁটে অগ্রসর হয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের কাছাকাছি এসে পজিশন নেয়। অন্যদিকে, লে, মনসুর কুমিরা রেল স্টেশনের আউটার সিগন্যালের কাছে এসে একটি ছড়াকে (নালাকে) সামনে রেখে অবস্থান নেন। ভারতীয় সৈন্যরা যক্ষ্মা হাসপাতালের সামনের গেটের পাশে অবস্থান নেয়।
তারপর ক্যাপটেন মাহফুজ পরিকল্পনা মােতাবেক তার নিজের দল এবং লে, মনসুরের দলকে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণের জন্য হাসপাতালের দিকে অগ্রসর হওয়ার আদেশ প্রদান করেন। এমতাবস্থায় সবাই হাসপাতালের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে ২০০ গজ দূরে থাকতেই পাকিস্তানি সেনারা দেখে ফেলে। | পাকিস্তানি সেনারা আচমকা গুলি বর্ষণ শুরু করে। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারাও পজিশন নিয়ে পালটা গুলি করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পটি রণকৌশলগত দিক থেকে সুবিধাজনক উচু স্থানে থাকায় এবং তাদের অত্যাধুনিক ভারি অস্ত্রশস্ত্র থেকেও গুলির তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে সম্মুখে। অগ্রসর হওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। এ জন্য ক্যাপটেন মাহফুজ বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যদের কভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
এমতাবস্থায় ভারতীয় সৈন্যরা তাদের ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার, ৭৫ মি.মি. আরআর এবং আর্টিলারি গান প্রভৃতি ভারী অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পকে লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করে। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনাদের ফায়ারের মাত্রা আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকে। এভাবে ফায়ার ও পালটা ফায়ার ১৫ ডিসেম্বর রাত ৮টা পর্যন্ত চলে। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা হঠাৎ ফায়ার বন্ধ করে দিলে তারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গেছে বলে মুক্তিযােদ্ধারা মনে করেন। এমতাবস্থায় তারা আবার সম্মুখে অগ্রসর হলে পাকিস্তানি সেনারা পুনরায় ফায়ার শুরু করে। উভয় পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি চলতে থাকে ১৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টা পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা এক পর্যায়ে ফায়ার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলে মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাম্পটি দখল করে নেন (সাক্ষাৎকার: আবু তাহের, ৩০ জুলাই, ২০০২)। | এ যুদ্ধে আনুমানিক ৮০-৯০জন পাকিস্তানি সেনা প্রাণ হারায় এবং ২২জনকে বন্দি করা হয়। অন্যদিকে, ২৫জন মুক্তিযােদ্ধা এবং ৫০জনভারতীয় সৈন্য শহিদ ‘হন। যৌথ বাহিনীর আক্রমণের পরিকল্পনা করার সময় পাকিস্তানি সেনাদের জনবল ও অস্ত্রশস্ত্রের ধরন ইত্যাদি সম্পর্কে আরও সুস্পষ্টভাবে জানা প্রয়ােজন ছিল। এতে করে মিত্রবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি আরও কমানাে যেত। পূর্ব থেকেই কভারিং ফায়ার ও ক্যাম্পের ওপর মর্টার ও আর্টিলারি ফায়ার করা উচিত ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পটির ওপর মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ করার পূর্বে আরও নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়ােজন ছিল বলে প্রতীয়মান।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানের সময় এলাকার জনগণ তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল। তাদের সাজসরঞ্জাম এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌছে দেওয়ার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাড়া দেয়। যৌথ বাহিনীর সৈন্যদের চট্টগ্রাম শহরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌছে দেওয়ার জন্য জনগণ ছিল খুবই উদ্গ্রীব। পথিমধ্যে ছােটো ছােটো খাল অতিক্রম করার জন্য খালের ওপর আশপাশের এলাকা হতে পাথর, বালির বস্তা ইত্যাদি এনে তারা বিকল্প রাস্তা তৈরি করে দেয়, যাতে যৌথ বাহিনীর সরঞ্জাম সহজে পার করা যায়। তা ছাড়া জনগণ যৌথ বাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ এবং অন্যান্য প্রয়ােজনীয় সমর সরঞ্জাম বহন। করার জন্য কিছু রিকশা ও গরুর গাড়িও জোগাড় করে (রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, ১৯৯৬: ৩৬২-৬৩)। আবার অনেকে নিজেরাই এগুলাে কাধে করে হেটে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছিয়ে দেয়। গ্রামের অনেকে যৌথ বাহিনীর সৈন্যদের জন্য নানান ধরনের কাচা খাদ্যদ্রব্যাদি যেমন: মুলা, গাজর ইত্যাদি জোগাড় করে তাদের হাতে তুলে দেয়। এতে যৌথ বাহিনীর সৈন্যদের মনােবল বৃদ্ধি পায় এবং প্রবল উৎসাহে দায়িত্ব পালনে মনােনিবেশ করেন।
যৌথ বাহিনী পরে কুমিরার দক্ষিণে ভাটিয়ারী এলাকায় তাদের মূল প্রতিরক্ষাসহ আরও দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড বরাবর ফৌজদারহাট পর্যন্ত ভাটিয়ারী-ফৌজদারহাট অক্ষে কতকগুলাে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তােলে। যৌথ বাহিনীর সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধন করার লক্ষ্যে এ প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলােতেই পাকিস্তানি সেনারা তাদের সব সৈন্য ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সমাবেশ ও ব্যবহার করে। কিন্তু তারা তখনকার সার্বিক পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারায় ভূমির রণকৌশলগত সুবিধাদি কাজে লাগাতে সমর্থ হলেও চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে পারে নি। কারণ, মুক্তিযােদ্ধা গেরিলা ও স্থানীয় সূত্রে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান সহজেই জানতে পারায় যৌথ বাহিনী তাদের সাথে মুখােমুখি যুদ্ধে না জড়িয়ে যথাসম্ভব তাদেরকে ব্লক দেওয়ার। পরিকল্পনা করেছে, যাতে তারা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারে।  যৌথ বাহিনী যথার্থই অনুধাবন করেছিল যে, পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এসব প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে আস্তে আস্তে যুদ্ধ করতে করতে পশ্চাদপসরণ করে শহরের জটিল বৈশিষ্ট্যময় অবস্থানে প্রবেশ করতে পারলে তাদের ধ্বংস করা খুবই কঠিন হবে। কারণ, সে ক্ষেত্রে শহরের প্রতিটি দালানকোঠা, বাড়িঘর ও দোকানপাট হবে তাদের একেকটি প্রতিরক্ষা দুর্গ। এতে যৌথ বাহিনী নিমলিখিত অসুবিধাগুলাের সম্মুখীন হতে পারে:
ক, পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করতে বহু সৈন্যের প্রয়ােজন হবে। খ. বহু সৈন্য এবং অসামরিক লােকজন হতাহত হবে। গ, শহর এলাকার দালানকোঠা, বাড়িঘর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। ঘ. পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করা বিলম্বিত হবে।
এ জন্য মিত্রবাহিনী পরিকল্পনা করে যে, ভাটিয়ারী-ফৌজদারহাট এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের এখানেই পরাস্ত ও শেষ করতে হবে। এ জন্য তারা ৮৩ ব্রিগেডের ২ রাজপুত এবং ৩ ভােগরা ব্যাটালিয়নকে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান বাইপাস করে পিছনে গিয়ে অবরােধ সৃষ্টি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে না পারে। আর ব্রিগেডটির তৃতীয় ব্যাটালিয়নটিকে পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর সামনের দিক থেকে সরাসরি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। পূর্বোক্ত ব্যাটালিয়ন ২টি পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের বাম পাশ ঘেঁষে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে সঠিক পথনির্দেশনার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার জন্য মুক্তিবাহিনীকে গাইড হিসেবে নিয়ােগ করে। সৈন্যদের কয়েক দিনের যুদ্ধ প্রস্তুতির লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, রসদসামগ্রী এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য আশপাশের এলাকা হতে আনুমানিক ১,২০০ অসামরিক লােক সংগ্রহ করা হয়। এদের দৈনন্দিন ভরণপােষণ মেটানাের প্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্য এবং তৈজসপত্র নেয়ার জন্যও ব্যবস্থা রাখা হয়। পরবর্তী সময় ব্যাটালিয়ন ২টির সৈন্যরা ১৫ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের কিছু আগে গাইডদের সহায়তায় পাহাড়গুলাের ভিতর দিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং প্রায় ১৫ মাইল পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে ফৌজদারহাটের কিছুটা দক্ষিণে গিয়ে রাতের অন্ধকারে মহাসড়কের দুই পাশে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে অবরােধ সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, ১ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর রফিকের নির্দেশে মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড এলাকার প্রায় ২০০ সশস্ত্র গেরিলা চট্টগ্রাম শহরে পূর্বনির্ধারিত কতকগুলো। জায়গায় অবস্থান নেয়। এ স্থানগুলােয় গেরিলাদের রাখার উদ্দেশ্য ছিল এ যে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে শহরে যুদ্ধ করতে হলে গেরিলারাই হবে একটি শক্তিশালী বাহিনী, যাদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংস করা সহজ হবে। অন্যদিকে শহরের রাস্তাঘাট এবং প্রতি ইঞ্চি জমি সম্পর্কে ধারণা থাকায় যে-কোনাে পরিস্থিতি মােকাবিলা করে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য গেরিলারাই হবে সবচেয়ে বেশি কার্যকর শক্তি। পরবর্তীকালে পরিকল্পনা মাফিক ১৫ ডিসেম্বর বিকালে যৌথ বাহিনী ভাটিয়ারীতে প্রতিরক্ষায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। এতে যৌথ বাহিনীর প্রায় ২০জন হতাহত হন এবং পাকিস্তানি সেনারা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। তবে যৌথ বাহিনীর সে সময় পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে চাপ প্রদানের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সেনাদের মহাসড়ক পথে যৌথ বাহিনীর উপস্থিতির ব্যাপারে উদৃবিগ্ন রাখা এবং তাদের দিকে পাকিস্তানি সেনাদের মনােনিবেশ বৃদ্ধি করা, যাতে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে চলমান ফোর্স যেন বিনা বাধায় নির্বিঘ্নে গন্তব্যস্থলে পৌছে যেতে পারে। অবশেষে বাইপাসকৃত ফোর্সটি লক্ষ্যস্থলে পৌছে তাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি মােতাবেক সব কাজ সম্পন্ন করে। মহাসড়কের যৌথ বাহিনীও চট্টগ্রাম শহরকে দখল করার জন্য সম্মুখ দিক থেকে আক্রমণ চালায় (রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, ১৯৯৬: ৩৭২-৩৭৪)।
যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানের সময় আইএনএস ভীক্রান্ত চট্টগ্রাম বন্দর অবরােধ। করে রাখে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলাের ওপর শেল নিক্ষেপ করে। এতে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। ১৪ ডিসেম্বর থেকেই সমন্বয়ের মাধ্যমে ভীক্রান্ত হতে সামগ্রিক ফায়ার পরিকল্পনা। অনুসারে শেল নিক্ষেপ করা হয়। মূলত এ শেলগুলাে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও চট্টগ্রামের রিফাইনারিতে নিক্ষেপ করা হয় (Singh, 1988: 168-9)। এভাবে অব্যাহত শেল নিক্ষেপের ফলে চট্টগ্রামের জ্বালানি তেলের ডাম্পগুলাে কয়েক দিন যাবৎ জ্বলতে থাকে। বন্দরের অনেক জাহাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়েকটি জাহাজ কর্ণফুলি নদীতে ডুবে যাওয়ায় বন্দরে নৌচলাচলের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষতির অবস্থা এমন ছিল যে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্থূপ পরিষ্কার করতে এবং ৫০০ ও ১,০০০ পাউন্ড বােমাসৃষ্ট গর্তগুলাে ভরাট ও মেরামত করে বন্দরকে ব্যবহার উপযােগী করে তুলতে ১ বছরেরও বেশি সময়। লাগে (রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম ১৯৯৬: ৩৬৬)। | যুদ্ধজাহাজ ভীক্রান্ত বঙ্গোপসাগরে রাখার উদ্দেশ্য ছিল, যাতে ভারতীয় বিমানগুলাে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলাের ওপর বােমা বর্ষণ করে স্থলপথে যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এ সময় চট্টগ্রাম শহরকে শত্রুমুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়ায় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলােকে ফৌজদারহাটে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে বােমা বর্ষণের জন্য নিয়ােজিত রাখা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন, যৌথ বাহিনী যখন ফৌজদারহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত ছিল, তখন যৌথ বাহিনীর অন্য একটি কলামও টঙ্গীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিয়ােজিত ছিল । 
ফৌজদারহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে বােমা বর্ষণের পাশাপাশি টঙ্গীতেও পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে বােমা বর্ষণের প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্র ও বিমানবন্দরকে দখলে রাখা যৌথ বাহিনী খুবই জরুরি মনে করায় পূর্বপরিকল্পনা পরিবর্তন করে ১৪ ডিসেম্বর টঙ্গীতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের বদলে ফৌজদারহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে বােমা বর্ষণ করার জন্য আদেশ দেওয়া হয় (Jacob, 1999: 123)। পরে যৌথ বাহিনীর ৮৩ ব্রিগেডের অধীনস্থ ২ রাজপুত ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী ফৌজদারহাট দখল করে নেয়। তারপর ১৬ ডিসেম্বর ৩ ডােগরা চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনী একই দিন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয় (Singh, 1988: 169)। পাকিস্তানি সৈন্য মুক্ত স্বাধীন চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সার্কিট হাউজে ১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের বন্দর এলাকার নৌবাহিনী স্থাপনায় এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আত্মসমর্পণের লক্ষ্যে একত্র হওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। পাকিস্তানি বন্দিদের দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত হয়। চট্টগ্রামে পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৬১জন অফিসার, ৩০৫জন জেসিও, নৌ ও বিমানবাহিনীর সমপর্যায়ের লােক এবং তিন বাহিনীর ৮৬১৮জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে (রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম, ১৯৯৬: ৩৭৯)।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!