You dont have javascript enabled! Please enable it! ভারতীয় বাহিনীর রণ পরিকল্পনার প্রস্তুতি ও প্রণয়ন, মিত্র বাহিনীর সমাবেশ - সংগ্রামের নোটবুক

ভারতীয় বাহিনীর রণ পরিকল্পনার প্রস্তুতি ও প্রণয়ন

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত কতগুলাে দিক নির্দেশনা প্রদান করে। এ নির্দেশনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জড়িত হয়ে পড়ার সম্ভাবনার ফলে সৃষ্ট যে-কোনাে ধরনের পরিস্থিতি তারা মােকাবিলা করতে বদ্ধপরিকর। এ থেকে আরও লক্ষ্য করা যায় যে, ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকেই এ সম্পর্কিত তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং পরবর্তীকালে এগুলাের সফল বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। ভারত সরকারের এরূপ কতকগুলাে গৃহীত পদক্ষেপ নিমে উল্লেখ করা হলাে:
ক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবে মূলত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে।
খ. ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করায় পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের ওপর হামলা করলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকেই সেই আক্রমণের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
গ, বাংলাদেশ সমস্যার কোনাে রাজনৈতিক সমাধান না হলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যুদ্ধ করার জন্য অবতীর্ণ হতে হবে।
ঘ, যুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াইয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নামতে হলে লক্ষ্য। হবে রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশকে দ্রুতগতিতে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর কবল মুক্ত করা।
ঙ. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশ নেয়ার অর্থই হবে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশ সীমান্তে নয়, পাকিস্তান সীমান্তেও চলবে।
চ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত চীনের ভূমিকার বিষয়টিও স্মরণ রাখতে হবে। উপযুক্ত বিষয়গুলাে বিবেচনায় এনে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী দুই ভাবে রণ পরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি গড়ে তুলতে থাকে। প্রথমত, মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে লড়াইয়ের জন্য পরিকল্পনা করা এবং পরিকল্পনানুযায়ী সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করার সময় ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রথমেই কতকগুলাে অসুবিধার কথা বিবেচনা করতে হয়। সেগুলাে নিম্নে উল্লেখ করা হলাে: ক. বাংলাদেশে অসংখ্য নদীনালা । কতকগুলাে নদী বিশাল হওয়ায় এগুলাে পারাপারের ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়তে হবে। খ. বাংলাদেশের নদীগুলাের অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হওয়ায় পশ্চিম থেকে পূর্বে অগ্রসর হওয়া কঠিন হবে; যদিও ভারত থেকে বাংলাদেশে কোনােও বড় সেনাবাহিনীকে পাঠাতে হলে পশ্চিম দিক থেকে পাঠানােই বেশি সুবিধাজনক। বাংলাদেশে রাস্তাঘাট অত্যন্ত কম । সেগুলােও অসংখ্য নদীনালার ওপর দিয়ে যাওয়ায় নদীনালার ওপর নির্মিত সেতুগুলাে ধ্বংস করে সহজেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে। ঘ. প্রয়ােজনীয় সংখ্যক সৈন্য, বিমান ও জাহাজ-বােট পাওয়া যাবে না। ও, উপরি-উক্ত অসুবিধাগুলাে সত্ত্বেও খুব দ্রুত ঢাকাসহ বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশে এমন সতর্কতার সাথে যুদ্ধ করতে হবে, যাতে সাধারণ নাগরিকের কোনাে ক্ষতি না হয়, দেশের সম্পদ ধ্বংস না হয় এবং যুদ্ধ চলবে শুধু পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। অর্থাৎ তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করতে হবে, কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এ যাবৎ সংঘটিত অন্যান্য যুদ্ধের মতাে সর্বাত্মক লড়াই করা যাবে না (মেজর রফিকুলইসলাম, পিএসসি, ১৯৯১: ১৪৫-১৪৭)। এ পরিস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে যার লক্ষ্য ছিল ৫টি: ১. প্রধান লক্ষ্য ক্ষিপ্রতা। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর লক্ষ্য ছিল যুদ্ধে। অবতীর্ণ হতে হলে ২ সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা পৌছাতেই হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য শহর বা ঘাঁটি দখলের জন্য সময় বা শক্তি নষ্ট করা হবে না।

প্রয়ােজনে সেগুলােকে এড়িয়ে যেতে হবে। শত্রুপক্ষকে ধোকা দেওয়া। শত্রুকে বােঝাতে হবে যে, তার চেয়ে অন্তত চার গুণ শক্তি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করছে। তা ছাড়া তাকে আরও দেখাতে হবে যে, ভারতীয় বাহিনী সব দিক থেকেই আক্রমণ করতে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, শত্রুপক্ষ তার সৈন্যবাহিনী কোনাে একটা এলাকায় জড়াে না করতে পারে এবং বাংলাদেশের চতুর্দিকে বিক্ষিপ্তভাবে সৈন্য ছড়িয়ে রাখতে বাধ্য হয়। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়া পাকিস্তানি বাহিনীকে পুনরায় একত্র হতে না দেওয়া। এতে পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় অন্য কোনাে দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধে নামতে সমর্থ হবে না। তা ছাড়া এতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে এনে তারা ঢাকা রক্ষার জন্য পদ্মা ও মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে কোনাে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে না। ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কোথাও কোনাে বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। ফলে ভারতীয় বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব কম হবে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সমর নায়কেরা ভালাে করেই জানতেন যে, কোথাও কোনাে বড়াে ধরনের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তাতে শুধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবে না, নিজেদের জাতীয় সম্পদও ধ্বংস হবে। এ জন্য ভারতীয় বাহিনী প্রথম থেকেই ঠিক করে যে, বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর তারা বড়াে সড়কগুলাে এড়িয়ে যাবে। যত দূর সম্ভব কাঁচা পথ দিয়ে চলাচল করার ওপর গুরুত্ব দেবে, যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ বা মাইন ফিল্ডগুলাে বাইপাস করা যায়। প্রথম থেকেই এমনভাবে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে যাতে বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল যুদ্ধের শুরুতেই ভেঙে দেয়া যায়। এতে সফল হলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।

উপরি-উক্ত ৫টি লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ভারত বাংলাদেশের প্রায় চতুর্দিকে সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটানাের সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা বাস্তবায়ন করে। উল্লেখ্য, ভারত বাংলাদেশের চতুর্দিকে যে সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটায় এর অধিকাংশই ছিল পার্বত্য ডিভিশনের। এ ডিভিশনগুলাে সাংগঠনিক দিক দিয়ে অন্যান্য ডিভিশনগুলাের মতাে হলেও কর্মপদ্ধতির দিক দিয়ে এদের কিছুটা পার্থক্য ছিল। যেমন- পাহাড় এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য প্রধানত এ ডিভিশনগুলাে গঠন করা হয়। তা ছাড়া তাদের অস্ত্রশস্ত্র একটু হালকা ধরনের। কারণ পার্বত্য এলাকায় ভূমির বন্ধুরতার জন্য চলাচল কঠিন হওয়ায় যে-কোনাে সৈনিকের জন্য অপারেশন করা শ্রমসাধ্য। তবে ট্যাংক বা ভারি কামান পার্বত্যাঞ্চলে বহন করা অসুবিধাজনক বলে প্রাধিকার না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ভূমির বৈশিষ্ট্যগুলাে বিবেচনায় এনে রণ কৌশল প্রণয়ন করতে গিয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রতিটি পার্বত্য ডিভিশনের সঙ্গে বাড়তি ট্যাংক ও আর্টিলারি রেজিমেন্ট সংযুক্ত করে। দ্বিতীয়ত, পার্বত্য ডিভিশনের সঙ্গে বড়ো ব্রিজ তৈরি করার মতাে কোনাে ইঞ্জিনিয়ার ইউনিট থাকে ।

কারণ, পাহাড়ের ওপর নদী সাধারণত প্রশস্ত হয় না। তবে বাংলাদেশে প্রশস্ত নদী থাকায় রণ কৌশলে প্রতিটি পার্বত্য ডিভিশনের সঙ্গে বড়াে বড়াে সেতু তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটও দেয়া হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর মােট ৪ ডিভিশন সৈন্য ছিল। সামরিক বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, কোনাে দখলদার বাহিনীকে উৎখাত করতে হলে আক্রমণকারীর অন্তত তিন গুণ শক্তি থাকা প্রয়ােজন। এ হিসেবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্তত বারাে ডিভিশন সৈন্য থাকার প্রয়ােজন ছিল। তা ছাড়া পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে সৈন্য, বিমান ও জাহাজ প্রাপ্তি কঠিন। তদুপরি চীন সীমান্তেও কিছু সৈন্য ও বিমান প্রস্তুত রাখা প্রয়ােজন। ভারত সৈন্য সংখ্যার ঘাটতি পূরণার্থে উত্তরে হিমালয় এবং আংশিকভাবে পূর্ব নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের সেনা অবস্থান থেকে সৈন্য সঞ্চালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর নেপথ্যে এ বিবেচনা কাজ করেছিল যে, শীতকালে ঐ সমস্ত এলাকা বরফাচ্ছাদিত থাকে। সুতরাং আক্রমণকারী বাহিনীর পক্ষে অগ্রাভিযান চালানাে কঠিন হবে। কিন্তু কোনােপ্রকারেই ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকা থেকে সৈন্য স্থানান্তর বিবেচনা করা হয়নি। সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানের সমাবেশকৃত ডিভিশনগুলাের বিপরীতে ভারতকে সমপরিমাণ শক্তির উপস্থিতি নিয়েই নিশ্চিত থাকতে হয়। ট্যাংক বহরের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রাধান্য থেকে যায়।  উত্তর-পূর্ব হিমালয় এবং এর নিমাঞ্চলে নিয়ােজিত লে. জেনারেল সগত সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ৪ কোরকে বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ কোরের অধীনে ন্যস্ত করা হয় ৮, ২৩ ও ৫৭ মাউন্টেন। ডিভিশনকে। এর মধ্যে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনটি হিমালয় থেকে নিয়ে আসা হয়। অন্যদিকে, ৮ ও ৫৭ ডিভিশন ২টিকে মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের বামপন্থি বিদ্রোহী নির্মূল অভিযান থেকে অব্যাহতি দিয়ে ৪ কোরের অধীন করা হয়। আগস্টের প্রথমেই ৪ কোরকে দ্বিখণ্ডিত করে চীনের সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করার জন্য ত্রিপুরা। রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত মােতায়েন করা হয়।

স্থলপথে অগ্রাভিযানের লক্ষ্যে প্রণীত রণ পরিকল্পনার পাশাপাশি ভারত পূর্বাঞ্চলে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও গড়ে তােলার পদক্ষেপ নেয়। তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আকাশপথে অন্তত রণাঙ্গনের গভীরে পর্যন্ত বিমান আক্রমণ চালানাে যাবে। বঙ্গোপসাগরের জলভাগে যুদ্ধের সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম সত্ত্বেও প্রয়ােজনে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে একটি কার্যকর নৌ-অবরােধ সৃষ্টির জন্যে। পূর্বাঞ্চলীয় নৌবহরকেও সক্রিয় করে তােলার পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। এভাবে একই সাথে স্থল, জল ও আকাশপথে সতর্ক মনােযােগ রেখে একটি বিশাল যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে। যুদ্ধের উপযােগী সরবরাহ ভান্ডার তৈরি এবং যােগাযােগ ব্যবস্থার বিষয়সহ যাবতীয় ব্যবস্থাপনা নিখুঁতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যুদ্ধ পরিকল্পনার পাশাপাশি সেই অনুযায়ী পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্নমুখী সেনা সঞ্চালন প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়। এ প্রক্রিয়া নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় (মেজর নাসির উদ্দিন, ১৯৯২: ২৩০-২৩২)।

মিত্র বাহিনীর সমাবেশ
লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিংয়ের নেতৃত্বে ৪ কোরের সদর দপ্তর আগরতলায় স্থাপন করা হয়। এর সাথে ৮, ৫৭ ও ২৩ পার্বত্য ডিভিশনসহ স্কোয়াড্রন পিটি৭৬, এস রুশ সাতারু ট্যাংক, ব্রিটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামানে সজ্জিত ১টি মাঝারি রেজিমেন্ট এবং ব্রিজ তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট রাখা হয়। ৩টি পার্বত্য ডিভিশনকে ভাগ করে বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে বিভিন্ন এলাকায় মােতায়েন করা হয় (আসাদুজ্জামান আসাদ, ১৯৯৬: ১০৪-১০৫)। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারতীয় বাহিনীর ৪ কোরের লক্ষ্য ছিল নিম্নরূপ: ক. স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মেঘনার পূর্বাঞ্চলে পুরােপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। প্রচণ্ড আঘাতে মেঘনার পূর্ব তীর বরাবর শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করে সর্বোচ্চ ৩ সপ্তাহের মধ্যে সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালী ও চট্টগ্রাম দখল। খ, এ সেক্টরের মধ্য ভাগ, বিশেষ করে আশুগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত মেঘনা তটরেখা কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্ব বহন করায় ভারতীয়। সমরবিদেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যে-কোনােভাবেই ঢাকার সাথে ‘লাইফ লাইন’ অর্থাৎ ঢাকা-চট্টগ্রাম যােগাযােগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। বন্দরনগর চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। গ, এতে ঢাকার সাথে সংযােগকারী মেঘনা নদীর তীর বরাবর আড়াআড়িভাবে অবস্থিত আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাঁদপুর- এ ৩টি প্রবেশদ্বারেও তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযােগ সৃষ্টি করা। ঘ, ফলে চূড়ান্তভাবে ঢাকায় আঘাত হানার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

অবশ্য ঢাকা দখল ৪ কোরের যুদ্ধ পরিকল্পনায় তখন পর্যন্ত রাখা হয় নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪ কোরের অধীনস্থ ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনকে কুমিল্লা ও কুমিল্লার দক্ষিণ এলাকা এবং নােয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চল দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ এ ডিভিশনকে মূলত লাকসাম, চাঁদপুর ও ফেনীর বিস্তৃত অঞ্চলে এবং একই সাথে এ বাহিনীরই অপর একটি অংশকে চট্টগ্রামে আক্রমণ চালানাের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এভাবে ৩টি সেনা ডিভিশনকেই ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণের এ পটভূমিতে মুক্তিবাহিনীর আনুমানিক এক লাখ সদস্য তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু আরও অন্তত ৪৫ হাজার মুক্তিযােদ্ধা বাংলাদেশের বিস্তৃত সীমান্ত বরাবর অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং ততদিনে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মুক্তিকামী মানুষও তাঁদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার পক্ষে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার জন্যে দেশের মধ্যে পুরােপুরি প্রস্তুত।

বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গণে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর ৮টি নিয়মিত ব্যাটালিয়নকে ৪ কোরের অধীনে উল্লিখিত ৩টি ডিভিশনের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এ রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ব্যাটালিয়নগুলাে চূড়ান্ত যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে ভারতীয় নিয়মিত বাহিনীর সাথে আক্রমণে অংশ নেবে। যৌথ কমান্ড গঠনের এ প্রক্রিয়ায় ২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ৫৭ ডিভিশন, ১, ৩ ও ৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ৮ মাউন্টেন ডিভিশন এবং ৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে রাখা হয় (মেজর নাসির উদ্দিন, ১৯৯২: ২৪২-২৪৪)।

 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড