চট্টগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়াভিযানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী
চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমিবিন্যাস ও ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের অন্যান্য অংশ থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এই খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচিত হয়েছে। এ অঞ্চলের বশির ভাগ এলাকা পাহাড়-পর্বতময় হওয়ায় এখানে সীমিত সংখ্যক রাস্তা বিদ্যমান। ফলে সৈন্য চলাচলের জন্য ক্ৰসকান্ট্রি পথ খুবই অসুবিধাজনক এবং রাস্তাগুলাে অপ্রশস্ত হওয়ায় এগুলাে দিয়ে চলাচলের সময় শত্রুকে অ্যামবুশ বা ফাদে ফেলা খুবই সহজতর। এ জন্য এসব রাস্তা ধরে সামরিক অগ্রাভিযান চালানােও সমস্যাসংকুল। পাহাড়-পর্বতগুলাে উত্তর-দক্ষিণে। লম্বালম্বিভাবে বিস্তৃত থাকায় রাস্তাগুলােও সেভাবে গড়ে উঠেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড ও রেললাইন কোনাে কোনাে স্থানে ভারতীয় সীমান্তের এতই কাছে যে ক্ষুদ্রান্ত্রের মাধ্যমেই চলমান সৈন্যকে আঘাত করা সম্ভব। ফলে মিত্র বাহিনীর পক্ষে ঢাকা অভিমুখী চলাচল খুবই সহজতর হয়। কিন্তু রাস্ত গুলাে উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত এবং সমগ্র অঞ্চল পাহাড়-পর্বতময় হওয়ায় অক্ষগুলাে (Approach) অত্যন্ত সংকীর্ণ। তা ছাড়া সমগ্র এলাকা ঘন বনভূমিতে। আবৃত থাকায় সামরিকবাহিনীর জন্য হাইড আউটে থাকা সুবিধাজনক হলেও অসংখ্য পাহাড়ি নদীনালা ও ঝরনা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত থাকায় সামরিক যানবাহন ও সৈন্য সঞ্চালন করা দুরূহ ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
চট্টগ্রামের সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য মূলত সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, ভারী শিল্পকারখানা, গ্যাস ফিল্ড, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। একই কারণে অঞ্চলটি ভূ-কৌশলগত দিক দিয়ে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি। বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদিতেও এ অঞ্চলটির প্রভাব যথেষ্ট। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের দক্ষিণে ও পশ্চিমে। বঙ্গোপসাগর অবস্থিত হওয়ায় ভারতমহাসাগরের সাথে যােগাযােগ খুবই সহজতর। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অঞ্চলটির গুরুত্ব যুগ যুগ ধরে। বজায় রয়েছে। সমুদ্রপথে বহিঃশত্রুর আক্রমণের জন্য চট্টগ্রাম অঞ্চল যেমন উন্মুক্ত, তেমনি পরাশক্তিগুলাের জন্যও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলােসহ অন্য দেশগুলােতে আক্রমণ পরিচালনা করা সহজতর। এমনকি, যুদ্ধের সময় সাজসরঞ্জাম ও রসদ।
সরবরাহ, সৈন্যদের স্থানান্তর, স্থানীয়ভাবে খাদ্যশস্য ও মাছের সহজলভ্যতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের গুরুত্ব সর্বাধিক প্রকৃতিগতভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বর্ষাকালে সামরিক অভিযান সীমাবদ্ধ রাখা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। কিন্তু নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এ অঞ্চল চলমান অপারেশনের জন্য যথােপযুক্ত। এ অঞ্চলের পূর্বাংশে ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় দুর্গম সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত থাকায় প্রকৃতিগতভাবে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত হিসেবে বিবেচিত। সে জন্যই লক্ষণীয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সৈন্যসামন্ত প্রয়ােজনের তুলনায় কম হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানাের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। উপযুক্ত কারণেই শুধু গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােয় সৈন্যসমাবেশ ঘটিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানি বাহিনী তাদের। রণ পরিকল্পনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থানভিত্তিক সৈন্যসমাবেশ করেছে। অন্যদিকে মিত্র। বাহিনী এতদঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যসমাবেশের রণ কৌশলগত দিকগুলাে বিবেচনায় এনেই কেবল অগ্রাভিযান পরিচালনা করেছে।
মিত্র বাহিনীর অগ্রাভিযানের প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমান্বয়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়ায় সেখানকার অর্থনীতিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। ভারত বৃহৎ শক্তিবর্গকে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বার বার অনুরােধ জানানাের পরও কোনাে ফলপ্রসূ সমাধানে পৌঁছানাে সম্ভব হয় নি। বিবিসি’র সাথে ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন যে, “পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত বরাবর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলে তা ভয়াবহ যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।” আমেরিকান টেলিভিশন সংস্থার সাথে এক সাক্ষাকারে ১১ আগস্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, “দুটো দেশই এখন যুদ্ধের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। আমি হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য আমরা যুদ্ধ করব।” ইয়াহিয়া খান প্যারিস থেকে প্রকাশিত লা ফিগারাে পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ১৯৭১ সালের ১ সেপটেম্বর বলেন, “আমি এ মর্মে সমগ্র বিশ্বকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই। যে, তারা যদি মনে করে, বিনা যুদ্ধে এক বিন্দু জমি দখল করতে পারবে, তবে তারা মারাত্মক ভুল করছে। এর অর্থই হবে সর্বাত্মক যুদ্ধ।” জিওসি ইন ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তান টাইমসে প্রকাশিত এক ঘােষণায় বলেন, “ভারত যদি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চায়, তাহলে সে যুদ্ধ হবে ভারতের মাটিতে।” পাকিস্তানি সমর নায়কদের এ ধরনের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে ভারত ও পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে। জড়িয়ে পড়তে পারে ( আসাদুজ্জামান ” ৭, ১৯৯৬: ৮৯-৯০)। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা প্রাপ্ত কতিপয় দেশের অভিজ্ঞতার আলােকে ভারত ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কোনােভাবেই দীর্ঘায়িত করা যাবে না।
এমনকি যুদ্ধ শুরু হলে তা শুধু বাংলাদেশ রণাঙ্গনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তব্যাপী যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটবে। তা ছাড়া এ যুদ্ধ পরিকল্পনায় চীনের দিক থেকেও আঘাত আসতে পারে-এমন একটি হুমকির মােকাবিলার বিষয়ও বিবেচনায় আনা হয়। কারণ, ১৩ এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে, তা নিছক একটি গণ্ডগােল। মাত্র এবং প্রতিবেশী ভারত এ গণ্ডগােলের সুযােগ নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে। তাই তিনি এমন আশ্বাসও দিয়েছিলেন যে, প্রয়ােজনে চীন ভারতের বিরুদ্ধে যে-কোনাে যুদ্ধে বন্ধুপ্রতিম পাকিস্তানের পাশে থাকবে। চীনের এরূপ মনােভাবে ভারতীয় সমর ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে চীনের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করে ভারতীয় সমরবিদেরা হিমালয় সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় চীনের আক্রমণের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে বিবেচনা করেন। ফলে তারা বাংলাদেশের যুদ্ধে ভারতের উত্তরে চীন সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করার ঝুঁকি নিতেও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এমনকি তারা চীনের সম্ভাব্য হুমকি মােকাবিলার জন্য প্রতিবেশী শক্তিধর সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একটি সামরিক চুক্তিও সম্পাদন করে (আসাদুজ্জামান আসাদ, ১৯৯৬: ২৩০-২৩২)। নভেম্বরের শুরু থেকেই ২৪ পরগনা, নদীয়া, দিনাজপুর, কুচবিহার, আসামের বিভিন্ন প্রান্ত এবং ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনারা ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে, ভারতীয় সেনাবাহিনীও সীমান্ত রক্ষীদের (বিএসএফ) সাহায্যে এ আক্রমণের জবাব দিতে থাকে।
ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি বিনিময় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে আখাউড়া এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড গােলা বর্ষণে ভারতের কমরপুর শহর এবং আশপাশের কতকগুলাে গ্রাম ক্ষত্রিস্ত হয়। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানি সেনারা আখাউড়ার কাছে একটি শক্তিশালী ঘাটি তৈরি করে। কারণ, আখাউড়া ছিল বাংলাদেশের ট্রেন-সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। চট্টগ্রাম ঢাকা-সিলেট-ময়মনসিংহ রেলপথে আখাউড়া একটি অন্যতম জংশন হিসেবেও বিবেচিত। এখান থেকেই ঢাকাসিলেট-ময়মনসিংহে ৩টি রেললাইন বহমান। তাই পাকিস্তানি সমরবিদেরা ভালাে করেই বুঝতে পেরেছিল যে, ভারত মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে আখাউড়া দখল করার চেষ্টা করবে, যাতে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের যােগাযােগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। এ জন্য পাকিস্তানি সেনারা ধরে নেয় যে, পাকিস্তানভারত যুদ্ধ শুরু হলে ভারত অবশ্যই আখাউড়া দখলের চেষ্টা করবে। এরূপ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা সম্ভাব্য যুদ্ধের মােকাবিলার লক্ষ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামসিলেটের যােগাযােগ ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য ফেনীতে কংক্রিট দিয়ে বাংকার তৈরি। করে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। পরে এ ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি সেনারা ভারতীয় এলাকায় প্রচণ্ড গােলা বর্ষণও চালাতে থাকে। ভারতও তাদের গােলাগুলির জবাবে ৮ নভেম্বর ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিগুলােয় আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়। এর ফলে ভারত দুই দিক দিয়ে লাভবান হয়। প্রথমত, ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকার ওপর পাকিস্তানি সেনাদের কামানের গােলা বর্ষণের ক্ষমতা কমে যায়। দ্বিতীয়ত, মুক্তিবাহিনীও অধিক ফলপ্রসূভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার সুযােগ পায় ।
নভেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রতিটি সেক্টর এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস, ক্ষিপ্রতা ও অবশ্যম্ভাবী বিজয় দেখে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ সময় সীমান্ত সংলগ্ন বিরাট এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। সারা দেশে গেরিলা তৎপরতা এত বৃদ্ধি পায় যে, পাকিস্তানি সেনারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মনােবল সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তের বালুরঘাট, গেদে ও বয়রা সীমান্তে উভয়পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি চলতে থাকে বয়রা সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের জবাব দেওয়ার জন্য এক পর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কপােতাক্ষ নদ অতিক্রম করে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানি বাহিনীও ১৪টি চীনা স্যাফি ট্যাংকসহ ভারী কামান নিয়ে ভারতীয়দের মােকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যায়। ফলে ২১ নভেম্বর উভয় পক্ষ পরস্পর মুখােমুখি হয় এবং একটি প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা ১৩টি ট্যাংক, ৩টি যুদ্ধবিমান এবং বেশ কিছু সৈন্য হারিয়ে পিছু হটে যায়। তা ছাড়া আখাউড়ার মতাে হিলির স্থানিক গুরুত্ব বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা হিলিকে সব সময় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। তাই তারা রেল। ওয়াগন মাটির নিচে বসিয়ে শক্ত বাংকার তৈরি করে। পরে ২৫, ২৬ ও ২৭ নভেম্বর গােটা বালুরঘাট এলাকায় উভয়পক্ষের মধ্যে ট্যাংক আক্রমণ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধেও পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এভাবে খণ্ড খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ থেকেই বাংলাদেশের সব সীমান্তেই পাকিস্তানভারত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একত্রে মিত্র বাহিনী গঠনের মাধ্যমে ঢাকা দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় (আসাদুজ্জামান আসাদ, ১৯৯৬: ২৩২-২৩৫)।
পাকিস্তানি বাহিনীর রণ কৌশল প্রণয়ন ও প্রস্তুতি
পাকিস্তানি সৈন্যরা শুকনাে মৌসুমে অর্থাৎ অক্টোবরের শুরু থেকেই তাদের প্রতিরক্ষা। ব্যবস্থার প্রয়ােজনীয় বিন্যাস শুরু করে। এ জন্য তারা ভারতীয় সীমান্তে ৭০ হাজার। সৈন্যের ৫টি পদাতিক ডিভিশন মােতায়েন করে। তা ছাড়া তাদের সাথে ৩০ হাজার সদস্যের আধা সামরিকবাহিনীও সংযুক্ত করা হয়। ৫০ হাজার রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যকেও প্রয়ােজনীয় সাহায্য ও সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। পাকিস্তানি সেনারা রণ কৌশলের আওতায় মুক্তিবাহিনীর। অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য তাদের সমস্ত শক্তি ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় নিয়ােজিত করে। তারা সীমান্ত থেকে ১০-১৫ মাইল, কোথাও কোথাও ৩০-৪০ মাইল পর্যন্ত বড়াে বড়াে সড়কের ওপর অসংখ্য বাংকার তৈরি করে। উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র সীমান্ত রক্ষা করা। তাই পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর গতিরােধ করার জন্য উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার দুর্ভেদ্য করে তােলার চেষ্টা করে। পরে সীমান্তের সব পাকা রাস্তার ওপর প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। মিত্র বাহিনী যেখানেই সৈন্যসমাবেশ ঘটিয়েছে সেখানেই তার বিপরীতে পাকিস্তানি বাহিনী শক্তিশালী বাংকার তৈরি করে তাতে ভারী কামানসহ সৈন্যদের নিয়ােজিত করে (আসাদুজ্জামান আসাদ, ১৯৯৬: ১০৭-১০৮)। কিন্তু কোনােভাবেই ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর গতিরােধ করতে সমর্থ হয় নি। এমতাবস্থায় তারা বুঝতে পারে যে, পশ্চিম থেকে অতিরিক্ত সৈন্য এনেও পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করা যাবে না, বরং তা করতে গেলে পাকিস্তানের ভারতীয় সীমান্তে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে ফেলা হবে।
তাই পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা ৩টি বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন করে এবং সে অনুযায়ী প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ বিকল্প ব্যবস্থাগুলাে হলাে: ক. ভারতের দখলীকৃত পূর্বাংশকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করা এবং পূর্ব রণাঙ্গনে তাদের ভাষায় আক্রমণকারী বাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে একটি পর্যায় পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা, যাতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সাহায্যে ভারতের সাথে গ্রহণযােগ্য। একটি নিষ্পত্তি অর্জন করা যায়। খ. পূর্বাঞ্চলে সামরিক পরাজয়ের ঘাটতি পূরণে পশ্চিমে ভারতের বিরুদ্ধে। সুনির্দিষ্ট বিজয় অর্জন করা, যাতে এ বিজয় থেকে দখলীকৃত ভারতীয় ভূখণ্ডের বিনিময়ে পূর্বাংশে বাংলাদেশ সংকট প্রশ্নে একটি অনুকূল রাজনৈতিক মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায়। প্রবাসী বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে। গ্রহণযােগ্য একটি সমঝােতায় পৌছানাের উদ্যোগ নেয়া হবে।
কিন্তু দেখা গেল যে, এক পর্যায়ে কলকাতার মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একাংশের সাথে ইতােমধ্যেই সংলাপের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ উভয়ই এ সংলাপ প্রক্রিয়ার শুরুতেই উৎসাহ প্রদর্শন করে। ভারত সরকার ঘটনাটি জানার পর সংগত কারণেই রুষ্ট ও চিন্তিত হয়ে ওঠে। দ্রুত এ উদ্যোগের বিপক্ষে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ | নেওয়ার ফলে সংলাপ প্রক্রিয়া তখনই বন্ধ হয়ে যায়। তাই পাকিস্তানের গ্রহণীয়। তিনটি বিকল্প ব্যবস্থার শেষটির কোনাে কার্যকারিতা থাকে নি। ফলে পাকিস্তানি সমরবিদেরা বাংলাদেশ রণাঙ্গনের বিস্তৃত সীমান্তরেখায় তাদের প্রাপ্ত সমর শক্তির পুরােটাই নিয়ােজিত করার মাধ্যমে একটি মাত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রচনা করে; যাতে প্রয়ােজনে এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে ক্রমান্বয়ে মধ্যাঞ্চলের দিকে। কেন্দ্রীভূত করা যায়। পরিশেষে, ঢাকাকে কেন্দ্র করে তারা বৃত্তাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যাতে করে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। পাকিস্তানের এরূপ পরিকল্পনার পাশাপাশি যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে জেনারেল নিয়াজি শহরকেন্দ্রিক যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নে সচেষ্ট হন। তিনি যশাের, ঝিনাইদহ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ভৈরব, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামকে প্রতিরক্ষা দুর্গে পরিণত করার নির্দেশ দেন। অর্থাৎ এসব শহরকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলাই এ নির্দেশের মূল কথা। উদ্দেশ্য, এসব শহরে অগ্রসরমাণ ভারতীয় বাহিনীকে বাধাদান করে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করা। উল্লেখ্য, শহরগুলাের প্রতিটি ঘাটিতে ৬০ দিনের রসদ ছাড়া ন্যূনতম ৪৫ দিনের রেশন জমা করা হয়। তা ছাড়া জেনারেল নিয়াজি ডিভিশন কমান্ডারের অনুমতি ব্যতিরেকে সীমান্তে নিয়ােজিত বাহিনীর যে-কোনাে ধরনের পশ্চাদপসরণ নিষিদ্ধ করেন। তবে তিনি দিক নির্দেশনা দেন। যে, কৌশলগত পশ্চাদপসরণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লে সে ক্ষেত্রে কিছুটা পিছু হটা যাবে এবং এ রকম পরিস্থিতিতে পশ্চাদপসরণরত বাহিনীকে নিকটবর্তী দুর্গশহরে এসে আশ্রয় নিতে হবে (মেজর নাসির উদ্দিন, ১৯৯২: ২৪৫-২৪৭)। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সমর নায়কেরা ৩টি পর্যায়ে সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। যেমন: প্রথম পর্যায়-২৫ মার্চ থেকে | এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। এ পর্যায়ে পকিস্তানি সামরিক পরিকল্পনা ছিল, সমস্ত শহরে বাঙালিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়া এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের চিহ্নিত করে তাদেরকে শেষ করে দেওয়া।
দ্বিতীয় পর্যায়-মুক্তিবাহিনী গেরিলা কায়দায় আক্রমণ শুরু করলে রণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে গেরিলাদের স্থানীয়ভাবে ধ্বংস। করার জন্য রাজাকার ও আলবদর নামে ২টি বাহিনী সংগঠিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ জন্য সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গড়ে তােলা হয়। রাজাকার বাহিনী প্রধানত অত্যাচারী দল হিসেবে এবং আলবদর বাহিনী প্রধানত ধর্মান্ধ যুবক ও গুণ্ডাশ্রেণির লােকদের নিয়ে গঠন করা হয়। রাজাকার বাহিনীর হাতে অস্ত্র হিসেবে দেওয়া হয় প্রধানত রাইফেল এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলাে ছিল: ১. গেরিলাদের খুঁজে বের করা; ২. গেরিলাদের সাহায্যকারী ও আশ্রয়দাতাদের ওপর অত্যাচার চালানাে এবং তাদের নাম-পরিচয় পাকিস্তানি সেনাদের সরবরাহ করা; ৩. ব্রিজ-রেললাইন ইত্যাদি পাহারা দেওয়া; এবং ৪. আলবদর বাহিনীকে শহর ও শহরের আশপাশে যারা পাকিস্তান বিরােধী এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সমর্থক, তাদের খুঁজে বের করা এবং সেই অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাদের খবর দেওয়া। পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল, যেভাবেই হােক মিত্র বাহিনীকে সীমান্ত এলাকায় বাধা দিয়ে বিলম্ব ঘটানাে এবং সীমান্তে সব কয়টি পাকা রাস্তার ওপর শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে অগ্রসরমাণ মিত্র বাহিনীকে প্রতিহত করা। পাকিস্তানি বাহিনী এমনভাবে যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করে, যাতে ১৪০০ মাইল বিস্তৃত সীমান্ত এলাকায় শক্ত ঘাঁটি, প্রচুর গােলাবারুদ ও রসদসামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য মিত্র বাহিনীকে বিলম্বিত করা যায় (আসাদুজ্জামান আসাদ, ১৯৯৬: ১০৫-১০৬)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড