পাকিস্তান সরকারের দলিলে এ নৌ-কমান্ডাে অভিযানের স্বরূপ
১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের সেই দুঃসাহসিক ও ধ্বংসাত্মক নৌ-কমান্ডাে অভিযান এবং তাতে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির ওপর তদন্ত করে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ একটি খসড়া রিপাের্ট তৈরি করে। এ রিপাের্টে ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। কমান্ডাে অভিযানের ধারণা ক্রম, আক্রমণের সময় ক্রম, আক্রান্ত জাহাজের নাম এবং ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানে ২টি জাহাজের ক্ষতির বর্ণনা দেওয়া হলাে:
ক, পাকিস্তানি পতাকাবাহী এমভি হরমুজ ৯৯১০ টন মালামাল নিয়ে করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ১৪.০৮.৭১ তারিখে ১৩ নম্বর জেটিতে নােঙর করে।
খ) পাকিস্তানি পতাকাবাহী এমভি আল-আব্বাস ১০৪১৮ টন মালামাল নিয়ে করাচি থেকে ০৯.০৮,৭১ তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে নােঙর করে। পরে জাহাজটি জেটি পরিবর্তন করে ১২ নম্বর জেটিতে নােঙর করে।
গ) ওরিয়েন্ট বার্জ ২৭৬ টন মালামাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ‘ফিস হারবার জেটিতে ঢাকা আসার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল।
ঘ) হরমুজ জাহাজের মাস্টারের বিবৃতি মতে, ৪ নম্বর হােল্ডে রাত ১টা ৪০ মিনিটে আর রাত ১টা ৪৮ মিনিটে আল-আব্বাসে বিস্ফোরণ ঘটে। ১টা ৫৫ মিনিটে তৃতীয় ও ২টা ২ মিনিটে চতুর্থ বিস্ফোরণ ঘটে।
ঙ) আল-আব্বাস মাস্টারের বিবৃতি মতে, ১টা ৫২ মিনিটে ২ নম্বর হােল্ডে বিস্ফোরণ, ১টা ৫৫ মিনিটে ২য় বিস্ফোরণ ঘটে।
চ) ওরিয়েন্ট বার্জের সারেংয়ের বিবৃতি মতে, প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে রাত ২টা ৩০ মিনিটে, ২য় বিস্ফোরণ রাত ৩টায় এবং ভাের ৬টার দিকে বার্জটি প্রায় তলিয়ে যায়।
ছ) নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের বিভিন্ন জাহাজের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা রয়েছে।
জ, সামরিক কর্তৃপক্ষের পরিদর্শনের তথ্য, কাউকে দায়ী করতে না পারা এবং চূড়ান্ত তদন্ত করার প্রয়ােজনীয়তা নেই মন্তব্য প্রদত্ত।
ঝ) তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যবিবরণীতে বলা হয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ভাবতেই পারে নি, এমন ধ্বংসাত্মক অপারেশন চলতে পারে। নিরাপত্তা জোরদার করার। লক্ষ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ দ্রুত জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তা ছাড়া দলিলটি থেকে জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে নিম্নলিখিত অংশ উদ্ধৃত হলাে। নৌ-কমান্ডাে অপারেশনে সংঘটিত এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতির পাকিস্তানি সরকারের ভাষ্য প্রাপ্তি এ প্রথম:DAMAGE CAUSED DUE TO EXPLOSIONS
M.V ‘HORMAZD: Hole at No. 4 hold. Two steel plates H 20
& J 21 hold: 64″ vertical, 33″ horizontal. Two steel plates H 20 & J 21 Hold: indented 10′-6″ horizontal 9 vertical frames & beam 45, 46, 47 Twisted. Cargo battens & Supports broken. Damage to cargo in way of No. 4 Lower Hold filled
with river Water. M.V ‘AL-ABBAS’: Hole at fore peak & No. 2 Hold Measured
as: Fore peak = 2′ x 3′ No. 2 Hold = 2′-10″ x 6′-3″ Buckled = 6’6″ x 5′-00″
Cargo in No. 2 hold damaged. (বিস্তারিত দেখুন এই গ্রন্থের ত্রয়ােদশ অধ্যায়ে; দলিল নম্বর ৫২৫, চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত রচনায় দলিলটি অত্যন্ত মূল্যবান, মৌলিক, গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক)
দ্বিতীয় অপারেশন ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্টের সফল নৌ অপারেশনে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অকেজো হয়ে পড়লে নিরাপত্তার কারণে বিদেশি জাহাজগুলাে বঙ্গোপসাগরের গভীর জল সীমায় রাত্রি যাপন করতে বাধ্য হয়। এসব বহিঃনােঙর করা জাহাজ থেকেও শত্রুপক্ষ যুদ্ধাস্ত্র ও মালামাল খালাস করত। এ পরিপ্রেক্ষিতে নৌকমান্ডােরা পরিকল্পনা করেন, তাঁরা গভীর সমুদ্রের ঐ সমস্ত জাহাজও আক্রমণ এবং ধ্বংস করবেন। দ্বিতীয়ত, গভীর সমুদ্রে নােঙর করা জাহাজে কোনাে নিরাপত্তা ৫হর ন কয় নৌ-ভােরা ঐ স্থানে নৌ অপারেশন পরিচালনা অত্যন্ত উপযুক্ত ও নি মনে করেন তাঁর দ্বিান্ত গ্রহণ এবং পরিকল্পনা করেন, বহিঃনােঙরে অবস্থানরত সমরাস্ত্র ও তেলের জাহাজ ডুবিয়ে দেবেন। সেই সাথে বিদেশি। জাহাজও আক্রমণ করে বিদেশিদের চট্টগ্রাম বন্দরে নৌযান পাঠাতে নিরুৎসাহিত করবেন। তারা স্থির করেন, যে করেই হােক বহিঃসমুদ্রে নােঙর করা আলােচ্য জাহাজে এ অপারেশন চালাতে হবে। কারণ: ..এই অভিযান যদি সফল করা যায়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর অপারেশনের চেয়েও বড়াে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়েও বহিঃনােঙরে অবস্থানরত জাহাজের সংখ্যা অনেক বেশি। সমরাস্ত্রবাহী। জাহাজসহ তেলের ট্যাংকারও রয়েছে সেখানে। পাকিস্তানিদের কাছে গুরুত্বের।
দিক থেকে সমরাস্ত্রের পরই রসদ হিসেবে তেলের স্থান। এ তেল সরবরাহ পুরােপুরি অচল করা সম্ভব হলে দখলদার পাকিস্তানিদের বড় রকমে ঘায়েল করা। যাবে। উপরন্তু, বহিঃনােঙর অপারেশনে বিদেশি জাহাজগুলাে যদি তলিয়ে দেয়া। যায় সেটাও হবে একটি বড় সাফল্য। এর ফলে বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলাে। বাংলাদেশের জলসীমায় তাদের জাহাজ পাঠাতে আর সাহসী হবে না। (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪: ৮৭)
প্রাথমিক পরিকল্পনা
নৌ-কমান্ডাে ফারুক-ই-আযম মুক্তিযােদ্ধা এনায়েত মওলাসহ অন্য কয়েকজন সহযােদ্ধার সমন্বয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনােঙরে বিদেশি জাহাজগুলােয় অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পিত গুরুত্বপূর্ণ এ অভিযানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন এনায়েত মওলা এবং নৌ-কমান্ডােদের গ্রুপ নেতা স্থানীয় কমান্ডাে ফারুকই-আযম। সঙ্গে ছিলেন দুর্ধর্ষ নৌ-কমান্ডাে জেড আবেদীন কাজল ও সাইদুর রহমান এবং স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা লােকমান গনি চৌধুরী। তারা পারস্পরিক সমঝােতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন, নৌকায় করে কমান্ডােরা জাহাজ বরাবর গিয়ে সমুদ্রে নেমে পড়বেন। তারপর সাতরে গভীর সমুদ্রে নােঙর করা জাহাজের কাছে পৌছাবেন এবং দ্রুত মাইন লাগিয়ে নৌকায় করে ফিরে আসবেন। এ অপারেশনে কমান্ডাের সংখ্যা থাকবে মােট ১১জন। তাদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য থাকবেন আরও কিছু গেরিলা। ঠিক হয় রাতের শেষ ভাটায় কমান্ডােরা নৌকা নিয়ে চলে যাবেন গভীর সমুদ্রে আর মাইন লাগিয়ে জোয়ারের সময় চলে আসবেন তীরে। আর ফিরতি নৌকা না পাওয়া গেলে সাঁতরে নির্দিষ্ট স্থানে চলে আসবেন। তারা আরও সিদ্ধান্ত নেন যে, অপারেশন শেষে তীরে ফিরে আসার সময় ইস্টার্ন রিফাইনারির বাতিঘর ডান দিকে রেখে সাঁতার কাটবেন। অন্যথায় শক্রর হাতে ধরা পড়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যাবে।
পর্যবেক্ষণ ও চূড়ান্ত পরিকল্পনা
অপারেশন অধিনায়ক ফারুক-ই-আযমের নেতৃত্বে ছােটো একটি পর্যবেক্ষণ দলকে জাহাজের দূরত্ব ও অন্যান্য তথ্যসংগ্রহের জন্য পাঠানাে হয়। তারা এ বিষয়ে বিশদ তথ্য পাওয়ার পর অপারেশনের সময় ও কার্যবিধি চূড়ান্ত করেন। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রণীত বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হয়। স্থির হয়, নৌ-কমান্ডােদের নিয়ে ছােটো গ্রুপ গঠন করা হবে, অপারেশনের জন্য বঙ্গোপসাগরের জোয়ারভাটার একটি নির্দিষ্ট সময় বেছে নিতে হবে, অপারেশনটি অবশ্যই রাতে পরিচালিত হবে। এবং রাতটি হতে হবে ঘন অন্ধকারময়। নিরাপদে অপারেশন পরিচালনার জন্য কমান্ডােরা কর্ণফুলির ওপারে মােহনার কাছাকাছি একটি নির্জন স্থান নির্ধারণ করেন। অপারেশন শেষে ফিরতি পথে দিক নির্দেশনা ঠিক রাখার জন্য মাঝে মাঝে পানি থেকে মাথা তুলে দিক ঠিক করে নিতে হবে এবং কমান্ডােদের নদীর অপর পাড় বরাবর সমুদ্রকূলে উঠতে হবে। সেখানে তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রস্তুত থাকবে সশস্ত্র স্থল মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বিশেষ দল।
অপারেশন
অপারেশনের দিন মােট ১১জন কমান্ডাে সমুদ্রতীরের পূর্বনির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হন। কিন্তু যে নৌকায় তাঁদের সাগরে যাওয়ার কথা, তা যথাসময় না পৌছালে কমান্ডােরা সেদিনের অপারেশন পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। ২ দিন পর পুনরায় নৌকা ছাড়াই অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে কমান্ডােরা কর্ণফুলি নদীর পূর্ব মােহনায় জলদিয়া বাতিঘরের। কাছাকাছি একটি স্থান থেকে ভাটার পর সমুদ্রে নেমে পড়েন। এ অপারেশনে কমান্ডােরা ছিলেন মােহাম্মদ হােসেন ফরিদ, আমির হােসেন, গােলাম মাওলা, সাইদুর রহমান, মননু, জেড আবেদীন কাজল, আবু মুসা চৌধুরী, নুরুল হক, রশিদ, তাহের, মনােজ ও হাশেম। কিন্তু প্রায় দেড় ঘণ্টা সাঁতরানাের। পরও দুঃসাহসী কমান্ডােরা টার্গেটের কাছাকাছি পৌছাতে পারে নি। কারণ, পর্যবেক্ষণ করার মধ্যে নৌ-কমান্ডােদের একটি ভুল থেকে যায়। ভুলটি ছিল। বহিঃনােঙরের সঠিক দূরত্ব অনুমান করার বিষয়। পর্যবেক্ষণকালীন তাঁরা অনুমান। করেছিলেন, এ দূরত্ব দেড় থেকে ২ মাইলের বেশি হবে না। স্বল্পতম দূরত্বের কথা। ভেবেই নৌ-কমান্ডােরা ঐ পথ সাঁতার কেটে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন । কিন্তু বাস্তবে যথার্থ দূরত্ব ছিল তাদের অনুমানের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। ইতােমধ্যে ভাটা শেষ হয়ে সমুদ্রে শুরু হয় উত্তাল জোয়ার নৌ-কমান্ডােরা বুঝতে পারেন তাদের ভুল। অবশেষে প্রতিকূল সমুদ্রে দূরত্বের মরীচিকায় ক্লান্ত কমান্ডােরা এবারও অপারেশন পরিকল্পনা পরিত্যাগে বাধ্য হন।
পাহাড় সম উঁচু উত্তাল তরঙ্গ আর ঝােড়াে বাতাসের বিপরীতে তীরে আসার জন্য কমান্ডােরা ক্লান্ত শরীরে ফিরতি যাত্রা শুরু করেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন। নৌ-কমান্ডাে বিপর্যস্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসী ও মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় রক্ষা পান। বাকি ৭জন মেরিন একাডেমির কাছে মৃতপ্রায় অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। এঁদের মধ্যে পরে কমান্ডাে ফরিদ অমানুষিক অত্যাচারে শহিদ হন। অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের পর ঢাকা সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ অপারেশনটি সম্পর্কে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র ১১ নম্বর খণ্ডের ২৭০ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত উল্লেখ আছে। ১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর থেকে (মুক্তিযুদ্ধ) নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, ফোর্সেস সদর দপ্তর এবং এশলন সদর দপ্তর, বিডিএফ-এর কাছে পাঠানাে ১৫ অক্টোবরের বার্তা নম্বর জি-০৫৪৮-এ বলা হয়, ২৩ অক্টোবর ১০জনের একটি নৌ-কমান্ডাে গ্রুপ ৩০ মাইল ভিতরে গভীর সমুদ্রে এক অপারেশনে যায়। কিন্তু তারা সেখানে পৌঁছাতে পারে নি। নৌ-কমান্ডাে দলটি তীরে ফিরলেও তাদের ১জন মােহাম্মদ হােসেন। সমুদ্রের গভীর পানিতে ডুবে মারা যায়। অন্যরা বিভিন্ন বেইসে এসে পেীছেন। এঁদের মধ্যে ৩জন পুরােনাে পাকিস্তানি নৌ বেইসের কাছে শক্রর হাতে ধরা পড়েন। এ ৩জন ছিলেন এস এন মাওলা, নুরুল হক ও আমির হােসেন। নৌকমান্ডাে আবুল হাসেম পুরােনাে শেল্টার থেকে শত্রু কর্তৃক ধৃত হন।
ফলাফল ও বিশ্লেষণ
এটি একটি চরমভাবে ব্যর্থ অপারেশন। এ ব্যর্থতা নৌ-কমান্ডােদের মনােবলে ঋণাত্মক ভূমিকা রাখে। অপারেশনের ব্যর্থতার মূল কারণ, পর্যবেক্ষণ রিপাের্ট থেকে বহিঃনােঙরের দূরত্বসংক্রান্ত প্রাপ্ত ভুল তথ্য। পর্যবেক্ষণ রিপাের্টে বলা হয়েছিল, তীর থেকে বহিঃনােঙরের দূরত্ব ১ থেকে দেড় মাইল। এ দূরত্ব ভেবে। নিয়েই কমান্ডােরা তাদের অপারেশন পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে সাহসী হয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃত দূরত্ব ছিল প্রায় ১০ মাইলের মতাে। উত্তাল সমুদ্রে এ দূরত্ব সাঁতরে গিয়ে অপারেশন করা কোনােক্রমেই সম্ভব নয়। ফলে কমান্ডােদের এ দানবীয় সাহসের খেসারত দিতে হয় চরমভাবে। ১১জনের। মধ্যে ৬জন বেঁচে গেলেও ১জন কমান্ডাে শহিদ হন। বাকি ৪জন পাকিস্তানি। সেনাদের হাতে বন্দি হন। অনভিজ্ঞ লােকদের দ্বারা পর্যবেক্ষণ করানাের মূল্য ছিল। অত্যন্ত চড়া। এ অপারেশনের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানি সেনারা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় তল্লাশি ও অত্যাচার চালায়। যার কারণে অনেক স্থল মুক্তিযােদ্ধাও শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। এতে চলমান গেরিলা যুদ্ধও খানিকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে ।
তৃতীয় অপারেশন: ২ অক্টোবর, ১৯৭১
বহিঃনােঙরের পূর্বোক্ত অপারেশন ব্যর্থ হলে নৌ-কমান্ডােরা প্রথমে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও উদ্যম হারান নি। তারা সুযােগ খুঁজতে থাকেন কীভাবে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর প্রতিশােধ নেয়া যায়। অক্টোবরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ইস্টার্ন রিফাইনারির টেকনিক্যাল ম্যানেজার আজিজুর রহমান নৌ-কমান্ডােদের খবর দেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি বার্মা ইস্টার্নের জেটিতে একটি বিশাল গ্রিক তেল ট্যাংকার এমভি অ্যাভলুস এবং আরেকটি ছােটো সরঞ্জামবাহী জাহাজ ‘মানা নােঙর করেছে। প্রাপ্ত খবরের ভিত্তিতে নৌ-কমান্ডােরা ঠিক করেন জাহাজ ২টিতে। অপারেশন চালিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ নােঙরে পুনরায় বাধা সৃষ্টি করবেন। দ্বিতীয়ত, অপারেশনটি সফল হলে শক্ত ঘাঁটিতে তেলের সংকটও সৃষ্টি হবে। বিশ্লেষণটি এ রকম: জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়া সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি বড়াে ধরনের তােলপাড় শুরু হবে এবং তারপর অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের ট্যাংকার কর্ণফুলির ত্রিসীমায় ঢুকতে সাহসী হবে না। একই সাথে এ পরিস্থিতি শত্রুপক্ষে ব্যাপক জ্বালানি ঘাটতির সৃষ্টি করবে। যুদ্ধজয়ের চেয়েও এর গুরুত্ব অনেক। বেশি। যুদ্ধের সময় গুলি ও জ্বালানির মধ্যে খুব পার্থক্য থাকে না (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪ : ৯৬)।
পর্যবেক্ষণ
জাহাজগুলাের অবস্থান, নিরাপত্তাব্যবস্থা, রক্ষীদের সংখ্যা ও অবস্থান, জাহাজের কাছে পৌছার ও ফিরে আসার সবকিছু পর্যবেক্ষণের জন্য কমান্ডাে ফারুক-ইআযম, আজিজুর রহমান ও তার স্ত্রীসহ গাড়িতে করে বন্দর এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। দ্বিতীয় বার ফারুক-ই-আযম অন্য দুই সহযােগী নুরুল হক ও নুর মােহাম্মদকে নিয়ে ঐ এলাকা পর্যবেক্ষণ করে আক্রমণের দিক, সম্ভাব্য বাধা, বাধা এড়ানাের সম্ভাব্য উপায় প্রভৃতি বিষয়ের ওপর প্রয়ােজনীয় ও তীক্ষ পর্যবেক্ষণ চালান। পর্যবেক্ষণকালে তারা দেখতে পান, একটি বিশাল আয়তনের তেলের। ট্যাংকার বার্মা ইস্টার্নের জেটি সংলগ্ন জায়গায় নােঙর করে আছে। আরেকটি গ্রিক মালিকানাধীন জাহাজ অ্যাভলুস এবং ঐ জাহাজের কাছাকাছি জল সীমায়। অপেক্ষাকৃত ছােটো আকারের অপর একটি জাহাজও তারা দেখতে পান।
পরিকল্পনা
পর্যবেক্ষণ রিপাের্ট পাওয়ার পর ঐ জাহাজ ২টিতে নৌ অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ অপারেশনের প্রধান পরিচালক ছিলেন ফারুক-ইআযম। তিনি ঠিক করেন, এ অপারেশনে ২জন নৌ-কমান্ডাে পাঠানাে হবে। তারা প্রত্যেকে জাহাজে ২টি করে মাইন লাগাবেন। তারা গুপ্তখাল দিয়ে কর্ণফুলি নদীতে প্রবেশ করবেন ফারুক-ই-আযম কর্তৃক নির্বাচিত কমান্ডােদ্বয় মুসা চৌধুরী ও নেজকে কল্পনার সব সঠিক দিক বুঝিয়ে দিয়ে মুসা চৌধুরীকে ‘অ্যাভলুস এবং ‘মন’য় মনােজকে মাইন স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অপারেশন
অপারেশনের সার্বিক দিক বুঝে নিয়ে কমান্ডােদ্বয় মাদারবাড়ির আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ট্যাক্সিতে করে পূর্ব কাঠঘরের নুরউদ্দিনের বাড়িতে পৌছেন সন্ধ্যার পর পর। এখানে তারা অপারেশনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাত ১২টার দিকে ফারুক-ই-আযম ও নুরুল হককে সাথে নিয়ে নদীর শহরমুখী পাড়ের পােস্তাগােলা বরাবর গুপ্তাখালের কাছে এসে পৌঁছেন। তারপর মনােজ ও মুসা পানিতে নেমে পড়েন। একটু সামনে। যাওয়ার পর তাদের সামনে পড়ে একটি ব্রিজ। ব্রিজটির ওপর পাকিস্তানি সেনারা টহলরত ছিল। কমান্ডােদ্বয় সতর্কতার সঙ্গে ডুব দিয়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হয়ে কর্ণফুলি নদীতে পৌছেন। তারপর নিরাপদে দ্রুত পূর্বপরিকল্পনা মাফিক জাহাজ ২টির গায়ে ২টি করে মাইন লাগিয়ে দেন। মাইন লাগানাে শেষ করে তারা সাঁতরে। নদীতীরে উঠে গ্রাম্য পথ দিয়ে ছদ্মবেশে নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থানে চলে যান।
ফলাফল
যথাসময়ে মাইনগুলাে বিস্ফোরিত হয়ে এমভি অ্যাভলুস’ ও ‘মানা সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়। প্রতিহিংসাপরায়ণ পাকিস্তানি সেনারা প্রতিশােধ নিতে কর্ণফুলি নদীতীরের জেলেপাড়া ও চরলৈক্ষায় সাধারণ জনগণের ওপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। এ সফল অভিযানে কমান্ডােদের দুর্বল হয়ে যাওয়া মনােবল প্রতিশােধ নিতে পারায় আবার চাঙা হয়ে ওঠে। এ অপারেশনটি বিস্তারিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র ১১ নম্বর খণ্ডের ২৭০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত আছে। ১ নম্বর সেক্টরের সদর সপ্তর থেকে পাঠানাে ১৫ অক্টোবরের বার্তা নম্বর জি০৫৪৮-এ বলা হয়, ১ অক্টোবর নৌ-কমান্ডাে কর্তৃক অ্যাভলুস নামে একটি গ্রিক তেলবাহী জাহাজ ধ্বংস হয়। নৌ-কমান্ডােদের দ্বারা ঐ জাহাজে লাগানাে সব। মাইনই স্বল্পতম সময়ের ব্যবধানে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ফাটল দিয়ে প্রবল বেগে পানি জাহাজের ভিতর ঢুকে পড়লে বিশাল ও ভারী অ্যাভলুস পানির ওপর আর বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে না পেরে খাড়া হয়ে সম্পূর্ণ ডুবে যায় । তেল ট্যাংকারটি ছিল ১৭ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন। প্রায় একই সাথে দ্বিতীয় জাহাজটিও ডুবে যায়। নৌ-কমান্ডােদের এ সাফল্য ব্যাপক, অতুলনীয় এবং উদ্দীপক উপাদানপূর্ণ। এতে উঁম দক্ষতা ও পরিকল্পনার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়। এ সফল অপারেশন পাকিস্তানি পক্ষের মনােবল ভেঙে দেয়।
নৌ-কমান্ডাে অপারেশন সম্পর্কে একজন গাইডের ভাষ্য থেকে তাঁর কার্যক্রম এখানে তুলে ধরা হলাে। এতে কমান্ডােদের কর্মধারা ও অপারেশন পরিকল্পকদের বিষয়ে জানা যাবে। আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে যে-সকল নৌ-কমান্ডাে ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, তাদেরকে গাইড করার দায়িত্ব দেয়া হয় পটিয়ার মুক্তিযােদ্ধা মাে. ইউনুছকে। তিনি নৌ-কমান্ডােদের গাইড করে ডবলমুরিং থানার পানওয়ালা পাড়া আশ্রয় হলে নিয়ে যান। তারপর অনেক কষ্টে ও বুদ্ধির ব্যবহারে তাদেরকে সেখান থেকে কর্ণফুলি নদী পার করে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট চরলৈক্ষা ইউনিয়নের বালুচরস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। সেখানে আব্দুল মান্নান। ও ফকির আহমদকে এদের আশ্রয়ের দায়িত্ব দিয়ে পুনরায় মাে, ইউনুছ নৌকমান্ডােদের অস্ত্র আনার জন্য চট্টগ্রাম শহরে ফিরে আসেন। বাংলাবাজার ঘাটে পৌছে তিনি দেখতে পান নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানি সেনারা ঐ ঘাট দিয়ে লােক পারাপার বন্ধ করে দিয়েছে। মাে. ইউনুছ বিকল্প পথ ব্যবহার করে মওলানা সৈয়দের সাথে যােগাযােগ করেন। ১৪ আগস্ট শহর থেকে টহলের জন্য কোনাে অস্ত্র নদীর অপর পাড় চরলৈক্ষাতে নেয়া সম্ভব হয় নি। পরদিন মওলানা সৈয়দের সহায়তায় অনেক মাইন ও স্টেনগান বড়াে বড়াে টুকরির ভিতর ভরে বিভিন্ন শাকসবজি দিয়ে এবং কতকগুলাে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। তারপর এগুলাে ডবলমুরিং থানার পানওয়ালা পাড়া থেকে কাধে ও মাথায় করে মাঝিরঘাটে আনা হয়। সেখান থেকে।
অস্ত্রগুলাে সাম্পানযােগে ঐ দিনই চরলৈক্ষার বালুচরের আশ্রয় স্থলে নিরাপদে পৌছানাে সম্পন্ন হয়। ১৫ আগস্ট দিবাগত রাত ১টা ৫৫ মিনিটে নৌ-কমান্ডােদের জন্য অভিযান শুরুর সিগন্যাল হিসেবে ভারতের কলকাতা রেডিও স্টেশন থেকে প্রত্যাশিত ইঙ্গিতমূলক গান আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি বেজে ওঠার সাথে সাথে ৪০জন নৌ-কমান্ডাে ৪টি ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রথম গ্রুপটি আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আবদুল মান্নানের গাইডে, ২য় গ্রুপটি মাে, শাকিব আহমেদের গাইডিংয়ে, তৃতীয় গ্রুপটি কবির মেম্বারের গাইডিংয়ে এবং চতুর্থ গ্রুপটি মাে. ইউনুছের গাইডিংয়ে কর্ণফুলি নদীর পাড়ে পৌঁছেন। প্রথম ২টি গ্রুপ ইছানগর থেকে এবং অপর ২টি গ্রুপ ভাঙারচর থেকে কর্ণফুলি নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে রাত ৩টার দিকে। ১ ঘণ্টা পর বিকট আওয়াজে সমস্ত চট্টগ্রাম কেপে ওঠে এবং সাথে সাথে আল-আব্বাস ৭ নম্বর ও হরমুজ ১৩ নম্বর জেটিতে ডুবতে আরম্ভ করে । সফল অপারেশন শেষে নৌ-কমান্ডােরা শেষ রাত্রিতে চরলৈক্ষার বালুচরে আশ্রয় স্থলে ফিরতে শুরু করেন। ৮-১০জন নৌ-কমান্ডাে আশ্রয় কেন্দ্রে এসে পৌছাতে না পৌছতেই মাে. ইউনুছ উপস্থিত নৌ-কমান্ডােদের নিয়ে শেল্টার ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। কারণ, ইতােমধ্যে সূর্য উঠে যাচ্ছিল এবং দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি। বাহিনী চারদিক থেকে প্রচণ্ড ও বেপরােয়া গতিতে গােলাগুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। ইতােমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে নৌ-কমান্ডােরা নিরাপদ শেল্টারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ইউনুছ ৩০-৩২জনের নৌ-কমান্ডাে গ্রুপটি নিয়ে পূর্ব দিকে বাের্ড বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
প্রায় ২ মাইল পথ চলার পর তারা বাের্ডবাজারস্থ এয়াকুবের বাড়িতে পৌছেন। কিন্তু এয়াকুব তাদের আশ্রয় দিতে রাজি হয় নি। কারণ, তার বাড়ির পাশেই ছিল রাজাকারদের ক্যাম্প। তবে তিনি তাদের সাহায্য করার জন্য ইউনুছের সাথে পুনরায় পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করেন। আধা মাইল যাওয়ার পর তারা ইব্রাহীম সওদাগরের বাড়িতে পৌছেন। এ বাড়িটিও নৌ-কমান্ডােদের জন্য নিরাপদ ছিল না। কারণ, দিনের আলােয় নৌ-কমান্ডােদের উপস্থিতি অনেকে দেখে ফেলেছিল। ঐ বাড়িতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তারা দুজন দুজন করে চট্টগ্রাম শহরের পানওয়ালা পাড়া শেল্টারে ফিরতে শুরু করেন। তবে অভিযানের পর নিরাপত্তার খাতিরে নৌ-কমান্ডােরা তাদের অস্ত্রগুলাে ইব্রাহীম সওদাগরের বাড়িতে রেখে যান। পরে ক্যাপটেন করিম ঐ অস্ত্রগুলাে উদ্ধার করেন। এরই মধ্যে ঐ দিন পাঞ্জাবিরা ত্বরিতগতিতে মৎস্যবন্দরে ক্যাম্প করে এবং আশপাশের লােকালয়ে নৌ-কমান্ডােদের অনুসন্ধানে অত্যাচার শুরু করে। বিকেলের দিকে নৌ-কমান্ডােরা তাদের শেল্টারের ছাদ থেকে দেখতে পান, নদীর ঐ পাশের বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে। এ শেল্টার থেকে নৌ-কমান্ডােরা পুনরায় ভারতে চলে যান। পরে পানওয়ালা পাড়া শেল্টার থেকে দুজন মুক্তিযােদ্ধা আবু ও জোশ মােহাম্মদ ধরা পড়েন। ফলে মাে. ইউনুছ ঐ শেল্টারে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে তাঁর নিজ এলাকা চরলৈক্ষায় ফিরে আসেন এবং গােপন আশ্রয়ে লুকিয়ে থাকেন।
কয়েক দিন পর আরেক দল নৌ-কমান্ডাে ডা. শাহ আলমের নেতৃত্বে পটিয়ায়। কৈ গ্রামের শামসুল হক সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। মাে. ইউনুছকে তাঁর গােপন আশ্রয় স্থলে খবর দেওয়া হয়, যেন তিনি এ গ্রুপের গাইড হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১২ ডিসেম্বর আরেকটি নৌ-কমান্ডাে অপারেশন পরিচালনা করার পরিকল্পনা হয়। ঐ রাতে ইউনুছ নৌ-কমান্ডােদের গাইড করে ২০জন নৌ-কমান্ডােকে ১ নম্বর। জেটির পূর্ব দিকে চর পাথরঘাটা এলাকায় পৌছে দেন। কিন্তু ঐ দিন অপারেশন করা যায় নি। কারণ, প্রস্তুতি নিতে নিতে বেশি রাত হওয়ায় আকাশে চাঁদ উঠে। গিয়েছিল। চাঁদের আলােয় অপারেশন করা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তারা শেল্টারে ফিরে আসার জন্য চর পাথরঘাটা এলাকা থেকে যাত্রা করেন। তারা পথিমধ্যে মাইনগুলাে। চরলৈক্ষার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক মওলানা জামানের ছেলে ইসলামের কাছে রেখে আসেন। ১৪ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে তারা আবার অপারেশনের জন্য মাে, ইউনুছের গাইডিংয়ে বন্দরের দিকে যাত্রা করেন। চর পাথরঘাটার ব্রিজ ঘাটে তারা অপারেশনের প্রস্তুতি নেন। রাত ২টার দিকে অপারেশনের উদ্দেশ্যে কর্ণফুলি। নদীতে নেমে পড়েন। এ অপারেশনে সুরাইয়া ও টেকনাফ নামে ২টি জাহাজ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। সফল অপারেশন শেষে কমান্ডােরা নিরাপদ আশ্রয় স্থল হিসেবে ঐ গ্রামে ফিরে আসেন (মাে. ইউনুছ, চরলৈক্ষা, পটিয়া, ২০০২)। দুঃসাহসিক, সুপরিকল্পিত এবং সফল এ নৌ-কমান্ডাে অভিযান পৃথিবীতে সংঘটিত অসংখ্য স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিবৃত্তে অত্যন্ত বিরল এক ঘটনা। বয়সে। তরুণ, শিক্ষিত, তীব্র আবেগপ্রবণ, উচ্চাভিলাষী কিন্তু অসমসাহসী এবং স্বল্প সময়ে সুপ্রশিক্ষিত এক দল কমান্ডাে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষক নৌ-কমান্ডাে অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, এ দেশের মানুষ তাদের স্বপ্নের স্বাধীনতাকে যােগ্যতাবলেই অর্জন করে নেবে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড