You dont have javascript enabled! Please enable it! চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম অপারেশন অপারেশন জ্যাকপট - সংগ্রামের নোটবুক

চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম অপারেশন অপারেশন জ্যাকপট

চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৯৭১ সালের ২৮ জুলাই। ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর রফিক ও ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় ডেল্টা সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং সম্মিলিতভাবে এ অপারেশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অপারেশনের পূর্বে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক অবস্থা, পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান ও শক্তি, বন্দরে পৌছানাের নিরাপদ গতিপথ, আশ্রয় স্থল, সমুদ্রবন্দরের জোয়ারভাটার তালিকা, মানচিত্র, সাংকেতিক নির্দেশনা, নৌকমান্ডােদের প্রত্যাগমন ও নিরাপত্তার জন্য সাহায্যকারী দল, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ১৪ আগস্ট রাতে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-কমান্ডাে অপারেশন। পরিচালিত হবে। এ প্রসঙ্গে হুমায়ন হাসান উল্লেখ করেন, ১৪ আগস্ট পাকিস্তানিদের কাছে তাদের জাতীয় জীবনের একটি বিশেষ গুরুত্ববাহী দিবস হিসেবে চিহ্নিত। ঐ দিন তাদের স্বাধীনতা দিবস। স্বভাবতই দিবসটি তারা আনন্দ-উল্লাস আর পান-ভােজনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করবে। ধরে নেয়া হয়, স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের কারণে ১৪ আগস্ট বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী বড় ধরনের কোনাে সামরিক অভিযানে যাবে না। একই কারণে তাদের নিরাপত্তামূলক সতর্কতায়ও কিছুটা শৈথিল্য আসতে পারে। আর এ সুযােগটি সযত্নে কাজে লাগানাের জন্যই অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার উপযুক্ত সময় হিসেবে ১৪ আগস্টের রাতটিকে বেছে নেয়া হয় (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪: ৬৪)।

তবে পরে বিভিন্ন বাস্তব কারণে (কমান্ডাে দল সময়মতাে যথাস্থানে পৌঁছতে পারায়) নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের তারিখ এক দিন পিছিয়ে ১৫ আগস্ট করা। হয়েছিল। তবে এ তারিখ পরিবর্তনের কথাটি নৌ-কমান্ডাে দলের নেতা ছাড়া আর কাউকে জানানাে হয় নি। নৌ-কমান্ডাে অপারেশন পরিকল্পনা প্রসঙ্গে রফিকুল। ইসলাম, বীর উত্তম বলেন: ২৮ জুলাই আমি ভারতীয় বাহিনীর ডেল্টা’ সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং-এর সাথে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি। চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর ও কর্ণফুলী নদীর ম্যাপ ও চার্ট পর্যালােচনা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করি। এ ধরনের। অভিযানে চন্দ্ৰতিথি, আবহাওয়ার অবস্থা, জোয়ার-ভাটার সময়, বাতাস, স্রোতের গতি-প্রকৃতি এবং আরও অসংখ্য তথ্য গুরুত্ব সহকারে আলােচিত হয়। মে মাস থেকেই আমি চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ধরনের কর্মতৎপরতা ও জাহাজ চলাচলসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করছিলাম। ফলে, জুলাই মাসের ২৮ তারিখে যখন আমরা পরিকল্পনায় বসলাম, ততক্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকাণ্ড ও কর্মচঞ্চলতা এবং কর্ণফুলী নদীতে জাহাজ চলাচলসম্পর্কিত বিস্তারিত সব তথ্যই আমাদের হাতে ছিল (এ প্রসঙ্গে এ গ্রন্থের দলিলপত্র খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে সন্নিবেশিত ৩৪০ নম্বর দলিলে জনৈক মারফি প্রেরিত চট্টগ্রাম।

বন্দরসম্পর্কিত গােয়েন্দা রিপাের্ট দ্রষ্টব্য; সম্পাদক) তাই আমরা সহজেই অনুমান করতে পারছিলাম যে, বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এ যােদ্ধারা (পরে নৌ-কমান্ডাে হিসেবে পরিচিত হয়) এ অভিযান পরিচালনায় কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে এবং কোন কোন পর্যায়ে কোথায় পাকিস্তানিদের সাথে তাদের সংঘর্ষ ঘটতে পারে। বন্দরে নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বন করছে এবং সেখানে প্রহরারত সেন্ট্রিদের মানসিক অবস্থা ও সার্বিক প্রস্তুতিই বা কেমন? সবকিছু সম্পর্কেই তত দিনে। আমাদের বেশ স্বচ্ছ ধারণা হয়ে গিয়েছিল। রাতের বেলা নদীতে সব ধরনের নৌ-চলাচল বন্ধ ছিল। শুধু পাকিস্তানিদের গানবােটগুলাে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর প্যাট্রল ডিউটিতে বেরিয়ে যেত। তাদের প্যাট্রলিংয়ে আসা-যাওয়ার সময়সূচি যদি আমাদের জানা থাকে এবং আমরা যদি আমাদের পরিকল্পনা। সম্পূর্ণ গােপন রাখতে পারি, তাহলেই এ ধরনের অভিযান চালানাে সম্ভব। অভিযানের দিন হিসেবে ১৪ আগস্ট নির্ধারিত হলাে, সে দিনটি পাকিস্তানিদের স্বাধীনতা দিবস। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৪ আগস্ট রাতের বেলা ৬০জন নৌকমান্ডাে কর্ণফুলি নদী সাঁতরিয়ে বন্দরের দিকে চলে যাবেন এবং সেখানে ‘বার্থিং করা সমুদ্রগামী ও অন্যান্য জাহাজে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘লিমপেট মাইন লাগিয়ে ভাটার টানের সাথে চলে যাবেন সমুদ্রের দিকে। ততক্ষণে পিছনে শুরু হয়ে যাবে তুমুল কাণ্ড। এক এক করে অনেক জাহাজ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং মূল জেটিও যথেষ্ট ক্ষগ্রিস্ত হতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ অভিযানের জন্য নির্বাচিত ৬০জন নৌ-কমান্ডাে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে ৮ আগস্ট চট্টগ্রামের পথে রওনা হবে। (রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, ১৯৮৯: ২৬৬)

অপারেশনের পরিকল্পনা
পরিকল্পনায় স্থির হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নির্ধারিত ৩টি গ্রুপের ২টি গ্রুপ স্থলপথে এবং ১টি গ্রুপ জলপথে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ অপারেশন পরিচালনার জন্য পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন গাইডের মাধ্যমে চট্টগ্রামের চরলৈক্ষায় পৌছবে। তারপর তারা অপারেশনের জন্য মােট ৬০জন নৌ-কমান্ডাে ৩টি গ্রুপে ভাগ হয়ে অংশগ্রহণ করবে। নৌ-কমান্ডােরা কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত নির্ধারিত ওয়েভে বাজানাে গান-সংকেতের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরের একটু দূর থেকে কর্ণফুলি নদীতে নেমে সাতরে বন্দরে পৌছবে। সেখানে নােঙর করা প্রতিটি জাহাজে ৩টি করে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দেবে। তারপর ভাটার টানের সাথে সাথে তীরে পৌছে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবে।

প্রস্তুতি ও যাত্রা পথ
নৌ-কমান্ডাে দল বাংলাদেশে প্রবেশের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট ভারতের পলাশি ঘটি ত্যাগ করে। ঐ দিনই কলকাতার ব্যারাকপুর সেনানিবাসে পৌঁছে। পরদিন ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে করে তারা আগরতলার বিএসএফএর নিউ ক্যাম্পে এসে পৌছায়। এখানে কমান্ডােদের পরিকল্পনা, দল বিভাজন, সমন্বয়, গতিপথ, অপারেশন স্থলের মানচিত্র, জোয়ারভাটার সময়, স্রোতের গতিসহ অপারেশন সংক্রান্ত সার্বিক বিষয়াদি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ৮ আগস্ট কমান্ডােরা নিউ ক্যাম্প ছেড়ে হরিণা পৌছেন। এখানে কমান্ডাে দলের নেতা এ ডব্লিউ চৌধুরী ১ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর রফিকের কাছ থেকে অপারেশনসংক্রান্ত প্রয়ােজনীয় নির্দেশ ও সামরিক সরঞ্জাম বুঝে নেন। এগুলাের মধ্যে ছিল প্রত্যেকের জন্য ২টি করে লিমপেট মাইন, ধারালাে ছুরি, ১ জোড়া কাপড়ের জুতা, ১ জোড়া ফিনস, ১টি সুইমিং কস্টিউম, ১টি হাফপ্যান্ট ও ১টি চটের ব্যাগ। এ দিনই কমান্ডাে দল হরিণা ক্যাম্প ত্যাগ করে শ্রীনগর ক্যাম্পে পেীছে এবং ঐ দিন রাতেই বাংলাদেশে প্রবেশের উদ্দেশ্যে শ্রীনগর ক্যাম্প ত্যাগ করে। কিন্তু সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রহরার কারণে তারা। ৯ আগস্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। ১০ আগস্টেও একই কারণে তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা সফল হয় নি। অবশেষে ১১ আগস্ট বৃষ্টি আর অন্ধকারের সুবিধা নিয়ে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে নৌ-কমান্ডােদের ২টি গ্রুপ স্থলপথে আর অন্য গ্রুপটি জলপথে বাংলাদেশে প্রবেশের উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্থলপথে আসা গ্রুপ ২টি পথপ্রদশর্কের সাহায্যে সাবরুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে হেঁটে ছাগলনাইয়া থানার জিনারহাট, রানাঘাট ও ফাজিলপুর হয়ে মুহুরি নদীর তীরবর্তী কৃষ্ণমন্দার বাজার এলাকায় পৌছে। সেখান থেকে কমান্ডােরা নৌকা করে মুহুরি ও ফেনী নদী পার হয়ে মিরসরাই থানার ইছাখালী গ্রামে পৌছেন। কমান্ডােরা তারপর মলিইয়াস, সুফিয়া, মগাদিয়া, মায়ানি, শাহেরখালী ও ডােমখালী হয়ে ১২ আগস্ট সমিতির হাটের কাছে করম আলী বাজারে পৌছেন (খলিলুর রহমান, ১৯৯৭: ৯০-৯১)। | উল্লেখ্য, এ পর্যায়ে তারা তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম ইছাখালীতে রেখে এসেছিলেন। পরে সেখান থেকে এগুলাে নূর মােহাম্মদ নামে এক গাইড সাম্পানে করে ফৌজদারহাটে নিয়ে আসেন। তারপর এখান থেকে অস্ত্র ও অন্য সরঞ্জামাদি তরিতরকারির ঝুড়ির নিচে লুকিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পিকআপে করে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর কমান্ডােরা যাত্রী বেশে বাসে করে শহরে পৌছেন। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় ৪০জনের কমান্ডাে দলটি আগ্রাবাদের মমতাজ মহল ও কাকলীসহ অন্যান্য গােপন আশ্রয় কেন্দ্রে পৌছে। এখানে উল্লেখ্য, ২০জনের তৃতীয় কমান্ডাে দলটি সীতাকুণ্ড থানার সলিমপুরে জেলেপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরােধে আটকে পড়ায় অপারেশনে অংশ নিতে পারে নি। সেখান থেকে নৌকমান্ডােরা শ্রমিকের বেশে মুক্তিযােদ্ধা আজিজুর রহমানের সহায়তায় বিদ্যুৎ বিভাগের পিকআপ ও অ্যাম্বুলেন্সে করে কর্ণফুলি নদীতীরস্থ মাঝিরঘাট খেয়াঘাটে পৌছেন। এখান থেকে কমান্ডােদের অস্ত্র ও অন্য সরঞ্জামাদি তরকারির ঝুড়িতে লুকিয়ে নৌকায় করে নদীর অপর তীর চরলৈক্ষার আশ্রয় স্থলে পৌছে ১৪ আগস্ট।

এদিকে ১৪ আগস্ট, ১৯৭১ তারিখে ‘ট্রানজিস্টার’ ‘অন’ করতেই আকাশবাণী কলকাতার গানের অনুষ্ঠানে দলনেতা শুনতে পেলাে পুরােনাে একটা বাংলা গান, ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাইনি। প্রতিদান।’ শুধু নৌ-কম্যান্ডােদের জন্যই এ গান। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওঁদের জন্য কলকাতা কেন্দ্র থেকে অন্য একটি গান প্রচারিত হবে এবং তারপর ট্রানজিস্টার ছুড়ে ফেলে দেয়া হবে। যুদ্ধের জন্য এসে গান শুনতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকতে হবে না আর। …১৫ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলাে সেই গান, যার জন্য দলনেতা উক্তষ্ঠিত হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন; ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি…।’ ১৪ আগস্টের প্রথম গানটি আসলে একটা গােপন সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ ছিল ২৪ ঘণ্টার । মধ্যেই দ্বিতীয় গান প্রচারিত হবে, অভিযানের জন্য অবিলম্বে প্রস্তুতি নিয়ে ফেল’। এখন ১৫ আগস্টে প্রচারিত এ গানটিতে ছিল সুস্পষ্ট নির্দেশ: অবিলম্বে যেভাবেই হােক মূল ‘অপারেশন চালাতে হবে। (রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, ১৯৮৯: ২৬৯-২৭০)

পর্যবেক্ষণ
বন্দরে অপারেশন সফল করার জন্য অপারেশন স্থল পর্যবেক্ষণ করার লক্ষ্যে নৌকমান্ডােরা চরলৈক্ষার আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ছােটো ছােটো গ্রুপে ভাগ হয়ে ১৫ আগস্ট সতর্কতার সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের অপর পাড়ে এসে পৌঁছেন। এখানে তারা নদীতে নামার স্থান, স্রোতের সময়, গতি, বন্দরে অবস্থিত জাহাজের সংখ্যা, আকৃতি ও অবস্থান প্রভৃতি বিষয়ে ভালাে করে পর্যবেক্ষণ করেন। বন্দর এলাকা পর্যবেক্ষণকালীন তারা দেখতে পান: বন্দরের ১২ নম্বর জেটিতে নােঙর করা আছে এমভি আল-আব্বাস নামের একটি অস্ত্রবােঝাই জাহাজ। হাজার টনের ওপর সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে জাহাজটি বন্দরে ভিড়েছে ৯ আগস্ট। কিন্তু তার মালামাল এখনাে খালাস করা হয়নি। বন্দরের সবচেয়ে বড় জাহাজ এমভি হরমুজ। পাকিস্তানের এ জাহাজটিতেও রয়েছে প্রায় হাজার টন যুদ্ধাস্ত্র। এমভি হরমুজ বন্দরে ভিড়েছে মাত্র এক দিন আগে ১৪ আগস্ট। এ জাহাজের মালামালও খালাস হয়নি। জাহাজটি নােঙর করেছে ১৩ নম্বর জেটিতে। বড়াে আকারের এ জাহাজ ২টির কাছাকাছি জলসীমায় আরও কয়েকটি বার্জ বা গানবোেট নােঙর করা আছে। এর একটিতে রয়েছে প্রায় ৩০০ টনের মতাে সমরাস্ত্র। কয়েকটি গানবােটও আছে। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে। জাহাজগুলোর সঠিক অবস্থান এবং অন্যান্য রেকি পর্ব শেষ করে আবার চরলৈক্ষার ঘাটিতে ফিরে যান কমান্ডােরা। দলনায়ক মােটামুটি মুখস্থ করে নিলেন পুরাে চিত্রটি। (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪: ৭৯)।

অপারেশন
পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গৃহীত পরিকল্পনা মােতাবেক অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে শত্রুপক্ষের অত্যধিক সতর্কতা ও শক্তির কারণে ৩জন নৌ-কমান্ডাে এ ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে বাকি ৩৭জনকে ৩জনের ছােটো ছােটো গ্রুপে ভাগ করা হয়। তারা প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি শেষে চরলৈক্ষার আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তানি সেনাদের গানবােটের নিরন্তর টহল ও জাহাজের সার্চ লাইটের তীব্র আলাে এড়িয়ে রাত ১টার দিকে কর্ণফুলি নদীতে নেমে পড়েন। তারপর দক্ষতার সাথে সাঁতরে কাছে গিয়ে সন্তর্পণে টার্গেট করা জাহাজগুলােয় মাইন লাগিয়ে দিয়ে পুনরায় সাঁতার কেটে তীরে ফিরে আসে। অল্পক্ষণ পরই মাইনগুলাে একে একে বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে হুমায়ন হাসানের বর্ণনা: কর্ণফুলীর ওপারে নৌ-কমান্ডােরা পায়ে ফিনস এবং পেটে গামছায় মাইন বেঁধে নিয়ে ছােটো ছােটো দলে পৃথক হয়ে নিঃশব্দে নেমে পড়েছেন পানিতে। নদীতে এখন জোয়ারের শেষ বেলা। একটু বাদেই ভাটার হালকা টান শুরু হবে। কমান্ডােরা এ জোয়ার-ভাটার সন্ধিক্ষণে ফিনসের হালকা টানে পানির ওপর নাক জাগিয়ে হাঁসের মতাে এগিয়ে যান জাহাজের দিকে। কোনাে জাহাজে মাইন লাগাবে তা আগে থেকেই ঠিক করে দেয়া আছে। কমান্ডােদের একটি দল নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি এসে নিঃশব্দে ডুব দিলাে। ভেসে উঠলাে এমভি আল-আব্বাসের শরীর ঘেঁষে। এখানটায় বন্দরের আলাে কিংবা সার্চলাইটের ফোকাস পড়েনি। প্রায় একই সময় অন্য একটি দল ভেসে ওঠে। এমভি হরমুজের গা ছুঁয়ে । বাদবাকি কমান্ডােরাও ততােক্ষণে পৌছে গেছে। অন্যান্য গাধাবােট ও গানবােটের কাছে।

মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে আল-আব্বাসের ইস্পাতের শরীর ছুঁয়ে আবার ডুব দিলেন কমান্ডােরা। ৩জন কমান্ডাে জাহাজের তিন জায়গায়, বিশেষ করে ইঞ্জিন রুম এবং বয়লার সােজা ৪-৫ ফুট পানির নিচে ৩টি মাইন সেঁটে দেয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কোমরের ছুরি দিয়ে নির্দিষ্ট ঐ স্থানের শ্যাওলা সরিয়ে অনায়াসেই মাইন লাগিয়ে দেন তারা। একইভাবে হরমুজ ও অন্য জলযানগুলােতেও মাইন লাগিয়ে দেয়া হলাে। এদিকে তখন নদীতে ভাটার টান। শুরু হয়ে গেছে। কমান্ডােরা এবার জাহাজের আড়াল ত্যাগ করে লম্বা এক ডুব দিয়ে যত দূর সম্ভব সরে গিয়ে ভেসে ওঠেন। তারপর আগের মতােই নাক জাগিয়ে হাঁসের পা দুলিয়ে নিঃশব্দে সাঁতরে ফিরে যান ওপারের দিকে। (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪: ৮১)।

ফলাফল
নৌ-কমান্ডােদের এ দুঃসাহসিক নৌ অপারেশনে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০টি টার্গেট সম্পূর্ণ ধ্বংস ও নিমজ্জিত হয়। এমভি আল-আব্বাস, এমভি হরমুজ, বার্জ ওরিয়েন্ট, ২টি গানবােট, ছােটো ছােটো কয়েকটি বার্জ ধ্বংস হয়। এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারিত হয়ে গেলে বিদেশি জাহাজ চট্টগ্রাম আসতে অসম্মতি জানায়। এ অপারেশন মুক্তিযুদ্ধের চরিত্রে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি ও গতিতে নতুনতর মাত্রা যুক্ত করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের নতুনভাবে যুদ্ধ পরিকল্পনা করতে বাধ্য করে। এ অপারেশনের মাধ্যমে নৌ-কমান্ডােদের মনােবল ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানি সরকার বহির্বিশ্বে যে অপপ্রচার চালাচ্ছিল, তা অসার প্রমাণিত হয়। সারা বিশ্বের বিবেক বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তির এ লড়াইয়ের প্রতি আকর্ষিত হয়। হুমায়ন হাসানের ভাষ্য এখানে উদ্ধৃতি যােগ্য: এই অভিযানের সাফল্য ঐ সময় বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর মনােবলই যে কেবল উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় তা-ই নয়, বিষয়টি খােদ পাকিস্তানের সামরিক জান্তার কপালেও দুশ্চিন্তার কুঞ্চিত ভাঁজ সৃষ্টি করে। একই সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা সম্পর্কে নড়েচড়ে ওঠে বিশ্ববিবেকও। পাকিস্তানিরা প্রথম দিকে নৌ-কমান্ডােদের এ তৎপরতাকে শক্রদেশ ভারতীয় নৌবাহিনীর ফ্রগম্যানদের অবৈধ কারসাজি বলে বিশ্ববিবেককে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু অচিরেই আসল বাস্তবতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং ক্রমেই আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলােয় নৌ-কমান্ডাে তৎপরতার ঢালাও প্রচার হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্রবন্দরে চলাচলকারী বিদেশি জাহাজগুলাের সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিগুলােও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। ঐ কোম্পানিগুলাে ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজের বীমার প্রিমিয়াম সুযােগ বুঝে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। কোনাে কোনাে বিদেশি জাহাজ নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকতেও অনীহা প্রকাশ করে।

বিদেশি জাহাজ তখন নদীবন্দরগুলােয় না ঢুকে বহিঃসমুদ্রে নােঙর করে। কিন্তু সেখানেও যখন আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডােরা তাদের অভিযান সম্প্রসারিত করে, তখন অবস্থা হয়ে পড়ে আরও বেগতিক। বস্তুত এ সময় থেকে নৌকমান্ডােদের ধারাবাহিক সব অভিযানের সাফল্যের ফলে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ এটা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে বাংলাদেশের চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষেই ব্যাপক নির্যাতিত গণমানুষের একটি সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ। নিছক রাজনৈতিক টানাপােড়েনে ভূমিষ্ঠ কোনাে সাময়িক সময়ের গণবিশৃঙ্খলা নয়। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রথম দিকে এ রকম। দুষ্কৃতকারীদের একটি বিশৃঙ্খলা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। বহির্বিশ্বের কোনাে কোনাে দেশ কিছুদিন এটা বিশ্বাসও করেছিল। কিন্তু অচিরেই সব অলীক বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটে এবং নিখাদ সত্য হয়ে জেগে উঠে। গণমানুষের সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা। নিছক মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে এ বাস্ত বতা কখনাে বেশিদিন ঢেকে রাখা যায় না। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরাও তা পারেনি। আর তা পারেনি বলে বাকি দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় মানুষ বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী নানামুখী ডামাডােলের মধ্যেও ঘটনার মূল সত্য একদিন ঠিকই আবিষ্কার করে। নেয়। (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪: ৫৯-৬০) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মােড় ঘুরিয়ে দেওয়া দুঃসাহসিক এ নৌ-কমান্ডাে অভিযানে হানাদার পাকিস্তানি জান্তার অন্তরাত্মা কেবল কেঁপেই ওঠে নি, সেই সাথে এ বিস্ফোরণের শব্দ যুগপৎ কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের দোসরদের নিরেট অবিবেচক ভিত্তিও। একই সাথে এ বিস্ফোরণ বিশ্ব বিবেককেও প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। বস্তুতপক্ষে এ অপারেশন সেদিন প্রশস্ত করতে শুরু করেছিল পাকিস্তানিদের চূড়ান্ত পরাজয়ের পথ। মুক্তিকামী গণ মানুষের চিরায়ত স্বাধীনতার সংগ্রাম অস্ত্র আর মিথ্যে প্রচারণা দিয়ে যে বিনাশ করা যায় না, এটা সেই মানব ইতিহাসেরই একটি শাশ্বত পাঠ । আর পাঠের সাথে সেদিন আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয় অবিবেচক পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতার ইতিহাসই প্রকারান্তরে বহমান রক্তের ইতিহাস। এ ইতিহাসেরই স্বর্ণোজ্জ্বল অংশ সৃষ্টি করেছিল একাত্তরের নৌ-কমান্ডােরা, যার সূচনা মধ্য আগস্টের একটি নিঃশব্দ গভীর রাতে সুতীব্র বিস্ফোরণের শব্দাবলি থেকে।

 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড