পাঁচলাইশ থানার পাশের নির্যাতন কেন্দ্রে অপারেশন
চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীও তাদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এরই অংশ হিসেবে নভেম্বরের শেষ দিকে কেসি-২-এর ডেপুটি লিডার জাফরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তাঁর সহযােদ্ধারা তাঁকে নিয়ে উদৃবিগ্ন ছিলেন। কিন্তু তার সন্ধান ও সংবাদ কেউ সংগ্রহ করতে পারে নি। ১৫ ডিসেম্বর ভাের রাতে মুক্তিযােদ্ধা তুষার মুমূর্ষ অবস্থায় পাকিস্তানি নির্যাতন কেন্দ্র ও বন্দি শিবির থেকে জয়নগরস্থ গােপন আস্তানায় পালিয়ে আসেন। তাঁর কাছে থেকে জানা যায়, পাঁচলাইশ থানা সংলগ্ন দক্ষিণের বাড়িটিতে মুক্তিযােদ্ধা জাফর বন্দি আছেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযােগীরা মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐ বাড়িটিকে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। তৎক্ষণাৎ মুক্তিযােদ্ধা আনােয়ার, ইকবাল, কামরুল, শান্তনু চক্রবর্তী, এমদাদুল হক দানুসহ প্রায় ১০জন মুক্তিযােদ্ধা গিয়ে বাড়িটি ঘেরাও করেন। এর মধ্যে মুক্তিযােদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর অগ্রাভিযানের ফলে শহরের বিভিন্ন স্থান হতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হয়েছে।উদ্ধৃত অবস্থায় পাঁচলাইশ থানা থেকেও সবাই পলায়ন করে। শুধু ২জন রাজাকার বাড়িটিতে পাহারায় নিয়ােজিত ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা সহজেই কেন্দ্রটি আক্রমণ ও অধিকার করেন। রাজাকাররা প্রতিরােধের চেষ্টা না করেই আত্মসমর্পণ। করে। তাদের অস্ত্রগুলাে মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
মুক্তিযােদ্ধারা বাড়িটি তল্লাশি করে কাউকে পায় নি। কারণ, পরে জানা গেছে, মুক্তিযােদ্ধা জাফরও সুযােগমতাে। পালিয়ে যান। ঐ বাড়ি হতে প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। তারপর মুক্তিযােদ্ধা দানু পাঁচলাইশ থানার দিকে আরও ২জন সহযােগীসহ অগ্রসর হচ্ছিলেন। তখন তার নজরে আসে, ২জন সৈন্য পূর্ব দিক থেকে থানার দিকে আসছে। তৎক্ষণাৎ দানু তাদেরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন। কিন্তু হঠাৎ গুলির শব্দে দানু আতঙ্কিত হয়ে পার্শ্ববর্তী ড্রেনের কাছে শুয়ে পড়েন। দানুর বর্ণনা মতে, তিনি এতই ভয় পেয়েছিলেন যে তার বিশ্বাস জন্মেছিল, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, তারই সহযােগী ২জন মুক্তিযােদ্ধা কোনাে নির্দেশনা ছাড়াই ঐ সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছােড়েন। অবশ্য এতে সৈন্য ২জন ঘটনাস্থলেই মারা। যায়।
কৈগ্রাম সেতু অপারেশন
বিভিন্ন অপারেশনের যাতায়াত পথে পটিয়ার কৈগ্রাম সেতুটি ছিল একটি গুরুত্ব সেতু। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ও রাজাকাররা সেতুটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার এক পর্যায়ে সেতুটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যও জরুরি হয়ে পড়ে। ক্যাপটেন করিম ছিলেন ঐ ব্রিজ অপারেশনের মূল পরিকল্পক । কৈগ্রাম সেতুটি ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের বেঙ্গুরা হাসপাতাল আশ্রয় কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩ কিলােমিটার দূরে। ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে ২৫-৩০জন মুক্তিযােদ্ধা ঐ হাসপাতাল থেকে রাত ১২টার দিকে প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে সেতুর দিকে যাত্রা করেন। তারা রাত ১টার দিকে অপারেশন স্থলে এসে পৌঁছেন। সেতুটি ছিল একটি টানা সেতু। সেতুর টানা লােহার রশিগুলাে পার্শ্ববর্তী একটি মিলঘরের খুঁটিতে শক্ত করে বাঁধা ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা লােহার রশিতে বিস্ফোরক লাগিয়ে সেতুটি উড়িয়ে দেন। তারপর নিরাপদে কুসুমপুরা হাজি আলী আকবরের বাড়ির আশ্রয় স্থলে চলে যান। ঐ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের সাথে ২টি এলএমজি, ৪টি এসএলআর, ৪টি স্টেনগান, ১৫-১৬টি রাইফেল এবং প্রয়ােজনীয় পরিমাণ গােলাবারুদ ও বিস্ফোরক নিয়ে গিয়েছিলেন সফল অপারেশনের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা কৈগ্রাম সেতুটি উড়িয়ে দেন এবং রাজাকারদের মনে প্রচণ্ড ভীতির সৃষ্টি হয়। এতে ঐ এলাকায় রাজাকারদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের গতিবিধি ও যাতায়াত পথ নিরাপদ ও সুবিধাজনক হয়ে যায়। এ নিরাপত্তা ও সুবিধা তাদের পরবর্তী অপারেশনের জন্য সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা মাে. শাহাদুল হক।
পটিয়ার খােয়াজনগর রাজাকার ইনফর্মার ও ডাকাত অপারেশন
পটিয়ার খােয়াজনগর এলাকায় এক রাজাকার ‘ইনফর্মারের কর্মতৎপরতা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ও টিকে থাকার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ঐ এলাকার এক ‘ডাকাত মুক্তিযােদ্ধাদের পরিচয়ে এলাকায় নানাপ্রকার চুরি-ডাকাতি করত। ফলে জনসাধারণের মনে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ও অসহযােগী মনােভাব জেগে উঠার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এ অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। সম্ভাব্য সময় রাত ১২টার দিকে ৩০৩২জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে হাজি আলী আকবরের বাড়ি থেকে প্রায় ৩-৪ কিলােমিটার দূরে খােয়াজনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। রাত প্রায় ১টার দিকে তারা ঐ এলাকায় গিয়ে পৌছেন। ঐ সময়। মুক্তিযােদ্ধারা চরলৈক্ষা ১ নম্বর ইউনিয়ন বাের্ডের সামনের গেটে বসে সেই রাজাকারকে আরও কয়েকজনের সাথে আলাপরত অবস্থায় দেখতে পান। ইব্রাহিম সওদাগর রাজাকার ইনফর্মারটিকে শনাক্ত করেন। মুক্তিযােদ্ধারা দুদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলেন। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা ডাকাতটির বাড়িতে গিয়ে তাকে বন্দি করেন। তাদেরকে বেল্লাপাড়া খালের পাড়ে এনে গুলি করা হয়। একজন ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে। মারা যায়। আরেকজন আহত অবস্থায় খালে ঝাপিয়ে পড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ অপারেশনের পর খােয়াজনগর এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অপারেশনের সাফল্য প্রধানত নির্ভর করেছে মুক্তিযুদ্ধ- সমর্থক ও সহযােগী ইব্রাহিম সওদাগরের সঠিক তথ্য সরবরাহ ও রাজাকারটিকে যথাযথভাবে শনাক্ত করার ওপর। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা নুর আহমেদ ও আমীর আহমেদ।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড