You dont have javascript enabled! Please enable it!
চান্দগাঁও অপারেশন
১৮ সেপটেম্বর কেসি-৭ চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। হরিণা ক্যাম্প হতে ৩০জনকে এ দলের সাথে পাঠানাে হলেও পথিমধ্যে নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে দলের অধিকাংশ সদস্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় সহকারী অধিনায়ক সৈয়দ মাে. ইমরান নিজেকে অধিনায়ক ঘােষণা করে চান্দগাঁও এলাকায় তৎপরতা শুরু করেন। এ তৎপরতায় সাফল্যের লক্ষ্যে পুরাে চান্দগাঁও এলাকাকে মােট ৮টি ভাগে বিভক্ত করে ৮টি গােপন আস্তানা তৈরি করা হয়। দলের মূল সদস্যদের সাথে পরে যােগাযােগ স্থাপন করে ব্যর্থ হয়ে ইমরান ও তার সহযােগী মুক্তিযােদ্ধারা। স্থানীয়ভাবে ৫০জন যুবককে রিক্রুট করে একটি লােকাল বেইজ স্থাপন করেন। ইমরানের ভাষ্য অনুযায়ী, এলাকায় এসেই তিনি স্থানীয় রাজাকারদের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেন। তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য এবং পাকিস্তানিদের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন, এদের অধিকাংশই শুধু জীবিকার জন্য রাজাকারের চাকরি করছিল। এদের সহায়তায় ইমরান ও তার দল অনেক অপারেশন করতে সমর্থ হন। কিন্তু চান্দগাঁও এলাকার এক দল রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা না করে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযােগিতা করে যাচ্ছিল।
বহদ্দারহাট থেকে সােজা বলিহাট পর্যন্ত খাজা রােডের অবস্থান। এ রােডের দুই পাশেই ঐ রাজাকার দল ও তাদের সহযােগীদের ক্যাম্প। কেসি-৭-এর অধিনায়ক ইমরান পরিকল্পনা করেন, এ ক্যাম্পগুলাে আক্রমণ করে রাজাকারদের বিপর্যস্ত এবং তাদের চলাচল সীমিত করে দিয়ে এলাকায়। মুক্তিযােদ্ধাদের গতিবিধি সহজতর করতে হবে । পরিকল্পনা মতাে বশর ও ইলিয়াসের নেতৃত্বে ২টি গ্রুপ গােপনে গিয়ে ক্যাম্পের দুই পাশে অবস্থান নেন। তারপর রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অপারেশন চালানাে হয়। পজিশন নেয়ার পর ক্যাম্প ঘেরাও করে মাইক দিয়ে ঘােষণা দেওয়া হয় এলাকার জনগণ যাতে বের না হয়। ইমরান ও তার দল ক্যাম্পের একদিকে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঐ এলাকায় ৭-৮টি ঘরে ১৫-২০জন পাকিস্তানি সহযােগী বসবাস করত। তারা আগুন দেখে বের হয়ে এলে তাদের দিকে বিভিন্ন পজিশন। থেকে গুলি করা হয়। এতে ৫-৬জন পাকিস্তানি সহযােগী মারা যায়। তাদের কাছে কয়েকটি এসএমজি পাওয়া যায়। বাড়ি ফেরার পর মুক্তিযােদ্ধা ইমরানকে ঐ রাতেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে ১৬ ডিসেম্বর তিনি ছাড়া পান। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা সৈয়দ মাে. ইমরান।
পিআইএ অপারেশন
স্টেডিয়ামের পূর্ব দিকে ছিল তৎকালীন পিআইএ অফিস। সেখান থেকে যাত্রী বহনকারী সেলুন কার বিমানবন্দরে যাতায়াত করত। পশ্চিম মাদারবাড়ি বাবুনি বাপের কলােনিতে রফিক ও সহযােগী মুক্তিযােদ্ধা লােকমান গনি চৌধুরী মিলে ঐ স্থানে গেরিলা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন (সম্ভবত অক্টোবর মাসে, শবে বরাতের রাত)। কারণ, ঐ রাতে রাস্তাঘাটে টুপিধারী মানুষ বেশি ছিল। এ সুযােগটাকে কাজে লাগানােই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। মাদারবাড়ি থেকে একটি রিকশা ভাড়া করে ২জন কাজির দেউড়ির মােড়ে আসেন। সেখান থেকে অন্য রিকশায় উঠে পিআইএ অফিসের সামনে আসেন। সেখানে দাঁড়ানাে পিআইএ-এর, ২টি গাড়িতে ২জনে একইসাথে বােমা নিক্ষেপ করেন। রিকশাওয়ালা ভয়ে রিকশা ছেড়ে পালিয়ে যায় । বিস্ফোরণে গাড়ি ২টিতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। তখন নেভাল অ্যাভিনিউর সেন্ট্রি তাদের অবস্থানের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছােড়ে। এ অবস্থায় তারা রাস্তা দিয়ে ক্রলিং করতে করতে পিআইএ অফিসের পাশে গিয়ে দেয়াল টপকে হেমসেন লেন হয়ে মাদারবাড়ি চলে আসেন। পিআইএ অফিসের ২টি গাড়ি পুড়ে যায়। আর তারা ২জনও আগুনে ঝলসে যান। শেল্টারে আহত অবস্থায় পৌছানাের পর গ্রুপ অধিনায়ক রহমান, জানে আলমসহ অন্য যােদ্ধারা ২জনকে ডাক্তারের ব্যবস্থা করে (ডাক্তার হাবিবুল্লাহ) চিকিৎসা করান।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মােহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
আমতলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়ির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ
মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্য করেন, জুবিলি রােডের সর্বশেষ প্রান্তে রেয়াজউদ্দিন বাজারের পূর্ব পাশে অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়ের পিছনে অবস্থিত আমতলায় প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়ি পার্কিং করা হয়। গেরিলা অপারেশনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সৈন্য ছাড়া যে-কোনাে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ওপর আঘাত হানা এবং ক্ষতিসাধন করা। সে লক্ষ্যানুযায়ী আলােচ্য আমতলায় পার্কিং করা গাড়িতে আক্রমণের চিন্তার উদয় এবং প্রয়ােজনীয় পরিকল্পনা প্রণীত হয়। তা ছাড়া অধিনায়ক সৈয়দ আবদুর রহমানের এ নির্দেশ ছিল যে, পথিমধ্যে যেখানেই পাকিস্তানি সৈন্য বা তাদের গাড়ি পাবে, সেখানেই আক্রমণ করবে। এ অপারেশন করেছিলেন মুক্তিযােদ্ধা রফিকুল ইসলাম। ২০ জুলাই সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে বাদামতলীর আহমদ হােসেন কনট্রাক্টরের ভাড়াবাড়ির আশ্রয় কেন্দ্র থেকে হেঁটে রেললাইন ক্রস করে প্রধান রাস্তায় গিয়ে মুক্তিযােদ্ধা রফিক একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে লালদিঘির পাড়ের দিকে রওনা হন। লালদিঘিতে যাওয়ার সময় পথের উভয় দিকে বেশ কিছু পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি তার আক্রমণের আয়ত্তের মধ্যে পড়ে।
কিন্তু নিজে নিরাপদে সরে পড়ার সুযােগের অভাবে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে পারেন নি। ট্যাক্সিটি লালদিঘির মাঠ থেকে ছেড়ে পরে সেখান থেকে আরেকটি ট্যাক্সি ভাড়া করে কোতােয়ালির মােড় দিয়ে নিউ মার্কেট হয়ে মূল টার্গেট জুবিলি রােডের আমতলার দিকে রওনা হন। এ সময় আমতলার তিন রাস্তার মােড়ে একটি মিলিটারি জিপ অবস্থান করছিল। গাড়িটি দেখে তখনই আক্রমণ না করে ট্যাক্সি নিয়ে নিউ মার্কেট হয়ে আবার আমতলায় ঘুরে আসেন। তখন আনুমানিক সাড়ে ১২টা। পাকিস্তানি মিলিটারিসহ পার্কিং করা জিপটিতে তিনি সুযােগমতাে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। আক্রমণ করেই তিনি জুবিলি রােড দিয়ে এনায়েতবাজার মােড় হয়ে কদমতলীর মােড়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে শেল্টারে চলে আসেন। নিরাপদে এসেই সাথে সাথে ঘটনাবলি গ্রুপ অধিনায়ককে অবহিত করেন। বেলা প্রায় আড়াইটায় গ্রুপ অধিনায়ক সৈয়দ আবদুর রহমান আমতলায় যান এবং জানতে পারেন, ২জন পাকিস্তানি সৈন্য মারাত্মক আহত হয়েছিল। সাথে কয়েকজন পথচারীও।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা রফিকুল ইসলাম।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!