অভয়মিত্রঘাট ট্রান্সফর্মার অপারেশন
বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিস্ফোরক স্থাপন করে অভয়মিত্রঘাটের কাছে অবস্থিত বিদ্যুৎ-ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত হয়। অপারেশন করার প্রধান সমস্যা ছিল ট্রান্সফর্মার সংলগ্ন ফরেস্ট অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত এক দল মিলিশিয়া। তথ্যসংগ্রহ করা হয় যে, ঐ মিলিশিয়া দল শুধু দিনের বেলায় প্রহরার কাজে নিয়ােজিত থাকে। রাতের বেলায় শহরে ফেরত চলে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা এ সুযােগ কাজে লাগানাের পরিকল্পনা করেন। সন্ধ্যার পর ৪-৫জন। মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল ব্যাপটিস্ট চার্চে অবস্থিত গােপন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরিঙ্গি বাজার হয়ে অভয়মিত্রঘাটের কাছাকাছি পৌছায়। অন্য ১টি দল সদরঘাটের দিক থেকে সেখানে পৌছায়। প্রথমে এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল ও গতিবিধি লক্ষ্য করা হয়। তারপর ২টি দল অভয়মিত্রঘাটের ট্রান্সফর্মারের কাছে পৌছায়। ৩জন বিস্ফোরক স্থাপন করেন এবং বাকিরা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকেন। বিস্ফোরক স্থাপনের পর পুরাে দল দ্রুত প্রস্থান করে। পরে বিস্ফোরণের ফলে ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস হয়। বিস্ফোরণের পর পাকিস্তানি বাহিনী এসে পুরাে এলাকা ঘিরে ফেলে। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা রফিক।
বার কোয়ার্টার পেট্রোল পাম্পে অপারেশন
পাকিস্তানি সেনাদের জ্বালানি সরবরাহে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে এ অপারেশন। পরিচালনা করা হয়। লােকমান ও ডা. মাহফুজ গ্রুপের ৮-১০জন মিলে বার। কোয়ার্টারে অবস্থিত পেট্রোল পাম্প বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। স্থানীয় একজন মুক্তিযােদ্ধা (নাম জানা যায় নি) ২ দিন আগে পেট্রোল পাম্পের আশপাশের এলাকা ঘুরে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে আসেন। এ সময় যাওয়াআসার রাস্তা, পাকিস্তানি সেনাদের টহল ও পেট্রোল পাম্পে প্রহরীদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা হয়। অপারেশনের আগে রাত ১০-১১টার দিকে পুরাে দল সরাইপাড়াস্থ গােপন আস্তানা হতে হেঁটে ঝর্ণাপাড়া পৌছায়। দলটি রাস্তার পাশে পজিশন নেয়। ৩জন পাম্পের ডিউটিরত প্রহরীকে অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রাখে। ২জন দ্রুত রিজার্ভ ট্যাংকের ওপর বিস্ফোরক স্থাপন করে ১৫ গজ দূরে নিয়ে ফিউজে আগুন ধরিয়ে দেন। তারপর বিস্ফোরণে পুরাে পেট্রোল পাম্পে আগুন ধরে যায়।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: আবুল কালাম।
ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার পরিবারের ওপর আক্রমণ
ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সক্রিয় সহযােগী। তার স্বাধীনতাবিরােধী এ ভূমিকার জন্য বিক্ষুব্ধ মুক্তিযােদ্ধারা তাকে হত্যা করার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ এবং তৎপর ছিলেন। সে জন্য তারা গোপনে উপযুক্ত সময়ের সন্ধান। করতে থাকেন। এমন সময় এক দিন বিশ্বস্তসূত্রে খবর পাওয়া যায় যে, চন্দনপুরায় ডা. সদরুদ্দিনের বাড়িতে ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার পরিবারবর্গ নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যাবে। এফএফ গ্রুপ-৮-এর গ্রুপ লিডার মাহবুব ঐ অনুষ্ঠানে হামলা করে সবাইকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেন। সে অনুযায়ী জয়নগর লেনের। গােপন আশ্রয় থেকে মাহবুবের নেতৃত্বে সৌরেন্দ্র ও ফজলু নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠানের। আগেই ডা, সদরুদ্দিনের বাড়ির পাশে অবস্থান নেন। এদিন বৃষ্টি পড়ছিল; তাই ৩জন একটি ড্রেনের মধ্যে রেইনকোট পরে অবস্থান নেন, যাতে টার্গেট অনুষ্ঠান। স্থল থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে গুলি বর্ষণ করা যায়।
অনুষ্ঠানের মধ্যে একজন গােয়েন্দাও রাখা হয় যাতে টার্গেট বের হওয়া মাত্রই খবর দিতে পারেন। অনুষ্ঠান শেষে পরিকল্পনা মতাে নিয়ােজিত মুক্তিযােদ্ধা গােয়েন্দা ডা. সদরুদ্দিনের বাড়ির সামনে সংকেত হিসেবে টর্চলাইটের আলাে জ্বালান। অপারেশন গ্রুপ ড্রেনের পাশে বৃষ্টি জনিত ঠান্ডায় দীর্ঘক্ষণ বসে অপেক্ষায় ছিল। বহু প্রত্যাশিত সংকেত পাওয়া মাত্রই ফজলু দৌড়ে এসে তার স্টেনগান থেকে ড্রাইভিং সিট লক্ষ্য। করে গুলি চালান। ৭-৮ রাউন্ড গুলি বের হওয়ার পর হঠাৎ অস্ত্র চালনায় প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ড্রাইভারের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। একজন এ অবস্থায় গাড়ির মধ্যে দ্রুত গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। কিন্তু গ্রেনেড গাড়িতে পড়ে গিয়ে নিচে পড়ে এবং বিস্ফোরিত হয়। ফজলুল কাদের চৌধুরীর সহযােগীরা পালটা গুলি ছুড়তে থাকে। এমতাবস্থায় ফজলু, মাহবুব ও সৌরেন্দ্র দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে প্রস্থান করেন। পরিকল্পনানুযায়ী প্রত্যাশিত সাফল্য না এলেও পাকিস্তানের সহযােগীদের জন্য এ ঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। এ ঘটনার পর ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার সহযােগীরা তাদের প্রকাশ্য চলাফেরা ও তৎপরতা সীমিত করতে বাধ্য হয়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড