পাথরঘাটা ট্রান্সফরমার ধ্বংস
চট্টগ্রাম শহরের মুক্তিযােদ্ধা নেতারা যৌথভাবে পরিকল্পনা করেন যে, শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ও জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটিয়ে পাকিস্তানি প্রশাসনকে ক্রমান্বয়ে অকার্যকর করা হবে। এরই অংশ হিসেবে পাথরঘাটার ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করেন কেসি-৩ দলের সদস্য মুক্তিযােদ্ধা মফিজুল ইসলাম ও মােঃ আজম (তৎকালীন সিলভার স্পুন রেস্টুরেন্টের এমডি)। তখন ছিল রােজার মাস। তাই তারা ইফতারের সময়টাকে অপারেশনের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেন। ইফতারের সময় সাইরেন বাজার পর লােকজনের চলাচল সাময়িকভাবে কমে যায়। কয়েক দিন ধরে তারা ইফতারের সময় এলাকার লােকজনের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করেন। ট্রান্সফর্মারের কাছাকাছি পাথরঘাটা গির্জায় ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের গোপন আশ্রয় স্থল। তাই সহজেই তথ্যসংগ্রহ সম্ভব হয়। বিকাল পৌনে পাঁচটার। সময় মুক্তিযােদ্ধা মফিজুল ইসলাম ও মাে. আজম একটি রিকশা নিয়ে পাথরঘাটার গির্জা স্কুলের সামনে আসেন। তারা পার্শ্ববর্তী মাঠে পায়চারি করতে থাকেন এবং সাইরেন বাজার জন্য অপেক্ষা করেন। সাইরেন বাজার পর পরই লােকজনের চলাচল স্তিমিত হয়ে আসে। তখন তারা তুরিতগতিতে ট্রান্সফর্মারের গায়ে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করে ফিউজে আগুন দিয়ে দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে চলে আসেন। একটু দূরেই ছিল রিকশা স্ট্যান্ড। রিকশায় ওঠার পূর্বেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং পুরাে এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা সৈয়দ মফিজুল ইসলাম। সম্পাদকের টীকা: এ গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে সন্নিবেশিত মুক্তিবাহিনীর দৈনিক পরিস্থিতি প্রতিবেদনে এ ধরনের একটি ঘটনার তথ্য রয়েছে। সেখানে ঘটনাটি ২৯ অক্টোবরে। সংঘটনের কথা বিধৃত। দ্রষ্টব্য: দলিল নম্বর ২২২। তবে এটিই সেই ঘটনা কি না, তা সুস্পষ্ট নয়।
বান্ডিল রােডে দালাল উকিলের চেম্বারে আক্রমণ
মুক্তিযােদ্ধা দল কেসি-৪ গােপন সূত্রে খবর পায় যে, বান্ডিল রােডে একজন দালাল উকিলের (নাম জানা যায় নি) চেম্বারে নিয়মিত পাকিস্তানি বাহিনীর সহযােগীদের। সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত পাকিস্তানি সহযােগীর কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টির এবং তাকে ভীত করার লক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ-আল-হারুনের নেতৃত্বে সেখানে গেরিলা অপারেশন চালানাে হয়। সাথে ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক, ডা. আমিনসহ মােট ৪জন। অপারেশনের জন্য অস্ত্র ছিল তিনটি স্টেনগান ও কয়েকটি গ্রেনেড। সন্ধ্যার পর ২টি ট্যাক্সিতে করে তারা খাতুনগঞ্জের গােপন আস্তানা থেকে রওনা হন। দালাল উকিলের চেম্বারের সামনে নেমেই দ্রুত যথাযথ পজিশন নিয়ে হারুন ও ফজলু ফায়ার শুরু করেন। ডা, আমিন কভারিংয়ের জন্য রাস্তার ওপর পজিশন নিয়েছিলেন। অন্য একজন মুক্তিযােদ্ধা ট্যাক্সিতে অপেক্ষমাণ ছিলেন, যাতে অপারেশন শেষে দ্রুত সরে পড়া যায়। বাইরে থেকে তারা ফায়ার করতে করতে ভিতরে প্রবেশ করেন । উকিলের চেম্বারের অভ্যন্তরে তখন ১০-১২জন অবস্থান। করছিল। স্টেনগানের গুলি বর্ষণে ১জন ব্যতীত বাকি সবাই নিহত হয়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আবদুল্লাহ-আল-হারুন ও মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক।
অস্ট্রো-এশিয়া ব্যাংকের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যের গাড়িতে গ্রেনেড নিক্ষেপ
মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক ও পাথরঘাটার রফিক মিলে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করেন। তারপর লালদিঘির পাড়ে অবস্থিত ‘অস্ট্রো-এশিয়া ব্যাংক’-এর সামনে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি লক্ষ্য করে চলন্ত ট্যাক্সি থেকেই গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিলেন, কিন্তু গ্রেনেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি কোনাে সেনা সদস্য হতাহত হয় নি। তবু এ ঘটনায় প্রশাসনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ান কোম্পানির ভিএইচএফ (VHF) সেট ছিনিয়ে আনা নাসিরাবাদ হাউজিং সােসাইটিতে রাশিয়ান তেল কোম্পানির একটি অফিস ছিল। কোম্পানি নিজস্ব যােগাযােগের জন্য একটি ভিএইচএফ সেট ব্যবহার করত। কেসি-২-এর অধিনায়ক আবদুল্লাহ-আল-হারুন এ সেটটি দখল বা অকেজো করার চিন্তা করেন প্রধানত দুটি উদ্দেশ্যে প্রথমত, এটি যদি ছিনিয়ে আনা যায় তাহলে। তাঁরা প্রয়ােজনে ব্যবহার করতে পারবেন। এতে তাদের সেক্টরের সাথে যােগাযােগে। নতুন মাত্রা যােগ হবে। দ্বিতীয়ত, একান্তই ছিনিয়ে নেয়া না গেলে এটি বিকল করে দেওয়া, যাতে পাকিস্তানি বাহিনীও কখনাে প্রয়ােজনে ব্যবহার করতে না পারে। মুক্তিযােদ্ধা ফজলু, ডা. জাফর ও শফিউল বাশার একটি প্রাইভেট কারে চড়ে গন্তব্যের দিকে রওনা হন। নির্দিষ্ট বাড়ির গেটে এসে হর্ন বাজাতেই বাঙালি। নিরাপত্তা প্রহরী দরজা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে অস্ত্রের মুখে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। সেদিন ছিল ছুটির দিন। তাই অফিসে কোনাে কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী ছিল । প্রহরীর কাছ থেকে একুটি শাবল সংগ্রহ করে এনে যে রুমে সেটটি রাখা হয়েছে, সে রুমের প্রধান দরজা ভেঙে ফেলা হয় এবং ওয়্যারলেস সেট খুলে নিয়ে আসা হয়। আসার সময় নিরাপত্তা প্রহরীকে বেঁধে রেখে আসা হয়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাকার: কেসি-২-এর অধিনায়ক আবদুল্লাহ-আল-হারুন এবং মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক। সম্পাদকের টীকা: এ গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে সন্নিবেশিত মুক্তিবাহিনীর দৈনিক পরিস্থিতি প্রতিবেদনে এ ঘটনার তথ্য রয়েছে। সেখানে ঘটনাটি পাঁচলাইশে ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে সংঘটনের এবং ২টি ওয়্যারলেস সেট দখলের কথা বিধৃত। উল্লেখ্য, পাঁচলাইশ থানার অধীনে নাসিরাবাদ। দ্রষ্টব্য: দলিল নম্বর ২২২।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড