You dont have javascript enabled! Please enable it!
ফটিকছড়ির বিবিরহাটে রাজাকার হত্যা
 
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক দল মুক্তিযােদ্ধা রামগড় হয়ে ফটিকছড়ির দাঁতমারা নামক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করছিলেন। ফটিকছড়ি থানার একজন স্থানীয় অধিবাসী তাদের বিবিরহাটের একটি রাজাকার ক্যাম্প ও তৎপরতা সম্পর্কে খবর প্রদান করেন। মুক্তিযােদ্ধা শফির নেতৃত্বে খােরশেদ, নাথুরাম বড়য়া, প্রণব বড়ুয়াসহ ৫জনের ১টি দল ঐ স্থানের রাজাকারদের হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে ছিল .৩০৩ রাইফেল ও হ্যান্ড গ্রেনেড । ঘটনাস্থলে পৌছে তারা পুরাে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে রাজাকারদের আড্ডা স্থল চায়ের দোকান ঘেরাও করেন। এমতাবস্থায় কয়েকজন রাজাকার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার। সময় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে ১জন মারা যায়। ২জনকে ধরে ক্যাম্পে এনে জিজ্ঞাসা করে অবশেষে হত্যা করা হয়। মাঝিরঘাটে পাকিস্তানি সহযােগীর রাইস মিলে গ্রেনেড নিক্ষেপের প্রচেষ্টা এফএফ গ্রুপ-৯৬-এর ডেপুটি অধিনায়ক সুলতান তার কামালঘাটস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে বসে এক পাকিস্তানি সহযােগীর রাইস মিলে গ্রেনেড নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা করে মুক্তিযােদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম ও স্থানীয় নুর আলীকে এর দায়িত্ব দেন। নুর আলী ঐ এলাকা ভালােভাবে চিনতেন। সে জন্য তাকে গাইড হিসেবে রাখা হয়।
উল্লেখ্য, ঐ রাইস মিলের মালিক ইদ্রিস এলাকার একজন প্রভাবশালী পাকিস্তানি সহযােগী ছিলেন। আনুমানিক রাত ১০টার দিকে নুর আলী ও জাহাঙ্গীর আলম কোমরে গ্রেনেড বেঁধে নিয়ে রাইস মিলের নিকটবর্তী একটি চায়ের দোকানে অবস্থান নেন। পরিকল্পনা মােতাবেক নুর আলী সেখানকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে জাহাঙ্গীর। আলমকে ইশারা দেবার কথা ছিল, যাতে ২জন একসাথে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম দেখলেন, তাঁর দিকে রাইস মিলের মালিক ইদ্রিস এগিয়ে আসছে। তিনি আকস্মিক এক প্রতিক্রিয়ায় দ্রুত গ্রেনেডটি ড্রেনের মধ্যে ফেলে দেন। ইদ্রিস জাহাঙ্গীর আলমকে ধরে ফেলে এবং তাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে তুলে দেবার হুমকি দেয়। এ কথাও সে বলে যে, জাহাঙ্গীর আলম তাকে হত্যা করার জন্য এসেছেন। ওখানকার উপস্থিত জনতা জাহাঙ্গীর আলমকে রক্ষা করে। মুক্তিযােদ্ধা জাহাঙ্গীর আলমের ধারণা ছিল, সহযােগী মুক্তিযােদ্ধা তার পরিকল্পনা ইদ্রিসের কাছে ফাস করে দেন।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম (স্থান: কামাল গেট)। পশ্চিম মাদারবাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাের্স বজলের বাড়ি আক্রমণ পাকিস্তানি সেনাদের কাছে গােপন সংবাদ সরবরাহকারী বজলের বাড়ি ছিল পশ্চিম মাদারবাড়িতে। এফএফ গ্রুপ-৯৬ তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। দলের ডেপুটি অধিনায়ক সুলতান ও অন্য ৫-৬জন সদস্য রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে বজলের বাড়িতে হানা দেন। বজল টের পেয়ে পিছনের দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা বাড়ির চতুর্দিকে ঘেরাও করে ফেললে হয়ত সে পালিয়ে যেতে পারত । অপরিপক্ক পরিকল্পনার কারণে তারা সফল হতে ব্যর্থ হন।
 
কদমতলী মােড়ে পাকিস্তানি সেনাদের বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ
 
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনারা শহরে টহলের পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ। স্থানে বাংকার নির্মাণ করে অবস্থান নিয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশনের টার্গেটের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা ও তাদের স্থাপনা ধ্বংস করা ছিল। সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কিন্তু এসব স্থাপনায় হামলা করা ছিল খুবই বিপজ্জনক। তবু মুক্তিযােদ্ধারা উদ্যম হারান নি। কদমতলীর মােড়ে পাকিস্তানি সেনাদের বাংকারের পিছন দিকে ছিল অনেক বিল্ডিং। মােড়টিতে চারটি রাস্তা এসে মিলিত হয়েছে। পশ্চিম দিক থেকে দেওয়ানহাট হয়ে একটি রাস্তা, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে কর্ণফুলি মার্কেট হয়ে একটি, আরেকটি উত্তর দিকে নােয়াখালী বাসস্ট্যান্ড হয়ে এবং পূর্ব দিকে মাঝিরঘাট হয়ে আরও দুটি রাস্তা কদমতলীতে এসে মিলিত হয়েছে। এফএফ গ্রুপ-১৭ এ বাংকারটিতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা করে। মুক্তিযােদ্ধা আবদুল হাফেজ ও তার ভাই শফি ছদ্মবেশে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান ও তৎপরতা লক্ষ্য করে আসেন। তারা দেখেন যে, ৫-৬জন পাকিস্তানি সেনা। বাংকারের অভ্যন্তরে অবস্থান করে। খুব কম সময়ই তারা বাইরে আসে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্টকে আক্রমণের জন্য বেছে নেয়া হয়। ঐদিন শহরের অন্যান্য স্থানেও বিভিন্ন মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ গ্রেনেড নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।  ভাের রাতে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা একই সাথে পূর্ব মাদারবাড়ি থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করার জন্য বের হন। আবদুল হাফেজের টার্গেট ছিল কদমতলী মােড়ের পাকিস্তানি সেনাদের বাংকার। তিনি রাস্তা ধরে না এসে পাড়ার অলিগলি ধরে হেঁটে রওশন মসজিদের পিছন দিকে দস্তগীর বাড়ির সামনে আসেন। সেখান থেকে ৫০  গজ দূরে ছিল বাংকারটি। তারা বাংকারের সামনে এগিয়ে গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে কয়েকজন আহত হয়। প্রকৃতপক্ষে গ্রেনেডটি বাংকারের অভ্যন্তরে পড়ে নি। পরবর্তীকালে ঐ বাংকারকে আরও মজবুত করে প্রস্তুত করা হয়।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আবদুল হাফেজ।
 
রেয়াজউদ্দিন বাজারে গ্রেনেড নিক্ষেপ
রেয়াজউদ্দিন বাজারের আশপাশের এলাকায় সব সময় পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল। কখনাে টহল দল হিসেবে আবার কখনাে বা নির্দিষ্ট অবস্থানে তারা থাকত। এলাকটি ছিল শহরের কেন্দ্রস্থলে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুক্তিযােদ্ধা দল এর আশপাশে অপারেশন পরিচালনা করে। লােকমান  হােসেনের নেতৃত্বাধীন এফএফ গ্রুপ-১৩৭ তথ্যসংগ্রহ করে যে, রেয়াজউদ্দিন বাজারে পাকিস্তানি সেনারা নিয়মিত সকালবেলা বাজার করতে আসে। বাজার করার সময় গলির ভিতর পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করা সহজ হলেও এতে আশপাশের সাধারণ জনতার হতাহতের সমূহ আশঙ্কা ছিল। তা সত্ত্বেও লােকমান পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য দায়িত্ব পান মুক্তিযােদ্ধা ফারুক উল ইসলাম। ফারুক সকাল ৭টার দিকে মােগলটুলি বাজারের তার চাচার বাসা থেকে।  রিকশা করে রেয়াজউদ্দিন বাজারে আসেন। গায়ে তার চাদর, পরনে লুঙ্গি এবং হাতে বাজারের ব্যাগ। আগের দিন রাতের বেলায় লােকমান তাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে ২টি গ্রেনেড দেন। রেয়াজউদ্দিন বাজারে পৌঁছেই তিনি প্রথমে কিছু আলু ও সবজি কিনে এতে গ্রেনেড লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু কোনাে পাকিস্তানি সেনার দেখা পেলেন না। তাকে নির্দেশ দেওয়া ছিল রেয়াজউদ্দিন বাজার থেকে নিউ মার্কেটের পথের যে-কোনাে স্থানে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চলে আসবেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের দেখা পেলেন। ৩জন সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনা বাজার করতে এসেছিল। তিনি বাজারের ব্যাগ থেকে গ্রেনেড নিয়ে। পিন খুলে প্রস্তুত করে নেন। পাকিস্তানি সেনারা তখন ডিম কিনছিল। নিরীহ ডিম বিক্রেতার কথা চিন্তা করে তিনি আর গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন নি। তারপর আরেকটি গলির মধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর তিনি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে ১জন সাধারণ লােকসহ ২জন পাকিস্তানি সেনা আহত হয়। সম্পাদকের টীকা: এ গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে সন্নিবেশিত মুক্তিবাহিনীর দৈনিক পরিস্থিতি প্রতিবেদনে এ রকম একটি ঘটনার তথ্য রয়েছে। সেখানে ঘটনাটি ১০ জুন ১৯৭১ সংঘটনের এবং ২জন পাকিস্তানি সেনা হত্যার কথা বিধৃত। এটি সেই ঘটনা কি না তা সুস্পষ্ট নয়।
দ্রষ্টব্য: গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে দলিল নম্বর ২০৬।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!