You dont have javascript enabled! Please enable it!
দুরছড়ি বাজারের যুদ্ধ
পার্বত্য চট্টগ্রামের কাসালং নদের পশ্চিম পাশে অবস্থিত দুরছড়ি বাজার বর্ষা মৌসুমে চতুর্দিকে জলবেষ্টিত থাকে। শুষ্ক মৌসুমে পূর্ব দিকের কাসালং নদী ব্যতীত অন্য তিন দিকে ধানক্ষেত। ৪-৫টি টিলা নিয়ে দুরছড়ি বাজার গঠিত। এলাকাটিতে জনসংখ্যা বেশি থাকায় এবং নিকটবর্তী অন্য কোনাে বাজার না থাকার কারণে দুরছড়ি বাজার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি সােমবার সাপ্তাহিক বাজার বসতাে। বাজারের দিন সেখানে ২-৩ হাজার লােকের সমাগম হতাে। বাজারের চতুর্দিকে ঘন জনবসতি। উল্লেখযােগ্য গ্রামগুলাের নাম: হীরারচর, খাগড়াছড়ি, শিশকমুখ, উলুছড়ি, খেদারমারা, পাবলাখালী, আমতলী, মহিষপজ্জা, ঢেবাছড়ি ও নলবুনিয়া। শুধু নৌপথেই যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল, সড়ক পথে কোনাে যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আনুমানিক দেড় মাস এ অঞ্চলটি মুক্ত এবং মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চট্টগ্রাম ও রাঙামাটির পতন হওয়ার পর (আনুমানিক মে মাসে) দুরছড়ি বাজারের কর্তৃত্ব এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলাে পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। স্থানীয় জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অনেক অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়েছিল। এখানকার ক্যাম্পে তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর জনবল ১২০জনের মতাে ছিল বলে জানা যায়। এলাকাটির চারদিকে পরিখা খনন করে তারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছিল। অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রের সাথে তাদের কাছে মর্টারও ছিল। ঐ এলাকাটি পরবর্তী সময় মিজো বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে পাকিস্তানি বাহিনী রাঙামাটি সদরে ফিরে যায়। জানা যায়, মিজো বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল বাঘাইছড়ি সদরে।
১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর রফিকুল ইসলামের নির্দেশে ভারতের শিলচর ক্যাম্প হতে অজ্ঞজয় চাকমা ও নুরুন্নবী চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এবং মেজর আর কে মালহােত্রা ও মেজর এফ এফ মানের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী (তিব্বত বাহিনী) সাজেক ইপিআর ক্যাম্প হয়ে রাতে বাঘাইছড়ি থানার অন্তর্ভুক্ত তুলাবন নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ১৫ নভেম্বর ভোের সাড়ে ৫টায় তারা অগ্রসর হয়ে বিনা বাধায় বাঘাইছড়ি সদর দপ্তর দখল করে নেয়। ঐ রাতেই মিজো বাহিনী (পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর) বটতলী গ্রাম হয়ে নদীর পশ্চিম পাড় দিয়ে দুরছড়ি বাজারে গিয়ে অবস্থান নেয়। ১৭ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী রাতে দুরছড়ি অভিমুখে রওনা হয় এবং প্রেমলাল কারবারির ঘাটের কাছে মিজো বাহিনী দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
এদিকে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর তুলাবন গ্রামে অবস্থানের খবর রাত আনুমানিক ১১টার দিকে মিজো বাহিনী জানতে পারে। ঐ রাতেই কাসালং নদীর পশ্চিম পাড় দিয়ে দুরছড়ি বাজারে এসে তারা বাজারের উত্তর দিকে ও পশ্চিম দিকের টিলায় অবস্থান নেয় এবং পরিখা খনন করে। মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মােট ১৫০জনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্য ছিল আনুমানিক ৩০জন। তারা ১৮ নভেম্বর ভাের আনুমানিক ৬টার সময় উলছড়ি গ্রাম হয়ে দুরছড়ি বাজারের কাছে অবস্থান নেন। সে অবস্থান থেকে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী দুই দলে বিভক্ত হয়ে (এক দল কাসালং নদীর পার্শ্ব দিয়ে উত্তর পাশ হতে এবং ২য় দলটি বাজারের পশ্চিম পাশ থেকে) শত্রুর অবস্থানের ওপর একই সময়ে আক্রমণ শুরু করে। শত্রুপক্ষ পালটা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ যুদ্ধ প্রায় দেড় থেকে ২ ঘন্টা স্থায়ী ছিল। শত্রুপক্ষ প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে বাজারের দক্ষিণ-পূর্ব পাশ দিয়ে ধানক্ষেতের আইল ধরে পিছু হটে আমতলী বাজারে অবস্থান নেয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৬-৭জন সদস্য গুরুতর আহত হন। সকাল ১০টায় আহতদের উদ্ধার করে মারিশ্যা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। মিত্র বাহিনীর ২জন তিব্বতি সৈনিক মারা যান। এ যুদ্ধে স্থানীয় তিনজন অসামরিক ব্যক্তি শহিদ হন । শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির কোনাে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮ নভেম্বর মিজোবাহিনী লংগদু থানায় চলে যায়। ঐ দিনই মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী আমতলী দখল করে এটিকে সাব-ক্যাম্প হিসেবে স্থাপন করে। ২১ নভেম্বর মারিশ্যা হতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী নৌকা ও স্পিডবােটযােগে এবং সড়ক পথে বাঘাইহাট দখল করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
তথ্যসূত্র: ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড কর্তৃক প্রস্তুতকৃত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পুস্তিকা। (দুরছড়ি বাজারের যুদ্ধের নকশাটি ১১৬৬ পাতায়)
(দুরছড়ি বাজারে পাকিস্তানি ও সহযােগী বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের বর্ধিত নকশাটি ১১৬৭ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!