লামা থানা অপারেশন
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
নতুন মুরংপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুরং জনগােষ্ঠী। মুক্তিযােদ্ধাদের সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। জনপদ হতে বিচ্ছিন্ন, চারদিকে পাহাড়ঘেরা এ জায়গাটি ছিল ট্রেনিং ক্যাম্প হিসেবে আদর্শ। প্রতিদিনই গােপনে অনেক ছাত্র-জনতা এখানে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের রসদপত্র সরবরাহ করে যেতেন। দেশের ভিতরে থেকেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য অনেকে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যোগ দেন। এভাবে ক্রমে ১৭জনের দল প্রায় ১০০ সদস্যের একটি শক্তিশালী গেরিলা বাহিনীতে রূপ নেয়। ১ নম্বর সেক্টরের সাথে। পত্রবাহক মারফত যােগাযােগ করে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ও আকাক্ষার কথা জানিয়ে অস্ত্র সরবরাহের আবেদন করা হয়। সেক্টর থেকে অস্ত্র দিতে চাইলেও যোগাযােগ ও সরবরাহ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে তা সম্ভব হয় নি। এর মাঝেই মুক্তিযােদ্ধারা খবর পান যে, লামা থানায় ইপিসিএএফ-এর সদস্য ও পুলিশ। দেশপ্রেমিক জনগণের ওপর অসহনীয় নির্যাতন চালাচ্ছে। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর এ অত্যাচারের সমুচিত জবাব দেওয়ার লক্ষ্যে লামা থানায় গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করা হবে। পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা সম্পূর্ণ গােপনীয়তার স্বার্থে জমি ক্রেতা ও বিক্রেতার ছদ্মবেশে থানাসংলগ্ন এলাকায় আলী মিয়া মেম্বার ও সুরত আলমকে পাঠানাে হয়। তারা অত্যন্ত সফলভাবে শক্রর প্রতিটি অবস্থান ও টার্গেট এলাকার খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেন। তা ছাড়া সমস্যাগুলােও তুলে ধরেন মুক্তিযােদ্ধা নেতৃত্বের কাছে। এর মধ্যে অন্যতম সমস্যা ছিল ক্যাম্প থেকে টার্গেট প্রায় ৪০ কিলােমিটারের পথ। এ পথ অতিক্রম করতে হলে প্রতি পদেই রয়েছে শত্রুপক্ষের কাছে ধরা পড়ার ভয়। তা ছাড়া লক্ষ্যস্থলে। দুর্গম পাহাড়ি পথ আর খরস্রোতা মাতামুহুরী নদী পেরিয়ে যেতে হবে। তবু অদম্য মুক্তিকামী যােদ্ধার এ দলটি অপারেশনের তারিখ ও সময় স্থির করে ১৫ অক্টোবরের। ভােররাত্রে। এর আগেই ১৪ তারিখ রওনা দিয়ে ২৭ কিলােমিটার দূরের মানিকপুর নামক গােপন স্থানে অবস্থান নিতে হবে ।
দল বিন্যাস ও টার্গেট এলাকায় অবস্থান
নতুন মুরংপাড়া ক্যাম্প হতে ১৪ অক্টোবর বেলা আনুমানিক একটায় মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি হাতে অপ্রতুল অস্ত্র আর বুকে অসীম সাহস নিয়ে যাত্রা করে মানিকপুরের উদ্দেশ্যে। মনােবলে একটুও চিড় না ধরিয়ে দুর্গম পথ পার হয়ে রাত আনুমানিক। দেড়টায় মানিকপুর হাইড আউটে পৌছায় দলটি। বিশ্রামের জন্য সময় দেওয়া হয়। মাত্র আধ ঘণ্টা । সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং শেষে যে দল বিন্যাস করা হয়, তা নিমরূপ: ক. কমান্ড গ্রুপ: হাবিলদার সােবহানের নেতৃত্বে ৪জন মুক্তিযােদ্ধা থানার পশ্চিম পাশে অবস্থান নেবেন এবং তাদের কাছে থাকবে ৩টি অস্ত্র । খ. অ্যাকশন গ্রুপ-১; নায়েক ফয়েজ আহমদের (ইপিআর) নেতৃত্বে ৭জন মুক্তিযােদ্ধা থানার পশ্চিম পাশে কমান্ড গ্রুপের সাথে অবস্থান করবেন। এবং সাথে ৪টি অস্ত্র থাকবে। অ্যাকশন গ্রুপ-২: নায়েক আবদুল কাদেরের (ইপিআর) নেতৃত্বে ৭জন মুক্তিযােদ্ধা থানার উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থান করবেন এবং সাথে ৫টি অস্ত্র থাকবে। অ্যাকশন গ্রুপ-৩: ল্যান্স নায়েক আবদুস সালামের (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) নেতৃত্বে ৭জন মুক্তিযােদ্ধা থানার পূর্ব পাশে রাস্তা বরাবর অবস্থান করবেন এবং সাথে ৪টি অস্ত্র থাকবে। অ্যাকশন গ্রুপ-৪: ল্যান্স নায়েক আমিনুল হকের (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) নেতৃত্বে ৭জন মুক্তিযােদ্ধা থানার উত্তর পাশের কোয়ার্টার বরাবর অবস্থান নেবেন এবং তাদের কাছে ৪টি অস্ত্র থাকবে। চ কাট অফ পার্টি: নায়েক আবদুস সােবহান (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ও সিপাহি আবদুল খালেকের সাথে ৬জন দুই ভাগে ভাগ হয়ে থানার দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের সংযােগ সড়কে পলায়নপর শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য। অবস্থান নেবেন এবং সাথে ৪টি অস্ত্র থাকবে। ছ, হােল্ডিং পাটি: ল্যান্স নায়েক ছায়েদুল হক (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ও সাথে ৪জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে থানার উত্তর পাশে অবস্থান করে বিশ্রামরত ও কোয়ার্টারে অবস্থানরত শত্রুপক্ষকে নিষ্ক্রিয় রাখবেন এবং সাথে ৩টি অস্ত্র থাকবে।
টার্গেট এলাকায় গমন ও থানা অপারেশন
মানিকপুরের হাইড আউট থেকে বন্ধুর পথ ও গহীন জঙ্গলাকীর্ণ লামা থানা প্রায় ১৩ কিলােমিটার পথ। তা ছাড়া খরস্রোতা মাতামুহুহী নদী বরাবর পাড়ি দিতে হবে বেশ কয়েক কিলােমিটার। এ জন্য ৪টি নৌকা জোগাড় করা হয়। মাঝিহীন সে নৌকা বাইতে হয় মুক্তিযােদ্ধাদেরই । ২ কিলােমিটার পর আবার নৌকা বদল করতে হয়। এভাবে খরস্রোতা মাতামুহুরীর সাথে সংগ্রাম করে মুক্তিযােদ্ধারা চূড়ান্ত মিলন স্থানে ভােররাতে পৌছে টার্গেট এলাকায় অবস্থান নেন। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, যেহেতু থানায় ইপিসিএএফ, পুলিশ ও রাজাকারসহ প্রায় ৮০-৯০জন সদস্য রয়েছে এবং অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় টার্গেটটি অত্যন্ত মজবুত। তাই
সরাসরি আক্রমণ না করে কৌশলে শত্রুদের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বের করতে হবে। সে অনুযায়ী হুইসেলের মাধ্যমে শত্রুদের সতর্ক করে আত্মসমর্পণের ঘােষণা দেওয়া হয়। শক্ররা এ ফাদে পা না দিয়ে বিভিন্ন পােস্ট ও অবস্থান থেকে অনুমাননির্ভর গুলি ছােড়া শুরু করে। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা পালটা গুলি বর্ষণ করেন। প্রায় ১ ঘন্টা ধরে চলে দুই পক্ষের এ মরণপণ যুদ্ধ। বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ লক্ষ্য করায় থানার ভিতরে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর সহযােগীদের মনােবল ভেঙে যেতে থাকে। তার ওপর ইপিসিএএফ সেনা কর্মকর্তারা আগের দিন সন্ধ্যায় অন্যত্র চলে গেছে। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে আহতও হয়েছে বেশ কয়েকজন। উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণের আবেদন জানায় তারা। বিভিন্ন পােস্ট এবং থানার ভিতর থেকে বের হয়ে আসে রাজাকার ও পুলিশ। থানার উঠানে একে একে জমা দেয় অস্ত্র। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা থানার ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পান, পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন আর চরিত্রহীনতার অজস্র স্বাক্ষ্য। অসমর্থিত সূত্রে এ অপারেশনে ৪জন রাজাকার, ২জন পুলিশ নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার কথা জানা যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয় ৩৮টি রাইফেল ও প্রায় দেড় হাজার রাউন্ড অ্যামােনিশন। বন্দিদেরকে পরবর্তী সময় ছেড়ে দেওয়া হয়। সার্বিক বিবেচনায় লামা থানা অপারেশন ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য একটি বড়াে বিজয়। এ অপারেশনে অর্জিত অসাধারণ সাফল্যে নতুন উদ্যম আর প্রেরণা বুকে নিয়ে মুক্তিযােদ্ধা দল প্রত্যাবর্তন করে নতুন মুরংপাড়া ক্যাম্পে।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে রণকৌশলগত বিভিন্ন দিক সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়ােজন নেতৃত্বের বিষয়টি। অপারেশনটিতে প্রত্যক্ষভাবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর প্রশিক্ষিত সৈনিক অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন দল-উপদলের নেতৃত্ব প্রদান করায় অপারেশনে বিভিন্ন দল-উপদলের সমন্বয়ের একটি সুস্পষ্ট পরিবেশ ছিল বলে প্রতীয়মান। তা ছাড়া অপারেশন পরিকল্পনায় ও রণকৌশলের প্রায়ােগিক বিষয়ের ওপর যে যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছিল, তা বিভিন্ন দলউপদলের অবস্থান গ্রহণ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। এ অপারেশনের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে ধারণা করা যায় যে, গেরিলা যুদ্ধের নীতি যথাযথ অনুসরণ না করে মুক্তিযােদ্ধারা একটি প্রচলিত যুদ্ধরীতি অনুসরণ করে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে অটল থাকেন। ফলে তারা শত্রুকে কার্যত এমনভাবে অবরােধ করেন, যাতে তারা থানা কমপ্লেক্স থেকে পশ্চাদপসরণ না করতে পারে। বিভিন্ন উপদল অত্যন্ত বিচক্ষণভাবে অবস্থান গ্রহণে সক্ষম হয়। তা। ছাড়া বিশ্রামরত শক্রদেরকেও নিষ্ক্রিয় করার পরিকল্পনা থেকে এটাই ফুটে ওঠে যে, মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশনটি অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিকল্পনা করেছিলেন।
অপারেশনটির মাধ্যমে প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র (পূর্বে উল্লিখিত) যেমন মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বড়াে প্রাপ্তি ছিল, তার চেয়েও বড় প্রাপ্তি ছিল তাদের আত্মবিশ্বাস অর্জন। তা ছাড়া অনেক দুর্গম পথ পেরিয়ে অপারেশনটি পরিচালনায় মুক্তিযােদ্ধাদের দৃঢ় মনােবল ও উন্নত শারীরিক যােগ্যতার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান। উন্নত রণকৌশল, অটুট মনােবল ও অদম্য সাহসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে এ অপারেশনটিকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
তথ্যসূত্র: ১. সাক্ষাৎকার: অনারারি ক্যাপটেন আবদুস সােবহান।
২. দৈনিক কক্সবাজার ও দৈনিক পূর্বকোণ। ৩, সাপ্তাহিক সাগরকণ্ঠ, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৯১।
ডুলাহাজারা সেতু অপারেশন
অবস্থান
সেতুটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অবস্থিত।
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
মূলত দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে সেতুটিতে মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন: ক, সেতু নিরাপত্তায় নিয়ােজিত রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণ করার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ভেঙে দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার
মহাসড়ককে মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচলকে গতিশীল ও নিরাপদ করা ।। খ, রাজাকার ও পুলিশের অস্ত্রগুলাে আয়ত্ত করে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারকে শক্তিশালী করা।
পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা
হাবিলদার সােবহানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২ নভেম্বর অতর্কিত হামলার মাধ্যমে এ সেতুতে অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ৪জনের ১টি দলকে সাধারণ পথচারী হিসেবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ৪জন হলেন: মুক্তিযােদ্ধা এমদাদ আহমেদ চৌধুরী, জামাল মিয়া, মােহাম্মদ হােসেন ও আইয়ুব বাঙালি। তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অপারেশনের দুদিন আগে পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত করেন। পর্যবেক্ষণের সময় তারা নিম্নলিখিত তথ্য সংগ্রহ করেন:
ক, সেতুতে পাহারায় থাকা রাজাকার ও পুলিশের প্রকৃত সংখ্যা। খ, চেকপােস্টের প্রহরীর সংখ্যা। গ, গার্ড, ডিউটি রুম ও বিশ্রাম এলাকার অবস্থান এবং তাতে সাধারণত অবস্থানকারীর সংখ্যা। ঘ, অস্ত্র ও গােলাবারুদ সম্পর্কে ধারণা। ঙ. রেইডের জন্য যাওয়া ও ফিরতি পথ এবং প্রয়ােজনীয় আরভি বা মিলন স্থান বাছাইকরণ। চ, রেইডের বিভিন্ন দলের অবস্থান নির্বাচন।
অপারেশন
নিজ অবস্থান নতুন মুরংপাড়া থেকে অপারেশনের পূর্বে চূড়ান্ত মিলন স্থানের গমন পথটি দীর্ঘ ও দুর্গম। পাহাড়ি ও জঙ্গলাকীর্ণ দীর্ঘ ২৩ কিলােমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাদেরকে চূড়ান্ত মিলন স্থানে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ পৌছাতে হয়। চূড়ান্ত মিলন স্থান ছিল সেতুর পশ্চিমের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে, আলী মিয়ার খামার নামেই পরিচিত। অপারেশন পরিচালনার জন্য স্থিরীকৃত দল বিন্যাস গতানুগতিক না হয়ে যে ধারা অবলম্বন করে, তা নিম্নরূপ: ক. কমান্ড গ্রুপ: হাবিলদার সােবহান এবং সাথে ৪জন। মােট ৪টি অস্ত্র। অবস্থান সেতুর দক্ষিণ-পূর্বে । খ. অ্যাকশন, গ্রুপ-১: নায়েক আব্দুল কাদের এবং সাথে ৮জন। অস্ত্রের সংখ্যা ৫টি। অবস্থান সেতুর দক্ষিণ-পূর্বে। অ্যাকশন গ্রুপ-২: ল্যান্স নায়েক আব্দুস সালাম এবং সাথে ৭জন। অস্ত্র ৪টি। অবস্থান সেতুর দক্ষিণ-পূর্বে। এ গ্রুপটি কাট অফ পার্টির দায়িত্বেও ছিল। ঘ, অ্যাকশন গ্রুপ-৩: ল্যান্স নায়েক আমিনুল হক এবং সাথে ৭জন। অস্ত্র ৪টি। অবস্থান সেতুর উত্তর-পশ্চিম পাশে। ৬. অ্যাকশন গ্রুপ-৪: ল্যান্স নায়েক ছায়েদুল এবং তার সাথের ৬জনের দায়িত্ব ছিল সেতুর উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থান নিয়ে কাট অফ পাটি ও কভারিং পার্টির কাজ করা। তাদের সাথে মােট ৫টি অস্ত্র ছিল। রেইডের জন্য সময় নির্ধারিত হয় রাত দেড়টায়। এর আগেই রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে চূড়ান্ত মিলন স্থান থেকে সব গ্রুপই শক্রর অজ্ঞাতসারে টার্গেট অবস্থানে পৌঁছে যায়। রাজাকার ও পুলিশ মুক্তিযােদ্ধাদের এ ধরনের আকস্মিক হামলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। ১০জন রাজাকার ও পুলিশের এ দলটির বেশির ভাগই ছিল ঘুমন্ত । রাত দেড়টায় রেইডের প্রথম আঘাতে ডিউটি | পােস্টের ১জন রাজাকার নিহত এবং অন্যজন আহত হয়। বিশ্রাম এলাকায় আহত হয় আরও ১জন রাজাকার। তবে সেতুতে উঠে চার্জ করাও খুব সহজসাধ্য হয় নি। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে দুই পক্ষের গুলি বিনিময়ের পর মুক্তিযােদ্ধারা দুই দিক থেকে সেতুর দিকে অকুতােভয়ে অগ্রসর হতে থাকলে শত্রুপক্ষ রণে ভঙ্গ দেয়। তবু আশপাশের পুকুর ও ডােবা তল্লাশি করে পাওয়া যায় আরও কয়েকজন রাজাকারকে। ততক্ষণে আশপাশের লােকজন মুক্তিযােদ্ধাদের। দেখার জন্য ছুটে আসতে থাকে। কিন্তু গােপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থেই মুক্তিযােদ্ধা দলটি খানিক বিশ্রামের মায়াকে ত্যাগ করে ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ অকুতােভয় যােদ্ধাদের মাঝে কেউ আহত হয় নি। বরং তারা দখলে নিয়েছেন শত্রুর ৩টি .৩০৩ রাইফেল এবং প্রায় ৩০ রাউন্ড গুলি।
বিশ্লেষণ
মুরংপাড়া গুপ্তাশ্রয় থেকে পরিচালিত সব অপারেশনের মধ্যে ডুলাহাজারা সেতু অপারেশন একটি উল্লেখযােগ্য অপারেশন। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের রণকৌশলগত অবস্থান গ্রহণ ও আকস্মিকতা অর্জনের দৃষ্টান্ত সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুট। শত্রুর দুর্বল প্রহরা ব্যবস্থা এ অপারেশনের সাফল্যের নিয়ামক হিসেবে পৰিলক্ষিত। অপারেশনের সাফল্যে মুক্তিযােদ্ধারা তাঁদের মনােবল সুসংহত করেন এবং প্রাপ্ত অস্ত্র তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে সংযােজিত হয়ে নতুন অপারেশন পরিকল্পনায় ভূমিকা রাখে।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক কক্সবাজার, ৩ মার্চ, ২০০২। (ডুলাহাজারা সেতু অপারেশনের নকশাটি ১১৬২ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড