You dont have javascript enabled! Please enable it!
ইদগা সেতুর দ্বিতীয় অপারেশন
প্রেক্ষাপট
ইদগা সেতুর প্রথম অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণে পাকিস্তানি হানাদাররা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন সেতু ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলাের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজাকার ও পুলিশের শক্তিশালী কিছু দলকে নিয়ােগ করে । ইদগা সেতুটি দক্ষিণে টেকনাফ ও উত্তরে চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজারকে যুক্ত করেছে এবং পশ্চিমে মহেশখালী চ্যানেলে যাওয়ার রাস্তা বড় একটি সড়কের সংযােগের ওপর অবস্থিত। তাই ইপিসিএএফ সেতুটির নিরাপত্তায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সেক্টর থেকে মুক্তিযােদ্ধারা নির্দেশ পান পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ভেঙে দেওয়া যায় এমন কিছু মাইনর অপারেশন ও ক্ষুদ্র যুদ্ধ পরিচালনার। এ নির্দেশে জোর দেওয়া হয়, যােগাযােগ ব্যবস্থা শত্রুর কর্তৃত্বমুক্ত করার ওপর। পাকিস্তানিদের মনােবল ভেঙে দেওয়া, অস্ত্র সংগ্রহ ও যােগাযােগ ব্যবস্থাকে শত্রুপক্ষের কর্তৃত্ব মুক্ত করার উদ্দেশ্যেই ইদগা সেতুতে দ্বিতীয় দফা অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা। জামাল, ফরিদ আহমদ ও সিরাজদৌলা- এ তিন সদস্যের দলকে ১৯ নভেম্বর স্কুল ছাত্র ও পথচারীর কভারে পর্যবেক্ষণ করতে পাঠানাে হয়।
উদ্দেশ্য,
ইদগা সেতু পাহারারত পুলিশ ও রাজাকারদের সংখ্যা ও অবস্থান, অস্ত্রের সংখ্যা, ডিউটি পােস্ট, গার্ড রুম, বিশ্রাম এলাকার বিশদ তথ্যসংগ্রহ করা। উল্লেখ্য, সেতুটি ছিল উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সেতুতে অপারেশনের তারিখ ও সময় নির্ধারিত হয় ২৩ নভেম্বর রাত ২টায়। রুট নির্ধারিত হয়, নতুন মুরংপাড়াভােমারিয়া কাঁচা সড়ক হয়ে সেতুর পূর্ব পাশের পাহাড়ে যােদ্ধাদের আক্রমণপূর্ব চূড়ান্ত মিলন স্থান। এজন্য প্রায় ১৮ কিলােমিটার পথ পাড়ি দিয়ে টার্গেটে পৌঁছাতে হয়। দল বিন্যাস পরিকল্পনা ছিল নিমরূপ: ক. কমান্ড গ্রুপ: হাবিলদার সােবহান এবং সাথে ৫জন, অস্ত্র ৪টি। খালের দক্ষিণে রাস্তার পূর্ব পাশে পশ্চিমমুখী হয়ে অবস্থান নেবেন। খ, কভারিং পাটি: হাবিলদার জলিল ও সাথে ৮জন, অস্ত্র ৬টি। রাস্তার পূর্ব পাশে টিলার দক্ষিণে অবস্থান গ্রহণ করবেন। অ্যাকশন গ্রুপ-১: নায়েক ফয়েজ আহমদ এবং সাথে ৯জন। অস্ত্র ৭টি। অবস্থান নেবেন খালের দক্ষিণ দিকের রাস্তার পূর্ব পাশে। ঘ. অ্যাকশন গ্রুপ-২: ল্যান্স নায়েক আবদুল কাদের এবং সাথে ৯জন। অস্ত্র। ৭টি। খালের উত্তরে রাস্তার পশ্চিম পাশে পূর্বমুখী অবস্থানে থাকবেন। অ্যাকশন গ্রুপ-৩: নায়েক আবদুস সােবহান এবং সাথে ৯জন, অস্ত্র ৬টি। তাদের অবস্থান হবে অ্যাকশন গ্রুপ-২-এর উত্তরে।
চ, সার্চ গ্রুপ: ল্যান্স নায়েক আবদুস সালাম এবং সাথে ৯জন। অস্ত্র ৬টি।
খালের উত্তরে রাস্তার সাথেই এদের অবস্থান নির্দিষ্ট। এঁরা হামলার পর
পরই টার্গেট সংলগ্ন এলাকা তল্লাশির দায়িত্ব পালন করবেন। জ, হােল্ডিং পাটি: ল্যান্স নায়েক ছায়েদুল ও সাথে ৭জন। অস্ত্র ৪টি। খালের উত্তরে উঁচু ভূমিতে বিশ্রাম এলাকামুখী অবস্থানে থাকবেন। অপারেশন। ২২ নভেম্বর বিকাল ৩টায় নতুন মুরংপাড়া হতে রেইড দলটি টার্গেট এলাকায় যাত্রা শুরু করে। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ দলটি ভােমারিয়া বিট অফিসের কাছে পৌছায়। বিট অফিসার তাদের খাদ্য ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেন। রাত ৯টায় তারা আবার টার্গেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। রাত ১টা নাগাদ সব গ্রুপই পূর্বনির্ধারিত অবস্থান গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত ছিল, অপারেশনের প্রকৃত সময়ের আগে কেউ গুলি বর্ষণ করবে না। রাত ২টা বাজার সাথে সাথেই কমান্ড গ্রুপের সাথে অ্যাকশন গ্রুপের অস্ত্র একত্রে গর্জে ওঠে। দুই পক্ষেই প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে তুমুল গােলগুলি চলে। অপারেশন শেষে সার্চ গ্রুপ সাফল্যজনকভাবে গ্রামের ভিতরে ঢুকে পলায়নপর ৫-৬জন রাজাকার ও পুলিশকে আটক করে। সর্বমােট যুদ্ধবন্দি হয় ১২জন। অন্যরা পালিয়ে যায়। এ অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত হয় নি। হস্তগত হয় ৭টি ৩০৩ রাইফেল ও ৩০০ রাউন্ড অ্যামুনিশন।
বিশ্লেষণ
ধারাবাহিক অপারেশন পরিচালনায় এটি ছিল ইদগা সেতুতে দ্বিতীয় অপারেশন। মূলত শক্রর চলাচলের রাস্তাকে বিপজ্জনক করে তােলা এবং তাদের মনােবল ধ্বংস করাই ছিল এ অপারেশনের লক্ষ্য। যেহেতু ইদগা সেতুতে পূর্বেই একবার অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল, তাই স্বাভাবিক কারণে প্রহরা ব্যবস্থা জোরালাে ছিল। অনুমান, মুক্তিবাহিনী নিঃশব্দে প্রহরীকে হত্যা না করে সরাসরি আক্রমণ। রচনা করে। অবস্থান গ্রহণে পুনরায় তারা সফলতার পরিচয় দেয়। তা ছাড়া তাদের অকুতােভয় আক্রমণ ও জয়ের জন্য দৃঢ়তা সার্বিকভাবে এ অপারেশন সাফল্যের উল্লেখযােগ্য দিক বলে চিহ্নিত করা যায়। এ অপারেশন মূলত শক্রর যােগাযােগ ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। তাই অপারেশনের সাফল্য। সম্পূর্ণভাবে অর্জিত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান। শত্রুর মনােবল ক্ষুন্ন ও অস্ত্র প্রাপ্তি অপারেশনের উপরি পাওনা হিসেবে পরিগণিত।
তথ্যসূত্র: ১.সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অনারারি ক্যাপটেন সােবহান। ২. দৈনিক কক্সবাজার ও দৈনিক পূর্বকোণ, ১৩ মে, ১৯৯৩।
(ইদগা সেতুর দ্বিতীয় অপারেশনের নকশাটি ১১৬৩ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!