অপারেশন গিরিচৌধুরী বাজার
প্রেক্ষাপট ও অবস্থান
ডিসেম্বরে প্রথম দিকে মিত্র বাহিনীর অগ্রাভিযান শুরুর পর অন্যান্য অঞ্চলের মতাে চট্টগ্রামেও পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবানসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রাম শহরে চলে আসার পরিকল্পনা করে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে আসা পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অ্যামবুশ করার জন্য পটিয়া থানার অন্তর্গত গিরিচৌধুরী বাজারকে উত্তম স্থান হিসেবে শনাক্ত করা হয়। পটিয়া থানা থেকে ২ কিলােমিটার দক্ষিণে, পটিয়া বিসিক শিল্প নগরীর দক্ষিণ-পূর্ব পাশে এবং চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কের ওপর এ বাজার অবস্থিত। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের ওপর এ বাজারে একটি ব্রিজ ছিল। ব্রিজটি ভেঙে পাকিস্তানি সেনাদের গতিরােধ করে ক্ষয়ক্ষতি করার কৌশল অবলম্বন করা হয়। গিরিচৌধুরী বাজারের ১০০ গজ পূর্ব দিকে ছিল চট্টগ্রাম-দোহাজারি রেললাইন।
উদ্দেশ্য
কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবানসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা যেন চট্টগ্রাম শহরের দিকে আসতে না পারে, সে জন্য তাদের যাতায়াতের পথে প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরােধ সৃষ্টি করাই ছিল এ অপারেশনের উদ্দেশ্য।
প্রাথমিক পরিকল্পনা
মুক্তিযােদ্ধা শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে প্রিন্সিপাল নূর মােহাম্মদ, মহসিন খান, হাবিবুর রহমান ও শামসুদ্দিন এ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন এভাবে: গিরিচৌধুরী বাজারে অবস্থিত ব্রিজটি আগেই ভেঙে ফেলা হবে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয় বাধার সম্মুখীন হবে। পরবর্তী সময় থেমে যাওয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে অ্যামবুশ করা হবে। এজন্য পুরাে দলকে নিম্নরূপ ২টি উপদলে বিভক্ত করা হয়: ১. প্রথম দল: মুক্তিযােদ্ধা জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে এ দলে ছিলেন অজিত, আবুল হােসেন, শফিউল আলম প্রমুখ। তাদের কাছে অস্ত্র ছিল ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ৩টি রাইফেল ও ২টি গ্রেনেড। তাদের কাজ ছিল ব্রিজের পশ্চিম পাশে তৈরি করা বাংকারে অবস্থান নিয়ে শত্রুর ওপর গুলি বর্ষণ করা। অপারেশন শেষে দ্রুত পশ্চিম দিকে গ্রামের মধ্যে নিজেদের প্রত্যাহার করবে।
২. দ্বিতীয় দল: মুক্তিযােদ্ধা মঞ্জুরের নেতৃত্বে এ দলে ছিলেন স্বপন, সােলেমানসহ ৭জন। তাদের অস্ত্র ছিল ১টি স্টেনগান, ১টি জি-৩ রাইফেল, ১টি এসএলআর ও ৪টি গ্রেনেড। এ দলের কাজ ছিল ১ম। দলের ১০০ গজ দক্ষিণে রাস্তার পশ্চিম পাশে একটি পুকুর পাড়ে পজিশন। নিয়ে শত্রুর ওপর গুলি বর্ষণ করা। পরিকল্পনা করা হয় যে, এ দল শত্রুর ওপর প্রথম গুলি বর্ষণ করবে। শক্র ব্রিজের সন্নিকটে এসে পড়লেই কেবল গুলি করা হবে। পরবর্তী সময় ১ম দলের প্রত্যাহারের সময়। কভারিং ফায়ার দেবে। তারপর গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।
প্রাথমিক কর্ম সম্পাদন ও পর্যবেক্ষণ
অপারেশনের আগের দিন ১১ ডিসেম্বর এ কে এম জয়নাল আবেদীন, মাহমুদ ও ফেরদৌস সন্ধ্যার দিকে গিরিচৌধুরী বাজারের দক্ষিণ পাশের গ্রামের বাসিন্দা ইমাম বক্স ও আবু তাহেরের সহযােগিতায় ঐ গ্রামের ২০-২৫জন সাহায্যকারীর মাধ্যমে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজারের ওপর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে পুরােনাে ব্রিজটি ভাঙতে শুরু করেন। প্রশ্ন জাগতে পারে যে, পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ব্রিজ ভাঙার কারণ কী? গেরিলাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিজের ১০০ গজ দূরে একটি বাংকার খনন করে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রসরমাণ দলকে প্রতিরােধ করা। মূলত অপারেশনের সুবিধার্থে এ ব্রিজটি ভেঙে ফেলা হয়। ভাঙার পর ব্রিজ থেকে ১০০ গজ উত্তর-পূর্ব কোণায় রাস্তার পাশে একটি বাংকার খনন করা হয়। এ ছাড়া আশেপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ করে তারা প্রয়ােজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। ব্রিজের আশপাশে ২-৩টি ছােটো দোকান। জানা যায়, এটি একটি বিলুপ্ত বাজার। পর্যবেক্ষণ দলের এ দুটো কাজ সম্পন্ন করতে সময় লাগে আনুমানিক ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। স্থানীয় কয়েকজন সহযােগী মুক্তিযােদ্ধাকে বাংকারের দায়িত্ব। বুঝিয়ে দিয়ে পর্যবেক্ষণ শেষ করে তারা সেখান থেকে এক কিলােমিটার দূরে। পটিয়ার সিও অফিসে গিয়ে মূল দলের সাথে যােগ দেন। পর্যবেক্ষণ দল তাদের নিরাপত্তার জন্য দুটি হ্যান্ড গ্রেনেড, একটি এসএলআর ও একটি এলএমজি নিয়ে। গিয়েছিল।
চূড়ান্ত অপারেশন পরিকল্পনা
পর্যবেক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতে ঐ রাতে সিও অফিসে বসে সার্বিক বিষয় পর্যালােচনা করে পরিকল্পনা করা হয়, গেরিলা দল ২টি গ্রুপে ভাগ হয়ে এ অপারেশনে অংশ নেবে। জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে ১ নম্বর গ্রুপ ইতােমধ্যে খননকৃত বাংকারে অবস্থান নেবে এবং ২ নম্বর গ্রুপ মনজুরের নেতৃত্বে বাংকার থেকে ১০০ গজ দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় অবস্থিত পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নেবে। পরিকল্পনায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি ভাঙা ব্রিজের কাছে এসে থামলে ২ নম্বর দল এবং তারপর ১ নম্বর দল ফায়ার ওপেন করবে। ২ নম্বর দল ১ নম্বর দলকে কভারিং সুবিধা দেবে। শাহজাহান ইসলামাবাদী, প্রিন্সিপাল নূর মােহাম্মদ,
মহসিন খান, হাবিবুর রহমান ও শামসুদ্দিনসহ সবাই মিলে এ অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।
অপারেশন
১২ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ৬টার দিকে ৫জনের ১ নম্বর দল এবং ৭জনের ২ নম্বর দলকে পটিয়া বিএডিসির একটি পিকআপে করে যথাক্রমে বাংকারের কাছে ও পুকুর পাড়ে নামিয়ে দিয়ে আসে। সকালবেলা গেরিলারা নাস্তা করে নি বিধায় স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা জলিল বাংকারের সামনের চায়ের দোকান থেকে চা-নাস্তা নিয়ে আসেন। ১জন সহযােদ্ধা বাংকারের সাথে অবস্থিত বটগাছের পাশে বসে সবাইকে চা পরিবেশন করছিলেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে তারা দেখেন, বাংকার থেকে প্রায় ৪০০-৫০০ গজ দূরে বাজারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া চট্টগ্রাম-দোহাজারি। রেললাইনের ওপর দিয়ে মানুষজন ছােটাছুটি করছে। তা দেখে গেরিলারা সজাগ হয়ে ওঠেন। ইত্যবসরে দেখা যায়, ৩-৪টি বিআরসিটি বাস দ্রুতগতিতে ভাঙা ব্রিজের দিকে এগিয়ে আসছে। গাড়িগুলাে ব্রিজের সামনে এসে হঠাৎ ব্রেক করে দাঁড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর খাকি পোশাকধারী ১জন পাকিস্তানি সেনা অস্ত্র হাতে গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে ভাঙা ব্রিজটির দিকে এগিয়ে আসে।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ২ নম্বর গ্রুপ থেকে ফায়ার করার কথা থাকলেও ফায়ার ওপেন হচ্ছে না দেখে ১ নম্বর গ্রুপ থেকে জয়নাল আবেদীন ফায়ার ওপেন করেন। ১ নম্বর দল ব্রিজের ওপর দাঁড়ানাে ঐ পাকিস্তানি সেনাকে লক্ষ্য করে গুলি শুরু করার পর পরই গাড়ির ভিতর থেকে ইয়া আলী শব্দ করে দরজা ও জানালা দিয়ে সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে পজিশন নিয়ে বাংকার লক্ষ্য করে পালটা গুলি করা শুরু করে। গাড়ি থেকে বাংকারের দূরত্ব আনুমানিক ১০০ গজ। ইতােমধ্যে ২ নম্বর গ্রুপও পাকিস্তানি সেনা ও তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করে। প্রায় ২ ঘণ্টা প্রচণ্ড গুলি বিনিময়ের পর হঠাৎ ১ নম্বর দল বাংকার থেকে দেখতে পায় যে, দোহাজারির দিক থেকে ট্রেনে করে আরও পাকিস্তানি সৈন্য আসছে। তা ছাড়া সংঘর্ষরত পাকিস্তানি সেনারা ক্রলিং করে পুকুরের দিকে ও বাংকারের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। দুই পক্ষের যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে এলে আত্মরক্ষার জন্য তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পরে ২টি গ্রুপই আনােয়ারায় মিলিত হয়। এ অপারেশনে ১ম দল ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ৩টি রাইফেল ও ২টি গ্রেনেড ব্যবহার করে এবং ২য় দল ১টি স্টেনগান, ৪টি রাইফেল, ১টি জিফোর রাইফেল ও ১টি এসএলআর ব্যবহার করে।
ক্ষয়ক্ষতি
গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এ সংঘর্ষে ১১জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। পাকিস্তানি সেনাদের ২টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গেরিলাদের তেমন কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
প্রভাব ও বিশ্লেষণ
সংঘর্ষ শেষে গেরিলারা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের ভিতর ঢুকে নিরীহ জনগণের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং গেরিলাদের খোঁজে এলােপাতাড়ি গুলি শুরু করে। ফলে ৫জন নিরীহ গ্রামবাসী শহিদ হন। এটি মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে একটি সুচিন্তিত অপারেশন। প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল হলেও সার্বিক সাফল্য আসে নি। কারণ, প্রথমত মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অস্ত্রশস্ত্র ও জনবল; দ্বিতীয়ত, পলায়নপর বেপরােয়া মনােভাব সম্পন্ন অধিক শক্তিধর শত্রু। সামগ্রিক বিচারে এটিকে একটি উল্লেখযােগ্য গেরিলা অপারেশন হিসেবে গণ্য করা যায়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাত্তার: মুক্তিযােদ্ধা এ কে এম জয়নাল আবেদীন।
জোয়ারিয়ানালা ও ইদগা সেতু অপারেশন
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কক্সবাজার এলাকার এক দল মুক্তিযােদ্ধা বার্মায় (বর্তমানে মীয়ানমার) আশ্রয় নেন। জুন মাসে এসব মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল বার্মা সীমান্ত পার হয়ে শত্রু অধ্যুষিত দেশের অভ্যন্তরে ফেরত আসে। সে সময় পরিস্থিতি খুব সুখকর ও অনুকূলে ছিল না। গেরিলা অপারেশনের জন্য প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ নেই, অস্ত্র নেই, গােলাবারুদ নেই, নেই সেক্টরের সাথে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ। তবু নিরাশ। হয় নি তারা। বান্দরবান সীমান্ত সংলগ্ন সােনাইছড়িতে গড়ে তােলে প্রথম অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখানে স্ব উদ্যোগে নিজস্ব পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়। কিন্তু অস্ত্র ও প্রয়ােজনীয় গােলাবারুদের অভাবপূরণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শমসের আলম চৌধুরী ও আলী মিয়া চৌধুরী। পরিমল বড়ুয়ার সহায়তায় মাটিতে পুঁতে রাখা ১৭টি রাইফেল ও ৮৫ রাউন্ড গুলি পৌছায় মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে। তারপর বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও প্রায় ১২ হাজার রাউন্ড অ্যামুনিশন তারা পেয়েছিলেন। এ শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে সংগঠিত মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে এলাকার মুক্তিকামী জনসাধারণকে জানানাে এবং রাজাকার ও পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই জোয়ারিয়ানালা ও ইদগা সেতু অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, পরিকল্পনাটি ১ নম্বর সেক্টরের অনুমােদনের পর ক্যাপটেন হারুন বাহকের মাধ্যমে একটি চিরকুটে এ অপারেশনের আদেশ পাঠিয়েছিলেন বলে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী জানান।
পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও দল বিন্যাস
সেপটেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পথচারী ও দিনমজুরের ছদ্মবেশে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি পর্যবেক্ষণ দল নির্দিষ্ট সেতু দুটোর আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত রাজাকার ও পুলিশের অবস্থান ও অস্ত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। জোয়ারিয়ানালা সেতুর পশ্চিম পাশে ডিউটি পােস্ট ছাড়া বিশ্রাম এলাকা ছিল ৩টি। ১টি রাস্তা সংলগ্ন ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে এবং অন্য ৩টি ছিল পার্শ্ববর্তী ২টি মাচা ঘরে। অপারেশনের সময় নির্ধারিত হয় মধ্যরাতে। মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন মাত্র ১৭জন। তাই পরিকল্পনা নেয়া হয় যে, অতর্কিতে জোয়ারিয়ানালা সেতু আক্রমণ করে সেই রাতে একই দলের মাধ্যমে ইদগা সেতু আক্রমণ করতে হবে। এর ফলে শত্রুরা সতর্ক হওয়ার সুযােগ পাবে না। অপারেশনের জন্য এপ বা দল বিন্যাস ছিল নিম্নরূপ: ক. কমান্ড গ্রুপ: হাবিলদার সােবহানের নেতৃত্বে ২জন মুক্তিযােদ্ধা ও ৩টি অস্ত্র। খ, অ্যাকশন গ্রুপ-১: ১জন এনসিও’র নেতৃত্বে ৪জন মুক্তিযােদ্ধা ও ৪টি অস্ত্র। অ্যাকশন গ্রুপ-২: ১জন ইপিআর এনসিও’র নেতৃত্বে ৪জন মুক্তিযােদ্ধা ও ৪টি অস্ত্র। ঘ, অ্যাকশন গ্রুপ-৩: ১জন এনসিও সাথে অপর ১জন যােদ্ধা সেন্ট্রি ডিসপােজালের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁদের সাথে ছিল ২টি অস্ত্র। উ. কভারিং ও কাট অফ পার্টি: ১জন এনসিও’র নেতৃত্বে ৪জন, অস্ত্র ৩টি। জোয়ারিয়ানালা সেতু আক্রমণ সুদীর্ঘ ২২ কিলােমিটার পাহাড়ি পথ ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মুক্তিবাহিনীর এ দলটি পূর্বনির্ধারিত চূড়ান্ত মিলন স্থানে (সেতুর দক্ষিণ-পূর্বে) পৌছে। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে, কোনাে গ্রুপই প্রয়ােজন ব্যতীত গুলি বর্ষণ করবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব গ্রুপ কোনােপ্রকার গােলাগুলি ছাড়াই সফলতার সাথে নিঃশব্দে ১০জন রাজাকার ও পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। এ সময় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে রাজাকারদের প্রাথমিকভাবে হাতাহাতি যুদ্ধ হলেও তাতে কেউ আহত হয় নি। উল্লেখ্য, রাজাকারদের বেশ কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রয়ােজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের দলে নেয়া হয়। সময় নষ্ট না করে মুক্তিযােদ্ধা দল রওনা দেয় পরবর্তী টার্গেট ১২ কিলােমিটার উত্তরে ইদগা সেতুর উদ্দেশ্যে।
ইদগা সেতু অপারেশন
জোয়রিয়া লা সেতু অপারেশনের জন্য নির্দিষ্ট একই দল বিন্যাসে এবার হাবিলদার সোবহানের তত্বাধীন মুক্তিযােদ্ধার দলটি প্রধান সড়ক ধরে ইদগা সেতুর দিকে অগ্রসর হয়। নিকটে পৌছলে সেতু পাহারারত রাজাকার ও পুলিশ। ও বন্ধাদেরকে দূর থেকে দেখে সন্দেহ করে তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। সৌভাগ্যক্রমে এতে কেউ আহত হয় নি। তুরিতগতিতে মুক্তিযে’ বা ‘সতুর দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের উঁচু ভূমিতে অবস্থান নেন। তাঁরা সেতুর হারায় নিয়ােজিত ইপিসিএএফ সদস্যদের ওপর পালটা গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। এ পর্যায়ে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি গ্রুপ। কভারিং ফায়ারের সমর্থনে সরাসরি সেতুর ওপর উঠে আসে। হতচকিত ও ভীত রাজাকার ও পুলিশের দল রণে ভঙ্গ দেয়। তারা ফেলে রেখে যায় ৯৫ রাউন্ড ৩০৩ রাইফেলের গুলি। তা ছাড়া তল্লাশিতে ধরা পড়ে ৩জন নিরস্ত্র রাজাকার। উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে এদের পােশাক ও ব্যাজ কাজে লাগিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি চতুরতার সাথে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে রাজাকারদের অস্ত্র, লোকবল ও বিভিন্ন অবস্থানের তথ্যসংগ্রহ করে। বিশ্লেষণ এ অপারেশন দুটি প্রতিরােধ যুদ্ধের সমাপ্তি ও গেরিলা যুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে। পরিচালনা করা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল সংগঠনে এ অপারেশনগুলাের গুরুত্ব বিশেষ বিবেচনার দাবিদার। এ অপারেশনের প্রধান লক্ষ্য ছিল কৌশলে সেতু দুটির প্রহরায় নিয়ােজিত রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের পরাস্ত করে অস্ত্র ও গােলাবারুদ সগ্রহ। এ অপারেশনে প্রাপ্ত অস্ত্র এবং রাজাকারদের ব্যবহার করে পরবর্তীকালে আরও কিছু অপারেশন পরিচালিত হয়, যা বস্তুতপক্ষে এ অপারেশনের সাফল্যের সাথে সম্পর্কিত। প্রথম সেতুটি বিনা বাধায় দখলের ঘটনায় আকস্মিকতা অর্জনের বিষয়টি পরিস্ফুট। দ্বিতীয় অপারেশনেও শক্রর সীমিত বাধা সত্ত্বেও তা মােকাবিলা করে তাদের পরাস্ত করার ঘটনা মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ও সাহসিকতার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন। উল্লেখ্য, সামরিক পরিভাষায় এটি Raid বা হানা। এটি সুনিশ্চিতভাবেই একটা সফল রেইড। তথ্যসূত্র:
১. সাক্ষাৎকার: অনারারি ক্যাপটেন আবদুস সােবহানের। ২, দৈনিক কক্সবাজার ও দৈনিক পূর্বকোণ।
(জোয়ারিয়ানালা ও ইদগাসেতু অপারেশনের নকশাটি ১১৬০ এবং ১১৬১ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড