You dont have javascript enabled! Please enable it! চানপুর এলএসডি গােডাউন ও রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
চানপুর এলএসডি গােডাউন ও রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ
উদ্দেশ্য
বাঁশখালী থানার চানপুর এলএসডি গােডাউন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের খাদ্য (চাউল ও গম) সরবরাহ করা হতাে। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ওপর সরকারি ফরেস্ট অফিসের রেস্ট হাউজে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার জন্য গােডাউন থেকে খাদ্যসামগ্রী ছিনিয়ে নেয়া এবং রাজাকার ক্যাম্পে হামলা করে তাদের বিতাড়িত করা ছিল এ অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য।
অবস্থান
বাঁশখালী থানা সদর থেকে ১০ কিলােমিটার উত্তরে থানার শেষ সীমান্ত সংলগ্ন শঙ্খ নদীর পূর্ব পাড়ে এবং আনােয়ারা থানা সদর থেকে ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে বর্তমান তৈলারদ্বীপ ফেরিঘাটের পূর্ব পার্শ্বে চানপুর এলএসডি গােডাউন অবস্থিত।
পর্যবেক্ষণ
গেরিলা মুক্তিযােদ্ধা জয়নাল ও মিন্টু ১টি রিভলভার ও ২টি হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে অপারেশনের দিন সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে লুঙ্গি ও ছেড়া শার্ট পরে গরিব মানুষের বেশে বাইনজুরি গেরিলা শেল্টার থেকে চানখালী নদীর পাড়ের বরকল ঘাটে যান। সেখান থেকে ১টি সাম্পানে করে তৈলারদ্বীপ ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হন। প্রায় ১ ঘণ্টা পর তৈলারদ্বীপ ঘাটে পৌছে গােডাউন সংলগ্ন পাশের বাজারে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খান এবং নানা আলাপচারিতার মাধ্যমে। আশপাশের খবরাখবর জানার চেষ্টা করেন। তারা সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এলএসডি গােডাউনের একজন কর্মচারীকে খোঁজার ছলে গােডাউনে প্রবেশ করে ভিতরের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেন। তারা গােডাউনের প্রবেশপথে খাকি পােশাকধারী লাঠি হাতে ২জন গার্ডকে এবং ৪টি তালাবদ্ধ গুদাম ঘর দেখতে পান। তা ছাড়া তারা কর্মকর্তাদের বাসাবাড়ি, লােকজনের চলাচলের অবস্থা ইত্যাদি দেখে গােডাউন এলাকা থেকে বের হয়ে পশ্চিম পাশের রাস্তা দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ২০-৩০ গজ সামনে এগিয়ে যান। সেখানে তারা পাহাড়ের টিলার। ওপর রেস্ট হাউজে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পের আধপাকা টিনের ঘরটি দেখতে পান। তারা লক্ষ্য করেন ক্যাম্পের সামনের রাস্তার ওপর কয়েকটি গােডাউন। সেখানে যাওয়ার পর তারা এলাকার লােকজনের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, এ ক্যাম্পে ১০-১২জন রাজাকার থাকে। কিছু রাজাকার বর্তমানে ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকের একটি গ্রামে অপারেশনে গেছে। পর্যবেক্ষণ শেষ করে তারা সাম্পানে করে। প্রত্যাবর্তন করেন।
পরিকল্পনা
সার্জেন্ট মহিউল আলম ও গেরিলা অধিনায়ক আবদুল লতিফ এ আক্রমণের প্রস্তাবটি গ্রুপ অধিনায়ক শাহজাহান ইসলামাবাদীর কাছে উপস্থাপন করেন। পরবর্তী সময় তারা ৩জন মিলে এ অপারেশনের বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন। আলােচনায় ঠিক করা হয় যে, ৪জন অধিনায়কের নেতৃত্বে ৪টি গ্রুপে ভাগ হয়ে গেরিলাদের ৩টি গ্রুপে গােডাউন ও রাজাকার ক্যাম্পের তিন দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করবেন। অন্য ১টি গ্রুপ পিছনে থেকে তাদের কভারিং দেবে।
অপারেশন
পর্যবেক্ষণ শেষ করে সাম্পানে এসে তারা বরকল ঘাটের দিকে সামান্য এগিয়ে যেতেই সিগন্যালের জন্য অপেক্ষমাণ দলকে দেখতে পান। সিগন্যাল পাটি পিছনের মূল দলকে ঘটনাস্থলে আসার জন্য সংকেত দেয়। উল্লেখ্য, বরকল ঘাট থেকে তৈলারদ্বীপের দূরত্ব প্রায় ২ কিলােমিটার। তাই রেকি পার্টিকে পাঠিয়ে দিয়ে মূল দল সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে মূল গেরিলা দল কাছাকাছি চলে আসতে সক্ষম হয়। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অধিনায়ক আবদুল লতিফের নেতৃত্বে নুরুল ইসলাম বাবু, সৈয়দ নুর, আবদুল হক, নুরুল আমিনসহ ১২জনের ৪ নম্বর গেরিলা দলকে শঙ্খ নদে কভারিং পার্টি হিসেবে রেখে বাকি ৩টি দল দ্রুত তীরে উঠে যায়। তারপর ৩ নম্বর দলটি অধিনায়ক হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে হাবিলদার আবু ইসলাম, আবুল বাশার, আবু তৈয়ব, মাে. সােলেমান, আবুল মনজুর, আবু বকর ও আবুল কাসেমসহ ১১-১২জন গেরিলা গােডাউনের উত্তর পাশের বাজারে অবস্থান নেন। ২ নম্বর দলটি সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে আবদুর রাজ্জাক, কাজী ইদ্রিস, আবদুল হক, মাে. ইদ্রিস, আবদুর আলিম ও জামাল আহমেদসহ ১২জন গেরিলা গােডাউনের দক্ষিণ পাশে ও রেস্ট হাউজের উত্তর পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে চলে যাওয়া রাস্তার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় অবস্থান নেন। অন্যদিকে, ১ নম্বর দলটি গ্রুপ অধিনায়ক শাহজাহান ইসামাবাদীর নেতৃত্বে এ কে এম জয়নাল আবেদীন, ফেরদাউস ইসলাম খান, ডা. গােলাম মাওলা, আবদুল গাফফার, আবুল মনজুর, মাহমুদুর রহমান, আবদুল মালেক, নূর মােহাম্মদ, মােজাহেরুল ইসলাম, এস এম আলমগীর মিন্টুসহ প্রায় ১৮-২০জনের গেরিলা দলটি গােডাউনের মূল ফটকে অবস্থান নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাম্পানের মাঝিমাল্লা ও এলাকার লােকজনসহ আনুমানিক শতাধিক লােক ১ নম্বর দলের সাথে গােডাউনের ভিতরে প্রবেশ করেন। প্রবেশের মুহূর্তে প্রথমেই কয়েকজন গেরিলা গেটে পাহারারত দারােয়ান। ২জনকে ধরে ফেলেন এবং ধমক দিয়ে বলেন, গােডাউনের তালা খুলে দে। ফলে তারা ভয়ে গােডাউনের তালা খুলে দেয়। তালা খুলে দেওয়ায় সাথে সাথে ১ নম্বর। গ্রুপের সঙ্গে আসা এলাকার লােকজন ও মাঝিমাল্লা মিলে গােডাউন থেকে চাউল ও গমের বস্তাগুলাে কাধে করে ঘাটে অপেক্ষমাণ গেরিলাদের ২টি নৌকায় ভরতি করতে থাকেন।
নৌকায় বস্তা ভরতি করার শেষ দিকে রাজাকাররা খবর পেয়ে গােডাউনের দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে গােডাউনের দক্ষিণ দিকে অবস্থানরত মহিউল আলমের নেতৃত্বে থাকা ২ নম্বর দলের প্রতিরােধের মুখে পড়ে। তারা রাজাকার বাহিনীকে গুলি করতে করতে দক্ষিণ দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে তারা পালিয়ে বাঁশখালী থানার জলদি ক্যাম্পের দিকে পালিয়ে যায়। ইতােমধ্যে গেরিলারা ২টি গুদাম থেকে প্রায় ৪০০ বস্তা খাদ্যশস্য সাম্পানে করে বাইনজুরি। গেরিলা শেল্টারে নিয়ে আসেন। গেরিলাদের ২ নম্বর দল রাজাকারদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত রেস্ট হাউজে উঠে তল্লাশি করে তেমন কিছু না পেয়ে ফিরে আসে। তবে বন বিভাগের ২জন দারােয়ান রেস্ট হাউজে প্রহরারত ছিল। এ অপারেশন চলে সকাল সাড়ে ১০টা। থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। গেরিলারা গােডাউন থেকে নৌকা বােঝাই খাদ্যশস্য নিয়ে চলে আসার সময় কিছু চাউল ও গম ঐ এলাকার গরিব লােকজনকে দিয়ে দেন। বাকিগুলাের মধ্যে কিছু খােলাবাজারে বিক্রি করেন। যারা গেরিলাদের সাথে সহযােদ্ধা হিসেবে অপারেশনে অংশ নেন, তাঁদের সবাইকে কিছু কিছু চাউল ও গমের বস্তা দেওয়া হয়। বেশ কিছু গম ও চাউলের বস্তা আশপাশের গেরিলা শেল্টারগুলােতে রসদ হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ অপারেশনে ২টি এলএমজি, ৫-৬টি এসএলআর, ৫-৬টি এসএমজি, ১৫-২০টি রাইফেল, ২০-২৫টি গ্রেনেড ও ৩টি রিভলভার ব্যবহার করা হয়।
প্রভাব
গেরিলারা অপারেশন শেষ করে চলে যাওয়ার পর বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যের সমর্থন নিয়ে রাজাকাররা এসে গােডাউনের আশপাশের বাজার ও এলাকার লােকজনকে মারধর ও অত্যাচার করে, দোকানপাট, বাড়িঘর। ভাঙচুর ও লুটপাট করে, কিছু নিরীহ লােকজনকে ধরে বাঁশখালীর জলদি হেডকোয়ার্টারসে নিয়ে যায়।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এ কে এম জয়নাল আবেদীন।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড