ফারুয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ
প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন পথে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন সময় যাওয়া-আসা করতেন। অপর পক্ষে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের খোঁজে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করতে থাকে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ফারুয়া এলাকার বেশ কিছু উদ্যমী যুবক যুদ্ধ প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যােগ দিতে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সম্মুখীন হন। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর পালটা আক্রমণ চালান। উল্লিখিত সম্মুখযুদ্ধ এমনই একটি আকস্মিক আক্রমণ এবং তার প্রতিরােধ ।
অপারেশন
২২ অক্টোবর বিকাল আড়াইটায় ফারুয়া এলাকার আনুমানিক ২৮০জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল সার্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা আরও উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে যাবে। সিদ্ধান্ত মােতাবেক তারা যাত্রা শুরু করে। যাত্রা পথ ছিল পাহাড়ি। পথিমধ্যে তারা হঠাৎ আক্রমণের মধ্যে পড়ে। আক্রান্ত হওয়ার সময় তাদের অবস্থান ছিল পাহাড়ের ওপর। ভূমির কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় তারা প্রথমে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর দলের ওপর গ্রেনেড চার্জ করে এবং রাইফেলের গুলি বর্ষণ করে। আক্রমণের দিক উপলব্ধি করতে পেরে পাকিস্তানি সেনারা তিন দিক থেকে তাদের। ঘিরে ফেলে এবং পালটা আক্রমণ চালায়। বেশ কিছু সময় ধরে আক্রমণ ও পালটা-আক্রমণের পর মুক্তিযােদ্ধা দল বিকল্প পথে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়।
বিশ্লেষণ
মাসটি ছিল অক্টোবর; অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে এ অপারেশনটি সংগঠিত হয়। এটা ছিল আকস্মিক আক্রমণের বিরুদ্ধে অপরিকল্পিত প্রতিরােধ। এতে মুক্তিযােদ্ধা দলের ৫জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং ৭৩জন যুদ্ধবন্দি হন। বাকি মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে যেতে সক্ষম হন। অপর দিকে শত্রুপক্ষের ২জন নিহত হয়। তা ছাড়া এ অপারেশন থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলাে, পথপ্রদর্শককে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করা, মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল পথ গােপন রাখা এবং উল্লিখিত এলাকার পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ না করা। তথ্যসূত্র: সাক্ষাঙ্কার: মুক্তিযােদ্ধা আবুল মনসুর সিদ্দিকী।
আরাকান সড়কে নগরপাড়া ব্রিজ অপারেশন
অবস্থান
চন্দনাইশ থানা সদর থেকে ২ কিলােমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এবং চট্টগ্রাম-দোহাজারি রেললাইনে কাঞ্চননগর রেল স্টেশন থেকে আনুমানিক আধা কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের নগরপাড়া গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় এ ব্রিজটির অবস্থান।
উদ্দেশ্য
পাকিস্তানি বাহিনীর যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেবার উদ্দেশ্যে এ ব্রিজটি ধ্বংস করা।
পরিকল্পনা ও অংশগ্রহণকারী
গ্রুপ অধিনায়ক শাহজাহান ইসলামাবাদীর পরিকল্পনায় এবং সেনাবহিনীর সুবেদার মেজর আবুল কাসেমের নেতৃত্বে এ কে এম জয়নাল আবেদীন, জব্বার, হাবিবুর রহমান, হারুন আল জাফর, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুল মালেক, মুজাহারুল হক, আবুল মঞ্জুর, আলমগীরসহ মােট ১০-১২জনের ১টি গেরিলা দল এ অপারেশনে অংশ নেয়।
পর্যবেক্ষণ
অপারেশনের ২-৩ দিন পূর্ব থেকে হাবিবুর রহমান ও মুজাহারুল হক। সকাল-সন্ধ্যায় ব্রিজটি রেকি করেন। তারা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান যে, ব্রিজটি রাস্তার পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে অবস্থিত। ব্রিজের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ গজ, প্রস্থ ৮ গজ এবং ব্রিজটি লােহার তৈরি। তারা লক্ষ্য করেন, সাধারণত গভীর রাতের পর সব ধরনের গাড়ি চলাচল একদম কমে যায়। এ জন্য গেরিলা দল গভীর রাতকে অপারেশনের সময় হিসেবে বেছে নেয়। উল্লেখ্য, এ ব্রিজ ও আশপাশের এলাকা। গেরিলাদের পূর্বপরিচিত।
অপারেশন
সুবেদার মেজর আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ১০-১২জনের ১টি গেরিলা দল আনুমানিক রাত ১২টার দিকে চন্দনাইশ থানা সদর থেকে ৫ কিলােমিটার পশ্চিমে বরমা ইউনিয়নে অবস্থিত বাইনজুরির গােপন আশ্রয় স্থল থেকে হেঁটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার (পুরাতন আরাকান সড়ক) সড়কে অবস্থিত নগরপাড়া ব্রিজের দিকে রওনা হয়। আশ্রয় স্থল থেকে গন্তব্যস্থলের দূরত্ব ছিল আনুমানিক ৬ কিলােমিটার। গেরিলা দল আশ্রয়স্থল থেকে স্থানীয় বরকল সড়ক ধরে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ৩ কিলােমিটার পথ পেরুনাের পর পাঠানদণ্ডি হয়ে চানমাঝি পাড়া (প্রকাশ, বড়ুয়াপাড়া) হয়ে পূর্ব দিকের জোয়ারা হিন্দুপাড়ার মাঝ দিয়ে গ্রামের সরু মেঠো পথে অগ্রসর হয়। রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে গেরিলারা নগরপাড়া ব্রিজ থেকে আনুমানিক ৫০-৬০ গজ দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান নেন। হাবিবুর রহমান ও রঞ্জিত ব্রজের ও রাস্তার বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য সামনে এগিয়ে যান এবং সহযােদ্ধাদের তার সংকেতের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। হাবিবুর রহমান ও রঞ্জিত ব্রিজ ও আশপাশের এলাকা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর সহযােদ্ধাদের অগ্রসর হওয়ার সংকেত দেন। সংকেতের সাথে বাকি গেরিলারা ব্রিজের ওপর চলে যান। খুব দ্রুততার সাথে গেরিলাদের সাথে আনা বস্তার ভিতর থেকে এক্সপ্লোসিভ বের করে সবাই মিলে ব্রিজের পাটাতনের ওপর লম্বালম্বি করে স্থাপন করেন। রঞ্জিত ও আবুল কাসেম ডিটোনেটর ও ফিউজ ফিটিং কাজের দায়িত্বে ছিলেন।
ডেটোনেটর ও ফিউজ ফিটিংয়ের পর সংযােগ তারটি আবুল কাসেম এক্সপ্লোসিভ থেকে প্রায় ৮-১০ গজ দূরে টেনে নিয়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাতে আগুন লাগিয়ে দেন। এ অবসরে গেরিলা দলের অন্যান্য সদস্যও ব্রিজ থেকে ১০০ গজ উত্তরে অন্য একটি কাঁচা রাস্তার মুখে যাওয়ার পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ব্রিজটি মাঝখান বরাবর পুরােপুরি ধ্বসে পড়ে। গেরিলারা সাথে সাথেই উত্তরের কাঁচা রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে গিয়ে বড়য়াপাড়া হয়ে আবার বাইনজুরি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন প্রায় সকাল পরে জানা যায়, ব্রিজটি ধ্বংসের ফলে এ রাস্তায় ৩-৪ দিন যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। অবশ্য পরে পাকিস্তানি বাহিনী বিকল্প বেইলি ব্রিজ বানিয়ে যাতায়াত করে। এ অপারেশনে ২টি এসএলআর, ২টি এসএমজি, ৫টি রাইফেল, ১০-১৫টি গ্রেনেড় এবং প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়।
বিশ্লেষণ
এটি একটি সুপরিকল্পিত সুবাস্তবায়িত গেরিলা অপারেশন। পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল সীমিত করে দিতে ব্রিজ ধ্বংস করা সেক্টর নির্দেশিত কর্মকাণ্ড। সেই অর্থে অর্পিত দায়িত্ব এতে পালিত হয়েছে কোনােরূপ বাধাবিঘ্ন ছাড়া এবং উদ্দেশ্যও অর্জিত।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এ কে এম জয়নাল আবেদীন।
বশরতনগর মাদ্রাসার আলবদর ক্যাম্প আক্রমণ
অবস্থান
বর্তমান চন্দনাইশ থানা থেকে ৫ কিলােমিটার দক্ষিণে এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে অবস্থিত দোহাজারি বাজার থেকে ৪ কিলােমিটার পশ্চিমে শঙ্খ নদীর পাড়ে বৈলতলী ইউনিয়নে বশরতনগর মাদ্রাসা অবস্থিত। মাদ্রাসাটি ছিল একতলা বিল্ডিং। মাদ্রাসাটির উত্তর-পূর্ব কোণা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণা পর্যন্ত সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় মাদ্রাসায় যাতায়াতের মূল গেট এবং পূর্ব দিকটা ছিল সম্পূর্ণ খােলা। গেরিলাদের আশ্রয় স্থল থেকে বশরতনগর মাদ্রাসার দূরত্ব প্রায় ৫ কিলােমিটার।
প্রেক্ষাপট ও অপারেশন
আনােয়ারা থানার তিশরী গ্রামের দত্তবাড়িতে ১২-১৩জনের ১টি গেরিলা দল দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সে সময় সাের্সের মাধ্যমে তারা খবর পায় যে, বৈলতলী ইউনিয়নের অন্তর্গত মাইজপাড়া এলাকায় হিন্দুদের ওপর রাজাকার-আলবদররা অত্যাচার-নির্যাতন ও ঘরবাড়িতে লুটপাট করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথেই ১৩জনের ১টি গেরিলা দল বিমানবাহিনীর সদস্য সার্জেন্ট আব্দুস সবুরের নেতৃত্বে তৈরি হয়ে চানখালী নদী পার হয়ে প্রায় ৩ কিলােমিটার পথ দৌড়ে অতিক্রম করে সেদিকে এগােতে থাকে। তারা ঘটনাস্থলের খুব কাছাকাছি পৌছার আগেই আলবদর বাহিনী গেরিলাদের আগমনের খবর পেয়ে পশ্চিম দিকে গেরিলাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পূর্ব দিকে তাদের ক্যাম্পে (বশরতনগর মাদ্রাসা) ফেরত যেতে থাকে। তখন। গেরিলারাও পালটা গুলি করতে করতে আলবদরদের পিছু ধাওয়া করেন। প্রায় ২ কিলােমিটার ছুটে রাজাকাররা বশরতনগর মাদ্রাসায় স্থাপিত তাদের ক্যাম্পের ভিতর প্রবেশ করে। | এই পর্যায়ে গেরিলারা ২টি দলে ভাগ হয়ে সীমানা প্রাচীরের বাইরে। উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় মাদ্রাসাকে ঘিরে অবস্থান গ্রহণ করে। ইতােমধ্যে আলবদররা দোতলার বাংকার থেকে এলএমজি দিয়ে গেরিলা অবস্থানের ওপর বৃষ্টির মতাে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। গেরিলারাও পালটা গুলি করে জবাব দিতে থাকেন। এভাবে আনুমানিক দেড় ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। গােলাগুলির এক ফাঁকে সার্জেন্ট আবদুস সবুর এক হাতে গ্রেনেড ও অন্য হাতে এসএমজি নিয়ে মাদ্রাসার সীমানা প্রাচীর টপকে ভিতরে প্রবেশ করে জানালা দিয়ে একটি কক্ষে গ্রেনেড চার্জ করেন এবং এসএমজি দিয়ে গুলি বর্ষণ করতে থাকেন।
এ পর্যায়ে আলবদরদের গুলিতে তার শরীর ঝাঝরা হয়ে যায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যান ও ঘটনাস্থলেই শহিদ হন।
আলবদরদের প্রচণ্ড আক্রমণ এবং অন্ধকার হয়ে আসায় গেরিলারা তাদের ঘেরাও প্রত্যাহার করে পিছনে চলে আসতে বাধ্য হন। এ অপারেশনের ৩ দিন পর শহিদ আবদুস সবুরের লাশ শঙ্খ নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। মুক্তিযােদ্ধারা ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তাকে দাফন করেন। এ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী গেরিলা সদস্যরা হলেন: এ কে এম জয়নাল আবেদীন, আবদুস সবুর, ফেরদৌস, আবদুল মজিদ, আবদুল মালেক, আলমগীর, মনজুর, গফুর, রহমান, মনির, আহাম্মদ ও আমিন। এ অপারেশনে গেরিলারা ১টি এসএমজি, ১০টি রাইফেল, ২টি এসএলআর ও ৮-১০টি গ্রেনেড ব্যবহার করেন। অপর পক্ষে আলবদররা চাইনিজ রাইফেল ও এলএমজি ব্যবহার করে।
ক্ষয়ক্ষতি
মুক্তিযােদ্ধা আবদুস সবুর ঘটনাস্থলে শহিদ হন এবং মনিরের মাথায় ও কানে গুলি লাগে। অপর ১জন সহযােদ্ধার হাতে গুলি লাগে। আলবদররা শহিদ আবদুস সবুরের এসএমজিটি নিয়ে যায়। অন্যদিকে, ২-৩জন আলবদর গেরিলাদের গুলিতে আহত হয়েছে বলে জানা যায়।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশন ছিল তাৎক্ষণিক চিন্তা প্রসূত। জনমনে আস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিচালিত হলেও বােঝা যায়, এটি পূর্বাপর বিবেচনাপ্রসূত নয়। এর পরিণামও মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়েছে। অন্যদিকে, আলবদরদের ক্ষতি উল্লেখযােগ্য নয়। এ ধরনের অপরিকল্পিত ও আকস্মিক সিদ্ধান্তে পরিচালিত অপারেশনে ক্ষতিসর্বস্ব পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তা ছাড়া এলাকায় তাদের অবস্থানের গােপনীয়তাও বিনষ্ট হয়, যা গেরিলা যুদ্ধনীতি সম্মত নয়।
তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এ কে এম জয়নাল আবেদীন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড