You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন কনখাইয়া খাল
প্রেক্ষাপট
রাউজান ও ফটিকছড়ি থানার সীমান্তের মধ্যবর্তী এলাকায় ধর্মপুর গ্রামে মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান করছিলেন। এ ক্যাম্পের দক্ষিণ দিক দিয়ে একটা বড়াে খাল পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। এটিই কনখাইয়া খাল। এ খালের দক্ষিণে রাউজানের আমিরহাটে পাকিস্তানি সেনাদের দৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুদের শক্তি ও দৃঢ় অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছাড়াই অনেকটা আবেগের বশবর্তী হয়ে অপরিকল্পিত আক্রমণ চালিয়ে তীব্র পালটা। আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের অবস্থান সংহত করে পুনরায় শত্রুদের সামনাসামনি মােকাবিলা করতে পেরেছিলেন।
অপারেশনের বর্ণনা
আনুমানিক ১০ ডিসেম্বর রাত ১১টায় আবু বকর সিদ্দিকী ও শেখ আবু আহমেদ দলের সদস্যরা আবু বকর সিদ্দিকীর ঘরে বসে চা খাচিছলেন। এমন সময় মুক্তিযােদ্ধা মাে. ইসমাইল খবর দেন যে, তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এ খবর শােনার সাথে সাথে কামালউদ্দিন চৌধুরীর দলের কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়কের অগােচরে অপরিকল্পিতভাবে হঠাৎ করে শক্রদের অবস্থান সম্পর্কে বিশদ না জেনে কনখাইয়া খাল এলাকার পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করেন। এ আক্রমণের সাথে সাথে শত্রুরা তাদের দৃঢ় অবস্থান থেকে তীব্র প্রতিরােধ রচনা করে।
শত্রুদের আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা হতভম্ব হয়ে পড়েন। সাথে সাথে তারা। পালটা-আক্রমণের পরিকল্পনা নেন। মুক্তিযােদ্ধারা তাৎক্ষণিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনার পর তাদের অবস্থান থেকে লক্ষ্য করেন যে, শত্রুপক্ষও পালটা-আক্রমণের জন্য। অগ্রসর হচ্ছে। এমতাবস্থায় শত্রুপক্ষ কার্যকর দূরত্বের মধ্যে আসামাত্রই মুক্তিযােদ্ধারা গুলি বর্ষণ শুরু করেন। দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কিছু সময় ধরে গুলি বিনিময় হওয়ার পর শত্রুপক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়। ইতােমধ্যে সকাল আনুমানিক ৮টায় স্থানীয় লােকজনের সহায়তায় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেন এবং প্রতিরক্ষা অবস্থানেই থেকে যান। শত্রুপক্ষ শক্তি সঞ্চয় করে আবার আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের তীব্র আক্রমণ প্রতিরােধ করেন। পরদিন রাতেই মুক্তিযােদ্ধা দল তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের কিছুটা পিছনে চলে আসে। তৃতীয়বার শত্রুরা নতুন শক্তিতে বিনা বাধায় সম্মুখ আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসে। এবার মুক্তিযােদ্ধা দল তাৎক্ষণিকভাবে অবস্থান বিন্যস্ত করে।
শেখ আবু আহমেদের নেতৃত্বে প্রথম দলে ৫জন মুক্তিযােদ্ধা এবং আবু বকরের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দলে ৫জন মুক্তিযােদ্ধা বিভক্ত হয়ে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের পিছনের একটা পুকুর পাড়কে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে অবস্থান নেন। অবস্থান নেওয়ার পর স্বল্প শক্তির কারণে দল নেতারা তাৎক্ষণিকভাবে শক্র মােকাবিলার বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। কিন্তু সহযােদ্ধারা দল নেতাদের মনােবল শক্তিশালী করার জন্য বার বার প্রেরণা জোগালেও তাঁরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ইতােমধ্যে সহযােদ্ধা বাবুল শীল দল নেতার কথা না শুনেই গুলি বর্ষণ শুরু করে শত্রুপক্ষকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে সামনের খালে অবস্থান নেন। শত্রুপক্ষ পিছু হটতে থাকে। এক ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর মুক্তিযােদ্ধারা আবারও শক্তিবৃদ্ধি করার প্রয়ােজন অনুভব করেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা স্থানীয় জনগণসহ ৫০০-তে উন্নীত হয়েছিল। ঐ দিন দুপুর ১২টা থেকে শক্ররা। মর্টার শেলিং শুরু করে এবং ১টা পর্যন্ত এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুপুর ১টার পর গুলি বিনিময় স্তিমিত হয়ে আসে। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা অন্য গ্রুপ থেকে এলএমজি নিয়ে এসে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের নিজ অবস্থান থেকে ৩ মাইল পিছনে নানুপুর হাই স্কুলে সেক্টর টুপসের ১টি কোম্পানির অবস্থান ছিল। কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন লে, শওকত। ঐ কোম্পানির প্রশাসনিক সহায়তার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন। তকালীন এমপি মির্জা আবু মনসুর।
মুক্তিযােদ্ধাদের একজন ঐ কোম্পানিকে। তাদের প্রতিরক্ষা দৃঢ় করার জন্য অনুরােধ করেন। অনুরােধের পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিনে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান দেখার জন্য কোম্পানি অধিনায়ক ঐ এলাকায় যান। কেননা, এর আগে ঐ কোম্পানির এক প্লাটুন জনবল ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নাজিরহাটে পাকিস্তানিদের হানা দিতে গিয়ে ১১জন সঙ্গীকে হারায়। কোম্পানি অধিনায়ক এজন্য মুক্তিযােদ্ধা আবু আহমেদ ও সােলায়মানকে ডেকে নিয়ে তাদের। প্রতিরক্ষা অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জেনে নেন। পরবর্তী সময় সুবেদার রহমত আলীর নেতৃত্বে ১টি প্লাটুন ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগ দেয়। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা তাৎক্ষণিক রণনীতি বদলিয়ে সম্মুখ আক্রমণ শুরু করেন। তারা শত্রু অবস্থানের ওপর মটার আক্রমণ শুরু করেন। এতে শত্রুদের মনােবল ভেঙে যায়। শক্ররা ৩ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ পরিচালনার পর পিছু হটতে থাকে। বিশ্লেষণ এ অপারেশন মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে বাস্তবায়িত অপারেশনগুলাের মধ্যে অন্যতম একটি। অপারেশনটি শুরু হয় আবেগতাড়িত হয়ে ও পরিকল্পনাহীনভাবে। তবে ক্রমে তা একটি শক্তিশালী, তীব্র ও কার্যকর অপারেশনে পরিণত হয়। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। কেননা ততদিনে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করেছিল। তা ছাড়া এ অপারেশনের নিকটবর্তী এলাকায় লে, শওকতের অধীনে নিয়মিত বাহিনীর ১টি কোম্পানি অবস্থান করত। তাদের থেকে সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
প্রাথমিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও কোনাে পরিকল্পনা ছাড়াই শক্তিশালী শত্রুর ওপর। ক্ষুদ্র দলের আক্রমণ করা এবং ক্ষেত্র বিশেষে অধিনায়কের সাথে বিভিন্ন দলের। সমন্বয়হীনতার কারণে তাদের অপারেশন কার্যক্রম ব্যর্থতার দিকে ধাবমান ছিল। পরবর্তীকালে সমন্বয়পূর্বক অবস্থান গ্রহণ করে দৃঢ়তার সাথে শত্রুকে মােকাবিলার মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সাফল্যকে অবশ্যম্ভাবী করেছেন। তা ছাড়া। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে ধোকা দিয়ে শত্রুকে অপ্রস্তুত করেছেন। এটিও তাদের সাফল্যের আরেকটি কারণ। অপারেশন এলাকায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এ অপারেশনটির গতিকে যে ত্বরান্বিত করেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা চলে। সর্বোপরি নিয়মিত বাহিনীর প্লাটুনটির দৃঢ় ও সময়ােপযােগী। অংশগ্রহণ ছিল শত্রুপক্ষের পরাজয়ের অন্যতম উপাদান। কেননা, শত্রুরা নিয়মিত বাহিনীর অংশগ্রহণ ও গােলা বর্ষণের তীব্রতায় বুঝতে সক্ষম হয় যে, সার্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি তাদের আওতার বাইরে চলে গেছে। তবে এ ধরনের পলায়নপর ছত্রভঙ্গ শত্রুকে তাৎক্ষণিক ধাওয়া করলে প্রভূত সাফল্য লাভ করা যেত, এ ব্যাপারে। মুক্তিযােদ্ধারা তেমন সজাগ ছিলেন না। যাহােক, সুসজ্জিত ও সুদৃঢ় অবস্থানের। ওপর এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের অদম্য মনােবল ও শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। মুক্তিযােদ্ধারা দীর্ঘদিন ধরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার পর ক্রমে যে শক্তিশালী। হয়ে উঠেছিলেন এবং সুসংগঠিত অবস্থানের ওপর আক্রমণের শক্তি অর্জনে সক্ষম। হয়েছিলেন, এ অপারেশনের মাধ্যমে তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তথ্যসূত্র: সাক্ষাঙ্কার: মুক্তিযােদ্ধা শেখ আবু আহমেদ। সম্পাদকের টীকা: এ অপারেশন সম্পর্কে আরও তথ্য ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪১৯ পৃষ্ঠায় বিধৃত:
ক. ঘটনা সংগঠনের কোনাে সুস্পষ্ট তারিখ নেই। খ, অপারেশন সংঘঠনের কারণ মিলিশিয়াদের সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার। গ, ভরত বড়ুয়া গ্রুপের অবস্থান ও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের অবস্থান। ঘ, মুক্তিবাহিনীর ২ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহার।
অপারেশন নারায়ণহাট
প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে প্রাথমিক সমর কৌশল প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন। প্রশিক্ষণের পর তারা আবার দেশে ফিরে আসতেন। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়া ও আসা সহজতর ছিল না। দেশের ভিতর এবং সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনী এজন্য সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখত। ফলে কখনাে কখনাে মুক্তিযােদ্ধারা বিপদের মুখােমুখি হতেন। পাকিস্তানি বাহিনীও এসব পথিক মুক্তিযােদ্ধা দ্বারা আক্রান্ত ও পর্যুদস্ত হতাে। মােহাম্মদ আমিনুল হক, মােহাম্মদ ইসাহাক ও নুরুল আফসার এ তিন অধিনায়কের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা দ্বিতীয় বার অস্ত্রসহ ভারত থেকে আসার পথে সাপমারা নামক স্থানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ সময় তাদের কাছে তথ্য আসে, ১ প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা নারায়ণহাটে অবস্থান নিয়েছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘেরাও করে তাদের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করার চিন্তা করেন।
পর্যবেক্ষণ
শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ১জন মুক্তিযােদ্ধাকে টুপি পরিয়ে বাজারে পাঠানাে হয়।
পরিকল্পনা
উপরি-উক্ত মুক্তিযােদ্ধার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযােদ্ধারা দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে শত্রুকে ঘেরাও ও আক্রমণ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। শক্রর অবস্থান নারায়ণহাট সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে মুক্তিযােদ্ধা দল শত্রু অবস্থানের ১ কিলােমিটার দক্ষিণে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে সেই এলাকার মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে অবস্থান নেন। পরিকল্পনা করা হয় যে, প্রথম দল শক্রদের প্রধান চলাচলের রাস্তা বন্ধ করবে, দ্বিতীয় দল পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রলুব্ধ করে তাদের আক্রমণ-স্থানে নিয়ে আসবে এবং তৃতীয় দল আক্রমণ করবে।
অপারেশন
পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিসেম্বরের ৩-৪ তারিখে রাত আনুমানিক ৮টায় মুক্তিযােদ্ধারা ৩টি দলে যথাযথভাবে অবস্থান নেন। তারা রাতেই আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ইতােমধ্যে শত্রুপক্ষ মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি এবং তাদের শক্তি সম্পর্কে জানতে পেরে পিছু হটার পরিকল্পনা নেয় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের পূর্বেই পিছু হটে যায়। সকালবেলা মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারেন যে, রাতেই শত্রুপক্ষ তাদের অবস্থান ত্যাগ করেছে।
বিশ্লেষণ
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পরিচালিত এ অপারেশন মুক্তিযােদ্ধারা বিনা সংঘর্ষে সমাপ্ত করেন। শত্রুদের পলায়ন-প্রক্রিয়ায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা তখন অত্যন্ত কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। অন্যদিকে, মুক্তিযােদ্ধারা সার্বিকভাবে দৃঢ় মনােবলের অধিকারী ছিলেন।
সম্পাদকের টীকা: ১. এ অপারেশন-সম্পর্কিত তথ্য ডা. মাহফুজুর রহমানের বাঙালির জাতীয়তাবাদী
সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শিরােনামের বইয়ের ৪১৮ পৃষ্ঠায় এভাবে বর্ণিত নারায়ণহাট পাঞ্জাবিদের শক্তিশালী ক্যাম্পটি আক্রমণ করেন লেফটেন্যান্ট শওকত, বদিউল আলম, আমিনুল হক, রফিকুল আলম প্রমুখের নেতৃত্বে ১৫০জন মুক্তিযােদ্ধা। পাঞ্জাবিরা এ ক্যাম্পটি ছাড়তে বাধ্য হয়। ২. এ গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়ের ৪০৩ নম্বর দলিলে সাপমারার এ ঘটনাটি উল্লেখ আছে। কিন্তু সেখানে কোনাে তারিখ উল্লেখ নেই।
গোমদণ্ডি রাজাকার ক্যাম্প অভিযান
প্রেক্ষাপট
সারােয়াতলীতে স্থানীয় রাজাকার কর্তৃক অবরুদ্ধ হওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা তাৎক্ষণিক পালটা-আক্রমণের মাধ্যমে ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা ও সাহসের সাথে শত্রুর মােকাবিলা করে রাজাকার বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এতে শক্ররা আরও বেশি প্রতিশােধ পরায়ণ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধা দলের সহযােদ্ধা আবুল মনসুর সিদ্দিকীর বােনকে অপহরণ করে এবং এ এইচ এম নাসির উদ্দিন চৌধুরীর বাড়িসহ অন্যান্য বাড়িতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। রাজাকারদের এ ধরনের কার্যকলাপে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর তীব্রভাবে ক্ষুব্ধ ও প্রতিশােধ পরায়ণ হন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সারােয়াতলী থেকে ফেরত মুক্তিযােদ্ধারা। বােয়ালখালী থানা সদরে অবস্থিত গােমদৃণ্ডি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা
সারােয়াতলী থেকে আসা মুক্তিযােদ্ধা এ এইচ এম নাসির উদ্দিন চৌধুরীর দল, হাবিলদার ফজলুল বারীর দল এবং বােয়ালখালীর মুক্তিযােদ্ধা সােলায়মানের দল কাকতালীয়ভাবে করেলডাঙা পাহাড়ে মিলিত হয়। সেখান থেকেই দল নেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা গােমদণ্ডি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন করবেন। তাদের মধ্যে ফজলুল বারী যে-কোনাে মূল্যে বােয়ালখালীকে মুক্ত করার ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন।এ অপারেশনের সাফল্যের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। প্রণয়ন করা হয়। পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি দলে ভাগ করা হয়। আক্রমণ দল রাজাকার ক্যাম্পের ৩০ গজ উত্তরে পায়ে চলার রাস্তা পার হয়ে একটি নালার ভিতরে অবস্থান নেবে। কভারিং দল আক্রমণ দল থেকে আরও উত্তরে রেললাইন বরাবর ইউনিয়ন পরিষদের অফিসের পিছনে অবস্থান নেবে। তৃতীয় দলের অবস্থান হবে গােমদণ্ডি রেল স্টেশনের উত্তরে রেল সেতুর কাছে। তাদেরকে রেল সেতু উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কেননা, একই সাথে এ দলের রেল সেতু আক্রমণের সাথে সাথে ট্রেন যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যাবে। এবং পাশাপাশি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনে অন্য ২টি দলকে কৌশলগত সহায়তা দিতে পারবে। আক্রমণের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৭ আগস্ট রাত আনুমানিক ১২টা।
অপারেশন
পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ দল অতি সন্তর্পণে ক্রলিং করে নালায় অবস্থান নেয়। আক্রমণ দলের মুক্তিযােদ্ধা ফজলুর কাছে গ্রেনেড ও স্টেনগান ছিল। তিনি গ্রেনেডের সেফটিপিন খুলে লিভার হাতে চেপে ক্রলিং করে রাজাকার ক্যাম্পের কাছাকাছি চলে যান এবং জানালা দিয়ে রাজাকারদের ওপর গ্রেনেড চার্জ করেই স্টেনগান দিয়ে ফায়ার করতে করতে ক্যাম্পের দোতলায় উঠে যান। আক্রমণের আকস্মিকতায় রাজাকাররা হতবুদ্ধি হয়ে পলায়নের জন্য যে যেদিকে পারে লাফিয়ে পড়ে অন্যদিকে, তৃতীয় দল রেলসেতু উড়িয়ে দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে টহল ট্রেন এসে পড়ায় আক্রমণ দল রাজাকারদের ক্যাম্পের পিছনে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। কেননা, গােমদণ্ডি রেল স্টেশন থেকে আক্রমণ করা রাজাকার ক্যাম্প অত্যন্ত নিকটবর্তী ছিল।
ক্ষয়ক্ষতি
আক্রমণের পরদিন সকালে জানা যায় যে, আক্রমণ দলের হাবিলদার ফজলু (অধিনায়ক), বেবী ও ওয়াজেদ শহিদ হয়েছেন। অনুমান করা হয় যে, তারা। ফ্রেন্ডলি ফায়ারে শহিদ হয়েছেন। অত্যন্ত আবেগের বশবর্তী হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করায় এ পরিণতি হয়েছিল। শত্রুপক্ষের ২০জন রাজাকার হতাহত হয়।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশন মূলত একটি প্রতিশােধমূলক অপারেশন। কৌশলগত দিক থেকে এটি একটি পরিকল্পিত অপারেশন। এ অপারেশনে তৃতীয় দল তাদের লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেও এটি একটি আংশিক সফল অপারেশন।
তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এ এইচ এম নাসির উদ্দিন চেীধুরী সম্পাদকের টীকা: ডা. মাহফুজুর রহমানের বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৫৭ পৃষ্ঠায় বর্ণিত তথ্য মতে: ক, রাজাকারদের প্রধান দপ্তরটি গােমদণ্ডি সার্কেল অফিসে স্থাপিত ছিল। খ, দপ্তরটি ২-৩ বার হামলা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ক্যাপটেন করিমের আক্রমণ অন্যতম।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!