You dont have javascript enabled! Please enable it!

জল্লাদের আদালত

বুধবার, এগারই আগস্ট। জল্লাদের সামরিক আদালতে আজ মুজিবের বিচার আরম্ভ। ইয়াহিয়ার অভিযােগ গুরুতর। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু করেছেন যুদ্ধ ঘােষণা। অতএব তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী। সম্ভাব্য শাস্তি প্রাণদণ্ড। তাঁর দণ্ড মকুব কিম্বা হালকা করতে পারেন একমাত্র ইয়াহিয়া খান। সাফ কথা বলেছেন তিনি। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যখন বসবে তখন মুজিবুর রহমান জীবিত থাকবেন কিনা তা বলতে পারেন না ইসলামাবাদের ডিকটেটর। বিচারটা হবে রুদ্ধ কক্ষে। বিদেশী কৌসুলীর প্রবেশাধিকার নেই সেখানে। দেশী উকিলদের কারও ঘাড়ে নেই একটার বেশী মাথা। ফরিয়াদী পক্ষকে বোস জেরা করলে গর্দান থেকে ওটাও খসে পড়বে মাটিতে। মামলার থাকে সাধারণতঃ তিনটি পক্ষ—আসামী, ফরিয়াদী এবং বিচারক। জল্লাদের আদালতে মাত্র দুটি পক্ষ, ফরিয়াদী বিচারক এবং আসামী। আগেভাগেই লেখা হয় গেছে রায়। বাকি শুধু বিচার প্রহসনের। জল্লাদরা সুরু করেছে সেই প্রহসন।
গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটেছে পাকিস্তানে। ওটা যদি চালু থাকত তবে ইয়াহিয়া খাস হতেন রাষ্ট্রদ্রোহী। গােটা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ভূইফোড় ডিকটেটর ইয়াহিয়া খান গায়ের জোরে দখল করেছেন ক্ষমতা। ধরে নিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী পদের ন্যায়সঙ্গত দাবীদারকে। গণহত্যা চালিয়েছেন বাংলাদেশে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভিটে ছাড়া করে পাঠিয়েছেন ভারতে। জঙ্গী বর্বরতার চরম উত্তর দিয়েছেন বাঙালী। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। সেখানে গড়ে উঠেছে পাল্টা সরকার। বন্দী মুজিবুর রাষ্ট্রপ্রধান। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া ধিকৃত দখলদার। তাঁর হুকুম পৌছায় না গ্রামাঞ্চলে। হাতের মুঠোয় পেয়েছেন তিনি মুজিবুর রহমানকে। তাঁর জবাই এর জন্য পাগল হয়ে উঠেছেন ইসলামাবাদের শাসকগােষ্ঠী। গত সাড়ে চার মাস ধরে পার বসে দেখছেন তারা গণবিক্ষোভের উত্তাল তরঙ্গ। এখনও দেখেন নি তার সংহার মূর্তি। মুজিবের রক্ত যদি পড়ে পাকিস্তানে তবে বাংলাদেশকে ভাসাবার জন্য প্রয়ােজন হবে না ব্রহ্মপুত্রের বন্যার। চার ডিভিসন পাক-চমূর রক্ত বইবে সারা দেশে। ওরা মুক্তিবাহিনীর হােষ্টেজ। একটিও জান নিয়ে ফিরতে পারবে না স্বদেশে।
সঙ্গত কারণেই উদ্বিগ্ন নয়াদিল্লী। মুজিবের মুক্তির দাবীতে সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রসঙ্ঘে পাঠিয়েছেন পত্র: দুনিয়ার রাষ্ট্রনায়কের কাছে আবেদন করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। মুজিব মুক্তির দাবী উঠাবার চেষ্টা চলছে বিশ্বসভায়। আমেরিকাও খুশী নয় ইয়াহিয়ার হঠকারিতায়। মার্কিন কর্তাদের মনে এখনও আচে ক্ষীণ আশা। বাংলাদেশের সঙ্গে হয়ত সম্ভব হবে ইসলামাবাদের বােঝাপড়া। তার জন্য জোরদার করছেন তারা ইয়াহিয়ার হাত। শক্তির ভিত্তিতে তিনি যাতে করতে পারেন সমঝােতার শর্ত আরােপ। মুজিব বেঁচে থাকলেই তা সম্ভব। তার জবাই এর অর্থ বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা। দেয়ালের এ লিখন অপরিবর্তনীয়। মার্কিন কর্তারা তা বুঝেন। বুঝেন বলেই তাদের মধ্যে চলছে আলােড়ন। কিন্তু আমেরিকার উপর আস্থা নেই কারও। তার আস্কারাতেই ইয়াহিয়অ মারমুখী। এখনও যদি প্রেসিডেন্ট নিকসন হাঁক দেন তবে নিমেষের মধ্যে খসে পড়বে জল্লাদের হাতের তরােয়াল। রক্ষা পাবেন মুজিবুর রহমান। সবাই জানে, মরতে ভয় পান বঙ্গবন্ধু। যিনি বাংলাদেশকে করেছেন মৃত্যুঞ্জয় তিনি মৃত্যু ভীতির ঊর্ধ্বে। এশিয়ার শান্তির জন্য আজ বড় প্রয়ােজন এই মহাপ্রাণের। ঘাতকের হাতে মুজিবের জীবনাবসান মর্মান্তিক। এর সম্ভাবনা সুস্থ মানুষের কল্পনাতীত। কোথায় আজ বিশ্ব জনমত? বাংলাদেশের গণহত্যায় এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দুঃখ দুর্দশায় মিলে নি তা বাঞ্ছিত সাড়া; মুজিবের বিপন্ন জীবন এনেছে নতুন চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জের মােকাবিলায় যদি ব্যর্থ হয় বিশ্ববিবেক তবে কেউ এড়াতে পারবেন না ভবিষ্যতের মহাসঙ্কট। এশিয়ার শক্তি বিন্যাসের মােড় প্রথম ঘুড়িয়েছে চীনা, মার্কিন এবং পাক আঁতাত। ভারত- সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি তাতে দিয়েছে পাল্টা মােচড়! রণ হুঙ্কারের বদলে শীঘ্রই শােনা যাবে ইয়াহিয়ার আতনাদ। মুজিব নিধন থেকে বিরত না হলে তার চোখের জলের সঙ্গে মিশবে নরঘাতকের তাজা খুন। তারপর তাঁকে ভাসিয়ে নেবে বাংলাদেশের সশস্ত্র গনবিক্ষোভের বন্যা। হয়ত এই মানবদ্রোহীর বিচারের সুযােগ পাবেন না স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। তার আগেই ঘটবে ইয়াহিয়ার অস্তিত্ব বিলােপ। মুজিব ফিরে না এলে অবশ্যই হাহাকার উঠবে বাংলাদেশের এবং ভারতের ঘরে ঘরে। সহস্র শিখা নিয়ে জ্বলবে মুক্তি সংগ্রামের আগুন। শত দুঃখের মধ্যেও মুক্তিবাহিনী পাবেন অশ্রুসিক্ত সান্তনা। স্বাধীনতার চরম মূল্যে—কোরবাণী। বাংলাদেশ কোরবাণী দিচ্ছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান মুজিবুর রহমানকে। গােটা বিশ্ব কি নিঃসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দেখবে ইসলামাবাদের মানবদ্রোহীদের জিঘাংসার নগ্ন আস্ফালন? লাথি মেরে ভাঙ্গবে না কি তারা জল্লাদের বিচারশালা? সে-সাহস যদি না থাকে তবে ক্ষতি নেই। অনিবার্যকে স্বীকার করবে বাংলাদেশ। তার বুক চিরে বেরিয়ে আসবে শুধু একটি কথা—প্রতিশােধ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১১ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!