You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন জিরি মাদ্রাসা
প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধারা পটিয়ার জিরি মাদ্রাসায় অবস্থানরত রাজাকারদের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেন। রাজাকারদের পর্যুদস্ত করার মাধ্যমে পাকিস্তানি প্রশাসনের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা গেরিলাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
উদ্দেশ্য
পটিয়ার জিরি মাদ্রাসায় অবস্থানরত ছাত্র নামধারী রাজাকারদের আক্রমণ ও বিতাড়িত করা।
পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা
স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা রুহুল আমীন মুরগি বিক্রেতার ছদ্মবেশে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত এবং পর্যবেক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতে জিরি মাদ্রাসার রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয়। সে অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা ৩টি দলে বিভক্ত হন। প্রতি দলে ৩-৪জন করে মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে আক্রমণ দলে ছিলেন এইচ এম নাসির উদ্দিন চৌধুরী, প্রদ্যুৎ পাল, মনসুর সিদ্দিকী ও ওবায়েদুল হাসেম সিকদার। তা ছাড়া শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে মাদ্রাসার পিছনের দুই কোণায় অন্য ২টি দলকে অবস্থান নিতে বলা হয়। এ অপারেশনে ১টি জি-৩ রাইফেল, ২টি স্টেনগান, ৩-৪টি গ্রেনেড এবং কিছু বিস্ফোরক ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
অপারেশন
আনুমানিক ১৫-১৬ জুলাই সূর্যাস্তের সময় মুক্তিযােদ্ধা গেরিলা দল আক্রমণ পরিচালনার জন্য অধিনায়কের বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে। টার্গেটের কাছে এসে আক্রমণ দল মাদ্রাসায় ঢােকার রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে দেখতে পায় যে, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রাস্তার পাশে একটি নলকূপে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য ওজু করছেন। আক্রমণকারী দল ক্ষিপ্রতার সাথে অধ্যক্ষকে জিম্মি করে। সাথে সাথে অন্য দল। ফাঁকা গুলি এবং উচ্চ স্বরে হামলা-হামলা বলে চিৎকার শুরু করে। এতে মাদ্রাসায়। অবস্থানরত রাজাকার দল অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা স্টেনগানের ব্যারেল ঠেকিয়ে অধ্যক্ষকে বলতে বাধ্য করেন, ছাত্রদের কাছে থাকা। ২২টি রাইফেল দিয়ে দিতে। এ সময় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নামাজ পড়ার অনুমতি চান। মুক্তিযােদ্ধা নাসিরউদ্দিন নিজ হাতে নলকূপ চেপে অজু করতে তাকে সাহায্য করেন। জিম্মি অবস্থায় অধ্যক্ষ মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে নিজে ছাত্রদের ডেকে স্থানীয় ভাষায় বললেন, “ওয়া ইতারা দেশের পােয়া-মুক্তিযােদ্ধা। তোয়ারা ছাত্র মানুষ, এগুন দিয়েরে কি গরিবা। অস্ত্রগুন দি ফেল।” (এরা দেশের ছেলে মুক্তিযােদ্ধা। তােমরা ছাত্র, এগুলাে দিয়ে কী করবে। অস্ত্রগুলাে দিয়ে দাও।) আক্রমণ দলের আদেশ অনুযায়ী অধ্যক্ষ তাদেরকে অস্ত্রগুলাে একত্রে দিতে বলেন। যথারীতি তারা অস্ত্রগুলাে দিয়ে দেয়। পাশাপাশি গেরিলারা অধ্যক্ষকে শাসিয়ে দেন এ বলে যে, ভবিষ্যতে যেন এখানে কোনােপ্রকার রাজাকার প্রশিক্ষণ না হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যেন সহযােগিতা করা না হয়।
বিশ্লেষণ
এটি একটি রক্তপাতহীন সফল অপারেশন। মুক্তিযােদ্ধারা এ অপারেশনে ২২টি .৩০৩ রাইফেল ও প্রচুর গুলি হস্তগত করেছিলেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযােদ্ধা গেরিলাদের বিভিন্ন আক্রমণ পরিচালনায় এগুলাে কাজে লেগেছিল। পাশাপাশি এ আক্রমণের সামাজিক প্রভাবও ছিল প্রবল। এতে সে সময়ে ঐ এলাকার রাজাকারদের মনােবল অত্যন্ত দুর্বল হয়েছিল এবং মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। স্থানীয় স্বাধীনতাকামী জনমনেও ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়েছিল। তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এ এইচ এম নাসির উদ্দিন। সম্পাদকের টীকা: ১, এ সংক্রান্ত নিমলিখিত তথ্য বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে
দক্ষিণ চট্টগ্রাম গ্রন্থের ১৩২ পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়: ক, আপারেশনের পূর্বে যােদ্ধাদের মিলন স্থল (RV) ছিল মাদ্রাসার পার্শ্বের কাজীরহাটের বুদপুর সরকারি হাসপাতালের উত্তর পার্শ্বের ছােটো একটি বাঁশের ঘরে। সেখান থেকে অপারেশনের রণকৌশল নির্ধারণ করা হয়। এ অপারেশনে আক্রমণ কৌশল ছিল ভিন্ন মাত্রার। সেমাইয়ের খাঁচায় ঘাস দিয়ে ৮-১০টি অটোম্যাটিক অস্ত্র রেখে আবার ঘাস দিয়ে অস্ত্রগুলাে লুকিয়ে তার ওপর। ১০-১২টি মুরগি রাখা হয়। তারপর মুরগি বিক্রেতার বেশে ২জন ২জন করে ১৬জন মাদ্রাসার পাশের বাজারে গিয়ে পৌছেন। ক্যাপটেন করিমের বাঁশির শব্দের সাথে সাথে গুলি শুরু হয় ও এক্সপ্লোসিভ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানাে হয়। ২. ভীত সন্তস্ত্র হয়ে ‘বদর বাহিনী’ অন্ত্র রেখে পালিয়ে যায় । ২০-২১টি রাইফেল ও ২ বাক্স গুলি উদ্ধার করা হয়। পটিয়ার জিরি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির আহ্বায়ক কর্তৃক থানা ও জেলা কমিটির সুপারিশসহ আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে লিখিত একটি দরখাস্তে সে এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা এবং তাদের দমনার্থে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন বিধৃত। সে আবেদনপত্রে ১৪ আগস্ট তারিখে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রমণ এবং ১৬টি রাইফেল লুটের তথ্য প্রাপ্ত। দলিলে উল্লিখিত তারিখই সে অর্থে ঐ অপারেশনের তারিখরূপে গণ্য করা যায়। উল্লেখ্য, দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিককাল পর সঠিক তারিখ মনে করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। তা ছাড়া দুটো তারিখের মধ্যে ব্যবধান এক মাস মাত্র। এ গুরুত্বপূর্ণ দলিলটি এ গ্রন্থের পঞ্চদশ অধ্যায়ে সন্নিবিষ্ট। দলিল নম্বর ৭০১।
অবরুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধা উদ্ধার অপারেশন – সারােয়াতলী
প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন ধরনের গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করার জন্য পরিকল্পনা করতেন। আক্রমণকারীরা ছােটো ছােটো দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্থানে সাময়িকভাবে অবস্থান করতেন। তারা নিরাপত্তা ও গেরিলা আক্রমণের কৌশলগত কারণে ঘন ঘন নিজ অবস্থান পরিবর্তন করতেন। এ ধরনের অবস্থান। পরিবর্তনের দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, পাকিস্তানি বাহিনী সব সময়ই তাদের পিছু তাড়া করত। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযােগিতাদানকারী কিছু স্থানীয় বিশ্বাসঘাতক সব সময় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ও অন্যান্য তথ্য হানাদারদের দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের বিপর্যস্ত করার জন্য সদা তৎপর থাকত। পরিস্থিতি সারােয়াতলীতে এ এইচ এম নাসির গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধাদের আকস্মিকভাবে অবরুদ্ধ হওয়ার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন প্রকৃতির।
রাইখালী রেলসেতুতে অবস্থিত রাজাকার পােস্টে অপারেশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করার জন্য ২৪ আগস্ট রাত আনুমানিক ১০টার সময় সবাই অধিনায়ক নাসিরের বাড়ির পিছনের সাইদুর রহমানের বাড়িতে একত্র হন। তাদের সংখ্যা ছিল ৭জন। ২৫ আগস্ট সকালে মুক্তিযােদ্ধারা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে সংবাদ পান যে, তাদেরই এক সহযােদ্ধা আবুল মনসুর সিদ্দিকীর বাড়িতে আনুমানিক ৩০জন রাজাকার ঢুকে তার বােনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তা ছাড়া রাজাকাররা এখানকার মুক্তিযােদ্ধাদেরকেও অবরুদ্ধ করে রেখেছে। অল্পক্ষণ পরই রাজাকাররা তাদের ওপর আক্রমণ করবে। এ সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিযােদ্ধারা ওদের আগেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেন। কেননা, আক্রমণ করা ছাড়া তাদের আর কোনাে উপায় ছিল না। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উত্তরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়ি। সেখানে প্রায় ১০০জন রাজাকার অবস্থান করত। দক্ষিণে বেঙ্গুরা রাজাকার ক্যাম্প এবং পূর্বে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত আনুমানিক ৩০-৩৫জন রাজাকার, পশ্চিমে গােমদণ্ডি রাজাকার ক্যাম্প। পূর্ব থেকেই ঐ সব রাজাকার অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধা দলের সম্যক ধারণা ছিল। ঐ সব ক্যাম্প তাদের অবস্থান থেকে বেশ দূরে ছিল। তবুও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের কোনাে সুযােগ ছিল না। তবে মুক্তিযােদ্ধারা অনুমান করতে পেরেছিলেন যে, তারা পালটা আক্রমণ করলে অন্যান্য অবস্থান থেকে আক্রমণকারী রাজাকার দল কোনাে কৌশলগত সহায়তা পাবে না। কেননা আক্রমণকারী রাজাকার দলের এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের পূর্ব সমন্বয় ছিল না।
অপারেশন
মুক্তিযােদ্ধা দল তাদের অবরুদ্ধ অবস্থা বুঝতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। তারা তাদের অবস্থান থেকে একটু সামনে অধিনায়ক নাসিরের বাড়ির সামনের বাঁশঝাড় ও পুকুরকে প্রাকৃতিক আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে সাময়িক প্রতিরক্ষা অবস্থান সৃষ্টি করে। আক্রমণকারী রাজাকার দলকে ধোকা দেবার জন্য তারা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটু সামনে চলে আসে। অপর পক্ষে শক্ররা ধরে নিয়েছিল যে, তারা অধিনায়ক নাসিরের বাড়িতেই আছে। মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র ছিল ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ২টি স্টেনগান, ১টি চাইনিজ রাইফেল এবং ৮টি ৩০৩ রাইফেল। ইতােমধ্যে আরও ৬জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের দলে যােগ দিতে সমর্থ হন। সময়ের অভাবে এ আক্রমণ পরিচালনার জন্য। সুনির্দিষ্ট কোনাে পরিকল্পনা করা যায় নি। শুধু একজনকে এলএমজিসহ পুকুর পাড়ে অবস্থান নিতে বলা হয়। অন্যরা সুবিধামতাে অবস্থান থেকে শত্রুর আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে শত্রুর উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে নাসির আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বারেককে নির্দেশ দেন এলএমজি চালানাের জন্য। গুলির স্বল্পতার কারণে বারেক ইতস্তত করছিলেন। কিন্তু নাসিরের কড়া নির্দেশে বারেকের লাইট মেশিনগান গর্জে ওঠে। সাথে সাথে অন্যরা তাদের অস্ত্র চালান। রাজাকাররাও পালটা গুলি ছােড়ে। মিনিট খানেক গুলি বর্ষণের পর মুক্তিযােদ্ধারা ক্রলিং করে এগােতে থাকেন। নাসির দেখেন যে, রাজাকাররা পূর্ব দিকে দৌড়াচ্ছে। এ সুযােগে একযােগে মুক্তিযােদ্ধারা গুলি করতে করতে তাদের পিছু ধাওয়া করেন। রাজাকারদের ধাওয়া করে এক পর্যায়ে নাসির কানুরদিঘির পাড়ে অবস্থান নেন। এখানে এসে যােগ দেন নাসিরের বাকি ৭জন মুক্তিযােদ্ধা। কানুরদিঘির পাড় একটি দুর্গের মতাে। নাসির আশা করেছিলেন, রাজাকাররা দল ভারী করে ফিরে আসবে। তিনি অ্যামবুশ করার সুযােগ পাবেন। প্রায় ৪৫ মিনিট তিনি অপেক্ষা করেন। তারপর চলে যান করলডেঙ্গার পাহাড়ে। পাহাড়ে উঠে দেখেন গ্রাম জ্বলছে। বুঝলেন, রাজাকাররা অন্য পথে গ্রামে ঢুকেছে। বিশ্লেষণ এ অপারেশন কোনাে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক অপারেশন নয়। সামরিক কৌশলগত ভাষায় এটা ছিল সুযােগী লক্ষ্যবস্তু (Opportunity target)। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের তথ্য এলাকাবাসীর মাধ্যমে রাজাকাররা জানতে পারে।
অবরুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধারা শুধু তাদের দৃঢ় মনােবলের কারণে অক্ষত অবস্থায় ফিরে। আসতে সক্ষম হন। এ অপারেশনে শত্রুপক্ষের একজন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে পােমরা ইলেকট্রিক টাওয়ার ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হ্যাকস ব্লেড, বিস্ফোরক, ডিটোনেটর প্রভৃতি জিনিসপত্র খােয়া যায়। তা ছাড়া রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধা আবুল মনসুর সিদ্দিকীর বাড়িও সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রকাশ্য দিবালােকে এ ধরনের আক্রমণ ও পালটা আক্রমণ এবং রাজাকারদের পরাজয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের জনগণ বাস্তব মুক্তিযুদ্ধের আস্বাদ পায়।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এ এইচ এম নাসির উদ্দিনসম্পাদকের টীকা: ১. ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত, বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থের  ৪৭-৪৮ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন সম্পর্কিত বিশদ বর্ণনা আছে। ২. এ অপারেশন-সম্পর্কিত ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত, বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৫৭ পৃষ্ঠায় বিদ্যমান তথ্য: পাকিস্তানি অনুচর। রাজাকাররা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ আক্রমণ হয় সকাল ১০-১১টার
কর্ণফুলি নদীতে ভাসমান বাঁশের চালানে অ্যামবুশ
প্রেক্ষাপট
এই অ্যামবুশ কর্ণফুলি নদীতে ভাসমান বাঁশের চালানে করা হয়েছিল। চন্দ্রঘােনা পেপার মিলের কাঁচামাল হিসেবে পাহাড়ি বাঁশ ব্যবহার করা হয়। এ বাঁশ সংগ্রহের জন্য পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বাঁশ কেটে একত্র করে বেঁধে কর্ণফুলি নদী দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকার সাহায্যে টেনে আনা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য এ রকম বাঁশের চালান বিভিন্ন সামরিক টহল ও অভিযানে কৌশলগত কভার হিসেবে ব্যবহার করত। সামরিক কৌশলগত চলাচল ও আক্রমণের সুবিধার জন্য বাশের ভাসমান চালানকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের মুখে পড়ে।
উদ্দেশ্য
এ অপারেশনের উদ্দেশ্য হলাে কর্ণফুলি নদীতে শত্রুকে এবং তাদের ব্যবহার্য সমস্ত রণকৌশল ধ্বংস ও বিনষ্ট করার মাধ্যমে জলপথে তাদের চলাচল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা।
পর্যবেক্ষণ
স্থানীয় একজন সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে নিত্যনৈমিত্তিক চলাচলের ভান করে অতি সাবধানে নদীর পাড়ে বেড়াতে এসে শক্রর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
পরিকল্পনা
পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মুক্তিযােদ্ধারা বেতাগী চৌধুরী বাড়িতে বসে এ অপারেশন পরিকল্পনা করেন। সাফল্যের সঙ্গে অপারেশন করার জন্য মুক্তিযােদ্ধা দল রাঙ্গুনিয়া থানার অন্তর্গত বিহারিহাটের পূর্ব পার্শ্বের কর্ণফুলি নদীর উত্তর পাড়কে স্থান হিসেবে নির্বাচন করে। মুক্তিযােদ্ধারা ২টি দলে বিভক্ত হয়ে নদীর একই পাড়ে থেকে জমির আইলকে (এক জমি থেকে অন্য জমিকে পৃথক করতে মাটির সামান্য উঁচু লম্বা অংশ) কভার হিসেবে ব্যবহার করে বাঁশের চালানে অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, বাঁশের চালান দেখা মাত্রই দ্বিতীয় দলের এলএমজি ম্যান সরাসরি ফায়ার করে আক্রমণ শুরু করবে। সাথে সাথে প্রথম গ্রুপও গুলি বর্ষণ করবে এবং আক্রমণকে বেগবান করবে।
অপারেশন
উল্লিখিত অপারেশনে ১০-১১জন মুক্তিযােদ্ধা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধা সুবেদার রহমান, হাবিলদার গােলাপ, সিপাহি আজিজ, প্রদ্যুৎ পাল, ওবায়েদ, কাশেম, রুহুল আমিন ও ইমাম শরীফের নেতৃত্বে ২টি দলে বিভক্ত হয়ে কর্ণফুলি নদীর পূর্ব পাড় বরাবর অবস্থান নিয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় দলের এলএমজি ম্যান যথাযথভাবে প্রস্তুত ছিলেন। দ্বিতীয় দল তীক্ষভাবে বাঁশের চালানের গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলেন। বাঁশের চালানটি নদী দিয়ে পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে আসছিল। চালানটি দ্বিতীয় দলের এলএমজি ম্যানের কার্যকর দূরত্বের মধ্যে আসা মাত্রই গুলি বর্ষণ শুরু করা হয়। সাথে সাথে প্রথম দলও আক্রমণকে তীব্রতর করার জন্য পরিকল্পনানুযায়ী গুলি বর্ষণ শুরু করে। বাঁশের চালান থেকেও পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলি বিনিময়কালীন বাঁশের চালানটি মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের কার্যকর দূরত্বের বাইরে চলে যায়। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণও বন্ধ হয়ে যায়।
ক্ষয়ক্ষতি
এই অ্যামবুশে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষতি হয় নি। অপর পক্ষে বাঁশের চালানের ৫জন মরে যায় জানা যায়।
বিশ্লেষণ
এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন। নৌপথে বাঁশের চালানকে কভার হিসেবে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল ও নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটানাের জন্য যথার্থভাবে পরিকল্পনা করা হয়। অপারেশনে যথেষ্ট সাফল্য থাকলেও সার্বিকভাবে অপারেশনে কিছু কৌশলগত ভুলত্রুটি ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা ভূমির ব্যবহারে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন। বাঁশের চালান বেশ দীর্ঘ একটি লক্ষ্যবস্তু এবং এ ধরনের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার জন্য ফাদ এলাকা বা অ্যামবুশ সাইটের বিস্তৃতিও বেশি হওয়া প্রয়ােজন। তা ছাড়া টার্গেট যাতে আয়ত্তের বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য বাধা প্রদানকারী দল থাকাও বাঞ্ছনীয় ছিল। ১০-১১জনের মুক্তিযােদ্ধা দলের জন্য লক্ষ্যবস্তুটি ধ্বংস করাটা ছিল বেশ কষ্টকর। এ ক্ষেত্রে জনবলের স্বল্পতার কারণেও অধিনায়কের পক্ষে ভূমির সঠিক ব্যবহার কষ্টকর ছিল। জনবলের অভাব ও অবস্থান নির্বাচনে কিছুটা দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও এ অপারেশনের সাফল্য ছিল পর্যাপ্ত। তা ছাড়া এ অপারেশনের পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সৈন্য দলের নির্বিঘ্ন যাতায়াত বন্ধ হয়, যা তাদের মনােবল ভেঙে দেয়। তথ্যসুত্র: সাক্ষাত্তার: মুক্তিযােদ্ধা আবুল মনসুর সিদ্দিকী।
সম্পাদকের টীকা: ১, এ অপারেশন-সম্পর্কিত আরও তথ্য ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৫৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত: ক. প্রাথমিক পর্যায়ে যােদ্ধারা ট্রলার ও নৌকার মাঝিদের নদীপথে নৌচলাচল বন্ধ করার জন্য অনুরােধ করেন। পরে কয়েকবার গােলাগুলি করলে মাঝি ও সারেংরা এ পথে নৌচলাচলও বন্ধ করে দেয়। খ, মুক্তিযােদ্ধা নুরুল আলম পাকিস্তানি সেনাদের Escort করা এক বার্জ আক্রমণ করে সেটা ছিনিয়ে নেন। কর্ণফুলি কাগজ কলের কাগজ বহনকারী যানবাহন ধ্বংস করার এ রকম তথ্য বিধৃত হয়েছে এ গ্রন্থের একাদশ অধ্যায়ে সন্নিবেশিত চিঠিপত্রে। দ্রষ্টব্য: দলিল নম্বর ৩২৬ ও ৩২৭। ৩২ নম্বর দলিলের লেখক চন্দ্রঘােনা গ্রুপের ক্যাপটেন। আবদুল আজিজ। আলােচ্য এ অপারেশনেও আবদুল আজিজ নামে ১জন সিপাহি অংশ নিয়েছিলেন। (কর্ণফুলি নদীতে ভাসমান বাঁশের চালানে অ্যামবুশের নকশাটি ১১৫৯ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!