রাউজান বিদ্যুৎ টাওয়ারে অপারেশন
প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ ফোর্সের তত্ত্বাবধানে গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধারা সেক্টরের নির্দেশনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (Key point installation) ছােটো ছােটো গেরিলা হামলা চালিয়ে শত্রুদের বিপর্যস্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিল। রাউজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করার অপারেশন ছিল এ রকম একটি পরিকল্পনা।
উদ্দেশ্য
বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের টাওয়ার উড়িয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত করা।
পর্যবেক্ষণ
এলাকা সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধা দলের পূর্বপরিচিতি ও পর্যাপ্ত তথ্য থাকায় অপারেশনের নির্দিষ্ট স্থান ও লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে তাদের পূর্ব পর্যবেক্ষণের প্রয়ােজন হয় নি। পরিকল্পনা বিদ্যুৎ টাওয়ার আক্রমণের জন্য গভীর রাতে ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে নােয়াপাড়া আহমেদ হােসেনের বাড়িতে বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরিকল্পনা প্রণয়নের আলােচনায় আনুমানিক ৭জন মুক্তিযােদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ টাওয়ার আক্রমণ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল আনুমানিক রাত ১টা। টাওয়ার পিলারের সাথে বিস্ফোরক সংযুক্ত করে এবং হ্যাকস ব্লেড (লােহার পাত কাটার বিশেষ যন্ত্র) দিয়ে টাওয়ারের লােহার পাত কেটে দিলে যথাসময়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে টাওয়ারটি মাটিতে পড়ে যাবে। এ পরিকল্পনার আলােকে মুক্তিযােদ্ধাদের পুরাে দলকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথম দল সরাসরি পিলারের কাছে। গিয়ে বিস্ফোরক সংযুক্ত করবে, দ্বিতীয় দল প্রথম দলের কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং তৃতীয় দল যে-কোনাে ধরনের অপ্রত্যাশিত আক্রমণ প্রতিহত করবে।
অপারেশন
পরিকল্পনা মাফিক ৭-৮জনের মুক্তিযােদ্ধা দল ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অপারেশন। পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট স্থান অর্থাৎ বিদ্যুৎ টাওয়ারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। টাওয়ারের অবস্থান ছিল রাউজান-রাঙ্গুনিয়া সড়কের উত্তরে গহিরার নিকটবর্তী পাহাড়ে। রাত আনুমানিক ১টায় মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি দল পাহাড়ের পাদদেশের একটু ওপরে টাওয়ারের নিকটবর্তী স্থানে উপস্থিত হয়। প্রথম দল নিরাপত্তা দল। দ্বিতীয় দল বিস্ফোরক সংযুক্ত করার এবং তৃতীয় দল হ্যাকস ব্লেড দিয়ে টাওয়ারের পাত কাটার জন্য নিয়ােজিত হয়। সম্পূর্ণ পরিকল্পনা মাফিক দ্বিতীয় দল যথারীতি বিস্ফোরক সংযুক্ত করে এবং তৃতীয় দল টাওয়ারের পাত কেটে ফেলে। টাওয়ারে লাগানাে বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে পাত কাটা ভিত্তি দুর্বল টাওয়ারটি পড়ে যায়।
বিশ্লেষণ
এই গেরিলা অপারেশন কার্যকরভাবে সফল ছিল। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ মারাত্মক বিঘ্নিত হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী সার্বিকভাবে প্রশাসনিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে, গেরিলা মুক্তিযােদ্ধারা এ সাফল্যজনক অপারেশনে তাদের মনােবল ও আত্মবিশ্বাস সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। এ ধরনের অবস্থার। পরিপ্রেক্ষিতে রাউজান বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের পিলার ধ্বংসের পরিকল্পনা এক ধরনের পরােক্ষ অভিযান, যা শত্রুদের ওপর বিভিন্ন মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছিল। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আবুল মনসুর সিদ্দিকী। সম্পাদকের টীকা: ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৬১ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন-সম্পর্কিত নিম্নলিখিত তথ্য আছে: ক. বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় গােলােযােগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্যাপটেন করিম, দুলাল, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, হাবিলদার রহমান, মাহফুজুর রহমান খান প্রমুখ রাউজানে
একটি পাওয়ার পাইলন বিস্ফোরক দিয়ে উপড়ে ফেলেন। খ, ঐ কয়েকদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে।
অপারেশন রাজাকার ক্যাম্প (মােগদাই, রাউজান)
প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে দেশপ্রেম বিবর্জিত জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ পাকিস্তানি বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করত। এতে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্নভাবে ব্রিতকর অবস্থায় পড়তে হতাে। মুক্তিযােদ্ধারা জনগণের সেই অংশকে আঞ্চলিকভাবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন সময়ে আক্রমণের মাধ্যমে তাদের নিরস্ত্র করে মনােবল ভেঙে দিতেন এবং অনেক সময় অস্ত্র উদ্ধার করে সেগুলাে দিয়ে পরবর্তী সময় যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। রাউজানের মােগদাই নামক এলাকায় এ ধরনের একটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করা হয়েছিল। রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও ধ্বংস করা এবং অস্ত্র উদ্ধার করা। পর্যবেক্ষণ রাউজানের মােগদাই এলাকা মুক্তিযােদ্ধাদের পূর্বপরিচিত থাকার কারণে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করার প্রয়ােজন হয় নি।
পরিকল্পনা
ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে ১২-১৪জন মুক্তিযােদ্ধা ২টি দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য প্রস্তুতি নেন। প্রতি গ্রুপে ৫-৭জন মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। ঠিক হয়, প্রথম গ্রুপের অবস্থান রাজাকার ক্যাম্পের প্রবেশপথের পূর্বে এবং দ্বিতীয় গ্রুপের অবস্থান রাজাকার ক্যাম্পের পিছনে উত্তর দিকে হবে। প্রথম গ্রুপ প্রথমে গুলি বর্ষণ শুরু করবে এবং দ্বিতীয় গ্রুপকে বলা হয় যে, প্রথম গ্রুপের কোডওয়ার্ডে সংকেত পাওয়ার পর গুলি বর্ষণ শুরু করবে।
অপারেশন
২০ অথবা ২২ সেপটেম্বর (আনুমানিক) রাত ১১টায় আক্রমণ পরিচালনার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরিকল্পনা মােতাবেক মুক্তিযােদ্ধা দল ২টি ভাগে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হতে থাকেন। প্রথম দল রাজাকার ক্যাম্পের প্রবেশপথে অবস্থান নেয়। দ্বিতীয় দল অবস্থান নেয় ক্যাম্পের উত্তর দিকের ঝােপজঙ্গলে। পরিকল্পনানুযায়ী প্রথম দল গুলি বর্ষণ শুরু করার পর কোনাে পালটা গুলির জবাব না পেয়ে গুলি বর্ষণ থামিয়ে দেওয়া হয়। রাজাকার অবস্থান থেকে কোনাে ধরনের সাড়া না পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ধারণা করেছিলেন যে তাদের অবস্থানে কেউ নেই। তখন প্রথম দল দ্বিতীয় দলের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। প্রকৃতপক্ষে, শত্রুরা তাদের অবস্থান থেকে আগেই সরে গিয়ে উত্তর দিকে অন্য একটি ঝােপের মধ্যে অবস্থান নিয়েছিল। এ ধরনের তাৎক্ষণিক অবস্থান পরিবর্তন হলাে একটি কৌশলগত প্রক্রিয়া, যা সামরিক কৌশল তত্ত্বে প্রতারণা (Deception) বলে পরিচিত। মুক্তিযােদ্ধাদের দুই দল একত্র হলে রাজাকাররা তাদের ঘিরে ফেলে এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারাও পালটা গুলি বর্ষণ করতে থাকে। গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে রাজাকাররা পিছু হটে উত্তর দিকে চলে যায়।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের তেমন কোনাে সাফল্য ছিল না। পরিস্থিতি ও ঘটনা। বিশ্লেষণে প্রতীয়মান, এ ধরনের অপারেশনে পুরাে দলকে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত করে শত্রুর ওপর চাপ সৃষ্টির যে কৌশল সাধারণত ব্যবহৃত হয় তা সফলভাবে প্রয়ােগে মুক্তিযােদ্ধারা ব্যর্থ হন। তা ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর অনাকাঙিক্ষত আচরণে বিকল্প পরিকল্পনা করার যে দিকটি রয়েছে, সে ব্যাপারটি অনুধাবনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ধারণা করা যায়। তবে সার্বিকভাবে রাজাকার ক্যাম্পে ঘন ঘন অপারেশন পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের ব্যস্ত এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখার দৃষ্টিকোণ থেকে অপারেশনটি স্বভাবতই কিছুটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আবুল মনসুর সিদ্দিকী। সম্পাদকের টীকা: ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থটির ৪৬০ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন সম্পর্কিত নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায়:
ক, এ অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয় আন্দারমানিক নতুন চৌধুরীর বাড়িতে।
খ, যুদ্ধে ৩জন রাজাকারকে হত্যা, ৭জনকে জীবিত ধরা হয়। রাজাকার ক্যাম্প হতে ২ ইঞ্চি মর্টার এবং ২টি এলএমজি উদ্ধার করা হয়।
(অপারেশন রাজাকার ক্যাম্পের (মেগদাই, রাউজান) নকশাটি ১১৫৮ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড