You dont have javascript enabled! Please enable it! পাথরঘাটা ট্রান্সফর্মার ধ্বংস, রাউজান চৌধুরীহাটের রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
পাথরঘাটা ট্রান্সফর্মার ধ্বংস
উদ্দেশ্য
মূলত দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে পাথরঘাটার ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সমর্থকদের মনে ভীতির সৃষ্টি ও তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার উদ্যোগ নেন। অন্যদিকে, তারা এ অপারেশনটির মাধ্যমে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি ও নিজেদের উপস্থিতি প্রমাণের প্রয়াস চালায়।
পরিকল্পনা
সেক্টর সদর দপ্তরের নির্দেশে চট্টগ্রামস্থ বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপ চট্টগ্রামে তাদের অপারেশন স্থান নির্ণয় করে সেগুলাে অনুমােদনের জন্য পুনরায় সেক্টর সদর দপ্তরে পাঠায়। এ প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে কেসি-২ গ্রুপ কয়েকটি অপারেশন স্থল চিহ্নিত করে। এর মধ্যে একটি পাথরঘাটা ট্রান্সফর্মার। এটি সদর দপ্তর কর্তৃক অনুমােদিত এবং কেসি-২ গ্রুপকে ঐ ট্রান্সফরমারটির ওপর অপারেশন চালানাের নির্দেশ প্রদান। করা হয়।
অপারেশন
সেক্টর সদর দপ্তরের অনুমােদন ও নির্দেশক্রমে অপারেশনের আগের দিন বেনু, কামাল ও শ্যামা দাস নামে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা তাদের বেইজ ক্যাথলিক চার্চ থেকে ২ পাউন্ড বিস্ফোরক, ফিউজ, ম্যাচ ও গ্রেনেড নিয়ে টার্গেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে পাথরঘাটার জেলেপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগী মিনুরাণী জলদাসের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ঐ দিন সন্ধ্যার পর তারা চুপিসারে ও অত্যন্ত সতকর্তার সাথে জেলেপাড়ার সম্মুখস্থ ট্রান্সফর্মারটির অবস্থান এবং অন্যান্য বিষয় ভালাে করে পর্যবেক্ষণ করেন। সেদিনই ভােররাতে মুক্তিযােদ্ধারা। অপারেশনের লক্ষ্যে বের হয়ে ৩০-৪০ গজ সামনে অবস্থিত ট্রান্সফর্মারের কাছে। পৌছেন। বেনু মিয়াকে গার্ডের দায়িত্বে রাখা হয়। ঐ রাস্তায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের চলাচল ছিল। তার কাজ ছিল অপারেশনকারী অপর ২জন মুক্তিযােদ্ধাকে পাকিস্তানি সেনা বা রাজাকারদের উপস্থিতি জানানাে। শ্যামা দাসের সহযােগিতায় থাকেন কামাল। শ্যামা ট্রান্সফর্মারের বৈদ্যুতিক পাইলনটিতে বিস্ফোরক স্থাপন করেন এবং তারা আজানের জন্য অপেক্ষা করেন। আজান দেওয়ার সাথে সাথে বিস্ফোরকের ফিউজে অগ্নিসংযােগ করেই তারা দ্রুত গলির। মুখে এসে দাঁড়ান। ট্রান্সফর্মারটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের শব্দে পার্শ্বস্থ কর্ণফুলি নদীতে টহলরত পাকিস্তানি সেনা ও পার্শ্ববর্তী রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকাররা ভীত হয়ে বিরামহীন ও লক্ষ্যহীনভাবে গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধাদের ছােটো দলটি ত্বরিতগতিতে জেলেপাড়ায় ঢুকে পড়ে। আতঙ্কিত জেলেরা মুক্তিযােদ্ধাদের ধরিয়ে দিতে চাইলে মুক্তিযােদ্ধারা গ্রেনেড ছুড়ে ত্রাসের সৃষ্টি করেন। মিনুরাণী জলদাসের সহযােগিতায় জেলেপাড়ার পিছনের দিকে দৌড়ে জে এম সেন হলের পাশে এসে ওঠেন। সেখান থেকে তারা তাদের বেইজে ফিরে আসেন।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে ট্রান্সফর্মারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হলে মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং তাদের মনােবল বুদ্ধি পায়। অন্যদিকে, তারা সহযােগী মিনুরানি জলদাসের সাহায্যে পরিস্থিতি সামলে উঠতে পেরেছিলেন। এ অপারেশনে অকুতােভয় নারী মুক্তিযােদ্ধা মিনুরানি জলদাসের অবদান ও সাহায্য মুক্তিযােদ্ধাদের বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল।
তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা মাে. ওয়ালীউল্লাহ (বে)। সম্পাদকের টীকা ১. ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৩৬৬ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন-সম্পর্কিত তথ্য এ রকম: পাথার ঘাটা। ট্রান্সফর্মারটি এফএফ ও বিএলএফ মিলে মুক্তিযােদ্ধা নুর আলীর নেতৃত্বে ধ্বংস করা হয়। এ গ্রন্থের দশম অধ্যায়, দলিল নম্বর ২২২-এ সন্নিবেশিত সেক্টর ১ কর্তৃক প্রেরিত দৈনিক পরিস্থিতি প্রতিবেদনে পাথরঘাটা ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরিত হওয়ার তারিখ ২৯ অক্টোবর হিসেবে উল্লিখিত। প্রকৃতপক্ষে, সে সময় প্রায় নৈমিত্তিকভাবেই এ ধরনের ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ ঘটত। সুতরাং উপযুক্ত দালিলিক প্রমাণ ছাড়া সঠিক তারিখ ও ঘটনা নির্ণয়। এতদিন পর দুরূহ বিষয়।
রাউজান চৌধুরীহাটের রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন
প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে জনগণের একাংশ তকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিকবাহিনীর সাথে আঁতাত করে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে আসছিল। এ জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন সময়ে সেই স্বাধীনতা বিরােধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এরূপ অসংখ্য ছােটো ছােটো অপারেশন চালিয়ে তাদেরকে নিরস্ত্র অথবা আক্রমণ করে তাদের শক্তি ও মনােবলকে দুর্বল করা হয়েছিল।
উদ্দেশ্য
রাউজানের চৌধুরীহাট রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করে অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার, তাদের মনােবল ভেঙে দেওয়া এবং জনসাধারণের মনে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তির প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করা।
পর্যবেক্ষণ
মুক্তিযােদ্ধা দল স্থানীয় অধিবাসী হওয়ায় শত্রুর অবস্থান এবং ভূমি সম্পর্কে আগে থেকেই সম্যক পরিচিত ছিলেন। এজন্য আক্রমণ পরিচালনার পূর্বে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়ােজন হয় নি।
পরিকল্পনা
মুক্তিযােদ্ধারা তাঁদের অধিনায়ক ক্যাপটেন করিমের বাড়িতে বসে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। সিদ্ধান্ত হয় যে, দুই দলে বিভক্ত হয়ে শক্ত অবস্থানের পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে একযােগে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। আক্রমণের ধরণ হবে আকস্মিক হানা (Surprise raid); যাতে শক্ররা হতবুদ্ধি হয়ে যায় এবং বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। মুক্তিযােদ্ধা দলটি ১টি এলএমজি, ৫-৭টি এসএমজি, ৬-৭টি ৩০৩ রাইফেল, ১টি রিভলভার এবং ৫টি গ্রেনেডসহ সজ্জিত হয়ে আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করে।
অপারেশন
আনুমানিক ১৫-২০ জুন (সঠিক তারিখ সংগ্রহ করা যায় নি) রাত আনুমানিক ২টায় অপারেশন পরিচালনা করা হয়। পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণের প্রয়ােজনে। মুক্তিযােদ্ধাদের ১৬জন ২টি দলে বিভক্ত হন। অধিনায়ক ক্যাপটেন করিম অন্যান্য সহযােদ্ধার কাছে অপারেশনের উদ্দেশ্য গােপন রাখেন। মুক্তিযােদ্ধারা প্রথমে নােয়াপাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাত্রা পথে তারা নৌকাযােগে কর্ণফুলি নদী পার হয়ে প্রথমে লাম্বুরহাটে পৌছেন। সেখান থেকে তারা অধিনায়ক ক্যাপটেন করিমের বাড়ির পাশে নােয়াপাড়ায় তাদের পূর্বনির্ধারিত মিলন স্থানে (Rendezvous) একত্র হন। রাত আনুমানিক ২টায় মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি দল। চৌধুরীহাটের পশ্চিম পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শত্রুর অবস্থানের পূর্ব ও পশ্চিম। পাশে সুবিধামতাে স্থানে অবস্থান নেন। নিজ অবস্থান সুদৃঢ় হওয়ার পর তারা শত্রুর ওপর অকস্মাৎ আঘাত হানেন।
ক্ষয়ক্ষতি
এ অপারেশনে ৮-১০জন রাজাকার মারাত্মক আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ৩টি রাইফেলও উদ্ধার করে। এ আক্রমণে নিজ দলের কোনাে ক্ষতি হয় নি।
বিশ্লেষণ
এ ধরনের অপারেশনে জব্দকৃত অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। এতে জনগণের মনে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি বিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং রাজাকারদের মনােবল ভেঙে যায়। তা ছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের কলাকৌশলের এ ধরনের বাস্তব প্রয়ােগ স্বীয় ক্ষমতার ওপর আস্থা সৃষ্টিতে কাজ করে। পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে একযােগে গুলি বর্ষণ করাটা সাধারণত ফায়ার নিয়ন্ত্রণে জটিলতার সৃষ্টি করে। তবে ভূমির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এ জটিলতা এড়ানাে সম্ভব হলে তা শত্রুর মনােবলের ওপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় এবং এ ক্ষেত্রেও এ ঘটনাটিই ঘটেছে বলে প্রতীয়মান। তাদের দুই দিক থেকে অবিরাম গুলি বর্ষণে রাজাকাররা হতভম্ব হয়ে পড়ে। ভূমির ব্যবহারে দক্ষতার কারণে নিজ দলের কোনাে ক্ষয়ক্ষতিও হয় নি। এ অপারেশন থেকে এটাই বলা যায় যে, মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার নিয়ন্ত্রণে কার্যকরভাবে দক্ষ ছিলেন এবং সঠিক সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে মৌলিক রণকৌশলের কিছুটা রদবদল করে সফলতা লাভ করতে সক্ষম। হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আবুল মনসুর সিদ্দিকী। (রাউজান চৌধুরীহাটের রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের নকশাটি ১১৫৭ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড