You dont have javascript enabled! Please enable it!
মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনে রেইড
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
আগস্ট মাস থেকেই কাপ্তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী বাংলাদেশের একমাত্র তেল শােধনাগারটি অচল করার জন্য ১ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর থেকে কৌশল নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম। বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চলছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করা এবং জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এ পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কারণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাব দেখা দিলে শক্রর যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়বে এবং এতে তাদের তৎপরতা হ্রাস পাবে। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দুটি ধ্বংস হলে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালি জনসাধারণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ যুক্তিতে দুটি প্রস্তাবই গ্রহণীয় হয় নি। ইস্টার্ন রিফাইনারি ও কাপ্তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মতাে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দুটি ধ্বংস না করে এর উৎপাদন সীমিত করার উদ্দেশ্যে বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সম্ভাব্য পরিকল্পনাকে সামনে রেখে ১, ২, ও ৩ নম্বর সেক্টরের সমন্বয়কারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংয়ের সাথে পরামর্শ করা হয়। পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ: ক. মদুনাঘাটের বিদ্যুৎ বিভাগের সাব-স্টেশন ধ্বংস করা। খ, কাপ্তাই ও চট্টগ্রামের মধ্যে যতগুলাে সম্ভব বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করা। নিমলিখিত সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে ঐ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়: ক. মদুনাঘাট থেকে পুরাে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তাই এ সাব স্টেশন ধ্বংস করে দিলে পুরাে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে প্রশাসন তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম ও তৎপরতা চালাতে ব্যর্থ হবে। বড়াে ধরনের প্রাণহানি ছাড়াই বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনটি ধ্বংস করা সম্ভব হবে। উপকেন্দ্রটিতে সীমিত জনবল ও অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। শহর থেকে দূরে হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্রুত হস্তক্ষেপ করার। আশঙ্কা কম ছিল; সর্বোপরি কেন্দ্রটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত ছিল। না।
অবস্থা

হালদা ব্রিজ থেকে ১০০ গজ পশ্চিমে চট্টগ্রাম মদুনাঘাট পাওয়ার হাউজ অবস্থিত। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এ কেন্দ্রের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরসহ পুরাে চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়। এ কেন্দ্রের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়ক। ব্রিজের পশ্চিম পাশ দিয়ে হালদা নদীর পশ্চিম তীর বরাবর একটি কাঁচা রাস্তা উত্তর দিকে মাদ্রাসা পর্যন্ত গিয়েছে। সাব-স্টেশনের ৫০০ গজ উত্তরে ওয়াপদা কলােনি অবস্থিত। স্টেশনটির পূর্ব পাশ দিয়ে হালদা নদী প্রবহমান। আশপাশের অঞ্চল ছিল হালদা নদীবিধৌত উর্বর ও বিস্তীর্ণ চাষাবাদযােগ্য জমিতে পরিপূর্ণ। মাঝে মাঝে রয়েছে অসংখ্য গাছপালা ঘেরা গ্রাম। কভার হিসেবে এ ধরনের গ্রাম যে-কোনাে যুদ্ধরত দলের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত।

পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা
সেপটেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরে বিমানবাহিনীর নির্ভীক অফিসার ফ্লাইট লে, সুলতান মাহমুদকে অপারেশনের অধিনায়ক নিযুক্ত করে পর্যাপ্ত ব্রিফিং প্রদান করা হয়। তিনি তাঁর রেইডিং পার্টির সদস্য নির্বাচন এবং এ জন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র বেছে নেন। আসন্ন অপারেশনের জন্য দলের সদস্যদের মহড়ার আয়ােজন করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের নির্দেশনায়। গেরিলাদেরকে অপারেশনে পাঠানোের প্রাক্কালে এ ধরনের মহড়ার ব্যবস্থা করা হতাে। তা ছাড়া গােপনীয়তার স্বার্থে দলের সদস্যদের নির্দিষ্ট সর্বশেষ ঘাটিতে পৌছার পূর্ব পর্যন্ত প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হতাে না। উল্লেখ্য, হরিণা ক্যাম্পেই প্রাথমিকভাবে ম্যাপে পর্যবেক্ষণ করে তথ্যসংগ্রহ করা হয়। পরবর্তী সময় সেক্টর সদর দপ্তর থেকে অধীনস্ত সাব-সেক্টর-২ ও অন্যান্য অপারেশন সদর দপ্তরের সাথে যােগাযােগ করে মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনের মানচিত্র রেফারেন্সসহ অপারেশনের জন্য অন্যান্য প্রয়ােজনীয় তথ্যসগ্রহ ও নিশ্চিত করা হয়। এ সম্পর্কে ১ নম্বর সেক্টরের গােপনীয় বার্তা নম্বর জি-০৯৪২ ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, জি-০৯৫০ ২২ সেপ্টেম্বর ৭১, জি-০৯৭৪ ২২ সেপ্টেম্বর ৭১ এবং সাব-সেক্টর ২-এর গােপনীয় বার্তা নম্বর জি-১০২০, ২৭ সেপ্টেম্বরের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে চট্টগ্রামকাপ্তাই সড়কে হালদা নদীর ওপর মদুনাঘাট অবস্থিত। এর ম্যাপ রেফারেন্স SQ ০১০৭ ম্যাপসিট নং ৭৯- ঘ (দ্রষ্টব্য: হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: একাদশ খণ্ড; পৃষ্ঠা ২০৬-২২৩)।
মুক্তিযােদ্ধা শাহাবুদ্দিন এ দলের ১জন সদস্য। তিনি আগে থেকেই এলাকাটি চিনতেন। সে জন্য অপারেশনের প্রয়ােজনীয় অনেক তথ্য পূর্বাহ্নেই জানা গিয়েছিল । ১১ সেপ্টেম্বর ফ্লাইট লে, সুলতান বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এক দল গেরিলা ও নিয়মিত সৈন্য নিয়ে হরিণা ক্যাম্প থেকে রওনা হন। ভারত থেকে রামগড় হয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে রাউজান থানাধীন উরকিচরের বড়ুয়াপাড়া স্কুলে এসে পুরাে দল গােপন আস্তানা তৈরি করে। ফ্লাইট লে, সুলতান মাহমুদ গােপন আস্তানায় আসার আগেই সেক্টর সদর দপ্তরের নির্দেশে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা নেতারা এ আশ্রয় কেন্দ্রটি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা। অধিনায়ক ক্যাপটেন করিম এক দল মুক্তিযােদ্ধাসহ এ দলের সাথে যােগ দেন।
তখন মােট মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩৫জনে। মুক্তিযােদ্ধা শাহাবুদ্দিন ও সার্জেন্ট নুরুল হক গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে বিদ্যুৎ সাবস্টেশনের আশেপাশের এলাকা রেকি করে নিম্নবর্ণিত বিস্তারিত তথ্যসংগ্রহ করেন: ক, উরকিচরের গোপন আস্তনা বড়য়াপাড়া স্কুল থেকে সাব-স্টেশনের দূরত্ব ছিল প্রায় ২ কিলােমিটার। অপারেশনের সময় হালদা নদী হয়ে যাওয়া এবং ফেরত আসা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। গ. সাব-স্টেশনে নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়ােজিত ছিল আনুমানিক ১০০জন | মিলিশিয়া। তারা সাব-স্টেশনের বিপরীতে রাস্তার দক্ষিণ দিকে হালদা ব্রিজের পশ্চিম পাশে একটি বিল্ডিংয়ে অবস্থান করে। সাব-স্টেশনের সার্চ লাইটের জন্য রাতে আশপাশের এলাকা আলােকিত থাকে। সাব-স্টেশনের পিছনে একটি কাঁচা রাস্তা এটি রামদাস হাটের সাথে সংযুক্ত। রাতে এদিকে কোনাে প্রহরী থাকে না। চ, জোয়ারভাটার সময় ভালােমতাে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ভাটার সময় গােপন আস্তানা থেকে নৌকায় অপারেশন স্থলে আসা এবং জোয়ারের সময় ফেরত যাওয়া সহজতর তারা লক্ষ্য করেন, রাত ২টার। দিকে ভাটা শুরু হয়। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ অপারেশনের বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন। তার সাথে ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা শাহাবুদ্দিন, সার্জেন্ট নুরুল হক এবং মহসিন। পুরাে দলকে মােট ২টি ভাগে বিভক্ত করে মূল কমান্ডে থাকেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান। মৌখিক আদেশ দ্বারা অপারেশনের সমগ্র পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া হয়। ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে ছিল কভারিং ও হােল্ডিং পার্টি-১ এবং কভারিং ও হােল্ডিং পাটি-২। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে ছিল মূল অ্যাকশন দল এবং কাট অফ পার্টি। তা ছাড়া তিনি পুরাে দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান প্রথমে গুলি করবেন এবং এটি অপারেশন শুরুর সংকেত হিসেবে বিবেচিত হবে। ক্যাপটেন করিমের দল গােপন আস্তানা থেকে গ্রামের ভিতর দিয়ে গিয়ে গােপনীয়তার সাথে হালদা ব্রিজের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থান করবেন। রাত ২টার মধ্যে অবশ্যই তারা পজিশন নেবেন। তাদের কাজ হবে নিমরূপ: ক, কভারিং ও হােল্ডিং পার্টি-১: রাস্তার দক্ষিণ পাশে ব্রিজের পূর্ব দিকে পজিশন নেবে। সংকেত পাওয়া মাত্রই তারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত মিলিশিয়াদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করতে থাকবে। অপারেশন শেষে মূল দল নিরাপদ দূরত্বে পৌছার আগ পর্যন্ত শক্রকে ব্যস্ত রাখবে।
খ. কভারিং ও হােল্ডিং পার্টি-২: ব্রিজের পূর্ব দিকে রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থান নেবে। সংকেত পাওয়া মাত্রই গুলি করে সার্চ লাইটগুলাে নষ্ট করে দেবে এবং মূল দলের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করা পর্যন্ত শত্রুকে ব্যস্ত রাখবে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতানের নেতৃত্বে মূল দল ২টি দেশি নৌকায় করে গােপন আস্তানা থেকে ভাটার সময় রাত ৩টায় ওয়াপদা কলােনির পাশে এসে নামবে। এদের কাজ হবে নিমরূপ: ক. কাট অফ পার্টি: মুক্তিযােদ্ধা শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে ৪জন মুক্তিযােদ্ধাকে এ দলে রাখা হয়। তারা ওয়াপদা কলােনি এবং রাস্তার ওপারের মিলিশিয়াদের অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা প্রতিহত করবেন। থ, অ্যাকশন পার্টি: ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতানের নেতৃত্বে দলটি অ্যাকশন পার্টি হিসেবে কাজ এবং সাব-স্টেশনের পিছনে অবস্থান নিয়ে মূল টার্গেট ধ্বংস করবেন। অপারেশন। পরিকল্পনা মতাে নির্দিষ্ট দিন রাত ২টার মধ্যে ক্যাপটেন করিমের দল তাদের অবস্থান নেয়ার কাজ সম্পন্ন করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতানের নেতৃত্বে মূল দল। ২টি নৌকায় করে হালদা নদীতে ভাটার সময় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তাদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৫জন। ওয়াপদা কলােনির সাথে একটি শুকনাে স্থানে সবাই নৌকা থেকে নেমে যান। নৌকা ২টি ওখানেই বেঁধে রাখা হয়। ২জন মাঝি আগেই ঠিক করা হয়েছিল। এঁরা দীর্ঘদিন ধরে হালদা নদীতে নৌকা চালাত। শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে কাট অফ পার্টিকে রেখে মূল দল সাব-স্টেশনের পিছনের কাচা রাস্তার পাশে অবস্থান নেন। তাদের কাছে ছিল ১টি এলএমজি, ১টি রকেট লঞ্চার ও ৪টি শেল এবং প্রত্যেকের কাছে এসএলআর, স্টেনগান ও ১টি করে গ্রেনেড। রকেট লঞ্চার আনা হয়েছিল মূল টার্গেট ধ্বংস করার জন্য। নায়েক মান্নান এটি বহন করেছিলেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, অধিনায়ক গুলি করার সাথে সাথেই গােলাগুলি শুরু হয়। কভারিং ও হােল্ডিং পার্টি-১ ও ২ তাদের অবস্থান থেকে ব্রিজের অপর দিকে মিলিশিয়াদের অবস্থানে গুলি করে তাদের ব্যস্ত রাখে। রকেট লঞ্চারের ২টি শেল নিখুঁতভাবে ২টি ট্রান্সফর্মারে আঘাত করে এবং ট্রান্সফর্মার ২টি ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ একটি গুলি নায়েক মান্নানের পেটে বিদ্ধ হয়। এতে তার সমস্ত নাড়িভুড়ি প্রায় বের হয়ে যায়। তাকে উদ্ধারের জন্য শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কাট অফ পার্টিকে ডেকে পাঠানাে হয়। একটি লুঙ্গির দুই দিকে ২টি কাঠের টুকরা ভিতরে প্রবেশ করিয়ে স্ট্রেচার বানানাে হয়। তারপর মূল দল নৌকায় চড়ে পরিকল্পনা মতাে দ্রুত বড়ুয়াপাড়ায় প্রত্যাবর্তন করে। তখন পুব আকাশে ভােরের আলাে পরিদৃষ্ট হয়ে ওঠে। মূল দল নৌকায় করে চলে আসার পর ক্যাপটেন করিমের দল অবস্থান প্রত্যাহার করে ফেরত আসে। ইপিআর-এর নায়েক আবদুল মান্নান পরে মারা যান। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের নিজ হাতে লিখিত ও স্বাক্ষরিত একটি সুপারিশনামায় তাকে মরণােত্তর খেতাব প্রদান করার সুপারিশ করা হয়। এ দলিলটি প্রকল্প কর্তৃক সংগৃহীত, নিচে এর Citation উদ্ধৃত হলাে: Killed in action, 6th Oct 1971, Hathajari, 0330 hr, Madhunaghat. He was detailed as a firing man of the RCL team during the raid and attack on the Madhunaghat power station (Transformer). Inspite of the grave danger of enemy fire and his vulnerability, he positioned himself to take on the target. He fired 3 rounds and destroyed 2 targets and damaged one when enemy shot him. He was brought to a safe place 5 miles from the target. He expired at 1000 hr on 6th due to his injuries. His action was beyond the call of his duty, for which he is recommended for military gallantry award of the equivalency of ‘Sitara-E-Basalaat’ (Pakistani). (9845:
গ্রন্থের চতুর্দশ অধ্যায়, দলিল নম্বর ৬১১)
বিশ্লেষণ
১২ অক্টোবর রাত ৮টায় ১ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর থেকে মুজিবনগর ফোর্সেস সদর দপ্তর ও ডেল্টা সেক্টর সদর দপ্তরে পাঠানাে একটি বিশেষ পরিস্থিতি বার্তায় (নম্বর জি-০৫৩৯) মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন অপারেশনের সাফল্য ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানা যায়। নিচে তা উদ্ধৃত হলাে: Special SITREP. Flt Lt Sultan and his group returned 11 Oct FN (Forenoon, ed.) after completing task inside Bangladesh. ALFA. Madhunaghat electric Sub sta [station, ed.] (RX 1268) on the north of Ctg [Chittagong, ed.] Kaptai rd [road, ed.] and west of Halda river. All the three transformers completely destroyed by RCL gun. Own tps [troops) led by Fit Lt Sultan raided the power Sub Sta and fired from a distance of 50 feet only on the transformers. En (enemy, ed.) kept firing on own tps from bunkers around power Sub Sta Own tps physically went inside the Sub Sta compound and fired on the transformers starting from the biggest transformer. Transformers burst and caught fire. Action took place on 06 Oct at 0400 hrs [hours, ed.). Total three rounds of RCL fired. Own cas (casualty, ed.). One Sep (sepoy, ed.] Abdul Mannan killed during action and has been buried with mil [military] honour inside Bangladesh. Gallantry award recommendation for the group follows. Request this action be given widest publicity in radio and newspapers. (দ্রষ্টব্যঃ হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: একাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৩-২৬৪). নিখুঁত পরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারণ, শত্রুর অবস্থান ও শক্তি সম্পর্কে সঠিক তথ্যসগ্রহ, টার্গেটের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন, মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল এবং সঠিক নেতৃত্বই অপারেশনের সফলতা বয়ে আনে। কৌশলগত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নেও নেতারা সক্ষমতার পরিচয় প্রদান করেন।
পুরাে দলকে কয়েকটি উলে বিভক্ত করে সঠিকভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। একটি উপদল সফলতার সাথে সব-স্টেশনের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত মিলিশিয়াদের দিকে গুলি বর্ষণ করে তাদেরকে ব্যস্ত রাখে ও বিভ্রান্ত করে। ফলে মিলিশিয়া দল মুক্তিযােদ্ধাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। এ সুযােগে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে অ্যাকশন দল সাফল্যের সাথে টার্গেট ধ্বংস করে। অ্যাকশন দলের যাতায়াতের জন্য হালদা নদীর জোয়ারভাটার সময়কে কাজে লাগানােয় পরিকল্পনাকারীর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। কভারিং ও হােল্ডিং পার্টি আগেই তাদের অবস্থান নেয়ার কাজ সম্পন্ন করলেও অ্যাকশন দল তাদের যাতায়াত ও কার্যসম্পাদনে অপেক্ষাকৃত কম সময় নেয়। এর ফলে শত্রুপক্ষ অপারেশনের আসল উদ্দ্যেশ্য বুঝে ওঠার পূর্বেই প্রধান কাজ সম্পাদিত হয়।  হরিণ” ক্যাম্পে ল নির্বাচনের পর মহড়ার আয়ােজন করা হয়েছিল। ফলে এ অপারেশনে নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজতর হয়। ভারত থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে গােপন আশ্রয় কেন্দ্রে আগমন এবং বড়ুয়াপাড়ায় অপারেশন দলের অবস্থানকে শক্রর কাছে দক্ষতার সাথে গােপন রাখা হয়। মদুনাঘাট সাবস্টেশনে পরিচালিত অপারেশনে সফলতার পিছনে সেক্টর সদর দপ্তরের সঠিক পরিকল্পনা এবং নির্বাচিত দলের কৌশল ও দক্ষতার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা ছিল অপরিসীম। তারা অপারেশন দলের জন্য আশ্রয়, খাবার ও যাবতীয় রসদসামগ্রী সরবরাহ করে। ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে একটি স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা দল অপারেশনে অংশগ্রহণ করে তাদের ভূমিকাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী করে তােলে।
কৌশলগত প্রয়ােগের ক্ষেত্রে মদুনাঘাট পাওয়ার সাব-স্টেশন ধ্বংস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অপারেশন। ইস্টার্ন রিফাইনারি কিংবা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে অপারেশন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না করার বিষয়টি একটি অত্যন্ত বিবেচক ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল। তা ছাড়া মদুনাঘাট পাওয়ার সাব-স্টেশনটি ধ্বংসের মাধ্যমে। কৌশলগত অর্জন উপরিউক্ত দুই লক্ষ্যবস্তু থেকে কোনাে অংশেই কম নয়। লক্ষ্যবস্তুতে অপারেশন পরিচালনার ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা করা হয়, তাতে তীক্ষ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে ভূমির সব সুবিধার পরিপূর্ণ ব্যবহার করা হয় এ অপারেশনে। | হােল্ডিং ও কভারিং পার্টি দুটির অবস্থান নির্বাচন এমনভাবে করা হয়, যাতে শত্রু অবস্থান ও পাটি দুটির অবস্থানের মাঝে একটি নদী বিদ্যমান থাকে। ফলে। শক্রর নিরাপত্তাকারী কোনােভাবেই কভারিং ও হােল্ডিং পাটির দিকে ভূমি প্রতিবন্ধকতার কারণে অগ্রসর হতে পারে নি। এ ক্ষেত্রে শত্রুর শক্তির আধিক্য তাদের জন্য কোনাে সুফল বয়ে আনেনি। তারা শুধু পালটা ফায়ারের মাধ্যমে। তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে। মূল দল রাস্তা ধরে না এসে নদীপথ ব্যবহার করে। উন্নত কৌশলের পরিচয় দেন। ফলে তারা গোপনীয়তা বজায় রেখে অবস্থান গ্রহণ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। তা ছাড়া কাট অফ পাটি কিংবা বাধা প্রদানকারী দলের অবস্থান ছিল সুচিন্তিত। এ দল এমনভাবে অবস্থান নিয়েছিল, যাতে তারা নিরাপত্তা দানকারী দলের অবস্থান থেকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে অগ্রসরমাণ কোনাে শত্রুকে সহজেই বাধা প্রদান করতে সক্ষম ছিল। তা ছাড়া লক্ষ্যবস্তুতে শত্রুর রিইনফোর্সমেন্ট হলেও এদের পথ রােধ করতে এবং এ দুটি কাজ ছাড়া মূল দলের নিরাপদ পশ্চাদপসরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম ছিল।
লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংসের জন্য মূল দলের রকেট লঞ্চার নির্বাচন ছিল যথােপযুক্ত। এ ধরনের টার্গেট রকেট লঞ্চারের মাধ্যমেই কিছুটা ব্যবধানে থেকেও ধ্বংস করা সম্ভব। এতে প্রচুর বিস্ফোরক ব্যবহার ব্যতিরেকে অত্যন্ত অল্প সময়ে সহজেই টার্গেট ধ্বংস করা সম্ভব। অপারেশনের সময় নির্বাচনে নদীর জোয়ারভাটার বিষয়টি বিবেচনা করাকে অত্যন্ত উন্নত কৌশল বলে চিহ্নিত করা যায়। সার্বিকভাবে এ অপারেশনের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের উন্নত রণকৌশলের প্রয়ােগ, বুদ্ধিমত্তা, উন্নত পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ অপারেশনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনী ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় গেরিলা কর্মকাণ্ড তীব্রতর করে তােলেন। এ অপারেশনের ফলে সেক্টর থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপনকারী গেরিলাও মনােবল ফিরে পান এবং উদ্যমী হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে এ অপারেশনের ফলে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলাে রক্ষা করার এ ব্যর্থতা পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবলকে দুর্বলতর করে তােলে। উল্লেখ্য, এ অপারেশনের পরবর্তী ক্রমবর্ধমান গেরিলা তৎপরতা পাকিস্তানি প্রশাসনকে ব্রিত ও শঙ্কিত করে তােলে।
মুক্তিযােদ্ধাদের সফল তৎপরতার বিপরীতে শত্রুপক্ষের দুর্বলতাও অপারেশন সফলতার নেপথ্য কারণ হয়েছিল। সাব-স্টেশন পাহারারত মিলিশিয়া দল রাতে শুধু একটি বিল্ডিংয়ে অবস্থান করত। পিছনের দিকে কোনাে প্রহরীর ব্যবস্থা রাখা হয় নি। ফলে এ সাব-স্টেশনের পিছনের ও পাশের দিকগুলাে ছিল অরক্ষিত। কেবল সার্চ লাইটের আলাে দিয়ে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করা সম্ভব নয়। মিলিশিয়াদের অবস্থানের সন্নিকটে গুরুত্বপূর্ণ হালদা ব্রিজ অবস্থিত হলেও এখানে নিরাপত্তার কোনাে ব্যবস্থা রাখা হয় নি। সে ব্যবস্থা থাকলে ব্রিজের অন্য পাশে অপারেশনের একটি উপদলের অবস্থান গ্রহণ সহজতর হতাে না। এ অপারেশন সফল হলেও পরিকল্পনা একেবারে নির্ভুল ছিল না। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের ওপর সাব-স্টেশনের দুই দিকে অথবা শহরের দিকে এবং কাপ্তাইয়ের দিকে কোনাে কাট অফ পাটি রাখা হয় নি। ফলে শক্র শক্তিবৃদ্ধি করে অপারেশন ব্যর্থ করে দিতে পারত। সামগ্রিকভাবে এ অপারেশন বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধের ক্রমবিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত।
তথ্যসূত্র এবং সম্পাদকের টীকা: ১. মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম রচিত, অনন্যা প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা। কর্তৃক প্রকাশিত লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থের পৃষ্ঠা ২৯০-৯১-তে এ অপারেশন সম্পর্কে বর্ণনা আছে। সেখানে অপারেশনের তারিখ ৩ অক্টোবর বলে উল্লিখিত । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ একাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৬৩-২৬৪-তে মুদ্রিত ১ নম্বর সেক্টরের পাঠানাে ১২ অক্টোবরের। বিশেষ পরিস্থিতি প্রতিবেদনে ৬ অক্টোবর মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনে অপারেশন করা হয় বলে উল্লেখ রয়েছে। ৩. এ গ্রন্থের চতুর্দশ অধ্যায় দলিল নম্বর ৬১১-তে সন্নিবেশিত ১৩ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখে এ অপারেশনের অধিনায়ক ফ্লাইট লে, সুলতান মাহমুদের নিজ হাতে লিখিত ও স্বাক্ষরিত মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য খেতাব প্রদানের সুপারিশনামায় তারিখ ৬ অক্টোবর হিসেবে বিধৃত। সুতরাং এটিই অপারেশনের সঠিক তারিখরূপে গণ্য। ৪, মুক্তিযােদ্ধা শাহাবুদ্দিনের সাক্ষাত্তার, ৩০ জুন, ২০০২, কাট্টলি, চট্টগ্রাম। (মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন রেইডের নকশাটি ১১৫৫ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!