২৫ এপ্রিল বাংলাদেশের সংহতি দিবস
বাংলাদেশের সংগ্রামকে সর্বতােভাবে সাহায্য করুন:
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাঃ)র প্রস্তাব
গত ৮-১২ এপ্রিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)র কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের সমর্থনে যে প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে তাহা নিম্নে দেওয়া হইল।
পাকিস্তানের সামরিক শাসন বাংলাদেশের হাজার হাজার নিরস্ত্র জনসাধারণকে যেভাবে হত্যা করছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কর্সবাদ)-র কেন্দ্রীয় কমিটি ইহার প্রতি গভীর ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছে।
বাংলাদেশের জনসাধারণ দীর্ঘকাল যাবত সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট দেশের শাসনভার অর্পণের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। পাকিস্তানের উভয় অংশের গণআন্দোলনের চাপে সামরিক ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খা শেষ পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্কের ভােটে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়।
পাকিস্তানের ৫টি অঙ্গরাজ্যের স্বায়ত্বশাসনের দাবি সম্বলিত আওয়ামী লীগের কর্মসূচির প্রতি বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ জন ভােটার সমর্থন জানান।
বাংলাদেশের জনগণের রায়কে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ইয়াহিয়া খা জনগণের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে এবং বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযান আরম্ভ করে। নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর বােমা নিক্ষেপ করে। সাধারণ মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করে, পাকিস্তানি সামরিক শাসন বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সামগ্রিক যুদ্ধ শুরু করেছে। আপােষ আলােচনার আড়ালে পাক মিলিটারি চক্র এই আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে।
বাংলাদেশের মানুষ পুলিশ ও মিলিটারির একাংশসহ নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে হাতের সামনে যে অস্ত্র পাওয়া গেছে তাহা নিয়েই রুখে দাঁড়ান। তাহাদের এই সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগ জনগণের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গৌরবজনক অধ্যায় সংযােজন করল।
এই পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশের মানুষ অস্থায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করে পাকিস্তানি মিলিটারি শক্তির বিরুদ্ধে বিরােচিত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানি সামরিক চক্রই এ জন্য সম্পূর্ণ দায়ী। তাহাদের পৈশাচিকতা ও গণহত্যার নিদর্শন ইতিহাসে বিরল।
এত সত্ত্বেও সমগ্র জনগণের সমর্থন পুষ্ট এই মুক্তিযােদ্ধাদের মিলিটারিরা দমন করতে পারছে না। মুক্তিযযাদ্ধারা সমগ্র গ্রামাঞ্চল এমনকি অনেকগুলাে শহর নিজেদের দখলে রেখেছে।
বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ আর অধিক সংখ্যায় সংগ্রামের পুরােভাগে এসে দাঁড়াচ্ছেন, যাহা সংগ্রামের জয়কে নিশ্চিত করছে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মাকর্সবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশের জনগণের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছে এবং সর্বপ্রকার সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
মিলিটারি শাসক চক্র বিশ্বব্যাপী এই হত্যাকাণ্ডের নিকে উপেক্ষা করে নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর। তাহাদের অত্যাচার ও গণহত্যা অব্যাহত গতিতেই চালিয়ে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি লক্ষ করছে যে, বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রামের প্রতি ভারতবর্ষের পার্লামেন্ট গভীর সমবেদনা ও সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির প্রয়ােজনে এই সমবেদনাই যথেষ্ট নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিয়ে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য এবং সামরিক বাহিনীর পরাজয়কে ত্বরান্বিত করার কাজে সর্বপ্রকার সাহায্য দেবার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি ভারত সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশের মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতি সারা ভারতের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনকে অভিনন্দন জানিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে গণতান্ত্রিক নীতিবােধের উপর প্রতিষ্ঠিত সমর্থনই ইহার সত্যিকারের মূল্য হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের প্রতি আবেদন রাখছে তাহারা যেন উগ্রপ্রাদেশিকতার প্রশ্রয় না দেন এবং প্রতিক্রিয়াশীল স্লোগান যেমন ঐক্যবদ্ধ বাংলা অথবা পশ্চিম পাকিস্তান সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কোনাে স্লোগান না তােলেন।
কেন্দ্রীয় কমিটি জনসাধারণকে করিতে দিচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ এই ন্যায় ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নহে।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক চক্রই দীর্ঘদিন যাবত পাকিস্তানের উভয় অংশের জনসাধারণের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক দাবি ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দাবিয়ে রেখেছে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যা অভিযান শুরু করেছে যাহার ফলে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা ঘােষণা করতে বাধ্য করেছে। পাকিস্তানের একগুয়েমি রক্ষিত হইতে পারে একমাত্র উভয় অংশের অঙ্গরাজ্যের গণতন্ত্র ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে।
কেন্দ্রীয় কমিটি পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত অংশের শ্রমজীবী মানুষের নিকট আহ্বান জানাচ্ছে তারা যেন বাংলাদেশের মানুষের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। নিজেদের স্বার্থে এবং তাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য এবং সর্বোপরি সামরিক শাসনের অবসানের জন্যই এই সমর্থন প্রয়ােজন।
সাম্রাজ্যবাদ যাতে এই অবস্থার কোনােরূপ সুযােগ না দিতে পারে তার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি সতর্ক করে দিচ্ছে।
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ভারত সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করার জন্য গণআন্দোলন গড়ে তুলতে কেন্দ্রীয় কমিটি তার প্রতিটি ইউনিটের প্রতি নির্দেশ দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের জনসাধারণের সাহায্যে অর্থ, বস্ত্র, ওষুধ প্রভৃতি সর্ব প্রকার সাহায্য সংগ্রহ করে কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে গঠিত সংহতি ও সাহায্য কমিটির নিকট পাঠাতে আবেদন করা হয়েছে। আগামী ২৫ এপ্রিল সংহতি দিবস পালনের আহ্বান জানানাে রয়েছে।
সূত্র: দেশের ডাক
০৬ এপ্রিল, ১৯৭১
০২ বৈশাখ, ১৩৭৮