চৌধুরীহাট, রাউজানের দুর্ধর্ষ রাজাকার নেতা টিক্কা খানকে হত্যা
উদ্দেশ্য
রাউজানের চৌধুরীহাট এলাকার দুর্ধর্ষ রাজাকার নেতা টিক্কা খানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণকে রক্ষা করার লক্ষ্যে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তাকে হত্যার মূল পরিকল্পক ছিলেন ক্যাপটেন করিম, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম। এ অপারেশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রদ্যুৎ কুমার পালকে।
পরিকল্পনা
ক্যাপটেন করিম প্রস্তাব করেন টিক্কা খানকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। কিন্তু তার দুর্ধর্ষ প্রকৃতির আচরণের জন্য কেউ তাকে হত্যা করতে সাহস পায় নি। অবশেষে ক্যাপটেন করিম তাঁর সতীর্থ মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল দুলালকে টিক্কা খানকে হত্যার প্রস্তাব দিলে তিনি এক শর্তে রাজি হন। তিনি বলেন যে, তাকেই অপারেশনের পরিকল্পনা করতে দিতে হবে। ক্যাপটেন করিম তাতে রাজি হন। দুলাল নিমলিখিতভাবে পরিকল্পনা করে ক্যাপটেন করিমকে অবহিত করেন;
ক, টিক্কা খানকে চৌধুরীহাট বাজারে হত্যা করা হবে।
খ, বাজারটির চারপাশে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নিয়ে থাকবে এবং বাজারের ভেতর থেকে গুলির আওয়াজ এলে তারা পালটা ফাঁকা গুলি করে দুই দিক থেকে এগিয়ে আসবে। দুলাল ১জন গাইডসহ বাজারে ঢুকে টিক্কা খানকে হত্যা করবেন।
ঘ, পাশের রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা গুলির আওয়াজ পেয়ে বাজারে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের প্রতিরােধ করার জন্য ৫জনের। একটি মুক্তিযােদ্ধার দল রাজাকার ক্যাম্পটির আশপাশে অ্যামবুশ অবস্থান। নিয়ে লুকিয়ে থাকবে। দুলালের এ পরিকল্পনায় ক্যাপটেন করিম সম্মতি প্রদান করেন।
অপারেশন
পরিকল্পনা অনুযায়ী, অপারেশনের দিন বিকালে বাজারের চতুর্দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান নেয়া শেষ হলে দুলাল ১জন গাইডসহ একটি থলের ভেতর ১টি এসএমজি, ১টি রিভলভার ও ৩টি গ্রেনেড নিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে বাজারে প্রবেশ করেন। বাজারটির শেষ মাথায় একটি পানের দোকানের সামনে টিক্কা খান দাড়ানাে অবস্থায় ছিল। দুলালকে গাইড ইঙ্গিতে টিক্কা খানকে চিনিয়ে দেন। দুলাল চোখের ইশারায় তাকে তক্ষুণি সরে যেতে বলেন। গাইড নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলে দুলাল তার কাঁধের চটের থলে থেকে এক ঝটকায় এসএমজিটি বের করে। টিক্কা খানকে ‘হ্যান্ডস আপ’ করার আদেশ দেন। টিক্কা খান ত্বরিতগতিতে তার। রিভলভার বের করার চেষ্টা করলে দুলাল তা কেড়ে নেন। এ অবস্থায় টিক্কা খান দুলালের হাত থেকে কোনােমতে নিজেকে ছাড়িয়ে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলে দুলাল গুলি করেন। টিক্কা খান ধানক্ষেতেই লুটিয়ে পড়ে। ইতােমধ্যে গুলির আওয়াজ শুনে ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে থাকা। মুক্তিযােদ্ধারা গুলি করতে করতে অগ্রসর হয়ে বাজারে প্রবেশ করেন। দুলাল তখন গুলি করে টিক্কা খানকে হত্যা করতে চাইলে ক্যাপটেন করিম ‘হল্ট’ বলে তাকে থামিয়ে দেন এবং নিজেই তাকে গুলি করে হত্যা করেন। অবশেষে তারা ঐ বাজারের এক মুসলিম লীগ সমর্থক দোকানদারের ক্যাশবাক্স ভেঙে প্রাপ্ত অর্থ এবং দোকানের কাপড়চোপড় জনগণের মধ্যে বিতরণ করে দেন। ঠিক সেই সময় বাজারে উপস্থিত থাকা দুই রাজাকার তাদের নেতাকে হত্যাকারী মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি করতে উদ্যত হলে দুলাল তাদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করেন। তাতে দুই রাজাকার ভয়ে রাইফেল ফেলে পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিযােদ্ধারা নিজস্ব আশ্রয় স্থলে নিরাপদে ফিরে আসেন। এ অপারেশনে প্রায় ২০জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। অপারেশনে তারা ৩টি গ্রেনেড, ১টি এলএমজি, ২টি এসএমজি, ২টি এসএলআর এবং ১০-১২টি রাইফেল ব্যবহার করেন।
ফলাফল
এ অপারেশনের মাধ্যমে দুর্ধর্ষ রাজাকার টিক্কা খানকে হত্যা করা হয় এবং ২টি রাইফেল ও ১টি রিভলভার মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। জনগণ টিক্কা খানের অত্যাচার থেকে মুক্তি পায় এবং তাদের মনােবল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড