চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রােডে মিলিটারি পুলের রাজাকার চেকপােস্ট অপারেশন
উদ্দেশ্য
মিলিটারি পুলের পার্শ্বস্থ রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থানরত রাজাকাররা ঐ এলাকার বােয়ালখালী খাল দিয়ে নৌপথে চট্টগ্রাম শহরে আসা যাত্রীদের সর্বস্ব লুট ও তাদের নির্যাতন করত। মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে তারা মাঝে মাঝে নিরীহ লােকদের ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌছে দিত। ফলে মুক্তিবাহিনী এদের এ অত্যাচার বন্ধ ও অস্ত্র হস্তগত করার জন্য একটি গেরিলা অপারেশনের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা ক্যাপটেন করিম মিলিটারি পুল এলাকায় প্রয়ােজনীয় পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেন। পর্যবেক্ষণে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি নিম্নলিখিতভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন: ক, প্রাইভেট কার থেকে চেকপােস্টের একটু দূরে নেমে ক্রলিং করে পােস্টের পাশে যেতে হবে। খ. চেকপােস্টের পাশেই রাখা কংক্রিট স্ল্যাবের তূপের আড়ালে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। গ, সেই আড়াল থেকে চেকপােস্টের ওপর আক্রমণ চালাতে হবে। ঘ. লোেকবল থাকবে ৫জন অধিনায়ক করিম, প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল), ওবায়দুল হক শিকদার, সমীর দে এবং আবদুস সালাম।
অপারেশন
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ৫জনের এ মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপটি মনসারটেক নামক স্থানে সন্ধ্যা সােয়া ৭টার দিকে একটি প্রাইভেট কার হাইজ্যাক করে তাতে চেপে চেকপােস্টের দিকে এগিয়ে যান। সাড়ে ৭টার দিকে তারা ওখানে পৌছে রাস্তার দক্ষিণপার্শ্বে অবস্থান নেন। ক্যাপটেন করিম দক্ষিণ পাশে থেকে যান। অন্য ২জন ক্রলিং করে বিকল্প সেতু দিয়ে রাস্তার উত্তর পাশে কংক্রিটের স্ল্যাবের ভ্রুপের আড়ালে অবস্থান নেন। বাকি ২জনকে চেকপােস্টের দুইপাশের গাড়ি থামানাের দায়িত্বে রাখা হয়। প্রথমে তারা চেকপােস্টের ওপর ১টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার পর একসাথে মুক্তিযােদ্ধারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যান। কিন্তু ঐ সময় চেকপােস্টে কোনাে রাজাকার ছিল না। তবে ইতােমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দিকে আসা একটি বাস ঐ চেকপােস্টের কাছে এসে থামে। কারণ, তখন অপারেশন করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা দুই পাশেরই গাড়ি থামিয়ে রাখছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের পাহারারত রাজাকার ভেবে ঐ বাস থেকে। পাকিস্তানি এক সুবেদার সেখানে নেমে পড়ে এবং বিনা কারণে বাস থামিয়ে রাখার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের গালিগালাজ শুরু করে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখে এবং বােঝে তারা মুক্তিযােদ্ধা। সে অবস্থায় সুবেদারটি ক্যাপটেন করিমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইতােমধ্যে আক্রান্ত ক্যাপটেন করিম সিগন্যালের মাধ্যমে সহযােদ্ধাদের সাহায্য চান। সিগন্যাল পেয়ে মুক্তিযােদ্ধা ওবায়েদ ক্যাপটেন করিমকে সাহায্য করতে এলে পাকিস্তানি সুবেদার তাঁকেও জাপটে ধরে। এ অবস্থায় প্রদ্যুৎ পাল দুলাল দৌড়ে এসে পাকিস্তানি সুবেদারের পেটে স্টেনগান ঠেকিয়ে গুলি করে ফেলে দেন। তারপর তারা ঐ একই প্রাইভেট কারে মনসারটেকের দিকে ফিরে আসেন। এ অপারেশনে ১টি এসএমজি, ১টি স্টেনগান, ১টি এসএলআর, ১টি রাইফেল এবং ২টি গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছিল।
ফলাফল ও বিশ্লেষণ
এ অপারেশনের পর থেকে ঐ এলাকায় রাজাকারদের প্রভাব কমে যায়। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এটি একটি অসম্পূর্ণ অপারেশন। মুক্তিযােদ্ধারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে অপারেশনের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করতে গিয়েছিলেন, তা পুরােপুরি সফল হয় নি। কারণ ছিল ২টি: ক. কংক্রিটের স্ল্যাবের পাশের অবস্থান থেকে চেকপােস্টের কাছে গিয়ে রাজাকারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না। এ জন্য তাঁদের রাস্তা অতিক্রম করতে হতাে, যা ছিল বিপজ্জনক। অযথা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করাও সম্ভব ছিল কারণ, এটি একটি প্রধান সড়ক এবং এ সড়ক দিয়ে সব সময়ই পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি প্যাট্রল ডিউটিতে যাতায়াত করত। তথ্যসূত্র: সাক্ষাকার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল) সম্পাদকের টীকা:
১. ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৪৯ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন-সম্পর্কিত নিমলিখিত তথ্য আছে: ক, অপারেশনে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭জন। এঁরা হলেন, ক্যাপটেন করিম, নাসির, ওবায়েদুল হক, জহির, আজিজ, দুলাল ও মাহবুব। খ, ব্ল্যাকবেল্টধারী মুক্তিযােদ্ধা ওয়াবেদুল হক ক্যাপটেন করিমকে পাকিস্তানি। | সুবেদারের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। গ. দুলাল পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করেন। তবে ক্যাপটেন করিমের ১১ অক্টোবর ১৯৭১ সালের এক চিঠিতে এ অপারেশনের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর এবং ঐ অপারেশনে ৪জন রাজাকার ও ১জন পাকিস্তানি সেনা, ঘটনাস্থলে হত্যা করার তথ্য রয়েছে।
দ্রষ্টব্য: এ গ্রন্থের একাদশ অধ্যায়, দলিল নম্বর ৩২৬ এ তারিখটিই অধিকতর গ্রহণযােগ্য। (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রােডে মিলিটারি পুলের রাজাকার চেকপোস্ট অপারেশনের নকশাটি ১১৫৩ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড