You dont have javascript enabled! Please enable it! রাঙ্গুনিয়ার পাদুয়া গ্রামের রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
রাঙ্গুনিয়ার পাদুয়া গ্রামের রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন
উদ্দেশ্য
ক্যাপটেন করিম পােমরার জলবিদ্যুৎ পরিবহণ টাওয়ার অপারেশন করতে গিয়ে কতকগুলাে ছােটো ছােটো অপারেশন পরিচালনা করেন। তার মধ্যে একটি পাদুয়ার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন। পােমরায় যাওয়ার পর ক্যাপটেন করিম খবর পান যে, পাদুয়া ক্যাম্পের রাজাকাররা ঐ এলাকার সাধারণ জনগণের ওপর। নানা ধরনের অত্যাচার করছে। এ খবর পেয়ে তিনি স্থির করেন, যে করেই হােক রাজাকারদের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে।
পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা
ক্যাপটেন করিম তার দলের ২জন সহযােদ্ধাকে পাদুয়ায় রাজাকারদের অবস্থান, সংখ্য যাওয়া-আসার পথ, অস্ত্রের ধরন- এসব নানাবিধ তথ্যসংগ্রহের জন্য। পাঠন বেক্ষণ রিপোর্ট পাওয়ার পর তিনি আরও কয়েকজন উপঅধিনায়কের সাথে ঐ ক্যাম্প অপারেশনবিষয়ক বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
অপারেশন
পরিকল্পনা অনুযায়ী, অপারেশনের দিন রাত ১১টার দিকে ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে তাদের আশ্রয় স্থল পাদুয়ার এক জেলেবাড়ি থেকে ৩০-৩৫জন মুক্তিযােদ্ধা প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাজাকার ক্যাম্পটির দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পর তারা রাজাকার ক্যাম্পটির পাশে এসে পৌঁছেন। পূর্বপরিকল্পনা মতাে ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে ৪টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পটির চারপাশে অবস্থান নেন। তারপর পূর্বনির্ধারিত সিগন্যালের মাধ্যমে চারটি গ্রুপ একসাথে চতুর্দিক থেকে ক্যাম্পটির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের এ আকস্মিক আক্রমণে ক্যাম্পের ভিতর অবস্থানরত রাজাকাররা হতচকিত হয়ে গেলেও পরিস্থিতি সামলে নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর পালটা গুলি শুরু করে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের মুখে তারা বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে পালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। মুক্তিযােদ্ধারা ৫-৬জন। রাজাকারকে ধরে ফেলতে সক্ষম হন। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে ক্যাম্পের ভিতর ৮-১০জন রাজাকার মারা যায়। শেষ পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাম্পের ভিতর ঢুকে ১৫-১৬টি রাইফেলসহ ১৩-১৪ বাক্স গুলি উদ্ধার করেন। ধৃত রাজাকারদের পরে বেদম প্রহার করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা ৩-৪টি এলএমজি, ৬-৭টি স্টেনগান ও ২০-২৫টি ৩০৩ রাইফেল ব্যবহার করেন।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনের ফলে এ এলাকা প্রায় রাজাকারমুক্ত হয়। শান্তি কমিটির লােকজন। ভয়ে এলাকা হতে পালিয়ে যায়। সাধারণ জনগণের মনে স্বস্তি ফিরে আসে। এটি একটি সুপরিকল্পিত, সুপরিচালিত ও সফল অপারেশন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব সম্পাদনে সক্ষম হয়েছেন। রাজাকার ও তাদের সহযােগীদের দৃশ্যমান পরাজয় ও বিপর্যয় স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতাকামী জনগণকে আরও উদ্বুদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছিল। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এম এন ইসলাম। ধলঘাট রেলব্রিজ ধ্বংস এবং সেনাবাহিনীর ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা অবস্থান ও উদ্দেশ্য ধলঘাট-কৃষ্টখালী রেলওয়ে ব্রিজ, পটিয়া। চট্টগ্রাম-দোহাজারির মধ্যে ট্রেন যােগাযােগ বন্ধ করে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার ও নির্যাতন প্রতিরােধ করা এবং ধলঘাট-কৃষ্টখালী ব্রিজে পাহারারত ২জন রাজাকারকে হত্যা করে তাদের অস্ত্র হস্তগত করা ছিল এ অপারেশনের উদ্দেশ্য। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক সােলায়মান ৩জন মুক্তিযােদ্ধাসহ ঐ ব্রিজ ধ্বংস করার যাবতীয় পরিকল্পনা করেন।
অপারেশনের জন্য সময় নির্ধারিত হয় গভীর রাত। অপারেশন ৪জনের ১টি ক্ষুদ্র মুক্তিযােদ্ধা দল সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বােয়ালখালীর জ্যেষ্ঠপুর গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক সােলায়মানের বাড়ি থেকে তাঁর নেতৃত্বে অপারেশন স্থানের দিকে যাত্রা শুরু করেন। প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটার পর তারা ব্রিজের ১০-১৫ গজ দূরে এসে ২টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চুপিসারে ক্রলিং করে ব্রিজের দুই মাথায় অবস্থান নেন। সংকেত মতাে অন্ধকারের মধ্যেই ব্রিজের ওপর ২টি গ্রুপ একসাথে পাহারারত রাজাকারদের ওপর গুলি চালাতে থাকে। আকস্মিক গুলি বর্ষণে সশস্ত্র রাজাকার দল কোনােরকম প্রতিরােধ না করেই ব্রিজ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে পালিয়ে যায়। অতঃপর মুক্তিযােদ্ধারা ব্রিজের গােড়ায় বিস্ফোরক লাগিয়ে তাতে অগ্নিসংযােগ করে ব্রিজটি উড়িয়ে দেন। সফল অপারেশন শেষে মুক্তিযােদ্ধা দলটি রেললাইন ধরে উত্তর দিকে ৫০০ গজের মতাে এগিয়ে গিয়ে রেলের পাথর সরিয়ে নিচে ১টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন পুঁতে রাখেন।

পরদিন সকালে চট্টগ্রাম-দোহাজারি লাইন দিয়ে ১টি ট্রেন এ স্থানে এলে মাইনটি বিস্ফোরিত হয় এবং ট্রেনটি ৪-৫টি বগিসহ উলটে পড়ে যায়। ঐ মাইন বিস্ফোরণে বেশ খানিকটা রেললাইনও উপড়ে গিয়েছিল। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা ১টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, প্রয়ােজনীয় পরিমাণে পিকে-২ বিস্ফোরক, ২টি স্টেনগান ও ২টি রাইফেল ব্যবহার করেন। ফলাফল ধলঘাট-কৃষ্টখালী রেলসেতু পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। চট্টগ্রাম-দোহাজারির মধ্যে ৩-৪ দিন রেল যােগাযােগ বন্ধ থাকে। তথ্যসূত্র: সাক্ষাকার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল)। সম্পাদকের টীকা: ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৪৯ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন সম্পর্কে বলা হয়, ক্যাপটেন করিম গ্রুপ এ অপারেশনে অনেক মিলিটারি ও রাজাকারদের বন্দি করতে সক্ষম হয়েছিল। (ধলঘাট রেলব্রিজ ধ্বংস এবং সেনাবাহিনীর ট্রেন উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার নকশাটি ১১৫২ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড